সোমা সাহার ছোটগল্প


আতঙ্ক

--"উর্মি...,এই উর্মি,একটু দেখতো মা কে এসেছে?গিয়ে দরজাটা একটু খুলে দে তো মা!"
বয়স কুড়ির একহারা চেহারার একটা মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়েই সিঁড়ি দিয়ে নীচের দিকে নেমে যায়। দরজাটা খুলে দিয়েই একেবারে একপাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়,যেন যে এসেছে তাকে ও ছোঁবে না!ছুঁলে অস্পৃশ্য হয়ে যাবে!
-কাকিমা,আমি খোকন,এই যে তুমি ক'টা জিনিস এনে দিতে বলেছিলে,এনে দিয়েছি,আর টাকা ফেরৎ টা উর্মির হাতে দিয়ে গেলাম!
উর্মির মা তখন 
বাথরুম থেকে জোর গলায় বলে, "বসতে বল উর্মি দাদাকে!"
কিছুটা ভয়ভীত হয়ে উর্মি খোকনকে বসতে বলে।

খোকন আড়চোখে উর্মির দিকে তাকায়,নজরটা কেমন যেন বিচ্ছিরি রকমের!,
-বলছিস বসতে?বেশ,বলছিস যখন বসলাম।
উঠোনের পাশে উঁচু জায়গাটাতে খোকন বসে,উর্মি আরও একটু দূরে সরে যায়।
উর্মির মা ততক্ষণে স্নান সেরে কোনোরকমে ভেজা গায়ে কাপড়টা জড়িয়ে ঘরে গিয়ে কয়েকবার চিরুনি দিয়ে চুলটা সাজিয়ে পিছনে একটা গামছা জড়িয়ে খোপা করে নেয়। তাড়াতাড়ি সিঁথিতে সিঁদুরটা ঠেকিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে যায়।

-কী যে উপকার করলি খোকন কী বলব!তোর কাকুও নেই, এখন একহাতে সবটা দেখতে হয়,তাই আর সময় হয়ে ওঠে না,আর উর্মিটাও হয়েছে এমন একটু বেরিয়ে গিয়ে আনতে পারবে না!তা কী খাবি বল?একটু কচুরি আনাই?

-না,না কাকিমা বাড়ি গিয়েই খাব,বসতে বললে এই তো বসলাম,এবার যাই,রেনু অপেক্ষা করবে।

যাবার বেলাতেও খোকন পিছন ফিরে উর্মির দিকে তাকায়।উর্মি নিজের পায়ের কাছে মাথা নামিয়ে নেয়।
রেনু খোকনের বউ।বছর ফেরেনি ওদের বিয়ে হয়েছে।গেলবারের শ্রাবণে বিয়ে করেছিল খোকন,বৃষ্টির রাতে বউ নিয়ে বাড়ি এসেছিল।খোকন নিজেই রেণুকে পছন্দ করেছিল।খোকনের বাবা নেই, বাড়িতে মা আর বউ।একটা ছোট্টদোকানে কাজ করে খোকন,আর পাড়ার চায়ের দোকানে আড্ডা দেয় বন্ধুরা মিলে।পাড়ার সবাই ওকে খুব সাহায্যকারী বলে জানে।
-চলি কাকিমা,আবার কিছু লাগলে বোলো,আমি এনে দেব!
উর্মি ততক্ষণে ওর ঘরে চলে যায়।পড়ার টেবিলটার সামনে বসে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সামনের চেয়ারের দিকে।মুখে চোখে একরাশ ভয়ের চিহ্ন।দেখেই মনে হচ্ছে কেমন যেন একটা অস্বস্তিতে আছে।

-উর্মি জিনিস কটা একটু রান্নাঘরে তুলে রাখতো,আমি ঠাকুর প্রণামটা সেড়ে নিই।

-মা তুমি খোকন দা কে কেন এসব এনে দিতে বলো,  বলো তো?তুমি আমি মিলেও তো আনতে পারি!

-তা এনে দিয়েছে তো কী হয়েছে?তোর বাবা থাকেনা,তুইও সবসময় বেরোতে চাসনা,তাই বলেছি। হ্যাঁরে তা আজ কি সৌম্যর সাথে ঝগড়া করেছিস নাকি,এতো মাথা গরম কেন সকাল সকাল?

-না কিছু হয়নি। ধূর!তুমি আমার কোনোকথাটাই শোনো না...

উর্মির মা ঠাকুরের সামনে বসে ফুল সাজায় আর মনে মনে বলে "আমার মেয়েটাকে একটু দেখো ঠাকুর,এতো খামখেয়ালি স্বভাব কিছুই বুঝিনা কী বলতে চায়,কী করতে চায়!" আর একবার করে "হরে কৃষ্ণ" নাম আওরায়।
-সামনের বছর বিয়েটা হয়ে গেলেই বাঁচি,সংসারের ভিতর ঢুকলে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে তখন আর এসব হাবিজাবি ভেবে মাথা গরম করতে সময় পাবে না।
কয়েকবার গুরুমন্ত্রটা জপ করে নিয়ে উর্মির মা গলায় কাপড়ের আঁচলটা পেঁচিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করে।

মায়ের কথামতো উর্মি জিনিস কটা রান্নাঘরে তুলে রাখে। জায়গাটা পরিস্কার করতেই ফোনটা বেজে ওঠে ওর। উর্মি তাড়াতাড়ি হাতটা ঝেড়ে ওর ঘরে ছুটে যায়।
-আজ মুড অফ মনে হচ্ছে!
-আরে আর বোলো না,মা কে কিছুতেই বোঝাতে পারিনা...
এতটা বলেই উর্মি হঠাৎ থেমে যায়।
-কী বোঝাতে পারো না?
-এই যে এতোক্ষণ ধরে না খেয়ে ঠাকুর ঘরে পড়ে থাকে, কিছুতেই কথা শোনে না!
-বুঝিয়ে বোলো শুনবে,আচ্ছা উর্মি এখন রাখি হ্যাঁ,অফিসে ঢুকে পড়েছি!
উর্মি অন্যমনস্ক ভাবে খুব আস্তে করে একটা 'হ্যাঁ' বলে,ওপারের ব্যক্তিটি আদেও শুনতে পেল কিনা কে জানে!

বেলা বারোটা।স্নান সেরে উর্মি সবে জামাকাপড়গুলো নিয়ে ছাদে উঠেছে।তখনও অদূরের চায়ের দোকানের ঝাঁপ খোলা।রাস্তায় দু একটা লোক যাচ্ছে।হঠাৎ উর্মির চোখ গেল একটা মেরুণ রঙের গেঞ্জি পড়া ছেলের দিকে।বুঝতে এতটুকু দেরী হলো না উর্মির।খোকন আর ওর এক বন্ধু, চায়ের দোকানটাতে ঢুকছে।উর্মি তাড়াতাড়ি নিজেকে আড়াল করে অন্যদিকে চলে আসে।আবার সেই পুরোনো ভয়টা মাথাচারা দেয়।বালতিটা ফেলেই নীচে চলে আসে।দরজা বন্ধ করে,পা দুটো নিজের বুকের কাছে গুটিয়ে নিয়ে সামনের চেয়ারটার  দিকে তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে।

কিছুক্ষণের জন্য ও একটা অন্য জগতে হারিয়ে যায়।যেখানে ও দেখে কয়েকটা আবছা অস্পষ্ট মুখ,আর তাদের বিচ্ছিরি সব মুখের ভঙ্গি,যেন ওকে খেতে আসছে।ভয়ে ও আরও জড়োসড়ো হয়ে যায়।নড়তে চড়তেও বাধা পায়।

উর্মির মা ততক্ষণে  বেশ কয়েকবার ওকে ডেকেছে। অন্যমনস্কতার কারণে উর্মি শুনতে পায়নি। ঘরে এসে  উর্মিকে ডাকতেই উর্মি প্রথমটায় চমকে উঠল।ওর মা ভয় পেয়ে ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে।উর্মির চোখ দিয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।নাক চোখ মুখ সব লাল হয়ে যায়। মা জিজ্ঞেস করায় উর্মি উত্তর দেয় বাবার জন্য মনখারাপ।

উর্মি ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে নীচে নামে,তখনও বেশ অন্যমনস্ক ও। মায়ের সাজানো থালার দিকে তাকিয়ে থাকে,অথচ ও কিছুই দেখছে না।খাওয়ার থেকে ফেলা যাচ্ছে বেশি।সেদিকে ওর এতটুকু হুঁশ নেই।

রাত্রি দশটা, উর্মি খেয়ে ওপরে চলে যায়। হাত মুখটা ভালো করে ধুয়ে মুখে মাখার ক্রীমটা ড্রেসিংটেবিল থেকে  নিতে যাবে এমন সময় সৌমর ফোন।
-মন ভালো হয়েছে মেয়ের?
উর্মি একটা হালকা হাসি টেনে বলল "হ্যাঁ"
-কী খেলে বলো আজ?
-ভাত, দিনেকার সবজি ছিল, ডাল, ডিম ভাজা।
সৌম্য মজা করে বলল,"বাহ্ ভালোই হয়েছে তবে!তা এখন কী করবে?কিছু পড়বে নাকি গান শুনবে নাকি কথা বলবে?"
সৌম্য উর্মিকে বুঝতে চায়,ও জানে জোর করে কাউকে কিছু চাপিয়ে দিতে নেই।সবার একটা আলাদা আলাদা পছন্দ থাকে,ভালো লাগা থাকে।উর্মিকে ও কোনোদিন জোর গলায় তাই কিছু বলেনা,কেউ ওর কথায় কষ্ট পেলে পরে ওরও খুব কষ্ট হয়।
গেল মাসে উর্মির সাথে সৌম্যর বিয়ের পাকা কথা হয়।সৌম্য বাড়ির এক ছেলে।বাড়িতে আর মা, বাবা, বোন।বোন এখন ছোট,পড়াশোনা করছে।এবার ক্লাস ইলেভেন।বাবা রিটার্য়াড পারসন,তবে সময় কাটান খুব সুন্দর। বই পড়েন, গান শোনেন,বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করেন।

-মা আমার ক্রীমটা শেষ হয়ে গেছে,কাল একবার আমার সাথে যাবে?
-আগে দেখিসনি,আজই আনা হতো বিকেলে গিয়ে,
-কাল এনে নেব।

পরদিন বিকালে উর্মি মায়ের সাথে বেরোয়।যাওয়ার সময় চোখে পড়ে খোকন আর ওর কটা বন্ধু নান্টুর চায়ের  দোকানে আড্ডা মারছে।উর্মি দেখে মাথা নামিয়ে নেয়।ওর মাকে খোকন জিজ্ঞাসা করে,"কাকিমা চললে কোথায়?"
-এই বাজারে,দরকার আছে
-আমায় বললে পারতে তো
-না,না তেমন কিছু না,ওই...
উর্মি মায়ের হাতটায় জোরে চাপ দেয়,বোঝাতে চায় ওদের এসব বলে কী হবে!
খোকন কিছু  বুঝেছিল তাই পরক্ষণেই বলে,
-বেশ যাও কাকিমা।
-উর্মি তুই খোকনকে দেখতে পারিসনা কেন বলত!কত বাধ্য ছেলে ও, যা বলি তাই শোনে।
-তুমি একটু বেশিই  ভালো বলো মা,আমার মোটেই ভালো লাগেনা এসব।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা  বাজারে এসে পড়ে। দোকানগুলোয় বড্ড বেশি ভীড়।উর্মি ভীড়  ঠেলে ভিতরে গিয়ে দোকানদারকে ক্রীমটা দিতে বলতেই,পাশে দেখে খোকনের বৌ রেনু।
-ভালো আছ দিদি?
উর্মি প্রথমটায় চমকে যায়,পরে বলে,"হ্যাঁ..., তুমি?"
-আমরা ভালো আছি,
-কার সঙ্গে এসেছ,একাই?
-না না ও এসেছে।
'ও এসেছে' শুনেই উর্মির মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়।কেন ভয় পায় উর্মি খোকনের কথা শুনলেই,কেন এমন ভড়কে যায়!

কোনোরকমে জিনিসটা নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে উর্মি মায়ের হাতটা ধরে জোরে হাঁটা দেয়,যেন চুরি করে পালাচ্ছে!
-এই ফুচকা খাবি?
-না মা কিছুই খাব না,ভালো লাগছে না।
উমা একটু রেগে গিয়ে বলে,-"কী হয়রে তোর মাঝেমাঝে?কেমন যেন করিস!"
উর্মি বুঝল মায়েরও খারাপ লাগে না।তাই একটু থেমে গিয়ে মা কে বলে
"বেশ চলো ফুচকা খাই"।

-এই গলিটায় একটা লাইট তো দিতে পারে বলো! কী অন্ধকার বলোতো!
উর্মি নিজেই বলে,উমা সারা দেয়না।মেয়ের ওরম আচরণে প্রায়ই ভাবনায় পড়ে যায়।ভাবে ডাক্তার দেখাবে কিনা,কেন ও এরকম করে!"

বাড়ি ঢুকে গেলে উর্মি আর একবার বাইরে আসে। বাইরের গেটটা তালা দেওয়ার জন্য। কয়েকটা কুকুর চেঁচিয়ে ওঠে। কারণটা খুঁজতে একবার রাস্তায় দাঁড়াতেই উর্মি দেখে সামনে খোকন। খোকন উর্মির হাতটা  খপ করে ধরে নেয়,উর্মি ছাড়াতে গেলে আরও জোরে চেপে ধরে।কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলে,-আর একবার আসবি উর্মি?
উর্মির মুখ শুকিয়ে যায়,সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়...,খোকন বলে,"কদিন পর তোর বিয়ে,তুই তখন তোর বরের,তার আগে আমি চাই আর একবার তোকে আমার করতে"!

উর্মির ভালো লাগেনা খোকনের এসব বাজে প্রস্তাব,তবু কিছু বলতে পারেনা।খোকন উর্মিকে ভয় দেখায়।ভয় দেখায় এই বলে যে, ওর বাবা আর কাজ থেকে বাড়ি ফিরবে না,ওর মা স্নান সেরে আর নাও বেরিয়ে আসতে পারে,উর্মি তাই চুপচাপ খোকনের কথা শুনে যায়।
উর্মির বিয়ে ঠিক হয়েছে।সৌম্য ভালো ছেলে। খোকন এও বলেছে,উর্মি যদি রাজী না হয় তবে সৌম্যকে ও সবটা বলে দেবে আগের ঘটনা।
উর্মিকে খোকন ভালোবাসেনা, ওর শরীরটা চায় শুধু। উর্মি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রাস্তার ওপাশের পোড়ো দেওয়ালটার দিকে।

গল্পকার সোমা সাহা
কাটোয়া, কাঠগোলা পাড়া, পূর্ব বর্ধমান























0 Comments