সোমনাথ বেনিয়ার মুক্তগদ্য


প্রায় রঙের সন্ধ‍্যা কিংবা 
কালো গোলাপ

"গর্ভের সামান‍্যটুকু জল, আর চারিদিকে তেজস্ক্রিয় বালি", দেখে কোনো পরিত‍্যক্ত বাড়িতে ঘুরে বেড়ানো কালো বিড়ালের থম নিয়ে গুপ্তবীজ হয়েছিলাম। সমস্ত প্রশ্নের হয়ত উত্তর ছিল। পুরো শহরটাই যেন পাশে অক্ষয়বৃক্ষের মতো দাঁড়াতে চেয়েছিল। সম্পর্কের বন্ধন টি.এম.টি বারের মতো মজবুত। আসানিসে টুটে গা নেহি! কিন্তু হৃদপেশী ফ্লেক্সিবেল। তাই মনের আচরণকে মান‍্যতা দিয়ে সম্পর্ককে রাবারের দেওয়াল বানিয়েছিল যাতে সমস্ত ঘাত-প্রতিঘাত সহ‍্য করে নিতে পারে। বেসিক কাঠামোর যেন কোনো ক্ষতি না হয়। এই যে ইট, বালি, সিমেন্ট, রঙ ইত‍্যাদি বাস্তবিক অভিযোজিত প্রেমের অভিধান। সেখানে স‍্যাঁতসেঁতে শ‍্যাওলা পড়বে, কোণায়-কোণায় ফার্নগাছ জন্মাবে, উঠতে গিয়ে হাত-পা ছড়ে যাবে, তবেই না বোঝা যাবে "একবার‌ই প্রেম এসেছিল জীবনে।" অবশ‍্য ফিরতেই হতো। ছেড়ে দিতেই হতো সব কিছুর অর্ধেক। এসব ছিল সময়ের দাবি। সময় তো পরিযায়ী পাখিদের মতো। হাজার-হাজার মাইল উড়ে যেতে পারে প্রিয়তমার জন‍্য। সহ‍্য করে নিতে পারে ডানার উপর আছড়ে পড়া প্রখর সূর্যের তপ্ত পঙ্‌ক্তিমালা। এসব ঘটনা। ঘটে। অজান্তে ঘটলে দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা নাছোড়বান্দা স্মৃতি। বলা ভালো এক ধরণের পোকা যে ভিতরে-ভিতরে বাহককে খেতে থাকে। তাই পঠনপাঠনের শেষ তারিখ ক‍্যালেন্ডারে আসতেই তিন চাকার টেম্পোর গর্জন শুনতে পেয়েছিলাম। নির্দেশ ছিল শহর ছাড়ার। অন্তরালে যাকে মন দিয়েছিলাম, তাকেও ছাড়ার। কাট অব মার্কের উপর গিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। স্নানের ধারায় চোখের জল মিশে গিয়েছিল। যারা জানতো তাদের হয়ত প্রয়োজন ছিল না। যাদের প্রয়োজন ছিল, তারা কেউ জানতেও পারলো না। অদ্ভুত এক সমীকরণ যার ফলাফল লিমিট টেনস টু জিরো! চিন্তা ভাবনার মধ‍্যে জট পাকিয়ে একরাশ কষ্ট বুকে চেপে সেই টেম্পো লোটাকম্বল গুটিয়ে দে দৌড়। শহর পেরোতে যতটুকু সময় লেগেছিল, ততক্ষণে আকাশের গায়ে প্রায় রঙের সন্ধ‍্যা বাসা বেঁধেছিল। কিছু পরিচিত মুখের আবছা দলকে নির্বাকভাবে বাইপাস করে গেলাম। আড়ালে কে যেন হার্টে বাইপাস সার্জারি করে দিয়েছিল। যদি একটু সময় পাওয়া যেত তখন না হয় উত্তর-প্রত‍্যুত্তরের খেলায় নিদেনপক্ষে একটি কালো গোলাপ আঁকা গ্রিটিংস কার্ড তার উদ্দেশ‍্যে পাঠিয়ে বলতে পারতাম, "মে আই কাম, গো আই মাস্ট!" ঊহ‍্য রাখতাম ফর দ‍্য টাইম বিইং। স্রেফ একটা লাইন বলার জন‍্য রেললাইন টপকে পচা খালের ধারে যেতাম। সূর্যের শেষ বেলার আলোটুকু চোখে-মুখে পরম তৃপ্তিতে মেখে যে ভাঙা নৌকোটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে আছে, তাকে বলতাম, "অথচ আমার সব সোনাদানা চুরি হয়ে গেছে এই বসন্তকালেই!" তখন অসময়ের কোকিল একবার ডেকে উঠলে সাতচারা খেলার সাত নম্বর চারাটা নিয়ে সেই খালের জলে ত‍্যারছা ভাবে ছুড়ে দিতাম আর সেটা সাতবার ব‍্যাঙের মতো ছপাৎ ছপাৎ করে লাফাতে-লাফাতে যেখানে ডুবে যেত সেখানেই ভাবতাম লুকিয়ে রয়েছে যত কালো ঐশ্বর্য। অবগাহন! শুধু অবগাহন! হয়ত কোনো এক পিছুডাকে উঁকি দিতাম। অবশ‍্য যে ডাকবে সে তো তখন বিকেল বেলায় পাড়ার বুড়ো দাদুর ব্রতচারীর লাইনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনার অপেক্ষায় ওরফে একটি নকুলদানার প্রতি শুভেচ্ছা জানানোর আর্জি নিয়ে চনমনে হয়ে আছে। আজ‌ও দাঁড়িয়ে আছে আমার সত্তার মনমরা ছায়া। দর্শন নিয়ে, "তুমি যেমন চালাও তেমনি চলি!"
কথা চলে না। কথা চলতোও না। বলতে বলেছিল, "অসুবিধা কোথায়?" তখন সে বয়স সুবিধা-অসুবিধা বুঝতো না। পথ মন দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে চলতো। তাই ফেরার দিন অনেকগুলি প্রিয়কে হাইড্রেনের পাশে নীল অপরাজিতা গাছের ঝোপে বিসর্জন দিয়েছিলাম। তার সঙ্গে সেই প্রিয় মুখ‌ও টুপ করে ডুবে গিয়েছিল। কোনো শব্দ হয়নি? হয়েছিল ব‌ই কী! একটা অগোছালো ছলাচ্ছল শব্দ উঠেছিল যার খোঁজে পথ চলতে গিয়ে অ্যালভিওলাইয়ের অনেক বয়স হয়ে গেল। কাশলে কফ জড়ানো স্মৃতি বেরিয়ে আসে। কালো কাক খুঁটে খেয়ে যায়। কালো পিঁপড়ে বংশবৃদ্ধির লোভে অবশিষ্টাংশের দিকে তেড়ে আসে। হাড়ের ভিতর মজ্জা প্রমিস বুঝতো না। যতটুকু ভালোলাগা আর ভালোবাসার দ্বন্দ্ব বুঝতে পারা যেত তার ক্রোড়পত্রে পান ছ‍্যাঁচার হামান দিস্তার সাথে ঠাম্মার মুখে রূপকথার গল্প বসবাস করতো। সব ভুল। সব মিথ‍্যে। সব মিথ‍্যে বলেই মানুষ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নে হাসে। স্বপ্নে কাঁদে। তাই সেও শুধু ড্রিম গার্ল হয়ে থাকলো। বুকের ভিতরটা রোলার কোস্টার। ঘুরতে-ঘুরতে কত কিছু রোমান্থন করে নিয়ে আসে। কত কিছুই তো প্রিয় ছিল চলার পথে। ভাবনার অনুরণন ইঞ্জিনের শব্দে ঢাকা পড়েছিল। জানা নেই যে কোনো অজ্ঞাত অভিমানে সেই শহর‌ও কি ধাক্কা দিয়ে চিরতরে বহিষ্কার করতে চেয়েছিল কিনা? এখন অনেক সময় কান্নার গুনগুন শব্দ শুনি। আমি না তুমি। দুটি ছায়া মুখোমুখি আর "হামারি আধুরি কাহানি!"

গদ্যকার সোমনাথ বেনিয়া
নিমতা, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ























0 Comments