বিকাশ বরের গল্প


অপরিবর্তিত

মাঝে মাঝে স্মৃতিও বিশ্বাসঘাতকতা করে!বিস্মৃতির অতলে গিয়ে দক্ষ ডুবুরির মত তুলে আনতে হয় বিস্মৃত সেই অরূপ রতন।
মুখটা খুব চেনা।অথচ ধরতে পারছি না, কার মুখ, কোথায় দেখেছি। রাত্রে ভাল ঘুম হয়নি।চিন্তাটা মাথায় জট পাকিয়ে আছে।কেন জানিনা ভাবনাটা আমায় কুরে কুরে খাচ্ছে !  অকারণই ! যতক্ষণ না জটটা খুলতে পারছি, কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না।
এমনই হয়।মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে,- "জট খোল, আমায় মুক্তি দে, গুরুভার নামিয়ে আমায় হাল্কা কর।"
সকালে চায়ের কাপের সঙ্গে চিন্তাটা আবার ফিরে এল। --খুব চেনা--খুব কাছের--তবুও অস্পষ্ট, অধরা, ঝাপসা--
মাথাটা ভার হয়ে আছে। কেন বিষয়টা নিয়ে ভাবছি, কেনই বা এত অস্বস্তি হচ্ছে কিছুই ঠাহর করতে পারছি না !
বাড়িতে এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। গতকাল তৃণা যেভাবে কট কট ক‍রে তাকিয়ে ছিল, যা সব প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিল, এরপ‍র ব্যাপারটা নিয়ে আর না এগোনোই ভাল। নিজের বুকের ভার নিজেকেই বয়ে বেড়াতে হবে। শেয়ার করে হাল্কা হওয়ার যো নেই !
গতকাল গোটা হাতিবাগান চষে বেড়িয়ে পুজোমার্কেটিং কোনোরকমে শেষ করেছি। শুরু হয়েছিল বড়বাজার দিয়ে।তারপর কলেজস্ট্রীট, নিউমার্কেট হয়ে হাতিবাগান।টানা এক সপ্তাহের যুদ্ধ!  পুজোর বাজার হাতে ঝুলিয়ে পেটপুজোর জন্য বৌ মেয়েকে নিয়ে ঢুকেছিলাম হাতিবাগানের "গজব" রেস্টুরেন্টে।   
খাবার অর্ডার দিয়ে টেবল জুড়ে বসেছি।এসির ঠান্ডা হাওয়ায় বাজারের ধকলে ক্লান্ত শরীরটা  ধাতস্ত হচ্ছে।যুদ্ধ শেষের বিধ্বস্ত শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে ভরা চাঁদের মোলায়েম আলোর মত।হঠাৎ চোখ পড়ল সামনের দু'টো টেবলের পরের টেবলটায়।চোখ সরাতে পারলাম না। আটকে গেল ফেভিকুইকের মত। মাঝবয়েসী ভারী শরীরের এক সুন্দ‍রী ভদ্রমহিলা অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখাচোখি হল। বুকের খানিকটা রক্ত চলকে উঠল মুখে।  ধড়াস্ করে বুকের শব্দ হল।খুব চেনা চেনা লাগছে ভদ্রমহিলাকে।  বেশ ক'একবার তাকালাম।যতবার দেখছি ততবার চোখাচোখি হচ্ছে! কেন এরকম হচ্ছে !ভদ্রমহিলা কী আমাকে চেনেন ? না নিছক দেখার জন্যই দেখা !
ব্যাপারটা তৃণার চোখে পড়েছে।কনুই দিয়ে একটা মৃদু ধাক্কা দিল।  "কী হচ্ছে এসব ! এত দেখার কী আছে !"একটু বিব্রত হলাম।সামলে নিলাম নিজেকে। তৃণা তখনোও গজ গজ করে চলেছে।--"গিলতে আসে না পরপুরুষ গিলতে আসে !

তিনদিন হয়ে গেল।চিন্তাটা পুরোপুরি মিলিয়ে যাচ্ছে না। মুখটা মাঝে মাঝে ভেসে আসছে। এরকম আগে কখনো হয়েছে কিনা মনে করতে পারছি না।

শনিবার আমার ছুটি।দমদম নর্দানের এসবিআই ব্রাঞ্চে গেছি একটা ডিমান্ড ড্রাফ্টের জন্য।  মেয়ের কলেজের ফিস দিতে।ড্রাফ্টটায় অ্যথেনটিক সিগনেচারের জন্য ফিল্ডঅফিসারের কাউন্টারে গেছি।চেয়ারে চোখ পড়তেই বুকটা ধড়াস ক‍রে রক্ত চলকে দিয়ে যেন  মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল ! তড়িতাবিষ্টের মত স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম !রেস্টুরেন্টে দেখা সেই ভদ্রমহিলা !যাকে নিয়ে ক'দিন ধরে বুকে ঝড় উঠেছে।আবিষ্টের মত ড্রাফ্টটা বাড়িয়ে দিয়েছি।ভদ্রমহিলা আমার দিকে অপলক তাকিয়ে। 
এত কাছে এসেও ঠিক ধরতে পারছি না।অস্বস্তিটা আবার মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠেছে ! হলটা কী ! কেন এমন হচ্ছে !
মাসতিনেক আগে ব্যাংকে এসেছিলাম তখন কিন্তু এনাকে দেখিনি।  
"আপনি অতনুদা না ?"  অতনু স্যান্যাল--
মৃদু স্বরে ভদ্রমহিলা বললেন । গলাটাও খুব চেনা লাগল। খুব পরিচিত চেনা কন্ঠ।মাথা নাড়ালাম।ঠিক তখনি চোখ পড়ল নেমপ্লেটের উপর।"তৃধা চৌধুরী।"নিমিষেই মাথার জট সব আলগা হয়ে গেল।ঝাপসা ছবি স্পষ্ট।প্রবাহমান জলরাশির মত একরাস স্মৃতি উঠে এল বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে।খুব স্পষ্ট করে‌।তৃধা --আমার তৃধা--!

পঁচিশ বছর আগের কথা।চাকরিজীবনের প্রথম পোস্টিং হয়েছিল মালদা টাউনে। মালদা ডি আর এম বিল্ডিংয়ে পার্সোন্যাল ব্রাঞ্চে পোস্টিং।নতুন চাকরি। নতুন শহর।শরীর জুড়ে শিহরণ !আনন্দের বান। কম বয়েসী এক তরুণ ছুটে বেড়াচ্ছে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। ঘরছাড়া গরু যেমন বেপোরোয়া  হয় ! ঠিক  যেন ছিলেকাটা বাণের মত !
আমরা চারজন একটা মেসে থাকতাম। চারজনই কলকাতার ছেলে।অফিসের পর সন্ধ্যায় সবার অলস সময়। হৈ হুল্লোড়, সিনেমা হল, ছোট্ট শহরটা  চষে বেড়ানো--সময় কাটছিল না যেন। টিউশনের অভ্যেস ছিল। সিনিয়র কোলিগদের বলতে দুটো টিউশন পেয়ে গেলাম।  অফিস সুপারভাইজার বোসদা বললেন, "মেধাবী ছাত্রী। 
বাবা কাটিহার ডিভিশনের কমার্সিয়াল অফিসার। ক্লাস টেনে পড়ে।  সিরিয়াসলি পড়াতে হবে।পুরো দায়িত্ব তোর।কাল থেকে লেগে পড়।"  
বোসদা সন্ধ্যায় অফিস ফেরতা ছাত্রীর বাড়িতে নিয়ে গেল। ছবির মত সুন্দর বাংলোটাইপের বাড়ি।  একমাত্র সন্তান।বোসদার কথামত আমার মহামূল্য টিউশন।
তৃধার সঙ্গে সেই প্রথম দেখা। ফ্রক পরা, বেনী ঝুলানো দুধেআলতা গায়ের রংয়ের প্রতিমার মত মুখের তৃধা।  রোগা পাতলা উজ্জ্বল মেয়েটা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল।  সেদিন কোন তিথি ছিল জানি না। তবে চাঁদের আলোয় বান ডেকেছিল।
ছাত্রীর সঙ্গে মাস্টারের সম্পর্ক যেমন হয়,  তেমনই তৃধাকে দেখতাম আমি।  মাস ছ'য়েক পর  সম্পর্কটা অন্য দিকে গড়াল।তৃধা আমার প্রেমে পড়ল। আমিও। একেবারে বাঁধন হারা দিগন্ত ছোঁয়া প্রেম।
এক বর্ষামূখর সন্ধ্যায় প্রথম টের পেলাম তৃধা আমায় ভালবাসে।
"কী হল! চুপ করে বসে আছ যে!" আমি তৃধাকে ধমক দিলাম।ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ছে অঙ্কের সাদা পাতায়। নীরবে, নিভৃতে।সেই প্রথম তৃধাকে স্পর্শ করলাম। হাতটা ধরলাম আলতো করে। "কী হয়েছে, আমায় বলতে পার ।"
কথা না বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল তৃধা। আমার ভেতরটায় কেমন যেন সব তালগোল পাকিয়ে গেল।   আমারও চোখে জল এসে গেল।গলার কাছে দলা পাকিয়ে কথা আটকে গেছে।তৃধার সুন্দর মুখে পৃথিবীর সব সৌন্দর্য এসে হামলে পড়েছে যেন ।   আমার অস্তিত্ব যেন মুহূর্তকালের জন্য লয় হয়ে গেল। অকূলপাথারে ভেসে পাল তোলা নৌকার পাগলা হাওয়ার মত আমি আবিষ্টের মত বললাম,"আই লাভ ইউ তৃধা।"

তৃধাকে ভালবেসে মালদা টাউনও আমার প্রিয় শহর হয়ে গেল।যে দিন পড়ানো থাকত না, অফিস ফিরেই  দাঁড়িয়ে থাকতাম মহানন্দার তীরে।  গোধূলিবেলায় তৃধার অপেক্ষায়।তখন মোবাইল ফোন ছিল না।পরের দিনের কথা আগের দিনে হত।  মহানন্দার পাড় ধরে আমরা হাঁটতে হাঁটতে ঝলঝলিয়া থেকে চলে যেতাম ইংলিশবাজারে।চাঁদের আলোয় ভাসতে ভাসতে যুঁই, রজনীগন্ধার ঘ্রাণ  নিতে নিতে আমরা কথা বলতাম। অফুরন্ত অনন্ত কথামালা।  সব কথায় লেগে থাকত ভাললাগা। সব কথায় জড়িয়ে থাকত রাতফুলের সুঘ্রাণ।পরদিন ঠিক কোন জায়গায় আমরা দেখা করব ,তৈরি হয়ে যেত তার রূপরেখা।
আমাদের এই গোপন দেখার একমাত্র সাক্ষী ছিল মহানন্দা। আর একজন জানত,যখন সে আকাশে থাকত। সে আমাদের ভালবাসার চাঁদ।
মেসের ছেলেরা জেনেছিল অনেক পরে।বোসদা আর তৃধার মা জানতে পেরেছিল আরো পরে।আমার মালদা ছাড়ার প্রাক্কালে।
"তুমি কোনদিন আমাকে ভুলবে নাতো!" তৃধা জিজ্ঞাসা করল।"এই মহানন্দা সাক্ষী এ জীবনে নয়।"আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম।  
দেখতে দেখতে তৃধার মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে এল।  আমি সবাইকে অবাক করে পরীক্ষার দিনগুলোতে ছুটি নিলাম।তৃধাকে একজামসেন্টারে  নিয়ে  যেতাম। গৃহশিক্ষকের দায়িত্ববোধ থেকে।তৃধার মা, আর অন্যরা অন্ততঃ সেটাই বুঝত।
আমি জানি, এই ছোটা আমার ভালবাসার ছোটা। আমার প্রাণপ্রিয় ভালবাসার জন্য ছোটা।আমি তৃধাকে বললাম, "দ্য বেস্ট, ফর ইয়োর ডিয়ারেস্ট।"তৃধা কথা রেখেছিল। নাইন্টিফোর পারসেন্ট মার্কস পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল।

একটা সুযোগ এসে গেল। বিনা চেষ্টায়‌। একেবারে উবজে। মালদার শুভ্র কলকাতার অফিসে কাজ ক‍রত।ও মিউচুয়াল ট্রান্সফারের প্রস্তাবটা নিয়ে এল।    অন্য কেউ হলে একেবারে হাতে চাঁদ পাওয়ার মত লুফে নিত। আমি কেমন নির্লিপ্ত রইলাম‌।তৃধাকে আমি ছেড়ে যেতে পারবো না। কিছুতেই না।
শুভ্র দিনরাত এক করে আমার পিছনে পড়ে রইল। অফিসের  সবাই বলল,"এ সুযোগ আর আসবে না।" 
আমি তৃধাকে বললাম‌। সবটা খুলে।তৃধা অনেকক্ষণ চুপ করে রইল।তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,  "তোমার ভাল আমার ভাল।"
আমি তৃধাকে প্রথমবারের জন্য জড়িয়ে ধরে বললাম, "তোমার অতনু তোমারি থাকবে চিরকাল।  কথা দিলাম।"
তৃধার চোখের জলে মহানন্দা ভাসিয়ে, মালদাকে কাঁদিয়ে, বুকে পাথরচাপা যন্ত্রণা নিয়ে মালদা ছাড়লাম।
আমার প্রিয় শহর, আমার প্রিয়াকে ছেড়ে---!

কে জানতো এমন হবে !কে জানত বিধাতার লেখন ! মানুষ এত উন্নত হয়েছে। গ্ৰহ গ্ৰহান্তরের খবর তার নখদর্পণে তবু কেমন অসহায়! কাল কী হবে কেউ জানে না।বিধাতার লেখন না যায় খন্ডন।নাঃ,আমি কথা রাখিনি। তৃধাকে দেওয়া কোনো কথা রাখিনি।

কফিশপে আমার মুখোমুখি তৃধা।পঁচিশ বছরে কত পরিবর্তন !মাথার পাকানো জটটা এখন খুলে গেছে‌।  আমার তৃধাকে আমি চিনেছি।দু'জনের শরীরে কত ঘাতপ্রতিঘাত। বুকের গভীরে  জমানো কান্নার পাথরের স্তর ।কত অজস্র পরিবর্তন !শুধু একটা জিনিস  অপরিবর্তিত রয়ে গেছে,সেটা আমাদের চোখের জল।

    গল্পকার বিকাশ বর
সিঁথি (দমদম), রায়পাড়া বাইলেন, কলকাতা




























0 Comments