
একটু উষ্ণতার জন্য
"এই করেছ ভালো নিঠুর হে,এই করেছ ভালো
এমনি করে হৃদয়ে মোর তীব্র দহন জ্বালো…’’
দক্ষিণমুখ খোলা একফালি বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিভোর হয়ে আপন-মনে গেয়ে চলেচন্দা,চন্দা রায়বর্মন।বরাবরই তার গানের গলাটা নাকি ভালো একথা সে অনেকবার শুনেছে পীযূষের মুখে। সেই পীযূষ এক সময় যার উষ্ণতায় তার দিন গুলো রঙিন হয়ে উঠত।সেই পীযূষ,যার জন্য সে রাতের পর রাত স্বপ্ন দেখেছে।
সেবারের ঘটনাটা সে কোনদিন ভুলবে না।কেমন করে ভুলবে!একটা ঢেউ তার সবকিছু কেড়ে নিয়ে চলে গেল। তারপর নদী থেকে অনেক জল বয়ে গেল।সে যখন পাল ছেঁড়া নাবিকের মতো এদিক-ওদিক ঠক্কর খেতে খেতে ঢেউ এর পর ঢেউয়ে ভেসে ভেসে চলেছে,ঠিক তখনই দেবদূতের মত হাজির হয়েছিল তমাল,তমাল রায়বর্মন- দক্ষিণ কলকাতার বনেদি পরিবারের শুভ্রাংশু শেখর রায় বর্মনের একমাত্র ছেলে।
বাজার থেকে ফিরে,এই সকালবেলা চন্দাকে একা একা এভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্ত তমাল বলে ওঠে,পাগল হলে নাকি তুমি! আবার, আবার ওইভাবে চেয়ে আছে! কি? কি দেখছো?চোখের পাতা ফেলো।
চন্দা ফ্যাল ফ্যাল করে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে-এক দৃষ্টিতে।
তমাল সজোরে তার কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে এবার বলে,কতবার তোমাকে না বলেছি,এভাবে বারান্দায় এসে তুমি বসবে না। তারপর গলা ছেড়ে সে ডাক দেয়-বিন্দি---ই,এই বিন্দি--ই---
সম্বিত ফিরে পায় চন্দা।ধীর-স্থির ভাবে মৃদু গলায় সে বলে,ওকে একটু বাজারে পাঠিয়েছি।তুমি যাও টেবিলের ওপর তোমার ব্রেকফাস্ট চাপা দিয়ে রেখে এসেছি।খেয়ে নাও।ঠান্ডা হয়ে গেলে আর ভালো লাগবে না।
-তুমি খাবে না?
-না।
-কেন?
-চুপ করে থাকে চন্দা।তারপর তাদের তিনতলা ঘরের পিছনের বাগানের দিকে হাত বাড়িয়ে ধীরে ধীরে গলা তুলে বলে,দেখো দেখো,ওই আমগাছটায় কি একটা পাখি একটানা ডেকে চলেছে।ওটা কী পাখি গো?
তমাল পায়ে পায়ে চন্দার পিছনে এসে দাঁড়ায়।পাতার ফাঁকে পাখিটাকে খোঁজার চেষ্টা করে সে।না কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না।তবে বড় কর্কশ একটা ডাক একটানা তার কানে আসছে।কান খাড়া করে, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে সে বলে,কাক-টাগ হবে বোধহয়।তুমি চলো,একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করে নেব।আমার খিদে পেয়েছে।
পাখিটার আওয়াজ টার দিকে কান পেতে চেয়ে থেকে চন্দা।তারপর বলে,তুমি যাও আমি আসছি।তুমিতো জানো এত সকালে খাবার অভ্যাস আমার নেই।আমি আর একটু বসি, সকালটা বড় ভালো লাগছে আজ।
তমাল আর দাঁড়ায় না।এরপর তাকে স্নান করে, নিজেকেই সবকিছু গোছগাছ করে নিয়ে অফিস যেতে হবে।যাওয়ার পথে একবার মিস্টার মুখার্জির চেম্বার ঘুরে যাবে সে।ডাক্তারবাবু তো বলেছেন,এখনো সব আশা শেষ হয়ে যায়নি,এ সময় সারাক্ষণ ওকে চোখে চোখে রাখবেন।হঠাৎ কোনো দুর্ঘটনা---,বিন্দি টা যে কি করে,বিরক্তিতে তার মুখ কুঁচকে ওঠে।
ডাইনিং টেবিলের ওপর টিফিনের ঢাকনা খুলে দেখে নুডুলসের বুক থেকে তখনো ধোঁয়া উঠছে।নুডুলস খেতে সে বরাবর ভালোবাসে।একথা তাহলে এখনো চন্দা ভোলেনি।আজ কি তাকে আগের থেকে অনেক বেটার লাগছে!হবে বোধ হয়।ডক্টর মুখার্জির প্রেসক্রিপশন টা তাহলে কাজে দিচ্ছে!
সে চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে আবারও উঠে দাঁড়ায়।চন্দাকে একবার হাঁক দেয়,এ্যাই,
শুনছো?এদিকে একবার এসো না।
তার মনে পড়ে,ডাক্তারবাবু তাকে বারবার করে বলে দিয়েছেন,মিস্টার বর্মন স্ত্রীকে যতবেশি সম্ভব সংসারে কাজে কর্মে ব্যস্ত রাখবেন।দেখবেন যেন একা একা না থাকে বেশি সময়।সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখবেন।যেন পড়ে না যায়।এ সময় কোন দুর্ঘটনা ঘটলে ওকে আর ফেরানো যাবে না।তাই সাত তাড়াতাড়ি সে বিন্দিকে তার দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে।বড় ভালো মেয়ে।তাদের দেশের বাড়ির কমলা মাসির মেয়ে।বড় চটপটে।কিন্তু এ সময় যে সে কোথায় গেল!
-এই শুনছো? আবার ডাক দেয় সে।চন্দা,আমি কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।ইচ্ছা করে প্লেটটা রান্না করে লুকিয়ে রেখে সে বলে,প্লেট কোথায়?খাব কিসে?
-বাবা! কিছু যদি তুমি খুঁজে পাও!একটা কাজ যদি নিজে করতে পারো!
বিন্দি--ই, বিন্দি--ইইই---ই,এই বিন্দি--ই,দেখ তো তোর দাদা বা…,হঠাৎ চুপ করে সে ভাবতে থাকে।
ডাইনিং থেকে তমাল বলে,ওকে আবার ডাকছো কেন?
বিন্দি কোথায়? সাড়া দিচ্ছে না কেন?ও কি এখনো ওঠেনি? বারান্দা থেকে ঘরে এসে হতচকিত হয়ে চন্দা বলে,হ্যাঁগো,বিন্দি টা কোথায় গেলো?ওকে দেখছি না কেন?
-ওকে তো তুমি কোথায় পাঠিয়েছে যেন--
-আমি পাঠিয়েছি!
হ্যাঁ তুমি--
চন্দা ভাবতে থাকে। আমি! ও,হবে হয়তো।আচ্ছা তুমি কি খুঁজছিলে যেন!
-আমায় খেতে দেবে না? বেলা হয়ে যাচ্ছে যে।
-হ্যাঁ। বসো।সে তাড়াতাড়ি রান্না ঘরে গিয়ে ভাতের
হাঁড়ির ঢাকনা খুলে দেখে চিৎকার করে বলে ওঠে- হ্যাঁগো,একটু ভাত নেই তো।কি খেতে দি তোমায়? মনে হয় বিন্দিটা সব ভাত খেয়ে ফেলেছে।
তমাল চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে বলে,এখন কি আমি ভাত খাই,যে ভাত থাকবে!তুমি ব্যস্ত হয়ো না,এসো।
রান্নাঘর থেকে তাকে ধরে নিয়ে এসে ডাইনিং টেবিলে প্রান্তে দাঁড় করায়।তারপর ধীরে ধীরে তার হাত ধরে ডাইনিং টেবিলের উপর ঢাকা দেওয়া নুডুলস এর ঢাকনা খুলে বলে-দেখো,এখনো কেমন ধোঁয়া উঠছে! সে শ্বাস ভরে নুডুলস এর গন্ধ শুকতে থাকে।
তখনো পাতার ফাঁক থেকে পাখিটা একটানা ডেকে যেতে থাকে।চন্দা তার কোলের মধ্যে দাঁড়িয়ে,ধোঁয়া ওঠা নুডুলসের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।ধোঁয়ার সর্পিল গতিতে তার দুচোখ জলে ভরে আসে।
একটু আগে সকালে গাওয়া গানটির আবেশে তার দু'চোখ বুজে আসে,আর বন্ধ চোখের আগল ঠেলে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়তে থাকে।
0 Comments