একুশ শতকের নারী ~ সৌম্য ঘোষের প্রবন্ধ


সৌম্য ঘোষের প্রবন্ধ 
একুশ শতকের নারী 

বিশ্ব ইতিহাস থেকে জানা যায়, নারীর পক্ষে এবং পাশে দাঁড়িয়ে পুরুষ যেমন লড়াই করেছেন, তেমনি পুরুষের পক্ষে ও পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করেছেন নারী। অন্যদিকে নারীর বহু সংগ্রামী-ইতিবাচক ভূমিকা ও অবদানের তথ্য ইতিহাসে উপেক্ষিত। "রাতের সব তারাই যেমন দিনের আলোয় লুকিয়ে থাকে" , তেমনি লুকিয়ে থাকে নারীর কীর্তি।
আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই ‘মানুষ মানুষের জন্য’; ‘মানুষ মানুষের পক্ষে’। নারীও মানুষ, পুরুষও মানুষ। যখন আমরা নারীকে সব ক্ষেত্রে (ব্যক্তিপর্যায়ে, পরিবারে, সমাজে, প্রতিষ্ঠানে, রাষ্ট্রে ইত্যাদি) ‘মানুষ’ বলতে পারব, মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে পারব, তখনই ‘নারীর পক্ষে পুরুষ’-এর প্রতিশ্রুতি, তার কাজ গুরুত্ব পাবে।

                 একুশ শতকের নারীরা নিজেদের কথা বলতে শুরু করেছেন৷ কিন্তু এখনো অনেক পথ চলার বাকি৷ অধিকারের লড়াই আরো তীব্র করতে হবে৷ এক সাক্ষাৎকারে এই কথা বলেন, জাতিসংঘের নারী বিষয়ক বিভাগের প্রধান৷
              এক সময় মনে করা হতো, নারীরা নিজেদের হেনস্থার কথা প্রকাশ্যে বলতে লজ্জা পান৷ নিজেদের অধিকারের কথা তাঁরা বলেন না৷ সময় বদলাচ্ছে৷ মেয়েরা নিজেদের কথা বলতে শুরু করেছেন৷ অধিকারের লড়াইও তীব্র হচ্ছে৷
         কিন্তু একুশ শতকে দাঁড়িয়ে বিশ্ব জুড়ে আদৌ কি খুব ভালো আছেন নারীরা? প্রশ্নটা উঠেছে এবং উঠছে বিভিন্ন কোন থেকে৷ কার্যত সমস্ত নারীর সেই স্বরই শোনা গেল, জাতিসংঘের নারী বিষয়ক বিভাগের প্রধান ফুমজিলা ম্লামবো নকুকার ভাষ্যে৷ সংবাদসংস্থা এপি'কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, আনন্দের কথা যে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নারীরা তাঁদের হেনস্থার কথা জানাচ্ছেন৷ আর মুখ বুঁজে থাকছেন না সকলে৷ কিন্তু সেই সংখ্যাটি হিমশৈলের শিখর মাত্র৷ এখনো অধিকাংশ ঘটনাই প্রকাশ পাচ্ছে না৷ তা প্রকাশ পেলে সমস্যাটির ভয়াবহতা আরো স্পষ্ট হবে৷
        নকুকা আশাবাদী৷ তাঁর মতে, আগামী দিনে আরো বেশি নারী তাঁদের হেনস্থার শিকার হওয়ার কথা সামনে আনবেন৷ বিচার চাইবেন৷ দোষীদের সমাজের সামনে তুলে ধরবেন৷ শুধু তাই নয়, অভিযুক্তরাও দ্বিতীয়বার এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর আগে দু'বার ভাববে৷ আগে তাদের ধারণা ছিল, দোষ করলেও মেয়েরা কিছু বলেন না৷ তাঁরা সমস্ত যন্ত্রণা মুখ বুঁজে সহ্য করে নেন৷ সমাজকে তাঁরা ভয় পান৷ কিন্তু আস্তে আস্তে মেয়েরা সমাজের সামনে সব কথা জানানো শুরু করায়, দোষীরা শঙ্কিত৷
             নকুকার কথায়, পেন্ডুলাম এতদিন স্থির ছিল৷ এবার তা দুলতে শুরু করেছে৷ জাতিসংঘের দেখা উচিত, যাতে সেই পেন্ডুলাম আবার পিছন দিকে চলে না যায়৷ শুধু জাতিসংঘ নয়, বিশ্বের সব সংগঠনেরই একযোগে কাজ করার সময় এসেছে৷ মেয়েদের বোঝাতে হবে তাঁদের অধিকার৷ সমাজের কাছে নারী অধিকারের জন্য লাগাতার দাবি জানাতে হবে৷ দাবিগুলি আদায় করে নিতে হবে৷ নারীদের জানাতে হবে, মানসিক, শারীরিক বা অন্য যে কোনো রকম হেনস্থার শিকার হলে কীভাবে তাঁরা সে কথা জানাবেন৷ অভিযোগ দায়ের করবেন৷
       সম্প্রতি হলিউডের এক বিখ্যাত প্রযোজকের বিরুদ্ধে যৌন নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছিল৷ নিজেদের হেনস্থার কথা জানিয়েছিলেন নারীরা৷ একযোগে সেই ঘটনার নিন্দা করেছেন অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং কলাকুশলীরা৷ অস্কার থেকে বার্লিনালে, গোল্ডেন গ্লোব থেকে গ্র্যামি সর্বত্র যৌন নিগ্রহের প্রতিবাদ জানানো হয়েছে৷ সরাসরি ওই প্রযোজকের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন অনেকেই৷ নকুকার মতে, এটা ভালো লক্ষণ৷ কিন্তু যৌন নিগ্রহ শুধু হলিউডেই হচ্ছে না, যেকোন দেশেই এই দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমন কি, প্রাত্যহিক জীবনে ট্রামে-বাসে-ট্রেনে-কর্মক্ষেত্রে প্রতিদিন দুনিয়া জুড়ে হেনস্থার শিকার হচ্ছেন নারীরা৷ সকলকে মুখ খুলতে হবে৷ তাহলেই এর বিরুদ্ধে সত্যিকারের আন্দোলন গড়ে তোলা যাবে৷
       একুশ শতকের বয়স হলো ২১। বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত (১৯৯৫) চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের পর ২৫ বছর চলে যাচ্ছে। আরও পেছন ফিরে তাকালে বিশ্ব নারীবর্ষ (১৯৭৫)–এর বয়স হতে দেখছি ৪৫। ‘নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণ’ সনদ জাতিসংঘ থেকে পাস হলো (১৯৭৯)। ‘নারীর অধিকার মানবাধিকার’ এই ধারাটিও যুক্ত হলো মানবাধিকার সনদে (১৯৯৩)।
        এসব আন্তর্জাতিক-বিশ্ব নারী সম্মেলনগুলোতে নারীর সম-অধিকার-মানবাধিকার বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনায় পুরুষ-পুরুষতন্ত্র-আইন-রাষ্ট্র-পরিবার-সমাজ-শিক্ষা-সংস্কৃতি এবং অর্থনীতি গুরুত্ব পায় সমভাবেই।
নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনায় ‘জেন্ডার’ সমতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বলা যায় লিঙ্গগত বিভেদ নয়, সমাজ-নির্মিত বিভেদই নারী-পুরুষের বৈষম্য-অসাম্য-নির্যাতন অব্যাহত রাখছে। যৌন নির্যাতনের ভয়াবহতা পুরুষকে বারবার আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে।
এ রকম একটা সংঘর্ষমূলক সময়ে সম্প্রতি পুরুষ সমাজের বিশ্ব প্রতিশ্রুতি ধ্বনিত হয়েছে: ‘নারীর পক্ষে পুরুষ’ (‘He For She’)। অর্থাৎ নারীকে পুরুষ যেমন যৌন নির্যাতন-অসম্মান করবেন না, তেমনি তাঁকে অধস্তনতা, বৈষম্য, অসাম্যের অবস্থানে ঠেলে দেবেন না। সম্মানজনক সম-অবস্থানে মানুষ হিসেবে নারী ও পুরুষ একসাথে দাঁড়িয়ে সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অনাচার-অবিচার-নির্যাতন রুখে দাঁড়াবেন। যেহেতু আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হাজার হাজার বছরের পুরুষতান্ত্রিকতা বজায় থাকছে, তাই নারীর পক্ষে পুরুষকে এই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হচ্ছে।
        
      ভিক্টোরীয় যুগের লেখক ও নারী ব্যক্তিত্ব হ্যারিয়েট মার্টিনিয়্যু (১৮০২-৭৬) বলেছিলেন, ‘বিগত ৫০ বছরে সমাজ পরিবর্তিত হয়েছে যথেষ্ট কিন্তু নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে বদলাল না।’ নারীকে শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময় পুরুষ ব্যক্তিত্ব জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-৭৩) তাঁর "The Observation Of Women"   (১৮৬৯) বইটিতে নারীর শোচনীয় অবস্থার কথা তুলে ধরে বলেছেন ‘আজকের দিনে বিয়েই হলো একমাত্র ক্ষেত্র, যেখানে আইনত দাসপ্রথা বজায় আছে।’ আমার ব্যক্তিগত অভিমত, সম্ভবত নারী-ই  হল বিশ্ব ইতিহাসে প্রথম ক্রীতদাস।
 রাজা রামমোহন রায়ের (১৭৭২-১৮৩৩) বক্তব্য: ‘একজন নারী একাধারে রাঁধুনি, শয্যাসঙ্গিনী এবং বিশ্বস্ত গৃহরক্ষী মাত্র।’ ...‘সকলের স্ত্রী দাস্যবৃত্তি করে’। (রামমোহন রায় গ্রন্থাবলী, পৃ. ২০৫)।
পুরোনো সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা তথা দাসত্বের শৃঙ্খল মোচনের লক্ষ্যে আঠারো শতকের আশির দশকে যে মহান ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) শুরু হয়েছিল, সেই বিপ্লবী আন্দোলনে নারী ও শিশুর অংশগ্রহণ বাস্তবেই নতুন যুগের উন্মোচন ঘটিয়েছিল। সেই বিপ্লবী পরিস্থিতিতেও পুরুষ সমাজ দাবীনামা তৈরি করলেন,  "Declaration of the Rights of Man-1789)"। প্রতিবাদে ঝলসে উঠলেন মেরি উলস্টোনক্রাফট (১৭৫৯-৯৭)। তিনি লিখলেন "A vindication of the rights of man (1790) এবং A vindication of the rights of Woman (1792)".
নারীর আন্দোলন, সংগ্রাম যখন উত্তুঙ্গ হয়ে উঠেছিল, তখন ১৮৩২ সালে ইংল্যান্ডে ‘পার্লামেন্টারি রিফর্ম অ্যাক্ট’-এ নারী ভোটাধিকার নিষিদ্ধ হয়েছিল। ১৮৫৭ সালে মেয়েদের কাজের দাবি নাকচ হয়ে গিয়েছিল। উদার জাতীয়তাবাদীদের বিধিব্যবস্থা ছিল এ রকম: ‘নারীরা বাইরের কাজে গেলে সাংসারিক জীবনে সংকট সৃষ্টি হয়। কাজেই ঘরেই মেয়েদের থাকা প্রয়োজন। ঘরকন্নাই মেয়েদের কাজ।’ দার্শনিক শোপেনহাওয়ার (Schopenhawer) বলেছিলেন: ‘সন্তানের জন্ম দিয়ে, সন্তান পালন করে ও স্বামীদের অধীনে থেকেই নারীরা তাদের জীবনের ঋণ পরিশোধ করবে। তাদের ইচ্ছামতো মত প্রকাশ করতে দেওয়া যায় না।’ পৃথিবীর সব দেশে এবং আমাদের দেশে সমাজে এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো চলমান রয়েছে।
            কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-৮৩) ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস (১৮২০-৯৫) বলেছিলেন, ‘শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির সঙ্গেই নারীর মুক্তি জড়িত।’ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত (১৯১৭) হওয়ার পরে এই তত্ত্বেরও সুফল ঘটেছে দেশে দেশে। কিন্তু তার পরও এবং এখনো এ নিয়ে তত্ত্বগত ও বাস্তবিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-
রাজনীতিক তর্ক-বিতর্ক ঘটছে। ‘নারীর পক্ষে পুরুষ’-এর ভূমিকা সমাজতন্ত্র-পুঁজিবাদ-বিপ্লববাদ-নারীবাদ ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও মতবাদের ক্ষেত্রে যেমন সাফল্য এনেছে, তেমনি ব্যর্থতাও ঘটিয়েছে। মৌলবাদ কখনোই নারীর পক্ষে দাঁড়ায়নি; নারী প্রগতি ও নারীর মানবাধিকারের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়ে চলেছে।
        রামমোহন রায় (১৭৭৪-১৮৩৩) সারাজীবন সংগ্রাম করে সতীদাহ প্রথা বন্ধে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ১৮৩২ সালের ১২ জুলাই প্রিভি কাউন্সিলের রায়ে সতীদাহ বন্ধের আইন চূড়ান্তভাবে ঘোষিত হলো। কিন্তু এখনো ভারতের কোথাও কোথাও সতীদাহ হচ্ছে এবং সতী হয়ে গৌরববোধ করতে চাইচ্ছে নারী নিজেও।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ‘বাল্যবিবাহ’ বন্ধে সারাজীবন লড়াই করেছেন। ১৯২৯ সালে আইনত বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ হলো। 
দ্বিধাহীনভাবে স্পষ্ট ভাষায় বলা যায়, ঊনবিংশ শতাব্দীতে মহান সংস্কারকারক রাজা রামমোহন রায়ের প্রস্তাবিত ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’ এর মাধ্যমে হিন্দু সমাজের বীভৎস ‘সতীদাহ প্রথা’ চিরতরে রদ হলেও এই একবিংশ শতাব্দীতেও বিভিন্ন অমানবিক প্রথা বন্দী করে রেখেছে আমাদের দেশের নারীকে। রামমোহন রায় সেকালে নারীর শরীরে প্রবেশ করিয়েছিলেন প্রাণ, পরবর্তীতে যা মহাপণ্ডিত ও মহৎ শিক্ষা এবং সমাজ সংস্কারক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবিনাশী অবদানে বিধবা বিবাহ প্রচলন; বাল্যবিবাহ বন্ধের মাধ্যমে ‘নারী’ ফিরে পেয়েছিল তার নতুন জীবন।

                    ঊনিশ শতকে অখন্ড বঙ্গদেশের নারীশিক্ষার পক্ষে বাঙালি পুরুষ বুদ্ধিজীবী-সমাজ সংস্কারক-সাহিত্যিকদের ব্যাপক ভূমিকা যদি না থাকত, তবে নারী জাগরণের দুয়ার খোলা সম্ভব হতো না। সে ক্ষেত্রে অবশ্য ব্রাহ্ম-হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ভূমিকা অগ্রণী ছিল। মুসলিম নারী জাগরণের ক্ষেত্রেও তাঁদের ভূমিকা রুদ্ধদ্বার মুক্ত করার পথ তৈরি করেছিল। এ ক্ষেত্রেও দ্বন্দ্ব ও প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় একশ্রেণির মুসলিম পুরুষ বুদ্ধিজীবীর মধ্যে।
কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, কাজী মোতাহার হোসেন,    প্রমুখ বহু ব্যক্তিত্ব নারীর পক্ষে লিখেছেন, কথা বলেছেন, সংগ্রাম করেছেন।
দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিবাহ পদ্ধতি’ (১৮৬১) প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যে কন্যা মূল্যদ্বারা ক্রীত হয়, সে বিধি-সম্মত পত্নী নহে।...স্ত্রী-পুরুষের মরণান্ত পর্যন্ত পরস্পর কাহারও প্রতি কেহ ব্যভিচার করিবেক না, সংক্ষেপেতে তাঁহাদের এই পরম ধর্ম জানিবে।’ পণপ্রথার বিরুদ্ধে নারীর পক্ষে পরম পুরুষ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই আদর্শ ঠাকুরবাড়ির সব পুরুষকে প্রভাবিত করেছিল। তা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন তাঁর মেয়েদের বিয়েতে পণ দিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তখন প্রশ্ন জাগে, কেন নারীর প্রতি পুরুষের সামাজিক এই অবমাননার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিজীবনে রুখে দাঁড়ালেন না? অথচ তাঁর ২২টি ছোটগল্পে তিনি পণপ্রথার বিরুদ্ধে লেখনী ধরেছিলেন।
একুশ শতকের চলতি দশকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এবং রাজধানীর কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক পুরুষ ব্যক্তিত্ব নারীর পক্ষে লিখছেন, বলছেন, যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করছেন। সন্দেহ নেই, সামগ্রিক বিচারে এসব কর্মকাণ্ড নারীর সামাজিক অবস্থানকে সংহত করছে। কিন্তু যখন দেখি ঘরে-বাইরে নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং সমাজে অপরাধের পরিধি বাড়িয়ে চলেছে, তখন ভাবনার জগতে আঘাত লাগে।
                 শত বছর আগে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ‘অর্ধাঙ্গ’ ও ‘ভ্রাতা-ভগ্নী’ লেখা দুটিতে পরিবারে একান্ত আপনজন হিসেবে পুরুষের যে স্বার্থপরতা, বৈষম্য ও নির্যাতনের কথা লিখেছেন, আজও বাংলাদেশ সেসব থেকে মুক্ত হয়েছে বলা যাবে না। পুরুষ বিদ্যমান পারিবারিক আইনকে নারীর বিরুদ্ধে যথেচ্ছ ব্যবহার করছে, আইনে প্রদত্ত সীমিত অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত রাখতেও সে দ্বিধা করছে না।
যখন বিপ্লবী প্রীতিলতা যুদ্ধক্ষেত্রে আত্মাহুতি দেওয়ার সময়েও প্রশ্ন রেখে যান ‘নারীর প্রতি বৈষম্য’ কেন পুরুষ নেতৃত্বে পরিচালিত বিপ্লবী দলের মধ্যেও বিরাজ করছে, তখন গভীর থেকে গভীরতর হয় এই প্রশ্ন যে ‘নারীর পক্ষে পুরুষ’-এর কার্যকর ভূমিকা কি একা পুরুষের পক্ষে পালন করা সম্ভব, নাকি সমাজ-পরিবার-রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠানের নারীর-পুরুষের তথা ‘মানুষের পক্ষে মানুষের’ সম্মিলিত প্রয়াস অধিক গুরুত্বপূর্ণ?
                আমাদের দেশে নারীদের মানসিক অবস্থান অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’র মতো—

"...পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি নই,
অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে সেও আমি নহি। যদি পার্শ্বে রাখো
মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর
কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখ-দুঃখে মোরে কর সহচরী
আমার পাইবে তবে পরিচয়। "
        পাশ্চাত্যের নারীবাদের কাণ্ডারী মেরি ওলস্টোনক্র্যাফট এবং প্রাচ্যের নারীবাদের মহীয়সী আদর্শ বেগম রোকেয়ার মতো বর্তমান সময়ের বাঙালি নারীকেও প্রজ্বলিত হতে হবে প্রগতির পথ ধরে হেঁটে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটিয়ে।

সাহিত্যিক সৌম্য ঘোষ 
চুঁচুড়া, হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ 






 





0 Comments