
বিকাশ বরের ছোটগল্প
রাঙামামী
তখন আমার স্কুলবেলা।সে প্রায় বছর তিরিশ আগের কথা।সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্ৰামে আমাদের বাড়ি।জল জমি,ছড়িয়েছিটিয়ে জনবসতি,কাঁচা রাস্তা আর চারপাশে নদীঘেরা ছোট্ট ভূখন্ড।তখন পড়াশুনোর ক্ষেত্রে যেভাবে ছেলেদের ওপর চাপ দেওয়া হত, মেয়েদের সেভাবে কেউ পড়ার কথা,স্কুল যাওয়ার কথা বলত না।ঘরসংসারের কাজ ভাল মতো শিখলেই হল।যত তাড়াতাড়ি পাত্রস্থ করা যায় ততই মঙ্গল।পাড়ার বেশিরভাগ মেয়েদের অক্ষরজ্ঞান ছিল না।ছেলেরা যা বলবে সেটাই হাইকোর্টের রায়।
আমাদের বাড়ির পাশে বিনোদমামার বাড়ি।নিজের মামা নয়,পাড়াতুতো মামা। ছোটবেলা থেকেই বিনোদমামাকে বিনুমামা বলে ডাকতাম।সেই বিনুমামার বৌ হল রাঙামামী।পাড়ায় রাঙামামী ছিল সবথেকে ফর্সা,সুন্দরী এবং শিক্ষিত।আমাকে কেন জানিনা খুব স্নেহ করত।বাড়িতে ভাল কিছু রান্না হলে লুকিয়ে মাকে দিয়ে যেত।বলত,"অলোক তো খুব খেতে ভালোবাসে এটা ওর জন্য।"আমার নাম অলোকেষ।রাঙামামী অলোক বলেই ডাকত।আমার তখন ক্লাস সেভেন।রাঙামামী প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসত।আমার বাংলাবইটা নিয়ে সুরেলা মধুর কন্ঠে গড় গড় করে কবিতা আবৃত্তি করে আমায় তাক লাগিয়ে দিত।বলত,স্কুলের লাইব্রেরী থেকে রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি এনে দিলে আমায় রবীন্দ্র সংগীত শোনাবে।আমি দু'একটা বই এনেও দিতাম।অবশ্য এসব চলত লুকিয়ে চুরিয়ে।বিনুমামা মেয়েদের পড়াশোনা পছন্দ করত না।খুব কড়া ধাঁচের লোক।বিনুমামার বাজারে মাছের আড়ত ছিল।নানান রকমের মাছ শহর কলকাতায় আড়ত থেকে চালান হত।বেশ পয়সাওয়ালা লোক বিনুমামা।প্রায় সারদিন আড়তেই কাটাত।গা থেকে ভুর ভুর করে আঁশটে গন্ধ ছড়াত।পাড়ার লোক বিনুআড়তদার বলত।বেশ রাত করেই আড়ত থেকে ফিরত।হাঁড়িয়া খেয়ে বিনুমামা তখন অন্য মানুষ।রাতদুপুরে রাঙামামীর ওপর চলত অকথ্য গালিগালাজ।কেন বিনুমামা এরকম ব্যবহার করত,কেন রাঙামামীকে এমন বিশ্রী গালিগালাজ করত আমি আজও বুঝতে পারিনি।রাতদুপুরের চিলচিৎকারে পাড়াসুদ্ধ সবার ঘুম ভেঙে যেত।রাঙামামী আমার আদর্শ ছিল।পাড়ার গরিব-দুখীদের লুকিয়ে চুরিয়ে সাহায্য করত।সবার বিপদে থাকত সবার আগে।পাড়ায় মেয়েদের পড়াশুনোর ব্যাপারে খুব উৎসাহ দিত।লেখাপড়া কেন জরুরি কেমন সুন্দর করে বুঝিয়ে বলত। সেসব আজও আমার মনের মণিকোঠায় উজ্জ্বল।সমাজে মেয়েদের জায়গাটা কোথায় সেটা ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল পাড়ার মেয়েরা।পাড়ার বয়স্করা রাঙামামীর এমন আচরণ পছন্দ করত না।বিনুমামা এসব একেবারেই বরদাস্ত করত না।রাতে বাড়ি ফিরে লোকের কথায় বিশ্বাস করে অত্যাচার চালাত রাঙামামীর উপর।মেয়েরা যে কী অসহায়,কতটা পুরুষনির্ভর তখন থেকেই আমি বুঝেছিলাম।
রাঙামামীর একটা দুর্বল জায়গা ছিল।সে হল তার একমাত্র ভাই।রাঙামামীর বাবার বাড়ির অবস্থা খুব খারাপ ছিল।দু'বেলা পেটপুরে খাওয়া জুটত না।অবশ্য সেসময় গ্ৰামবাংলায় খুব অভাব ছিল। অনেকের দু'বেলা পাত পড়ত না।গ্ৰামের অবস্থাপন্ন লোকেদের থেকে ধার নিয়ে সংসার চালাত।বিনিময়ে সরাবছর বেগার খাটুনি।
রাঙামামির ভাই প্রায় বিনুমামার বাড়িতে এসে থাকত।এটা বিনুমামার অসহ্য ছিল।সেই দিনগুলোতে রাঙামামীর ওপর খুব অত্যাচার চলত।
একদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এসে শুনলাম রাঙামামীকে ভূতে ধরেছে।বই-খাতা ফেলে ছুটলাম।রাঙামামী গোঁ গোঁ করছে আর ধনুকের মত বেঁকে যাচ্ছে।পাড়ার লোকজন ঝাঁপিয়ে জড় হয়েছে। বিনুমামা আজ আর হাঁড়িয়া খায়নি।খুব স্বাভাবিক অবস্থায় কথা বলছে।মন্ডল পাড়ার দীনু ওঝা ঝাড়ফুঁক করছে।চামড়ার চটি নাকে ধরে শুঁকোচ্ছে।গোটা হলুদ পুড়িয়ে নাকে ধরছে।পোড়া গরম হলুদে রাঙামামীর নাকটা পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে।সমানে চলছে ঝাঁটার মার।অসহ্য যন্ত্রণায় রাঙামামী কেঁপে কেঁপে চিৎকার করে উঠছে।সেসময় আমাদের গ্ৰামে অনেককে ভূতে পেত।দীনু ওঝা এসে সেই ভূত ছাড়াত।গরম সরষে গায়ে ছিটিয়ে চলেছে দীনু ওঝা।ফর্সা গায়ে কালো ছিট ছিট দাগ পড়ে যাচ্ছে।এমন দৃশ্য চোখে দেখা যায় না। সন্ধ্যা গড়িয়ে আসছে।আমি আর থাকতে পারলাম না।রাঙামামীর উপর এমন অত্যাচার আমি অন্তত সহ্য করতে পারব না।বাড়িতে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখের জল ফেলছি।
দিনসাতেক পর রাঙামামী আমাদের বাড়িতে এল।অনেকটা স্বাভাবিক।আমার কাছে এসে বই ঘাঁটছে।আমি আর থাকতে পারলাম না।মনের মধ্যে যে কৌতূহল বাসা বেঁধেছিল তার নিরসন করতে চাইলাম।অস্ফুটে রাঙামামীর কাছে গিয়ে বলাম, "রাঙামামী,সত্যি সত্যি তোমায় ভূতে ধরেছিল! "রাঙামামী আমার মাথায় হাত রেখে বলল,"না রে আমি ওসব ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করি না।"
বললাম,"তাহলে যে সেদিন তোমায় ওই ভাবে ভূতে পেয়েছিল।"
রাঙামামী একটু যেন হাসল।তার দু'চোখ জলে চিক্ চিক্ করছিল।কথা বলতে গিয়ে গলা জড়িয়ে যাচ্ছিল।চুপিচুপি আমায় বলল,"আগে বল, কাউকে এ কথা বলবি না।"আমি মাথা দু'দিকে নেড়ে কথা দিলাম।
"তাহলে শোন,ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে ভূতে ধরার অভিনয়টা করতে হয়েছিল।না হলে ভাই আর আমি তোর বিনুমামার হাত থেকে সেদিন বাঁচতাম না।"আমি হাঁ পেতে রাঙামামীর কথা গিলছি।
"ভাই সেদিন পাঁচশো টাকা চুরি করেছিল।টাকাটা তোর বিনুমামা আমার কাছে রাখতে দিয়েছিল।ভাই সে টাকা নিয়ে বাড়িতে দিয়ে এসেছে।ভাইকে বাঁচাতে নাটকটা করতেই হল।"আমার আর মুখ থেকে কথা সরেনি।পরম শ্রদ্ধায় রাঙামামীকে জড়িয়ে ধরলাম।
0 Comments