
পাভেল ঘোষের ছোটগল্প
ভুবনস্যার
আজ ভুবনস্যারের স্বপ্ন ভঙ্গের দিন...!আকাশের দিকে ছল ছল চোখে তাকিয়ে সে'কথাই ভাবছেন উনি...! মেঘগুলোকে আজ বড় অভিমানী দেখাচ্ছে..! যেন অন্য পাড়ায় ওদের বাসা। দল বেঁধে ছুটছে একের পর এক। মাঝে মাঝে রোদ্দুর লুকোচুরি খেলে উস্কে দিচ্ছে ভুবনস্যারের স্মৃতিমেদুর সোনালী দিনগুলোকে....!
শুরুতে যে স্কুল থেকে শিক্ষকতার পাঠ নিয়েছিলেন,আজ বছর দেড়েক সেই স্কুলেই চলে এসেছেন জেনারেল ট্রান্সফার নিয়ে।
মাঝে সুদীর্ঘ উনিশ বছর কেটেছে সুদূর বাঁকুড়ার পলাশপুর চন্ডীবালা বিদ্যাপীঠে।ওখানকার রুক্ষ মাটি,জল বাতাসকে জীবনের ছন্দ করে নিয়েছিলেন উনি। স্কুলে ছাত্র ছাত্রীদের জগৎ জুড়ে ছিলেন 'ভুবনস্যার'। কিন্তু শেষ বয়সে মাতৃভূমিকে উপেক্ষা করতে পারেননি উনি।চলে এসেছেন হৃদয়পুরে।
পলাশপুরে শেষ দিনটা আজও চোখের সামনে ভাসে ওনার।ছাত্র ছাত্রী অভিভাবকরা ভালোবেসে জড়ো হয়েছিল বিদ্যালয় জুড়ে।তারা কিছুতেই যেতে দেবে না তাদের প্রিয় স্যারকে।শেষ মুহূর্তে একটা কথাতেই উনি ছাড় পেয়েছিলেন,"পলাশপুর আমার বাবা,হৃদয়পুর আমার মা।মায়ের জন্য বড় মন খারাপ করছে যে..! মাঝে মাঝেই আসবো..! চিন্তা নেই আপনাদের.."
শেষের বাক্যকে সম্মান দিয়ে ওনারা রাজী হয়েছিলেন।
এখনো ছুটি পেলেই ছুটে যান পলাশপুরে। ওখানে সবার সাথে দেখা করে তবেই ওনার 'ছুটি' । উনিশ বছরে পলাশপুরের ধুলোয় যতন করে গাছ লাগিয়েছেন কয়েক হাজার। সবার হৃদয়ে একটা মন্ত্রই গেঁথে দিয়েছিলেন,"একটা গাছ,একটা সন্তান,প্রাণ দিয়ে তাকে রক্ষা করুন...।"বিদায় সংবর্ধনায় স্কুলের সভাপতির কথাটা আজও কানে বাজে ওনার,"ভুবনস্যার এই এলাকাকে 'বৃক্ষপুর' বানিয়েছেন....,ওনার কাছে পলাশপুরের মানুষ চিরকৃতজ্ঞ...!"
চোখে জল আসে ভুবনস্যারের।
ধূলোকনার মত উড়ে গেছে তেইশটা বছর।
আর আজ কাকতালীয়ভাবে আগস্টের তেইশ তারিখ। হৃদয়পুরে উত্তমবাবুর জায়গায় ডেপুটেশন ভ্যাকেনসিতে শিক্ষকতা জীবনের হাতে খড়ি হয়েছিল এই দিনে। সেই দিনের স্মৃতি আজও শারদ প্রাতের শিউলির মতোই টাটকা।
দ্বিতীয়বার স্থায়ী শিক্ষক পদে এসেই হৃদয়পুরের ছাত্রছাত্রীদের 'নয়নের মনি' হয়ে উঠেছেন অচিরেই। তবে কালের নিয়মে 'বেত' ছেড়েছেন বটে,কিন্তু বদ অভ্যাসটা আজও ছাড়তে পারেন নি উনি। ছাত্রদের ভালোবেসে কান মুলে 'হারামজাদা' বলে সম্মোধনটা।
আর এই বদ অভ্যাসটার জন্যই আজ ম্যানেজিং কমিটির সভায় তার ডাক পড়েছে।
"স্যার,হেডস্যার আপনাকে ডাকছেন..." অশিক্ষক কর্মী রতনের কথায় সংবিত ফেরে ভুবনস্যারের।
গতকাল ক্লাস সেভেনের অরিত্র অংকে একটা অনভিপ্রেত ভুল করতেই ওর কানটা মুলে বলেছিলেন ভুবনস্যার, "হারামজাদা....! তোর মত ছেলে এই সামান্য ভুলটা করলো কি করে..?" প্রত্যাশাটা অরিত্রর উপর বেশী বলে একটু জোরেই মুলে ফেলেছিলেন ওর কান। ব্যাস, এতেই হয়ে গেছে বিপত্তি..!
আজ সকালে স্কুলে আসতেই হেডস্যার
বললেন,"ভুবনবাবু,অরিত্রর বাবা আমায় ফোন করেছিলেন..। আপনার বিরুদ্ধে কমপ্লেন লজ করতে টিফিনের সময় উনি আসবেন। আসলে আপনাকে ডেকে নেব আমি। কমিটি মেম্বাররাও থাকবেন.…."
গতকাল রাত্রে প্রাক্তন ছাত্র রাজীবের সঙ্গে ফোনে বাক্যালাপটা মনে পড়ে যায় ভুবনস্যারের। ফোনটা রাখার আগে রাজীব বলে উঠেছিল,
"ও স্যার,একবার হারামজাদা বলুন..বড় মিষ্টি লাগে যে শুনতে আপনার কণ্ঠে..!"
"হারামজাদা...! রাখ ফোনটা.." হেসে ফোনটা কেটে দিয়েছিলেন রাজীবের মাস্টারমশাই। আর আজ 'হারামজাদা' বলার অপরাধে..! মনটা বড় বিমর্ষ লাগছে ওনার।
ভাবতে থাকেন,এই বদ অভ্যাসটা তাকে কাটাতেই হবে...,যেভাবেই হোক,যেমন করেই হোক..!
"না,না,আপনারাই বলুন...,আমার ছেলেকে 'হারামজাদা' বলার রাইট ওনাকে কে দিল? কাল সারাদিন ও কত কষ্ট পেয়েছে জানেন আপনারা..? আমি চাই 'আইদার' উনি প্রকাশ্যে ক্ষমা চান 'অর' কথা দিন যেন আর...."
প্রধান শিক্ষকের কক্ষে প্রবেশের আগের মুহূর্তে কথাগুলো কানে যায় ভুবনবাবুর। গলার আওয়াজ শুনেই বোঝেন,অরিত্রর বাবা। প্রবেশের দরজায় থাকা পর্দার আড়ালে ওনার পশ্চাৎ ভাগ নজরে আসে ভুবনস্যারের। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপছেন উনি।
প্রধান শিক্ষক সুময়বাবু ওনাকে সামলাচ্ছেন শুধু একটা কথাই বলে,"বিষয়টা দেখছি আমরা...! ভুবনবাবুকে ডেকেছি,উনি আসলেই.…."
কক্ষে ঢোকার আগে একটু নার্ভাস অনুভব করেন ভুবনবাবু। শিক্ষাঙ্গনে এই প্রথমবার, লজ্জা ও অপমানের ভয়ে...!
হঠাৎ ওনাকে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুময়বাবু বলে ওঠেন,"ভুবনবাবু আসুন। কি সব গালমন্দ করেছেন ছাত্রকে..?নিন,এবার আপনি সামলান।আর পারি না বাপু।অনেক তো বয়স হলো,এবার নিজেকে শোধরান....!"
ওনার কড়া কথার কোনো প্রতিবাদ না করে ভুবনস্যার একপ্রকার জোর করেই কক্ষে প্রবেশ করেন নত মস্তকে। কি করে বোঝাবেন উনি,কাউকে একটু বেশী ভালোবাসলে বকার সময় 'হারামজাদা' শব্দটা তার হৃদয় থেকে আসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ? দুটো কান ভীষণরকম গরম হয়ে যাচ্ছে তার। সভায় সকলের মুখ অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।বুঝতে পারছেন,মোমের মত গলছেন অপমানে বিদ্ধ হয়ে।
বেদনায় ভরা অশ্রুকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না পেরে চোখ বন্ধ করে ফেলেন ভুবনস্যার। কান্না 'অশ্রু স্রোত' হয়ে গাল বেয়ে নীচে নামতে শুরু করে ওনার।
"ভুবনবাবু,অরিত্র কিছু বলতে চাইছে আপনাকে..."
সুময়বাবুর কন্ঠ কানে যেতেই চোখ খোলেন ভুবনস্যার।দেখেন,ওনার সামনে অরিত্র দাঁড়িয়ে কিছু বলতে চাইছে।
"অরিত্র..আমার ভুল হয়েছে রে..আর কোনোদিন তোকে হারামজাদা.."
ভুবনস্যার পুত্রসম ছাত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বলতেই প্রিয় স্যারকে জড়িয়ে ধরে অরিত্র।
"স্যার,আমি বাবাকে কিছু বলিনি বিশ্বাস করুন...! বাবা রাতুলের বাবার কাছে কাল রাতে জেনেছে..., আমি বলিনি....!"
"তাহলে কাল থেকে তুই ঠিকমতো খাস নি কেন হারামজাদা...?"
কান্না ভেজা গলায় উনি অরিত্রকে প্রশ্ন করেই জিভ বের করেন লজ্জায়..! বুঝতে পারেন ভুবনস্যার, আবার অভ্যাসবশত বলে ফেলেছেন বিতর্কিত শব্দটা..।
"বাবা আজ স্কুলে আপনাকে বকবে শুনে কাল থেকে মন খারাপ করছিল।তাই কিছু খাইনি...! বিশ্বাস করুন স্যার..!"
প্রিয় স্যারের শরীরে মুখ গুঁজে বলে ওঠে অরিত্র।
ঝাপসা চোখের আবছা আলো ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে ওঠে ভুবনস্যারের। কক্ষে সবার 'নতমুখ' নজর এড়ায় না ওনার। বাইরে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন,ক্লাস সেভেনের ছাত্ররা দল বেঁধে প্রধান শিক্ষকের কক্ষের বাইরে।হারামজাদাদের মুখগুলো শানিত তরবারির মতোই ঝকঝকে দেখাচ্ছে আজ..!
মেঘেদের দল অভিমান ছেড়ে আপন ভুবনে আসছে,বেশ বুঝতে পারেন উনি..।
মনে পড়ে যায় কাল রাত্রে রাজীবের কথাটা,
"ও স্যার, একবার 'হারামজাদা' বলুন....!"
2 Comments
স্যার প্রনাম নেবেন। সত্যিই মন ছুঁয়ে গেল, আর মনে পরে গেল আপনার কাছে টিউশন এর দিন গুলো । শুভ শিক্ষক দিবস ❤️❤️❤️
উত্তরমুছুনচমৎকার লিখেছেন। বিশেষ দিনের জন্য অভিনন্দন জানাই।🙏
উত্তরমুছুন