অদিতি ঘোষদস্তিদারের ছোটগল্প

সংগীতসুধা 

স্নান সেরে ঘরে ঢুকল বুলু। মা এখনো পাশবালিশ আঁকড়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। জানলা দিয়ে রোদ এসে ভেসে যাচ্ছে বিছানা। মায়ায় বুকটা ভরে গেলো কেমন যেন! পর্দাটা  টেনে দিয়ে আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো ।                                                 স্বপ্ন দেখছিলেন সুপ্রভা। ফুলের বাগান, নীল আকাশ, তিনি এক্কাদোক্কা খেলছেন! হঠাৎ ঢং ঢং করে কোথায় যেন বেল বেজে উঠলো!
চমকে জেগে সুপ্রভা জোরে চেঁচিয়ে উঠলেন "কটা বেজে গেলো?"
তারপর ধড়মড় করে একেবারে উঠে বসে চারপাশটায় তাকালেন। খানিকক্ষণ বুঝতে সময় লাগলো।
" চেঁচিয়ে  উঠলে কেন মা? কি হয়েছে?"
মায়ের গলা পাশে রান্নাঘর অবধি গেছে। বুলু চা করা ফেলে প্রায় ছুটে এলো।  
" ভাবলাম বুঝি অ্যালার্ম বাজছে! চমকে উঠেছি। আসলে স্বপ্ন দেখছিলাম রে!"
" আহারে! তোমার অ্যালার্ম ফোবিয়া হয়েছে মা, এতো বছর না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে!"
ম্লান হাসলেন সুপ্রভা। চোখের কোণে কালি, গাল ঢুকে যাওয়া মাকে দেখে বুলুর আবার কষ্ট হলো।
কতদিন মানুষটা ভালো করে ঘুমোতে পারে নি।
বাবা চিরকালই রাগি, দাপুটে। বিছানায় পড়ে  গিয়ে আরো বাড়লো অত্যাচার। সারা রাত বিছানার পাশে চেয়ারে বসে থাকতে হত  সুপ্রভাকে। ঘন্টায় ঘন্টায় এটা ওটা হুকুম। না পেলে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল।
বুলু তখন কলেজে। বাবার টাকাপয়সা প্রায় সবটাই ওষুধ আর খাওয়াদাওয়ায় চলে যেত। মেয়েটার যাতে পড়ার ক্ষতি না হয় তার জন্যে সব কষ্ট নিজের ওপর নিয়েছিলেন সুপ্রভা।
কথা প্রায় বলতেনই না,সারাদিন চুপ করে শুধু অক্লান্ত পরিশ্রম।
একটাই লক্ষ্য বুলুকে মানুষ করা।
ভাল ছাত্রী ছিল বুলু বরাবরই। স্কলারশিপ জুটেছিল বিদেশ যাবার। রাজি ছিল না বুলু একেবারেই।মা'ই জোর করলো।
বছর পাঁচেক বুলু পিএইচডি শেষ করে কলেজে চাকরি করছে আমেরিকায়। সংসারের সব ভারই তুলে নিয়েছে।
বাবা চলে যাওয়ার খবর পেয়ে গেলো দেশে।
সুপ্রভা তো কবে থেকেই চুপ। স্বামী চলে যাবার পর এলো সারা শরীর জুড়ে অবসাদ।কাজ যতদিন ছিল টেনে যাচ্ছিলেন। কাজ নেই। এলো জীবন জুড়ে শুধু বিষণ্নতা। কিছুই ভালো লাগে না। বাইরে নিজেকে বের করতেও তীব্র অনীহা। সারাদিন ঘরে বসে থাকেন একা একা।
বুলু চেষ্টার ত্রুটি রাখলো না। সব ডাক্তারই  জানালেন এসবই  ডিপ ডিপ্রেশনের ফল। ঘুমই একমাত্র ওষুধ।
ওষুধ খেয়েও ঘুম আসেন না চোখে সুপ্রভার। সারারাত জেগে জেগে কেটে যায়।  আর মাঝে মঝেই চমকে চমকে ওঠান। কিসের যেন দেরি হয়ে গেলো!
অনেক কষ্টে মাকে রাজি করিয়ে বুলু মায়ের ভিসা করাল।
আজ সপ্তাদুয়েক হলো সুপ্রভাকে নিয়ে বুলু ফিরেছে কাজের জায়গায়!
নতুন জায়গায় এসে সুপ্রভার খুব যে একটা পরিবর্তন হলো না নয়। তও বুলু নিশ্চিন্ত মা কাছে আছে।
কাল বুলুর দুই কলিগ প্রফেসর এসেছিলেন বাড়িতে। বাঙালি।
সুপ্রভা  আসতে চাননি কাছে। বুলু জোর করেনি।
বীরেন বলে যে ভদ্রলোক এসেছিলেন তিনি ভারী ভালো গান করেন। তিনি যখন গাইছিলেন, ''নিদ্ নাহি আঁখিপাতে", হঠাৎ কে যেন গলা মিলিয়ে গেয়ে উঠলো,
"আমিও একেলা, তুমিও একেলা!"
বীরেন আর বাকিরা চমকে উঠলেন, কিন্তু গান থামালেন না।
গান শেষহতে সবাই দৌড়ে পাশের ঘরে গিয়ে দেখলেন সুপ্রভা বিছানায় বসে আছেন আর দরদর করে চোখ দিয়ে পড়ছে জলের ধারা!
বুলুর মনে পড়লো দিদা বলেছিলো মায়ের  পছন্দের মধ্যে শুধু ছিল গান। অতুলপ্রসাদের গান গাইতেন রেডিওতে।
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির দাপটে আর হয়ে ওঠেনি।
একটার পর একটা গান গেয়েগেছিলেন সুপ্রভা কাল।  বুলু অবাক হয়ে দেখেছিলো মায়ের মুখের প্রশান্তি।
ঘুম  এসেছিলো কাল অনেকদিনের পর। একেবারে রাত জুড়ে।  আজ ভোরে ভাঙলো সেই ঘুম।
বুলু গেয়ে উঠলো," মাগো, ঘুম এলো আঁখিপাতে!"

সাহিত্যিক অদিতি ঘোষদস্তিদার 
১৮৯ জনসন রোড, নিউ জার্সি, আমেরিকা




















0 Comments