
ওয়াকিং স্টিক
বাইশ বছর পর এই শহরে এসে মনে হচ্ছে, দোয়েলের সেই ঘাড় কাত করা বিকেল নেই। জোনাকির আধো আলো আধো ছায়ার নীল নির্জনে ভালবাসার কথা নেই। সাদা কাগজে ভাঁজ করা মনের অস্থিরতা নেই। সব হারিয়ে গেছে। কোন্ মাতাল হাওয়ায় ঝরাপাতার মত উড়ে গেছে। এত বদল হয়েছে এই শহরে? পথঘাট, জীবনযাপনের ছবি থেকে ভালবাসার সাজ।
শীতপাখির মত সাঁতরাগাছির ঝিলে ফিরে আসার কোন ইচ্ছেই ছিল না। শুধু ঝিমলির ঋণের টানে,বাইশ বছর পর ফেরা। ঝিমলির জীবনে এতটুকু ছায়া না ফেলেই রায়গঞ্জে পা বাড়াব। যদিও অবিনাশ আর তার ছেলে রূপক কিছুতেই ফিরে যেতে দেবে না। কিন্তু ফিরতেই হবে।
হ্যাঁ, অবিনাশ এই ঠিকানাটাই বলেছিল। ৩২/১,ফার্ন রোড।
যাচ্ছি যাচ্ছি...হুড়মুড়িয়ে দোতলা থেকে নেমে আসে ঝিনুক।বাড়িতে একা। আই হোলে চোখ রাখে। লম্বা চওড়া এক মধ্যবয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে। আগে কোনদিন মানুষটাকে দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না।
--- কাকে চাই? আগন্তুকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ঝিনুক।
--- ঝিমলির সঙ্গে দেখা করতে চাই। দরজার ওপাশ থেকে উত্তর ভেসে আসে।
--- না, ঝিমলি নামে এ বাড়িতে কেউ থাকে না।
--- একটা জিনিষ দেবার ছিল।
--- আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। হয়তো ভুল ঠিকানায় এসেছেন। ঝিনুকের বিনীত জবাব।
--- ঠিক আছে। মনে হয় আমারই ভুল হয়েছে।
আগন্তুক ফিরে যেতেই, দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ডান হাতে ওয়াকিং স্টিকের সাহায্যে মানুষটাকে ফুটপাত ধরে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সে।
খুব খারাপ সময়। চারপাশে খারাপ মানুষের অভাব নেই। চেনাজানা না হলে দরজা খুলবি না। আগে আইহোলে দেখে নিবি। মায়ের এই একঘেয়েমি কথায় ঝিনুক মাঝে মাঝে রেগে যায় বটে, কিন্তু আজ সে মায়ের সতর্ক বাণী পালন করে ঠিকই করেছে।
স্কুল থেকে ফিরে মেয়ের মুখে ঝিমলি নামটা শুনে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যায় মালবিকা। এই নামটা তো সে কোনদিন কারো কাছে প্রকাশ করেনি। দীর্ঘ বাইশ বছর বুকের ভেতর এই নাম লুকিয়ে রেখেছে। তাহলে কি সময়ের ঝরাপাতা সরিয়ে সেই ভন্ড প্রতারক তমাল ফিরে এলো এই শহরে? এই ঠিকানা সে পেল কোথায়?
--- মা, ঝিমলি নামে তুমি কাউকে চেনো? মেয়ের প্রশ্নে তার চমক ভাঙে।
--- নারে, আমার তিন কুলে ওই নামে কেউ আছে বলে মনেই করতে পারছি না। একটু হেসে অস্বস্তি আড়ালের চেষ্টা করে।
--- যা একটু চা কর দেখি! মেয়েকে খুব কমই আদেশ করে মালবিকা এখন ঝিমলিকে এড়াতেই এই ফরমান।
--- আমার বন্ধুবান্ধবের ভেতরেও তো ঝিমলি বলে কেউ নেই।
--- আহ্ থাক না,ওই নাম ঘেঁটে লাভ কী? চায়ে চিনি দিয়ে ফেলিস না যেন?
--- ঝিমলিকে কী একটা জিনিষ দিতে এসেছিলেন। চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিলে রেখে ঝিনুক বললো।
--- এসব ভন্ডামি বুঝলি! দুষ্টের ছলের অভাব হয় না। এখন বুঝলি তো,কেন দরজা খুলতে বারণ করি।
কী সব ভাবছে মালবিকা? হয়ত সত্যিই অন্য কোন এক মানুষ তার আদরের ঝিমলিকে উপহার দিতে ভুল ঠিকানায় চলে এসেছে। তমাল তো কবেই হারিয়ে গেছে। তবু আজ কেন শুধু সেই-ই এসে দাঁড়াচ্ছে?বাইশ বছর আগে কোন এক ফিরে যাওয়া নিস্তেজ সূর্যের ঝিম ধরা বিকেলে রায়গঞ্জ থেকে বাবার অসুস্থতার খবর আসতেই সেদিন ছুটে গিয়েছিল তমাল। তারপর চার মাস কোন খবর নেই। মায়ের চোখকে কোনমতেই এড়ানো যায় না। মা বাবার আদরের মলিও পারেনি। এমনিতেই অসবর্ণে আপত্তি ছিল। এই চরম প্রতারণার সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে একমাত্র মেয়ের সম্বন্ধ করে ফেলেছিলেন, মানবেন্দ্র সেন। মালবিকার বাবা। নামী কোম্পানির সিইও অরিন্দম রায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর একমাত্র আদরের মেয়েকে। আজ আবার নতুন করে সবকিছু মনে পড়ছে। এত বছর পর বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখা নামটা যে এইভাবে তারই আত্মজার মুখে শুনতে হবে,স্বপ্নেও ভাবেনি সে।
--- কিরে, এত দেরি হল? মালবিকার গলায় উৎকণ্ঠার সুর।
---- আর বোলো না মা,আজ রূপক হঠাৎ জোর করেই ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল। ওর বাবার এক বন্ধুর সাথে আলাপ করাতে। ওনাকে দেখে আমি তো অবাক! উনিই ত পরশু সকালে ঝিমলির খোঁজে এখানে এসেছিলেন। উনি বাইশ বছর পর কলকাতায় এলেন। রূপক বলছিল,বাইশ বছর আগে নাকি রায়গঞ্জে ওনার অসুস্থ বাবাকে দেখতে গিয়ে বিরাট দুর্ঘটনায় পড়েন। তাতেই ওনার ডান পা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তিন মাস হাসপাতালে ছিলেন। মেয়ের কথাগুলো ভেতর থেকে মালবিকাকে ভাঙতে শুরু করল। দমকা বাতাসে মনের জানালাগুলো খুলে যাবার আগেই বন্ধ করে দিতে হবে।
---- মানুষটা ভীষণ প্রাণবন্ত, জানো তো মা! কত গল্প করলেন। আমাকে ত ছাড়তেই চাইছিলেন না। ওনাকে দেখে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
---- কেন মন খারাপের কী হল?
--- এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পথে বাইকের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে ওয়াকিং স্টিকটা ভেঙে গেছে। এখন ভাবলে এত খারাপ লাগছে। ঝিনুক অনুতাপের সুরে বলল।
--- তা হ্যারে, তোর আঙ্কেলের নামটা তো বললি না।
---- তমাল...পদবিটা যেন কী,মনে পড়ছে না।
--- ঠিক আছে, এবার তুই যা ফ্রেশ হয়ে নে। আমি চা বসাচ্ছি।
--- ওহ্ মা,তোমায় বলতে ভুলেই গেছি, সামনের শুক্রবার ওনার জন্মদিন। উনি বারবার যেতে বলেছেন।
--- হ্যা যাবি। পারলে একটা ওয়াকিং স্টিক কিনে নিয়ে যাস। বার্থডে গিফট।
--- তুমি তো দারুন সাজেশন দিলে মা! এতে আমারও মনটা কিছুটা হালকা হবে। আমি এক্ষুনি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি চা বসাও। ঝিনুক চটপট বাথরুমে ঢুকে পড়ে।
আজ বাইশ বছর পর তমাল নামটা যেন হাওয়ায় উড়তে উড়তে মালবিকা ওরফে ঝিমলির পায়ের কাছে এসে পড়ল। কুঁড়িয়েও নিল সে। বুঝল, সেদিন তমাল তার ঝিমলিকে কোন কিছু ফিরিয়ে দিতেই এসেছিল। তমালের কিইবা আছে,তাকে ফিরিয়ে দেবার মত। তাহলে কি সেই পাঁচ হাজার টাকা? বাবার অসুস্থতার প্রয়োজনে যা সে চেয়ে নিয়েছিল।
আর ভাবতে পারে না। হঠাৎ যেন মনের ভেতর অনেক দিনের জমে থাকা কষ্ট মুক্তোদানার মত ঝিমলির গাল বেয়ে নামতে থাকে। পাড় ভাঙা নদীর মত কাঁদতে ইচ্ছে করে । কিন্তু ঝিমলিকে আজ কান্না লুকোতেই হবে। তা নাহলে একটু পরেই মেয়েটা এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলবে,মা তুমি কাঁদছ কেন?
1 Comments
ওয়াকিং স্টিক দারুণ লাগলো।
উত্তরমুছুন