
বীজ
সুবল মন্ডল আকাশের দিকে তাকায়।ভরা আষাঢ় মাস।ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ।ছিটেফোঁটা মেঘর চিহ্নটুকু নেই !আকাশ যেন জ্বলছে। বেশিক্ষণ আকাশের দিকে তাকালে চোখে আঁধার নেমে আসে।"এ কেমন আষাঢ় মাসরে বাপ !মেঘের দেখা নিই,বিষ্টির নাম নিই,আষাঢ়ের দু'হপ্তা তো গইড়ে গেল!''
সুবল মনে মনে বিড়বিড় করে।
সুবল মন্ডলের বিঘে তিনেক চাষের জমি আছে। বৎসরকার খোরাক ওই জমি থেকেই আসে। তিনজনের সংসারে কোনোরকমে পেটের ভাতটা জোটে।চাষের মরসুমটা বাদ দিয়ে অন্য সময় মহাজনদের বাড়িতে জনমজুর খাটে সুবল।কোনোরকমে ছেলের পড়া আর সংসার খরচ চলে যায়। সুবল আবার আকাশ দেখে।আকাশের ভাবলক্ষণ সে ভাল বোঝে।কোন মেঘে বৃষ্টি হয়,কোন মেঘে বাজ পড়ে সে ভালমত বোঝে।আকাশের কোন কোণে মেঘ জমলে ঝড় ওঠে সুবল একবার দেখে নিখুঁত বলে দিতে পারে।আকাশ, জল, মাটি তার নাড়ীতে।
সুন্দরবনের নোনামাটিতে একবার ফসল হয়।ধেনোজমি সব একফসলী জমি।বর্ষার এদিক ওদিক হলে ফসল মার খায়।আষাঢ়ে বৃষ্টি না হলে চাষ পিছিয়ে যাবে।বীজতলা তৈরি না হলে চাষ হবে কীকরে !সুবল আবার বিড়বিড় করে,"এবার কী খরা ডাকবে নাকি !"সুবল চাষের ব্যাপারে একটা কথা মানে।"আষাঢ়ের ভর ভর, শ্রাবণের বারো, এর মধ্যে যত পার।"খনার বচন আওড়ায় সে।পুকুরের জল সেচে বীজতলা বানিয়েছে সুবল।ধানচারা লক লক করে বেড়ে উঠছে।বৃষ্টি না হলে সব শেষ।দেরি করে বৃষ্টি হলে,ফসল মার খাবে।নাবি চাষে ফসল মার খায়।
সুবল আজ আকাশের ভাবগতি কিছুই বুঝতে পারছে না।শুকনো জমিতে নাঙ্গল দেবে কীকরে !
সুবল মন্ডল তার জমিতে ধপ্ করে বসে পড়ল।শুকনো রুক্ষ জমিতে সোহাগ করে হাত বোলাতে থাকে সে।জমি গর্ভবতী হলে তো বছরভর খাওয়াদাওয়া।
"কী মোড়োল, মাটিতে গুপ্তধন খুঁজতিছো নাকি?"
ফুলি পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলল।বৃষ্টি না হওয়ার জন্য এখনো চাষের কাজ শুরু হয়নি।গরু-বাছুর বাঁধা পড়েনি।মাঠময় সব চরে বেড়াচ্ছে।ফুলি গোবর কুড়োতে এসেছে।গোবর কুড়িয়ে ঘুঁটে বানায় সে।সারাবছরের জ্বালানি নিয়ে তার চিন্তা নেই। ফুলি গোবরের ঝুড়ি কাঁখে নিয়ে হেলেদুলে চলেছে।
পানপাতার মত পিতিমার মুখ ফুলির।ফর্সা রং রোদ জলে পড়ে তামাটে বর্ণ হয়ে গেছে।ঝরঝরে মেদহীন শরীর।গতরটা ধরে রেখেছে ফুলি।সুবল অবাক বিস্ময়ে ফুলিকে দেখছে।এই মেয়েটা তো তার বউ হওয়ার কথা ছিল।জন্ম, মৃত্যু বিয়ে--তিন বিধাতা নিয়ে।কপালে না থাকলে হবেটা কি করে !
পাড়ারই মেয়ে ফুলি।ছোটবেলা থেকেই ডানপিটে।দেখতে ভাল বলে গুমোরও ছিল।সুবলকে দেখেও দেখত না।সুবলের জেদ বেড়ে গিয়েছিল।ফুলিকে একা পেলে সে তার ভালবাসার কথা বলবে।বছর পনেরোর ফুলি তখন বাগানের সেরা ফুল।তার চারপাশে ভ্রমরার মধুঢালা সুর।সদ্যযৌবনে পা দেওয়া ফুলি ভ্রমরের গুঞ্জনে পুলকিত।পাড়া-বেপাড়া দাপিয়ে বেড়ানো ফুলি কাউকে পাত্তা দিত না।বাইশ বছরের যুবক সুবল ফুলিকে ধরতে চাইত।পাঁকাল মাছের মত পিছলে যেত ফুলি।সুবল অবাক হয়ে ভাবত,ফুলির শরীরে কী একটুও প্রেম নেই ! মনে স্বপ্ন নেই ! বুকে ঢিপঢিপানি নেই !
লক্ষ্মপুজোর রাতে পাড়ার ছেলেমেয়েরা গ্ৰামের স্কুলমাঠটায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মাঠের একপাশে মঞ্চ বাঁধার কাজ চলছে।পাড়ার ছেলেরা নাটক মঞ্চস্থ করবে।কোজাগরী পূর্ণিমা।পাড়ার সবাই নাটক দেখে রাতভর জাগবে।সুবলেরও নাটকে পাট আছে। সে মঞ্চ বাঁধার কাজে হাত লাগিয়েছে। ভরাচাঁদের আলোয় দিনের মত পরিষ্কার সব।মায়াবী আলোতে সবকিছুই স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে।আজ বড় আনন্দের দিন।ধনী গরিব সবার ঘরে পুজো।লক্ষ্মীমায়ের কৃপায় তো বছরভর সবার অন্নকষ্ট হয় না।আজ সারারাত সবাই জাগবে।
ফুলিরা মাঠে কানামাছি খেলছে।কানামাছি ভোঁ ভোঁ যাকে পাবি তাকে ছোঁ---সুবল দেখল, ফুলির চোখে গামছা বাঁধা।সে দু'হাত সামনে বাড়িয়ে সাথীদের ছুঁতে চাইছে।সুবলের মাথায় একটা বদবুদ্ধি খেলে গেল।এই সুযোগ।ফুলিকে কাছে পাওয়ার !সে চুপি চুপি বিড়ালের পায়ে ফুলিকে জড়িয়ে ধরল।ফুলি ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেল।
ঝট করে সে চোখের গামছা টেনে খুলে ফেলল।সুবল তাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে !ফুলি অনুচ্চ একটা শব্দ তুলে বলল, "ছাড়ো সুবলদা,কর কি লাগছে যে!"
সুবল ফুলিকে জড়িয়ে ধরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,"আমি তোকে ভালবাসি ফুলি।"তারপর ফুলিকে ছেড়ে এক দৌড়---
সেসব দিন, সেই লক্ষ্মীপুজোর রাত্রির কথা মনে হতেই সুবল আপন মনে হেসে উঠল।কম বয়সে কী আর জ্ঞান গম্মি থাকে।তখন রক্তের উজান স্রোত।তখন রক্তে নেশা ধরানো মাদকতা।তেতে যাওয়া কড়াইয়ের মত রক্ত গরম!
"হাসতিছো যে বড় !"ফুলি গোবরের ঝুড়ি নামিয়ে রেখে সুবলের পাশে এসে বসেছে।
"এমনি !"
"এমনি এমনি কেউ আবার হাসে নাকি !"
ফুলি সুবলের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।লম্বা সুঠাম শরীরের সুবলদা এখন একটু কুঁজো হয়ে গেছে।চুলে পাক ধরেছে।গায়ের চামড়া ঢিলেঢালা।এই মানুষটা তাকে একদিন জড়িয়ে ধরেছিল। অজগরের মত।শরীরের সব উষ্ণতা ঢেলে।সেই সোহাগি উষ্ণতা ফুলি এখনোও অনুভব করে।
হঠাৎ খিল খিল করে হেসে উঠল ফুলি। ঝুড়িটা তুলে নিয়ে হেলেদুলে চলে যায় সে।সুবল এক দৃষ্টে ফুলির চলে যাওয়া দেখছে।"মেয়েডার কপাল খারাপ।নইলে গোপালের সাথে বিয়ে হয় !"সুবল একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আপন মনে বলে ওঠে।
সম্পন্ন অবস্থা দেখে ফুলির বাবা মা পাড়ার গোপাল পাত্রের সঙ্গে ফুলির বিয়ে দিয়েছিল।গোপালের বাবা গোবিন্দ পাত্রের অকাল বিয়োগের পর গোপাল লাটসাহেবি চাল মেরে,নেশা ভাং করে বছর তিনেকের মধ্যে জমিজায়গা বেচে দিয়ে একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে।গোপালের ছেলেপুলে নেই।ফুলির কোল আলো করে কেউ আসেনি।পাড়ার লোক ফুলিকে "বাঁজা" বলে।
সুবলের মনে হল, ফুলি তার বউ হলে তার এমন অবস্থা হত না।কেউ আর ফুলিকে "বাঁজা" বলত না।
ফুলির ছন্দময় চলে যাওয়া দেখে সুবলের শরীরটা শক্ত হয়ে গেল।তার খুব ইচ্ছে করছে ফুলিকে সাপের মত জড়িয়ে ধরতে।
মাথার উপর আকাশটা বড় নির্দয়।আষাঢ়ের জল নয়,আগুন ঝরিয়ে চলেছে।বীজতলা শুকিয়ে কাঠভোলাকে নিয়ে জল সেচতে হবে।কতদিন আর এভাবে ধানচারাগুলো বাঁচিয়ে রাখা যায় !সুবল পাকা চাষি।তার অকৃপণ যত্ম-আত্তিতে,নিরলস পরিশ্রমে গ্ৰামে সবার থেকে বেশি ফসল ফলে তার জমিতে। সবাই তার জমিতে মা লক্ষ্মীর কৃপা দেখে হা পেতে যায়। সুবলের নিজেকে নিয়ে গর্ব হয়।সে নিজেকে পাকা চাষির বেটা বলে।সুবল বীজতলার কাছে গিয়ে মনমরা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।সে আর একটা বীজতলা বানিয়েছে।কাল বীজধান ছড়াবে।আষাঢ়ে ধানচারা তৈরি না হলে শ্রাবণে রোয়ার কাজ হবে কিকরে !
আকাশ আর কতদিন মুখ ফিরিয়ে থাকবে !সুবল আকাশটা দেখে। বাড়ির দিকে দ্রুত পা চালায়।বস্তায় বীজধানে অঙ্কুর হয়েছে। দাওয়াতে ছড়িয়ে অঙ্কুরিত বীজধানগুলো এক একটা করে ছাড়াতে হবে।
ছেলে ভোলাকে নিয়ে বাড়ির দাবায় অঙ্কুরিত ধানগুলো ছড়িয়ে দিয়েছে।হাতের আলতো স্পর্শে ধানগুলো পৃথক করছে সে।"দেখ বাপ,ক্যামনে কলা ছাড়াতে হয়।ক্যামনে ধান থেকে বীজ বের হয়,এসব শিখে নে।চাষির বেটা যতই লেখাপড়া কর,এগুলো তোরে শিখতে হবে।"আলো বর আর ছেলের বীজধান ভাঙা দেখছে।সে এসে হাত লাগাল।সুবল ছেলে আর বউয়ের উদ্দেশ্যে বলল," বীজ হল আসল জিনিস।ফসল কি আর এমনি এমনি ফলে !যার যত ভাল বীজ তার জমিতে তত ফসল।"বীজের কথা বলতে গিয়ে সুবল আপন মনে হেসে উঠল।ফুলির কথা মনে পড়ল তার।ফুলির ওমন সুন্দর শরীরজমিনে বীজ অঙ্কুরিত হল না।আসলে বীজটাই যে ভাল না।বীজ ভাল না হলে জমিন যতই সরেস হোক না কেন অঙ্কুর গজাবে কী করে !ওমন জমি পেলে সে সোনার ফসল ফলিয়ে দেখাত।সুবলের ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি আলোর চোখ এড়ায়নি।"আ মলো,এর মধ্যে হাসি কোতাথেকে আসে! আমি কিছু বুজিনা বুজি !আলো চিড়বিড়িয়ে ওঠে।সুবল নিজেকে সামলে নেয়।"হাসি কি আর এমনি আসেরে বউ !দুখেও আসে। তুই অতশত বুজবি না।"
এক একটা বীজধান আলাদা করছে সুবল।তার মনে হল,যতই জল,আলো,মাটি ভাল হোক না কেন,বীজ ভাল না হলে ফসল মার খায়।
0 Comments