
ডাইনি
চম্পা এই বয়সেই ডাইনি অপবাদ পেল। হরিজনের মেয়ে ডাইনি অপবাদ পেলে কি আর রক্ষে আছে! একঘরে হল মেয়ে এবং মেয়ের কারণে বাপ মা আর ভাই। দোষের মধ্যে ওকে দেখে হরিহর চাটুজ্জের মুখে রক্ত উঠল। সে কী রক্ত! এই ব্যাপারে চুপিচুপি বলে রাখি চাটুজ্জে মশাই বিগত ছমাস ধরে টিবিতে ভুগছিলেন। কিন্তু যজমান চলে যাওয়ার ভয়ে কাউকে জানান নি। তিনি সেদিন দত্ত বাড়ির জন্মাষ্টমী পূজা সেরে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে। চম্পা সেসময় কলতলায় খাবার জল আনতে গেছিল। ভর্তি কলসি কাঁধে তুলতে গিয়ে তার শাড়ি আড় হয়ে যায়। অনাবৃত অবতল মসৃণ নারী উদর দেখে মধ্য বয়সি চাটুজ্জে রাম বিষম খেলেন। কাশি, মানে প্রবল কাশি! পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। উবু হয়ে বসে পড়লেন। বসে কাশতে কাশতে চোয়াল গড়িয়ে রক্ত পড়তে লাগল। হরিহরের লুকোনো টিবি রোগের খবর ফাঁস হওয়ার জোগাড়। এবার বুঝি সব যজমান গেল! সেই ভাবনার মধ্যে চতুর পুরুত কূল খুঁজে পেলেন। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, - ওরে খেলে রে, খেলে রে; ডাইনি খেলে রে!
আশপাশের লোকজন ছুটে এল। তাঁর চোখে মুখে মাথায় জল দিল। চাম্পাই প্রথম জল দিতে দিতে গেছল কিন্তু তাকে কেউ তাঁর কাছে ঘেঁষতে দিল না। চাটুজ্জের যজমান এ যাত্রায় টিকে গেল। তাঁকে একটু ধাতস্থ করিয়ে লোকজন বাড়ি পৌঁছে দিল। সেই থেকে চম্পা ডাইনি হল। প্রশাসনিক ভয়ে কেউ তাকে মারল না, ধরল না; অদূরে কটূক্তি করল এবং সেদিন থেকে একঘরে করল। গুজব উঠল ওই মেয়েকে যখন তখন স্থানে অস্থানে ঘুরতে দেখা যায়। কেউ আবার তাকে জ্যান্ত পায়রার ঘাড় মটকে খেতেও নাকি দেখেছে!
চম্পা সেদিন থেকে শত সিদ্ধ হল ডাইনি বলে। মাস দুয়েক পরে শোনা গেলে চম্পা নাকি বাড়ি থেকে পালিয়েছে। শোর উঠল,- ডাইনি আবার কোন গ্রাম খেতে গেল!
বেলা হতে জানা গেল ডাইনি গেছে পাশের গাঁয়ের গোকুলের সাথে। গোকুলের? অনেকেই চোখ কপালে তুলল। সে মিনসের বয়স হল সখ গেল না! গোকুলের সংসার খেলে গা ডাইনি; তার যে দু'বাচ্চা-বউ আছে বাড়িতে। ওই ডাইনিই গোকুলের মাথাটা খেয়েছে। ও তো করে কলকাতায় সিনেমা পাড়ায় চা-টিফিন বানানোর কাজ করে। ক'পয়সা ইনকাম যে বউ থাকতে পর মেয়েমানুষকে সঙ্গে নিয়ে যায়! ওর বউটাও যেতে দিল?
কেউ বলে,- না না, গোকলার বউ বলল ডাইনি ইয়ে চাম্পা নাকি কলকাতায় কাজ শিখতে গেছে।
- কাজ শিখতে! ডাইনি করবে রান্নার কাজ? গোকলা নিয়ে গেল কোন আক্কেলে!
কেউ যোগ করে, - রাম রাম! এবার শহরের মানুষের মুখ দিয়া রক্ত উঠে মরবে গো!
- ভদ্দর লোকের খাবার ডাইনি রাঁধে নাকি! এই বললেম দেখে নিও ও ডাইনি কলকাতা ছাড়া হবে। মরবে.. মরবে!
চম্পা ডাইনি আর গোকুলকে নিয়ে গ্রামে জল্পনা তুঙ্গে। অবসর বিনোদনের জন্য বেশ রসাল মুখরোচক পাচ্য!
কিছুদিন পরের কথা। আজ মহালয়া। তিথি গোলযোগের জন্য পুজো পিছিয়েছে, মহালয়াও। মেয়ের এরকম খবর বাপ মায়ের কাছে এল অনেক পরে। ওদের বাড়িতে টিভি নেই তাই সে খবর লোকমুখে ঘুরে ঘুরে পেল দুপুরে। চাম্পাও ডাইনি হবার পর মা বাবাকে সব কথা জানে না। হরিহর চাটুজ্জে সেদিন দ্বিতীয়বার রাম বিষম খেয়ে অসুস্থ হল। গাঁয়ের অনেকেরই বিষম খাবার অবস্থা। কেউ ব্রাশ মুখে দিয়ে ঘুম চোখে টিভিতে মহালয়া চালিয়ে আবার বিছানাতেই ধপ করে বসে পড়ল।যে বিছানায় বসে ছিল সে টিভির কাছে গিয়ে দুগ্গার মুখটা ভালো করে নিরীক্ষণ করে দেখল। দুগ্গা না ডাইনি ইয়ে এ গাঁয়ের চম্পা! সকলের চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসার জোগাড়। সেদিন গাঁয়ে আবার জল্পনা তুঙ্গে উঠল। কয়েকজন গোকুলের বাড়ি গেল খবর আনতে। তার বউ নিশ্চিত করল ওই দুর্গাই চম্পা ডাইনি সে কলকাতা গিয়ে অভিনয় করছে এবং শিখছে।
আবার বিস্ময়ের পালা। ডাইনি আবার কার মাথা খেল! ডাইনিও দুগ্গা হতে পারে! ঠাকুরের কি খেলা? নাকি চম্পা ডাইনিই নয়? কেউ কেউ ' জয় দুগ্গা জয় দুগ্গা ' বলে করজোড়ে মাথা ছোঁয়াল, - রোক্কে করো মা; পাপ নিও না মা! পাপ নিও না। ডাইনি নয় মঙ্গল- দায়িনী মা আমার..
চম্পা সেইদিকে কলকাতায় অভিনয় করছে। সুখের কথা এই যে, সেদিন চাটুজ্জে মশাই অসুস্থ হয়ে পড়তে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। টিবি রোগের যথাযথ চিকিৎসা করে তিনি এখন সুস্থ হওয়ার পথে। তিনি মনস্থির করেছেন সুস্থ হওয়ার পর সবাইকে সচেতন করবেন রোগ যাতে কেউ চেপে না রাখে।
লেখক ডা: করণ দেবদ্যুতি
কালিকাখালি, মঠ চন্ডীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর
0 Comments