
সামাজিক পরিবর্তন ও মূল্যবোধের পতন
সমাজ একটি পরিবর্তনশীল ব্যবস্থা। এটি সমাজের চাওয়া না চাওয়ার ওপর নির্ভর করে না। পৃথিবীতে এমন কোন সমাজ নেই যে সমাজ পরিবর্তন চায় না। যেহেতু সমাজের পরিবর্তন একটি শাশ্বত নিয়ম, তাই সমাজতাত্ত্বিক বা নৃতাত্ত্বিক রা এ বিষয়ের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করেছেন। সমাজের পরিবর্তন অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক উভয় দিক দিয়ে ঘটতে পারে। আর এই পরিবর্তনের ফলে সমাজের কাঠামোর যেমন পরিবর্তন ঘটে, তেমনি সমাজের আদর্শ, রীতি-নীতি ,মূল্যবোধের ও পরিবর্তন ঘটে। এ প্রসঙ্গে ব্রিটিশ সমাজবিজ্ঞানী সামনার সর্বপ্রথম আলোকপাত করেন, তিনি বলেন সমাজ সরল অবস্থা থেকে জটিল অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অনুরূপ বক্তব্য আমরা শুনতে পাই হারবার্ট স্পেনসার, এমিল ডুর্খেইম এবং ম্যাক্স ওয়েবারের পর্যালোচনা থেকে।
আদিম যুগে অসহায় মানুষ বাঁচার তাগিদে গড়ে তুলেছিল সমাজ। সমাজের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিল বাঁচার সব উপাদান। তারপর সময় যত এগিয়েছে সমাজের গঠনের যেমন পরিবর্তন এসেছে তেমনি কাজেরও পরিবর্তন এসে গেছে। এ কথা অবশ্য বলে রাখা ভালো যে তখন সমাজে শ্রমবিভাজন গড়ে ওঠেনি,সমাজে তখন যৌথবিবেক এবং যৌথচেতনা যথেষ্টই সজাগ ছিল, সমাজে ধীরে ধীরে মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেছিল। তারপর সমাজের বিবর্তনের ফলে সমাজ যত গতিশীল এবং যান্ত্রিক হয়েছে ততোই সমাজ থেকে মূল্যবোধ হারিয়ে গেছে।
উনবিংশ শতকের শেষ দিক থেকে সমাজ জীবনে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। তখন সমাজে পুঁজিবাদের রমরমা, শিল্পায়নের ফলে সমাজ দ্রুতগতিতে এগুতে থাকে, সমাজের ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়তে থাকে, ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি উপনিবেশ দখলের জন্য লড়াই শুরু করে, তারা এশিয়া আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার গরিব দেশ গুলিতে উপনিবেশ স্থাপন করে, শুরু হয় শোষণ নর্যাতন, এবং তার সাথে শুরু হয় মূল্যবোধের পতন। আমরা দেখেছি দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের জন্য উপনিবেশবাদ দায়ী। আর এই উপনিবেশবাদ প্রকারান্তরে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের সূচনা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে সমাজ জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে, সমাজের কাঠামো এবং আভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি তেও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, ইউরোপ তো বটেই এমনকি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে এই পরিবর্তন ঘটতে থাকে। এই সময় কালে সমাজ জীবনে পরিবর্তনীয় অন্যতম কারণ ছিল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানের বিকাশ। এইভাবে আদিম সমাজ থেকে আধুনিক সমাজের উত্তরণ, এবং তার কাঠামো পরিবর্তনের পার্থক্যের অন্যতম কারণ হিসেবে প্রযুক্তিকেই দায়ী করা হয়। এ বিষয়ে সবচেয়ে লক্ষণীয় দিকটি হলো পুঁজিবাদ বিকাশে প্রযুক্তির ব্যবহার। আর এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় সামাজিক মূল্যবোধ কি বিদায় জানায়।
সামাজিক পরিবর্তন একটি সার্বভৌম এবং অনিবার্য প্রক্রিয়া। কিন্তু সামাজিক পরিবর্তনের গতি কিন্তু কখনো সমান হয় না, অষ্টাদশ শতকে এর গতি শুরু বর্তমানে সামাজিক পরিবর্তনে এর গতি যথেষ্ট ঊর্ধ্বমুখী, বলতে গেলে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এই গতিকে বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে।
সামাজিক পরিবর্তনের অনেক প্যাটার্ন বা ধরন দেখতে পাওয়া যায়। তবে অধিকাংশ সমাজবিজ্ঞানী রৈখিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী, তবে একথাও ঠিক কিছু কিছু সামাজিক পরিবর্তন উপর থেকে নিচে নিচে থেকেও উপরে লক্ষ্য করা গেছে। উদাহরণ হিসেবে ভারতীয় সমাজ পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমে ভারতীয় সমাজ আধ্যিত্মকতার দিকে অগ্রসর হয়, পরবর্তীকালে ভারতীয় সমাজ বস্তুবাদের দিকে অগ্রসর হতে থাকে, যার ফলে ভারতীয় সমাজ থেকে দ্রুত মূল্যবোধের পতন ঘটাতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে অর্থাৎ স্বাধীনোত্তর পর্বে ভারতের দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ন ঘটতে থাকে, তার সাথে সাথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় সমাজ প্রচন্ড গতিশীল হয়ে ওঠে, ফলে সমাজের আভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক দিকের ব্যাপক পরিবর্তন করতে শুরু করে। বিবর্তনের পথে সমাজ ও সংস্কৃতি বদলাতে থাকে, মানুষ আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক হয়ে ওঠে, যার ফলে ধীরে ধীরে সমাজ থেকে মূল্যবোধ বিদায় নিতে শুরু করে।
কোন সমাজ ও সংস্কৃতিকে মূল্যবোধের ভিত্তিতে বোঝা যায়, মূল্যবোধ হল ব্যক্তির কোন বিষয় সম্পর্কে ভালো, প্রত্যাশিত অথবা খারাপ, অপ্রত্যাশিত এরূপ বাছবিচার, যা ব্যাক্তির চিন্তন মনন বিবেকতাড়িত এবং নির্দেশিত। মূল্যবোধ কখনো স্থির থাকে না,সময় ও পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সাথে মূল্যবোধের পরিবর্তন আসে।যেমন এক সময় ছিল যখন ভারতীয়রা সম্ভবত নৈতিকতা ও ধার্মিকতার মূল্যবোধকে বেশি গুরুত্ব দিত। ভুল কাজ করার আগে তারা বার বার চিন্তা করে দেখতো, কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় তারা চিন্তা করে দেখতো যে তারা যা করতে যাচ্ছে তা যেন ধর্মবিরুদ্ধ না হয় ,তারা একথাও ভাবতো যে অনৈতিক কাজ করলে নরকে যেতে হবে।
নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় বর্তমান ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে বড় সমস্যা। মানুষের কাছ থেকে সমাজ সমাজ সব সময় সমাজ নির্দেশিত আচরণ প্রত্যাশা করে, কারণ নীতিহীন সমাজ কখনই কাম্য নয়, ইহা সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়,নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় সমাজ ও পরিবারের শনির দশা, এর ফলে সামাজিক সম্পর্ক গুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, স্বামী-স্ত্রী, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, সবার মধ্যে আজ যেন ভাঙ্গা ভাঙ্গা সম্পর্ক দেখা যাচ্ছে। নীতি বা আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জীবনে মূল্যবোধ গড়ে ওঠে।যে সমাজে নৈতিক মূল্যবোধের চর্চা গড়ে ওঠে সেই সমাজ আদর্শ সমাজ হিসেবে পরিচিত হয়। নৈতিক মূল্যবোধ ব্যক্তি জীবন কে মহান করে, ব্যক্তিকে চরিত্রবান ও আদর্শবান করে গড়ে তোলে।
আমাদের বর্তমান সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ প্রায় বিদায় নিতে চলেছে, ফলে আমাদের সমাজে আজ নানা রকম অন্যায় ,অনাচার ,পাপাচার দুর্নীতি, স্বার্থপরতা ,জালিয়াতি ভিড় করছে। খুনিরা , ধর্ষণকারীরা, নারী পাচারকারীরা বুক ফুলিয়ে সমাজে ঘোরাঘুরি করছে। আজ আমাদের সমাজে চলছে অবৈধ উপায়ে অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতা, নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ সেবার নামে মানুষকে শোষণ করছে, বলতে গেলে নার্সিংহোম যেন শোষনের যন্ত্র। ডাক্তার এবং নাসিম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে একটা অশুভ আঁতাত গড়ে উঠেছে, অকারণে নানা টেস্ট, অপ্রয়োজনীয় ওষুধ, নরমাল ডেলিভারি পেশেন্টকে সিজার করানো, মরা মানুষকে ভেন্টিলেশনে রেখে দিয়ে বিলবাড়ানো, একাধিকবার ডাক্তারের ভিজিট দেখানো, আরো কত কি! এগুলি এলিটের দস্যুবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়। এছাড়া চাকরির ক্ষেত্রে স্বজনপোষণ, ঘুষ অর্থ প্রভাব খাটিয়ে পদোন্নতি ইত্যাদি তো আছেই।
সাম্প্রতিককালে আমাদের সমাজে শিশু হত্যা, ধর্ষণ, ছিনতাই, শিশু কিশোর অপরাধ, আত্মহত্যার মতো ঘটনা বেড়েই চলেছে, যা সমাজকে যথেষ্ট বিব্রত করছে, এক সময় ভারতীয় সমাজে মূল্যবোধ যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল, অনৈতিক কাজ কি মানুষ পাপ বলে মনে করত। কিন্তু আজ ভোগবাদ সমস্ত কিছুকে বিসর্জন দিচ্ছে, সমাজকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বর্তমানে পরিবার, পবিত্র সমাজ ও রাষ্ট্রে মূল্যবোধের অভাবে যে শনির দশা নেমে এসেছে তার একমাত্র চিকিৎসা মূল্যবোধ চর্চা, তাছাড়া এ থেকে মুক্তির কোনো উপায়ে আমাদের কাছে আজ খোলা নেই। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ করতে এগিয়ে আসতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে, এবং তার সাথে যথার্থ ভূমিকা পালন করতে হবে।
0 Comments