বিশ্বনাথ প্রামাণিকের ধারাবাহিক গল্প


"আমাদের চুপকথা"
[পর্ব- ২]

মিনতি

জীবনে কোনও দিন ডায়রি লিখিনি। অথচ কতবার লিখতে চেয়েছি। পারিনি। ভয় হয়,পাছে উনি দুঃখ পান। ওর পাগলামি কি দিন দিন বাড়ছে? অমা! একি কাণ্ড! মানুষটা সেই এক ভাবনা নিয়ে সারাজীবনটাই কাটিয়ে দিলো গো! দেখতে বড় ইচ্ছা হয় তার। সে কেমন রূপসী! কি আছে তার- যার জন্য এমন ছিনে জোঁকের মতো দিন রাত লেগে আছে!ভাগ্যবতি তুমি, সৌভাগ্যবতি।

এই এতো বয়সেও স্বামী-পুত্র ভরা সংসার নিয়েও মানুষটাকে আজও চিনে উঠতে পারলাম না।

ছেলেটা বায়না ধরেছে। বাবা- মায়ের বিয়ের রজত জয়ন্তিতে এবার বড় করে উৎসব করবে। কি হবে এসব করে! নেহাত সুমুর আব্দার,তাই আর না করতে পারিনি। ও বড় হচ্ছে, ওর ইচ্ছা- অনিচ্ছাকে তো মর্যাদা দিতে হবে! এই তো সেদিন মুখুজ্জে গিন্নিদের সুবন্ন জয়ন্তী হল। কি ধুমধাম,হই হুল্লোড়, তারপর মাস পেরতে না পেরতেই মুখুজ্জে গিন্নি বিধবা হলেন। আমারো যদি…

রাম,রাম এ কি ভাবছি! ওঁর শতবছর পরায়ু হোক, ওঁর কোলে মাথা রেখে যেন চোখ বুঝতে পারি। হে ঈশ্বর, অপরাধ নিও না।   

মানুষটাকে দেখলে আজকাল বড় কষ্ট হয়। সারা জীবন একটু শান্তি পেলে না। সব দিয়েছি, ওকে সুখী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। তবু...

কতবার দেখেছি ঘুমের ঘোরে বকবক করছে। কখনো বা কাঁদছে ছেলেমানুষের মত। কতবার ঘুম থেকে উঠে সারারাত বারান্দায় পায়চারী করতে দেখেছি। সব, সব দেখেছি। তবু সামনে যেতে পারিনি, পাছে ও লজ্জা পায়। এমন করে কি মানুষ বাঁচতে পারে!

কি অপরাধ করেছি আমি! যার জন্য এই এতকিছুর মধ্যেও এমন নিঃসঙ্গ হয়ে আছি! ও কিন্তু কোনদিন আমাকে কষ্ট দেয় নি। না চাইতেই সব পেয়েছি- ভালো ভালো শাড়ি, গহনাতে আলমারি ঠাসা। কি হবে এসব! ইচ্ছা করে টান মেরে ফেলে দিই সব। তারপর যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রনা কি তবে আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে? কি জানি হয়তো হবে। তবু মুখ ফোটে ভিখারীর মতো ভালোবাসা ভিক্ষা করতে পারবো না আমি।

রাত কত হলো কে জানে! রাতের তারারা এখনো জেগে আছে আকাশের গায়ে। সারারাত ওরা আলো দেবে মিটমিট করে। ওদের ক্লান্তি নেই। ওরা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করে না। আমারও যদি দুটো ডানা থাকত বেশ হত।মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় ওদের দেশে চলে যাই।

সুবিমল এখনো ঘুমাচ্ছে। ভাঙা চাঁদের আলো এসে পড়েছে ওর মুখে। কানের পাশে চুল গুলোতে পাক ধরেছে ।এ নিয়ে ওর কি আক্ষেপ! বলে- বুড়ো হয়ে গেছি। বয়সের এই বেড়ে ওঠা ও মানতে পারে না। ওর ধারণা এখনো সেই কলেজে পড়া পাতলা ছিপছিপে যুবকটি আছে। আর ওর হাত ধরে চলেছে ওঁরই বয়সি আরো একজন।  

কতবার ওকে বলতে শুনেছি ,অরুনার কথা। হাওয়ায় দোলা খাওয়া এলোমেলো চুলগুলো ওর ঘারের কাছে যখন উড়ে এসে পড়ত, ওঁর নাকি ভারি ভালো লাগত। গল্পের তুফান উড়িয়ে সমানতালে পা চালিয়ে ওরা  চলেছে নদীর পাড় ধরে। কিংবা কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার অলিতে গলিতে। নীল রঙের শাড়ি- সালোয়ার ওঁর বড় প্রিয়। সে কি তার জন্য? কি জানি! শুনেছি নীল রংয়ের সালোয়ারে তাকে নাকি বেশ মানাত।

কতবার নীল কাপড় কিনতে চেয়েছি ও আগ্রহ দেখায়নি। ও বলে - সবকিছু সবাইকে মানায় না। হালকা গোলাপিতে তুমি অতুলনীয়। কি জানি! শুধু বলার জন্য বলা কিনা! নাকি আমার মন রাখতে চাওয়া!

সব পুরুষ মানুষের মতো ও নয়। বৌয়ের মনে রেখে কথা বলা ওর ধাতে নেই । যা ভাল লাগে সাফ সাফ বলে দেয় । যা ভালো লাগে না, তাও …  

যেবার সুমন পেটে এল, অফিস থেকে ফিরে আমাকে ধরে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিল- দেখো, তোমাকে কেমন লাগছে! যেন মনে হয় একটা দানব তোমার পেটটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে পাহাড় করে তুলেছে।

-আহা! কি কথার ছিরি! এ সময় সব মেয়েরই এমন দেখতে হয়।

-হয় নাকি?

-হয় তো। দেখনি তোমার বৌদির, কত বড়টা লাগছিল! 

ও আর কিছু বলেনি। আনমনে হয়ে পড়েছিল। অস্ফুটে শুধু বলেছিল- তারও তো এমন হবে। সবকিছুতেই ওঁর তার কথা মনে পড়ে। সব ভাবনাতে ওঁর সে।

পাগল একটা, পাগল। পাগল তো। যে দিন বিশেষ লেখা লিখি করে না এ ঘরে এসে শুয়ে পড়ে, বুঝতে পারি ও আজ আদর চাইছে- কেমন যেন এক অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আজ ওর মাথায় বড় হাত বুলাতে ইচ্ছা করছে । কিন্তু যদি জেগে ওঠে! জাগুক, তবু আজ একটু বাঁধন ছাড়া হতে দোষ কি! সুবিমল কি জেগে ছিল! আমার হাতের স্পর্শে ও চঞ্চল হয়ে ওঠে- কিগো তুমি ঘুমাবে না! আর কত লেখালেখি করবে?

এইতো এবার শোবো, তুমি ঘুমাও।

-রাত কত হলো? হবে, দুটো কি তিনটে। তুমি ঘুমাও, তোমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিই।

-তোমার শরীর খারাপ হবে মিনু, আর না এবার ঘুমোতে এস।

-তাহলে আজকাল আমার কথা ভাবো?

ও কিছু বলে না। ওর উত্তরের প্রত্যাশাও করিনা। ধীরে ধীরে ওর পাশে শুয়ে পড়ি। দীর্ঘ পঁচিশ বছর যেমন শুয়ে আসছি। ও কোন কথা বলে না। আমাকে কাছে পেয়ে বামদিকের নাইট বাল্বের সুইচ অফ করে দেয় সুবিমল।

    ৯ই বৈশাখ ১৪১৭

মিনতি, রাত ২টো ৫৬

ক্রমশ...

                        

      লেখক বিশ্বনাথ প্রামাণিক    বিদ্যাসাগর পল্লীসোনারপুরকলকাতা১৫০
















0 Comments