
"আমাদের চুপকথা"
[পর্ব ৩]
অরুনা
‘’অজো নিত্যঃ শাশ্বত হয়ং পুরানো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’’
- শ্রীমদ্ভাগবত গীতা; সাংখ্যযোগ, শ্লোক-২০
এখন সকাল। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে গীতা পড়ার অভ্যাস করেছি। আমার শ্বশুর মশাই বলেন, সকালে স্নান করে পূজা পাঠ সেরে নিষ্ঠাবান চিত্তে গীতা পাঠ করলে মন পবিত্র হয়, সারাদিন নাকি ভালো থাকা যায়। কথাটা যে কত সত্যি তা এ ক’বছরে বেশ বুঝতে পারছি। পুজাপাঠ সেরে রোজ এখন নিয়ম করে আরও একটা কাজ করি। তা হল-ডায়রি লেখার অভ্যাস। সে বলত,ডায়রি নাকি ভালো বন্ধু হতে পারে। ঠিক নিকট জনের মতো মানসিক দুঃখ,কষ্ট,যন্ত্রণার শরিক হতে পারে সেও।
আজ পুব গগনে আকাশ ঝকমকিয়ে সূর্যি ঠাকুর উঁকি দিচ্ছে।কোথাও এতটুকুও কুয়াশার প্রলেপ নেই।এ সময় রোজের মতো আজও পুবের আলোয় আমাদের পুব মুখো বড় ছাদ বারান্দা ভরে গেছে। আর তারি আলো এসে পড়েছে আমার ঠিক পায়ের নীচটায়। ছাদের রেলিং এ রাখা চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, ডালিয়া,নানা রঙের ফুল গাছগুলো যেন হাসছে।
শীতের সকাল বলে ছেলে-মেয়েরা এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। রজতাভ ও ঘরে ঘুমাচ্ছে।অভ্যাস মতো আমি শুধু ভোরবেলা উঠি। এ সময় প্রকৃতি দেখতে বড় ভালো লাগে। স্নান সিক্ত ভেজা চুলের গোছা এসে পড়েছে আমার চোখে-মুখে। ছাদের এই ঘরে এ সময়টা বেশ নিরিবিলি। শুধু কটা ছাতার পাখি লাফিয়ে লাফিয়ে কিচির-মিচির করতে করতে নেচে চলেছে গোটা ছাদময়। ওরা কি প্রাণ চঞ্চল!
ঠিক তার মতো। কতদিন তার কোন খবর পাই না। সুবিমল মজুমদার। একদা কলেজের কিশোরী মেয়ে গুলোর নয়নের মণি। আর হবে নাই বা কেন! যেমন সুন্দর রুপ,তেমনি স্মাট। আর সে ছিল আমার স্বপন চা…,ছি ছিঃ এ আমি কি লিখছি! এ কথা যে এখন ভাবা ও যে পাপ!
তবু ভাবনা গুলো ঠেকিয়ে রাখা যায় কৈ! ভাবনা আসে যে ভাবনার নিয়মে। সে ও কি এখন আর ডায়রি লেখে? আমার কথা কি আর ভাবে?
খাতা ভর্তি যত সব হিজিবিজি লেখা- অসমাপ্ত গল্প,অপরিনত কবিতা- সব নিয়ে এসে প্রথম আমাকে দেখানো চাই। তখন যদি ওর মুখের একটা ছবি তুলে রাখতে পারতাম, কি যে মুখের অবস্থা হত- টেনশনে আর লজ্জায় একেবারে কুঁকড়ে যেত। এখন মনে পড়লে বড় হাসি পায়।
এক সময় সে ও আমাকে লেখালিখির জন্য কত বুঝিয়েছে। অভিমান করে বলেছে-‘’ সাহিত্যের ছাত্রী, এত গল্প-কবিতা পড়িস, কোনদিন এক কলম লিখে দেখতে ইচ্ছা করে না তোর? তুই কি রে?’’
হেসে বলেছি- সবার দ্বারা সব কিছু কি হয়? তুই লিখিস,এই তো আমার হল। ও মৃদু হেসে চুপ করে যেত,আর জোরাজুরি করত না।
কবিতা তো দূরের কথা, জীবনে কোনদিন ডায়রি পর্যন্ত লিখিনি। আর আজ ওর সেই নেশা এই বুড়ো বয়সে এসে কেমন করে যেন আমায় পেয়ে বসেছে।
বড় অভিমানি ছিল সে। কথায় কথায় ছেলেমানুষটির মতো রাগ করত। রাগলে ওকে বেশ দেখতে লাগত। ইচ্ছা করত,আরও বেশি করেই রাগিয়ে দিই। আবার সে রাগ ভাঙাতে আমাকেই তো সাধ্য-সাধনা করতে হত। বড় ছেলেমানুষ ছিল সে।
কতদিন আর ওর খবর পাই না। কোথায় আছে কে জানে! একদিনের কথা খুব মনে পড়ে-
আমরা মফস্বলের ছেলে মেয়ে, তায় মফস্বলের কলেজে পড়ি। প্রথমবার ওর সঙ্গে কলেজ স্টীট গিয়ে গুচ্ছের খানেক বই পত্তর কেনা কাটা করে ফেরার পথে পথ হারিয়ে ফেলি। যদিও পথ হারানোর ব্যাপার টা ও আমার কাছে গোপন রাখতে চেয়েছিল ( বোধহয় ওর পৌরুষে লেগে ছিল),আমিও না বোঝার ভান করেছিলাম। পাছে ও লজ্জা পায়। সে দিন ওকে ঠিক আমার অভিভাবকের মতো মনে হচ্ছিল। আমার হাত ধরে অতি সন্তর্পণে বড় বড় রাস্থাগুলো পার করছিল। যেন আমি কচি খুকি,আর ও আমার গোঁফ ওয়ালা ইয়া বড় গার্জেন! হা হা হা…
আজো কত স্মৃতি আছে মন জুড়ে। সব কি আর লিখে শেষ করা যায়!
কলেজ থেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমরা প্রায় এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। বড় কোন ছুটি পড়লে আমরা লুকিয়ে দেখা করতাম। কলকাতা বইমেলা থেকে কলেজের নদীর তীর- কিছুই বাদ যায় নি। ভালবাসার কাঙাল ছিল সে। আজও কি সে আমাকে তেমন ভালবাসে!
রজতের বাবা বলে খবরের কাগজে ‘হারানো কলমে’ একটা বিঙ্গাপন দাও। কিম্বা এফ এম এ ‘’হারায়ে খুঁজি’’ অনুষ্ঠানে চিঠি দাও- না হয় আমার অফিসের ফোন নম্বরটাই দেবে (তখন মোবাইলের এত রমরমা ছিল না। আমাদের বাড়িতে ও ল্যান্ডফোন এলো অনেক পরে)। রজতের বাবা কত পরামর্শ দেয়। জানি কিছুই মন থেকে বলে না। তবু আমি তো কোনদিন ওঁকে কিছু গোপন করি নি।
ও কি আজকাল আমাকে ব্যঙ্গ করছে! কোন পুরুষ মানুষ তার স্ত্রীর প্রাক্তন প্রেমিককে কি খুঁজে আনে? ওরা বড় স্বার্থপর,ওদের ধারনা ভালোবাসা পাওয়ার একচেটিয়া অধিকার শুধু পুরুষ মানুষের- সে প্রাক্তন প্রেমিকার হোক বা সতীসাদ্ধি (!) বউ এর।
অবশ্য রজতাভ সে রকম নয়। কোনদিন আমাকে এতটুকু দুঃখ দেয় নি। বরং শান্ত মনে মনোযোগ দিয়ে আমাদের সব কথা শুনেছে। আমার পাশে থেকেছে সব সময়। সময় সময় মনে হয়, ওঁকে আমি ঠিক সুখী করতে পারিনি। ও বড় চাপা স্বভাবের। মুখে কিছু বলে না কখনো। সুবিমল নিজেকে প্রকাশ করত বেশি,রজতাভ ঠিক তার উলটো।তাই ওঁকে নিয়ে ইদানীং ভয় হয়,ভাবনা হয় বেশি।
কেউ নাকি তার প্রথম প্রেম ভুলতে পারে না। হবে হয়ত! সুবি প্রায় বলত-
‘’নশ্বর দেহের নাশে আত্মা স্থায়ী হয়।
নাহি তার হ্রাস বৃদ্ধি নাহি তার ক্ষয়।।‘’
কি জানি বলার জন্যে বলা কিনা!
যাক,আজ আর না। ওর এবার ঘুম থেকে উঠবার সময় হয়ে এলো। বিল্টু টা উঠে পড়েছে মনে হয়। আমার শ্বশুর মশাইয়ের আমার হাতের চা না হলে চলে না। সুবি,যেখানে থাকো,ভালো থেকো তুমি।
অরু
১লা পৌষ ১৪১৭; সকাল
ক্রমশ...
0 Comments