পার্থ প্রতিম হালদারের ছোটগল্প
বিকৃত ক্ষুধা
[প্রথম পর্ব]
মহানগরের বুকে দিনের আলো নিভে আস্তে আস্তে রঙিন অন্ধকার নেমে আসছে । বাড়ি ফিরছে সারাদিন পরিশ্রমে ক্লান্ত মানুষেরা । শুধু ক্লান্তি নেই মহানগরের যৌনপল্লির পতিতা দের। কারণ যৌনপল্লি তে কখনও রাত নামে না । ঘুম আসে না, ক্লান্তি আসে না। চলে দেহ ব্যবসা ও নারী মাংসের দর দাম।চলে রূপ অনুযায়ী দর কষাকষি ও দেহপসরার বিকিকিনি। ওঠা নামা করে সস্তায় মেক আপ করা আকর্ষণীয় মুখের বাজার দর । এ যেন প্রেমহীন প্রেমের নগরী। কারণ এখানে টাকার বিনিময়ে আদর সোহাগ ভালোবাসা বিক্রি হয়। সাজানো হয় প্রতিদিন নতুন নতুন কুঞ্জ তথা বাসর। আর প্রতি রাতে কত শত পুরুষেরা যে তাদের বাসর সজ্জার সঙ্গিনী হয় তার নেই ঠিক।
তবে শুধু যৌনপল্লির পতিতা দের কথাই বা বলি কেন, এমন অনেক মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে আছে যারা প্রতি রাতে সাজগোজ করে, টি শার্ট - জিন্স - কুর্তি বা টপ পরে গায়ে পারফিউম মেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে । টাকার বিনিময়ে কারোর সাথে রাত কাটিয়ে আসে। তারা কিন্তু হয়তো বা বিভিন্ন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত মেয়ে । যারা প্রথম প্রথম অনেকের সাথে ভার্চুয়াল সম্পর্ক তৈরি করে নেয়,পরে তা বাস্তবে পরিণত করে । যাতে করে চলে যৌনতৃপ্তি উপভোগ, চলে ব্যাবসাও। ঘুচে যায় একাকীত্ব। যারা অনেকর কাছে কর্ল গার্ল বলে পরিচিত। এই ডিজিটাল যুগে তারা অনলাইনের মাধ্যমেও বুক হয়ে যাচ্ছে । আবার কোথাও ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে অনেকে সম্পর্কে লিপ্ত হচ্ছে।
তবে শুধু কর্ল গার্ল নয় । ছেলেরাও এখন আর পিছিয়ে নেই। তারাও নাকি তাদের পুরুষত্ব বিক্রি করছে বিভিন্ন কর্পোরেট বিজনেস ম্যান দের স্ত্রীর কাছে বা অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত কিছু বেপরোয়া নারীর কাছে । আবার সমাজে এমন অনেক মহিলা আছেন যারা পেটের দায়ে পতিতা বৃত্তি করেন না, করেন স্বভাবে বা চরিত্র দোষে । করেন সবার চোখের আড়ালে ।তাই সমাজে পতিতা বলে তারা পরিচিত হয়নি। স্বামী বা পরিবারের চোখে ধুলো দিয়ে তারা নিশ্চিন্তে অনেক অনেক লোকের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক করছেন বা শারীরিক সম্পর্ক করে বেড়াচ্ছেন। সেখানে শিকার টি সন্তানের বয়সী হলেও তাদের কোন সমস্যা নেই। লজ্জা নেই। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে , ব্যবসায়ে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে, আয় কমে যাচ্ছে পতিতা লয়ের মেয়ে গুলোর। যারা কিনা পেটের দায়ে শরীর বিক্রি করছে , খদ্দেরের অপেক্ষায় ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে রাত জেগে বসে থাকছে।
তবুও অন্ধকারময় পঙ্কিল জটিল জীবন কে আচ্ছন্ন করে , দুবেলা দুমুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য আলো আঁধারি রঙিন গলিতে, হাসি মুখে, এলোমেলো ভাবে শাড়ি পরে,নানারকম বডি মুভমেন্ট বা এক্সপ্রেশন করে বারবিলাসিনীরা শিকার ধরার চেষ্টা করে । ঠোঁটে রঙ মেখে, টানা টানা চোখে কাজল পরে মায়া জাল বিস্তার করার চেষ্টা করে। অধর ও কপোল রঙিন তুলিতে চিত্রিত করে । আবার কখনও মেদ যুক্ত ফর্সা পেট , ট্যাটু আঁকা গভীর নাভি বা চর্বি হীন শ্যামলা রঙের পেট বের করে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ বা স্লিভলেস ব্লাউজ পরে,আর কাঁধের কাছে ব্রা এর ফিতে টা একটু বের করে রেখে পুরুষ কে আকৃষ্ট করে এইভাবে বিচিত্র ছলনায় বড় বড় শহরের বাজারের মোড়ে তারা খদ্দেরের অপেক্ষায় বসে থাকে। আর ক্লান্ত পথচারী দের কে নানান ইশারা ও বিভিন্ন ছলনায় প্রলুব্ধ করে। এরাও নাকি আবার এমন অভিশপ্ত রাত গুলো তেও ঝলসে যাওয়া চোখে হাজার হাজার স্বপ্ন দেখে। তাই তাদের দিকে যদি একটু সহানুভূতি দৃষ্টিতে তাকানো যায় তাহলে জানা যাবে তাদের জীবনের করুণ ইতিহাস , শোনা যাবে তাদের ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।
কলকাতার শোভাবাজারে একটা কাজে গিয়ে রমজানের মনে হলো ,'নার্গিস কে একটি বারের জন্য দেখে আসি। অনেক দিন হলো তাকে দেখিনি। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। সেই কবে পেপারে তাকে দেখেছিলাম। তারপরে আর কখনও নার্গিসের সুন্দর মুখ খানা দেখার সৌভাগ্য হয়নি।' সোনাগাছির গলি দিয়ে যেতে যেতে, এমন টি ভাবতে ভাবতে রমজান দেখতে পেলে কয়েক টা মেয়ে ছোট ছোট জামা পরে রাস্তার দুপাশে লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ বা পান চিবোচ্ছে, কেউ আবার সিগারেট টানছে। কারোর হাতে বা গুঠকার প্যাকেট। মেয়ে গুলোর বয়স বারো - তেরোর বেশি হবে না। কিন্তু তাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয় তারা যেন অনেক পরিনত। রমজানের এখনও মনে আছে , এক জ্যোৎস্না রাত্রি তে ছাদে বসে নার্গিসের মুখে পতিতা দের জীবন যাত্রার সেই গল্পের কথা । তখন ছোট ছোট বাচ্চা মেয়ে দের কথাও নার্গিস একবার তাকে বলেছিল। বলেছিল ছোট ছোট মেয়েদের কে কোন এক ওষুধ খাইয়ে যৌনপল্লির মাসি নাকি তাদের কে বড়ো করিয়ে দেয়। অর্থাৎ খুব দ্রুত তাদের শরীরের বৃদ্ধি ঘটিয়ে দেয়। যাতে করে বারো তেরো বছরের মেয়ে গুলো কে সতেরো আঠারো বছরের মেয়ে বলে মনে হয়।
এমন সময়ে হঠাৎ একটা চিৎকারে রমজানের ভাবনায় বাধা সৃষ্টি হলো। দেখতে পেলো পতিতা পল্লির মাসি বা সর্দারনী চীৎকার করে করে কোন এক মেয়ের চুল মুঠি ধরে ছোট এক ঝুপড়ি থেকে বের করে রাস্তায় আনছে । আর মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে সর্দারনীর পা জড়িয়ে ধরে বলছে, ' মাসি আজ দাঁড়াতে পারবো না। আজ দাঁড়াতে পারবো না মাসি। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে । শরীর টা আমার ভালো নেই মাসি।' বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলে। রমজান কাছে গিয়ে মেয়ে টি কে দেখে হতভম্ব হয়ে বলে ফেললে, 'নার্গিস!'
নার্গিস ছিল তার বাবা মায়ের খুব আদরের মেয়ে। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট ও সুন্দরী। তাই বাবা মা আদর করে তার নাম রেখেছিলেন জাসমিন। রাস্তার কন্ট্রাকটরের কাজ করায় জাসমিনের বাবার ইনকামও ভালো ছিলো। কিন্তু জাসমিনের যখন তেরো বছর বয়স তখন জাসমিনের বাবা জাসমিনের মাসি কে নিয়ে ফেরার হয়ে যান। তারপর থেকে লজ্জা ঘৃণা অপমানে, চরম দুঃখ কষ্টে নার্গিসের মা নানা রকম দুশ্চিন্তায় ভুগতে থাকেন । বোধহয় মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন । যার ফলে সন্তান সম পাড়ার ছেলে দের কাছে নিজের যৌন চাহিদার কথা প্রকাশ করে ফেলতেন বা কথা বলার সময় তাদের মনের যৌনতা কে উস্কে দিতেন । যদিও এসব তিনি মুখ ফুটে কখনও বলতেন না কিন্তু বিভিন্ন হাবভাবের মাধ্যমে পাড়ার ছেলে দের কে বুঝিয়ে দিতেন। শুধু তাই নয়, পাড়ার সন্তান বয়সী ছেলে বা বয়স্ক লোকেদের সাথে কখনও রাতের আঁধারে ঝোপ ঝাড়ে , কখনও বা নিজের বাড়ির বারান্দা তে, রান্না ঘরে বা বেডরুমে তিনি শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে থাকেন। যার ফলে বয়সের গোধুলি লগ্নে , যৌবন অস্তমিত হওয়ার আগে, উত্তপ্ত চুয়াল্লিশ বছর বয়সে প্রখর যৌবনের তাপে তিনি আরেক বার প্রেগনেন্ট হয়ে পড়েন। তারপর কোন এক শুভক্ষণে জাসমিনের মায়ের কোল আলো করে নার্গিসের ছোট ভাই আজাদের জন্ম হয়। তা সত্ত্বেও জাসমিনের মায়ের স্বভাব এখনও বদলায় নি - যেখানে তাঁর বয়স প্রায় পঞ্চাশ হতে চললো। মায়ের এমন অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন দেখে মায়ের প্রতি জাসমিনের ঘৃণা চলে আসে । ঘৃণা চলে আসে নিজের প্রতি। নিজের বাবার প্রতি।
তাই মাত্র ষোলো বছর বয়সে হিন্দুর ছেলে ভুতোর সঙ্গে জাসমিন পালিয়ে যায়। পালিয়ে যায় রাতের অন্ধকারে, বাসে করে। যাওয়ার সময় সে ভুতো কে বলে, 'আমি তোমাদের ধর্মের রীতি নীতি অনুযায়ী জীবন যাপন করতে চাই। আমার খুব ইচ্ছে তোমাদের সমাজের বউ দের মতো শাড়ি, সাঁখা ও সিঁথিতে সিঁদুর পরার । তুমি বোধ হয় জানো, যেদিন থেকে তোমার প্রেমে পড়েছি সেদিন থেকে তোমাকে নিয়ে কত কিছু ভেবেছি। ভেবেছি প্রতিদিন সকালে স্নান করে এসে ভিজে চুলে তোমাকে ডেকে তুলবো। তোমার পায়ের ওপর মাথা রেখে অনেক সেবা করবো।ঘোমটা মাথায় দিয়ে রোজ সন্ধ্যা বেলায় তুলসি মঞ্চে পুজো করবো ।' বলে জাসমিন ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে। ভুতো কিছু না বলে জাসমিনের মুখ টা তার বুকে জড়িয়ে ধরলে। এমন সময় জঙ্গীর মতো মুখোশ পরা কিছু মানুষ হাতে রক্তমাখা ছুরি নিয়ে হুড়হুড় করে বাসে উঠে পড়ে কারোর নাকের বাঁকা নথ, কানের দুল, গলার হার টেনে ছিঁড়ে নিতে শুরু করলে । কিন্তু বাসের একটি মানুষও ভয়ে প্রতিবাদ করতে পারলে না। শুরু হলো মহিলাদের চীৎকার, আর্তনাদ। বয়ে গেল রক্তের বন্যা। এমতাবস্থায় ভূতো প্রতিবাদ করে উঠলে। রাগে গর্জন করে উঠলে। মারতে উদ্যত হলে । কিন্তু একা আর কতজনের সঙ্গে লড়বে ? লোহার রড দিয়ে মাথায় মেরে ভুতো কে অচেতন করে ফেলে দিয়ে জাসমিন কে তারা তুলে নিয়ে গেলে ।
রাতের অন্ধকারে আট - নয় জন মিলে ফাঁকা মাঠে জাসমিন কে বারবার ধর্ষণ করলে। তারপর তার চোখ মুখ বেঁধে নিয়ে গেলে অজানা এক দেশে । কিন্তু অচেতন অবস্থা তে জাসমিনের যেন মনে হলো সে সাজগোজ করে শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে। তবে যখন তার চেতন ফিরে আসলো সে দেখতে পেলো কত গুলো সুন্দরী মহিলা তার সেবা করে চলেছে। ওষুধ খাওয়াচ্ছে। আর ঘরের বাইরে নারী মাংসের দর দাম চলছে। তিক্ত বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে জাসমিন বুঝতে পারলে এটা পতিতালয়। কিন্তু এটা ভেবে সে এক ফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি। কি হবে চোখের জল ফেলে? কারণ ভুতোর কাছে মুখ দেখানোর মতো এখন আর তার সেই সতীত্ব নেই। সমাজে নতুন করে বাঁচার ইচ্ছা নেই। আশাও নেই। স্বপ্নও নেই।
এমনটি যখন ভাবছে তখন বাইরে থেকে একজন পতিতা ওরফে রাধিকা ছুটে এসে হাসতে হাসতে বললে, 'এই এবার ওঠ্। ভালো করে সেজে নে। মাসি তোকে ডাকছে। বাইরে গিয়ে লাইট পোস্টের নীচে এবার রূপের পসরা মেলে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তো । তোকে দুই লাখ টাকা দিয়ে মাসি কিনেছে - তা কি এমনি ! তোর থেকে ছয় লাখ টাকা তুলতে না পারলে মাসির রাতের ঘুম উড়ে যাবে রে । চল্ চল্ আর দেরি করিস নে। দেরি হলে আবার মাসি চীৎকার শুরু করে দেবে। ওঠ্ নার্গিস ওঠ্।' তখন জাসমিন বললে, 'আমার নাম তো জাসমিন। নার্গিস নয়।' এ কথা শুনে রাধিকা খিল খিল করে হেসে উঠলে। আর বললে, 'বাড়িতে আমার নাম ছিল মনীষা । কিন্তু গরীব বাবা মায়ের আদরের সেই নাম হারিয়ে গিয়ে কখন যে পতিতালয়ের রাধিকা হয়ে গেলাম বুঝতেও পারলাম না। তখন আমার সদ্য কুঁড়ি ধরা তেরো বছরের প্রস্ফুটিত যৌবন। অকালে আমার বুক ভরা ভালোবাসার সলিল সমাধি হয়ে গেল। নাম টা পরিবর্তন হয়ে গেল। হয়ে গেলাম রাধিকা। অত কম বয়স থেকে বুক ভরা যৌবন ও ভালোবাসা নিয়ে প্রতি রাতে হাতে হাতে বদলাতে থাকলাম।' বলে রাধিকা ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললে। রাধিকার চোখের জল মুছে দিয়ে তাকে একটু আনন্দ দিতে হাসতে হাসতে নার্গিস বললে , 'মোবাইলে লুকিয়ে লুকিয়ে এত পর্ণোগ্রাফি ভিডিও দেখেও কী ছেলে দের মনের সাধ মেটে না ? তাছাড়া এখন পাড়ায় পাড়ায় তো কত টুম্পা বৌদির আবির্ভাব ঘটে গেছে। তাও পতিতা লয়ে ছেলেরা যে কেন আসতে চায় ভেবে পাই না ।'
[দ্বিতীয় পর্ব]
নার্গিসের মুখে এমন কথা শুনে রাধিকা হি হি করে হেসে উঠলে । তারপর নার্গিসের গায়ে চিমটি কেটে, আড় চোখে নার্গিসের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে রাধিকা বললে, 'দূর হ। তাহলে তো আমরা বেঁচে যেতাম রে।'
কিন্তু পতিতা পল্লি থেকে বাঁচার যে কোন রাস্তা নেই , মুক্তির যে কোন পথ নেই তা তারা ভালো করেই জানে। কিন্তু সময় প্রবহমান নদীর মতো। সমস্ত বাধা ঠেলে সে এগিয়ে চলে। সময়ের থেকে বড় আর কিছু নেই। আর তাই এই সময়ের হাত ধরেই নার্গিসের জীবনে পরিবর্তন আসে। নতুন বসন্ত আসে। নার্গিস ওরফে জাসমিনের জীবনে আসে রমজান। রমজান কে পেয়ে নার্গিস যেন মুক্তির আকাশ খুঁজে পায়। ঘটনাক্রমে , অনেক বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে কয়েক মাসের মধ্যে তাদের বিয়েও হয়ে যায়। চলে যায় মুর্শিদাবাদে রমজানের বাড়িতে। কিন্তু রমজানের বাড়ির সংকীর্ণ গণ্ডি তে, বদ্ধ পরিবেশে সে আঁতকে ওঠে। আঁতকে ওঠে রমজানের মায়ের কাহিনী শুনে।
রমজানের মা লক্ষ্মী দাস বোলপুরের মেয়ে। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা। মুর্শিদাবাদে একবার ঘুরতে গিয়ে রমজানের বাবার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তারপর সেই পরিচয় টা ধীরে ধীরে প্রেম পর্যন্তও গড়িয়ে যায়। কিন্তু রমজানের মা ভালো করে জানতেন বাড়ির লোক জানতে পারলে মুসলিম ছেলের সঙ্গে কখনও বিয়ে দেবেন না । তাই তিনি রমজানের বাবার সাথে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। বিয়ে করেন মুসলিম ধর্মের রীতি নীতি অনুযায়ী। নিজের ধর্মের সঙ্গে আত্মিক যোগ ছিন্ন করে দিয়ে , নাড়ির বন্ধন ছিন্ন করে রোজাও করেন, নামাজও পড়েন। এখন বোরখাও পরেন। ভালোবাসতে শুরু করেন মুসলিম সমাজ সংস্কৃতি কে। কিন্তু একসময় তাঁর জীবনে আসে এক কাল রাত্রি । যা তাঁর সমস্ত চিন্তা ভাবনা কে ওলট পালট করে দেয়।
রমজানের বাবা সেদিন বাড়ি তে ছিলেন না।তিন বছরের ছেলে রমজান কে কোলে করে নিয়ে রমজানের মা ঘুমোচ্ছেন। হঠাৎ বাইরে থেকে রমজানের চাচা ভাবি ভাবি বলে ডাকতে শুরু করলেন।বললেন বাড়িতে খুব বিপদ দরজা খুলে বেরিয়ে এসো ভাবি।আচমকা ঘুমের ঘোরে উঠে গিয়ে রমজানের মা দরজা খুললে। সঙ্গে সঙ্গে রমজানের দুই চাচা আর রমজানের বুয়ার তিন ছেলে রমজানের মায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শুরু করলেন অশ্লীল আচরন।কিন্তু সেদিন রমজানের মায়ের চীৎকার শুনে, আর্তনাদ শুনে বাড়ির অন্যরা কেউ বেরিয়ে আসেননি।তাঁর ইজ্জত বাঁচানোর কথা কেউ ভাবেননি।আসেননি পাশের ঘরে শুয়ে থাকা রমজানের চাচিও। জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁরা রমজানের মায়ের পরণের শাড়ি টেনে খোলার চেষ্টা করেন। তখন আর্তনাদ করে কাঁদতে কাঁদতে রমজানের মা বলতে থাকেন ,'আমাকে ছেড়ে দাও ভাই সব । তোমরা আমাকে ছেড়ে দাও। আমি পোয়াতি। পেটে আমার ছয় মাসের বাচ্চা। আমার বাচ্চা মরে যাবে। ছেড়ে দাও ভাই রা।তোমাদের পায়ে পড়ি।পায়ে পড়ি তোমাদের ছেড়ে দাও আমাকে।'সঙ্গে সঙ্গে রমজানের চাচা ও বুয়ার ছেলেরা মিলে রমজানের মায়ের মুখ হাত পা চেপে ধরলেন। আর একজন চাচা রমজানের মায়ের ওপরে উঠে বললে, 'তোর শাড়ি না খুললে তোর চীৎকার বন্ধ হবে না। তোকে ধর্ষণ না করা অবধি তোর লজ্জা দূর হবে না । তোর ছেলের বাবা হতে আমাদের খুব ইচ্ছে করছে।ইচ্ছে করছে তোকে ধর্ষণ করতে।' তারপর একে একে সবাই মিলে পাশবিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করলে। যার ফলে পেটের বাচ্চা টা নষ্ট হয়ে গেল। বিছানা তে রক্তের বন্যা বয়ে গেল।
রমজানের মায়ের মুখে এমন ঘটনা শুনে ভয়ে আতঙ্কে নার্গিস ঝরঝর করে কেঁদে ফেললে। আর কাঁদতে কাঁদতে রমজানের মা কে বললে, 'মা তুমি কেন প্রতিবাদ করলে না ? বোরখার বন্ধন খুলে কেন বেরিয়ে গেলে না ?' তখন রমজানের মা বললেন, 'এতে মুসলিম ধর্মের অপমান। স্বামীর অপমান। হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী স্ত্রীর কাছে স্বামী হলেন দেবতা। যে দেবতা কে আমি এত ভালোবাসি, যে দেবতার টানে হিন্দু ধর্ম - সমাজ - সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়েছি। বেরিয়ে এসে মুসলিম ধর্ম নিয়েছি। সেই ধর্ম কে, সমাজ কে , সেই ধর্মের দেবতা তথা আমার স্বামী কে কী করে অপমান করি ? তাছাড়া হিন্দু সমাজও তো আমাকে আর গ্রহণ করবে না। তাই শত অপমান যন্ত্রণা সহ্য করেও এখানে থেকে গেলাম। তবে এখন আর আগের মতো আমার সমস্যা হয় না। এখন এই সমাজের সংস্কার, রীতি - নীতি, আচার - আচরণ আমারও রক্তের মধ্যে প্রবল বেগে বইতে শুরু করেছে। ওদের থেকে এখন আমিও আর আলাদা নই।' শাশুড়ির মুখে এমন টা শুনে নার্গিসের চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো । কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর নার্গিস বললে , 'মা গো হৃদয় টাকে এত পাষাণ কী করে করলেন। আমি তো পারবো না । আমি কখনও পারবো না। পারবো না আপনার মতো এত কিছু মুখ বুজে সহ্য করতে । পারবো না নারীত্বের অপমান করতে । আমি চললেম।' - বলে বোরখার বন্ধন খুলে, বহু বছরের মরচে ধরা লাল কালো লোহার রডের জানলা ভেঙে নার্গিস রঙিন অন্ধকারে বেরিয়ে গেল।
তারপর প্রায় এক বছর নার্গিসের সঙ্গে রমজানের কোন যোগাযোগ ছিল না । সেই কবে ২০২০ সালের লকডাউনের সময়ে আনন্দ বাজার পত্রিকা তে একবার তার ছবি দেখেছিল মাত্র। তারপরে আর কখনও তাকে দেখেনি। কিন্তু আজ নার্গিস কে এমন অবস্থা তে দেখে রমজানের চোখে জল চলে আসলো। সুন্দরী প্রাণবন্ত নার্গিসের দাঁড়ানোর সেই ভঙ্গি, কাজল পরা টানা টানা চোখের চাউনি, শাড়ি পরার ধরণ, হাতের মেহেন্দি, রঙিন ঠোঁট, ফুল হাতা নেটের ব্লাউজ, নাকের বাঁকা নথ, কপালের ওপর পড়ে থাকা এক গুচ্ছ চুল, মুখের মিষ্টি হাসি, কালো গভীর রঙিন সেই চোখ সময়ের স্রোতে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। যে রূপ দেখে রমজান একসময় তার প্রেমে পড়েছিল। বিয়েও করে নিয়েছিল। যে বাজার দরে একসময় সে জাসমিন থেকে নার্গিস বা নাগিন নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল । সেই নার্গিসের কিনা আজ এই দুর্দশা। কারণ তার আর সেই আগের মতো রূপ যৌবন নেই। আগের মতো তাই তার ইনকামও নেই। সে এখন বিগত যৌবনা বা যৌবনহীনা । কুৎসিত, ব্যাধিগ্রস্ত ও শীর্ণ দেহের নারী। এক অজানা রোগ তার শরীরে বাসা বেঁধেছে। সারাক্ষণ ব্লিডিং হচ্ছে। হাঁচি সর্দি কাশি জ্বর সারাক্ষণ লেগে রয়েছে। তবুও দু বেলা দু মুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য হতাশ নয়নে কর্দমাক্ত নোংরা অপরিষ্কার পথের ধারে মিন মিন করে জ্বলা লাইট পোস্টের নীচে খদ্দেরের জন্য সে এখনও অপেক্ষা করে।
কিন্তু আজ তার শরীর টা একদম ভালো ছিলো না। তা সত্ত্বেও পতিতা লয়ের সর্দারনী বা মাসি তাকে দাঁড়াতে বাধ্য করাচ্ছে। কারণ বাইরে এক বীভৎস কুৎসিত চেহারার খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে। মাসির মুখের অশ্লীল ভাষা, অত্যাচার ও নির্যাতনে অবশেষে নার্গিস সেই বীভৎস চেহারার লোকটির হাত ধরে ছোট্ট ঝুপড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে বাধ্য হলে।তা দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে,চোখের জল মুছতে মুছতে,রঙিন অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে,আলো ঝলমলে শোভা বাজার মেট্রো স্টেশনের দিকে রমজান এগিয়ে গেল।
0 Comments