সৌমিত্র চৌধুরীর অণুগল্প
টিয়ার খোঁজে
এই পাড়াতে আমি এখনও আসি।
আগে আসতাম টিয়াকে দেখবো বলে। টিয়ার ভালো নাম সুদর্শনা। সুদর্শনা সকালের টিউশনি ফেরতা পাঁই পাঁই করে সাইকেল চালিয়ে বন্ধুদের অনেকটা পেছনে ফেলে চলে আসতো। বটতলা মোড়ে হ্যান্ডেলে হাল্কা মোচর মেরে ডানদিকের ফাঁকা রাস্তা ধরত। তারপর ফুল ছাপ ওড়না বাতাসে দুলিয়ে সোজা আমতলা মাঠ। আম গাছের নিচে কয়েকটা ভাঙাচোরা সিমেন্ট বাঁধাই বেঞ্চি। একটা দখল করে আমি বসে থাকতাম। ও সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে নিচু গলায় কথা বলত। আমার খেলা নিয়েই বকবক করত বেশি। কোন ম্যাচে আমার সটে গোল হলে ওর আনন্দ দেখে কে? বলত, ‘কার্লোস, কলকাতার ময়দানে খেলবে তুমি একদিন’। কথা চলত অল্প সময়। তারমধ্যেই ও হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠত। ‘দেরি হয়ে গেল কালোদা, আমি যাচ্ছি’ বলেই পাখির মত ফুড়ুৎ করে হাওয়া। আম গাছের মগ ডালে ঘন পাতার আড়ালে কয়েকটা টিয়া তখন ট্যাঁ ট্যাঁ করে উঠত। ওদিকে পিছন ফিরে সাইকেলের প্যাডেল দাবাতে দাবাতে সুদর্শনাও পাখির সুরে গলা সপ্তমে তুলত।
তখন গড়িয়ে যাওয়া সকাল। ওর স্কুল যাওয়ার তাড়া। ক্লাশ নাইনের ভালো ছাত্রী ও। আমার প্রথম বর্ষ। পাসকোর্স। মফস্বলের কলেজ। ক্লাসে যাবার তাড়া নেই। গেলেও হয়, না গেলেও। সুদর্শনা চলে গেলে আমতলা মাঠে কয়েকজন বন্ধুর সাথে হাল্কা একটু ফুটবল খেলে বাড়ি ফিরি। ফুটবল আমার রক্তে ছিল। জেলার টিমেও তিন বছর খেললাম।
তত দিনে সুদর্শনা রায় চলে গেল চেন্নাই। মেডিক্যাল পড়তে। আমি বেকার। ফুটবল তো পয়সা দেয় না। তাই ছাত্র পড়াই। আর সম্ভবনা নেই জেনেও নির্ভুল ইংরাজিতে চাকরির দরখাস্ত লিখে চলি। মোবাইল হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করে সুদর্শনার ব্যস্ততার খবর জানতে পারি। আরও জানতে পারি, সুদর্শনার বাবা চান তাঁর একমাত্র মেয়ে যেন বাংলাতে না ফেরে।
সব জেনেও এ-পাড়াতে আমি ফিরে ফিরে আসি। সাইকেল ঠেঙিয়ে এসে ভাঙা বেঞ্চিটা দখল করি। আমতলার মাঠে বাচ্চা-জোয়ান এখনও কার্লোস রোনাল্ডোর স্বপ্ন বুকে নিয়ে ফুটবলে লাথি মারে। আমগাছের উঁচু শাখায় একটা পাখির ট্যাঁ ট্যাঁ শুনতে পাই।
গাছের মগ ডালে পাতার আড়ালে আমি টিয়াকে খুঁজতে থাকি।
সাহিত্যিক সৌমিত্র চৌধুরী
নিউটাউন, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
লেখক পরিচিতিঃ
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী (জন্ম 25.11.1954, মালদা) বিশিষ্ট ক্যানসার বিজ্ঞানি ও লেখক। ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল সায়েন্টিস্ট (ICMR); চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থা। অধ্যাপনা করেছেন এবং তিন দশক কর্কট রোগ সংক্রান্ত গবেষণায় নিযুক্ত। ক্যানসার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে শতাধিক গবেষণা পত্র। আবিষ্কৃত পেটেন্টের সংখ্যা দুটি। পেটেন্টের ভিত্তিতে করে ওষুধ আবিষ্কারের চেষ্টায় রত দিল্লীর আই সি এম আর। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বহু গবেষণা সংস্থার সদস্য ড. চৌধুরীর অধিনে ডক্টরেট ডিগ্রী সম্পূর্ণ করেছেন দশ জন ছাত্র-ছাত্রী।
বিজ্ঞান গবেষণার পাশাপাশি অসংখ্য গল্প কবিতা প্রবন্ধ, ভ্রমণ আখ্যান এবং কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। বহু বিদেশী গল্প কবিতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। বিজ্ঞান বিষয়ক শতাধিক রচনা বাংলা পত্রিকায় (জ্ঞান ও বিজ্ঞান, কিশোর বিজ্ঞানী, কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, বিজ্ঞান বিচিত্রা ইত্যাদি) প্রকাশিত হয়েছে। বহু সাহিত্য পত্রিকায় – দেশ, বর্তমান, এই সময়, কথা সাহিত্য, একুশ শতক, শৈব ভারতী, সঙ্কেত ইত্যাদি— অসংখ্য ছোটগল্প লিখেছেন তিনি।
পুরস্কারঃ
‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য্য।
‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য।
গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
প্রকাশিত বইঃ
১। বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান)
২। আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ)।
৩। বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থঃ Anticanc cancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)।
0 Comments