যখন কন্ট্রাক্টরকে জিজ্ঞাসা করে জয়পুর মোড় বাসস্টপে নামলাম,গোধূলির আলো তখন ম্লান হতে বসেছে।
বাসটা চোখের আড়াল হতেই দেখি,সামনে খোলা মাঠ যেন 'সবুজ সমুদ্র'। একটা রাস্তা বাস স্টপ থেকে এঁকেবেঁকে কোনো গ্রামের ঠিকানায় অজগর সাপের মত চলে গেছে। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘেদের দল গোধূলির আলোয় স্নান সেরে নিয়েছে কিছুক্ষন আগে। সন্ধ্যার এই মেঘগুলোকে বাবা বলতেন 'মনখারাপিয়া মেঘ'। 'আগামী আঁধার' ওদের গা থেকে আলো শুষে নিচ্ছে বলে ওরা এইসময় বড় অভিমানী থাকে।
পাখিরা ঘরে ফেরার তাগিদে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে উড়তে উড়তে নিজেদের বাসভূমিতে ফিরছে।
এই প্রাকৃতিক দৃশ্যান্তরে অবশ্য কোনো হেলদোল নেই আমার। এখানে আসাটা স্রেফ কয়েক মুহূর্তের সম্মতির ফসল।
তাও আপনাদের চুপি চুপি বলি,'খাওয়ার লোভে...!'
কি অবাক হচ্ছেন? তাহলে খুলেই বলি।
গত পরশু অফিসে বিক্রম হঠাৎ বলে বসলো,"আমি পরশু আসছি না অনিরুদ্ধ….।"
আমি কারণ জানতেই বললো,"আমার পিসেমশাইয়ের ওইদিন শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান,সারাদিন ওখানে...!"
শুনেই চোখ কান বুজে লজ্জার মাথা খেয়ে বলে বসলাম,"তাহলে তো জোর খাওয়া দাওয়া.…!"
"তা হবে..! পিসেমশাই মাছ খেতে খুব ভালোবাসতেন, তাই তিন চার রকম মাছের পদ হবে শুনেছি..."
বিক্রমের কথা শুনে আমার ভিতরের পেটুকেশ্বর জেগে উঠলো। প্রস্তাবটা নির্লজ্জের মত দিয়েই বসলাম ওকে,"তাহলে কি পরশু যাবো বিকুভাই..?"
"আসতে পারিস,আপত্তি নেই। তবে একটু পাড়া গাঁ..! মানিয়ে নিতে হবে কিন্তু.."
"রসনার তৃপ্তির জন্য আমি নরকে যেতেও রাজী..! শুধু কিভাবে যেতে হবে বল..?"
"আমাদের অফিসের সামনে দিয়েই কাটোয়াগামী বাসে উঠে কট্রাক্টরকে বলবি,জয়পুর মোড় যাবো। ব্যাস...! বাস থেকে নেমে দেখবি, সামনেই একটা আঁকাবাঁকা পথ সোজা চলে গেছে পিসিদের গ্রামের দিকে ...। মিনিট কুড়ি ওই পথ ধরে হাঁটলেই গ্রামটা। নামটাও বেশ মিষ্টি...'সোনাইমুড়ি'। পথ শেষে একটা দুর্গামন্দির পড়বে। ওখানে কাউকে বলবি,রণিদের বাড়ি যাবো। ঠিক আছে.?"
এক নিঃশ্বাসে বলে গেল বিক্রম।
"কতক্ষন লাগবে যেতে?"
"ঘন্টা দেড়েক ...! অফিস থেকে টিফিন আওয়ারেই চলে যাবি। ফেরার লাস্ট বাস সাড়ে সাতটায়..! আরাম'সে বাড়ি ফিরতে পারবি..!"
বিক্রমের কথায় নিশ্চিন্ত হলাম আমি।
সেদিন থেকেই অপেক্ষা করে আজ হল সেই দিন, মানে আমার 'উদরপূর্তির মুহূর্তকথা' শুরু।
আঁধার নামছে নিঃশব্দে। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে,তাই দ্রুত পা চালালাম।
"অনিরুদ্ধ, যাও কোথায়..?"
আমার নাম ধরে আবার কে ডাকছে..? এখানে পরিচিত কেউ যে আছে,বাপের জন্মেও তো শুনিনি।
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি,এক বৃদ্ধ। লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আমায় ইশারা করে ডেকে চলেছেন।
আলোর অভাবে ঠিকমত মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। ঘাড়ে গলবন্ধ,মাথায় যে চুল নেই সেটা এই অনালোকিত প্রেক্ষাপটে অবশ্য বিলক্ষণ বুঝছি।
"আ... মা..য়... ড..ডা..কছেন ?"
আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম।
এটা আমার ছেলেবেলার দোষ। অযাচিত মুহূর্ত সামনে এলেই তোতলাতে থাকি।
"আর কে আছে এখানে,তুই আর আমি ছাড়া..?"
বৃদ্ধ মানুষটি খেঁকিয়ে উঠলেন।
কিন্তু আমার নাম উনি জানলেন কি করে ? শহর থেকে এত দূরে যেখানে আমার কোনো আত্মীয়স্বজনই নেই,সেখানে আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে..! বেশ অবাকই হলাম।
কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না। বলে বসলাম,"আপনি আমার নাম জানলেন কি করে..?"
"বানিপীঠ বিদ্যাপীঠে পড়তিস, তাই তো ? বড় হয়ে গেছিস, কিন্ত মুখটা একই রকম আছে..।"
এবার বৃদ্ধের গলাটা একটু মিনমিনে শোনালো।
যা ব্বাবা..! এতো দেখছি আদ্যোপান্ত জানে...!
ফাঁদে পড়ছি না তো? রহস্যটা জানতে হচ্ছে।
"হেঁয়ালি না করে বলুন তো আপনি কে..?"
বেশ জোরে ধমকের সুরে বললাম ওনাকে।
"কি রে ....! ক্লাস এইটে গোপাল স্যারের 'রাম ঠ্যাঙানি'টা মনে পড়ছে..?"
ওঁর কথা শুনে এক লহমায় মনের মধ্যে বিদ্যুতের ঝিলিক খেলে গেল। মনে পড়ে গেল বিদ্যালয় জীবনে সোনা রোদে মাখা রূপকথার মতো দিনগুলি। ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন গোপালবাবু। ছাত্র দরদী মানুষটি ক্লাসে যখন পড়ানো শুরু করতেন,আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতাম। অষ্টম শ্রেণীতে একবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম ক্লাসে। স্যার সঙ্গে সঙ্গে সেটা খেয়াল করে বলেছিলেন,"বলতো,আগের লাইনটা কি বললাম.?" সেদিন আমি আমতা আমতা করতেই জুটেছিল 'প্রবল মার'। পরে ডেকে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,"তোর কাছে এটা আশা করিনি..! আর কখনো এমন আনমনা হসনি, কেমন?" মার খাওয়ার সব দুঃখ চলে গিয়েছিল স্যারের স্নেহে। আজও মনে আছে..।
"স্যার....! আপনি?" স্মৃতির পাতা উল্টে গোপাল স্যারকে মনে পড়তেই শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে গেল।
"মনে পড়েছে বজ্জাত..? আমার এই গ্রামেই বাড়ি। অবসর নিয়ে এখানেই পাকাপাকি বাস।
তা তুই যাচ্ছিস কোথায়?"
"স্যার..., কলিগের পিসেমশাইয়ের শ্রাদ্ধ খেতে.... "
"কিন্তু এখন...? সেতো দুপুরেই সব ভুরিভোজ হয়ে গেছে...!"
"আমার অফিসে কাজ ছিল স্যার। তাই দেরী হয়ে গেল..."
"আসতেই হতো..?"
"না স্যার,মানে আমি একটু খেতে ভালোবাসি..."
স্যারকে সবটা খুলে বললাম আমি।
শুনে হঠাৎ উনি চুপ করে গেলেন।
পরিবেশটায় নীরবতা যেন হঠাৎ গ্রাস করলো। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে,সেই শব্দও শুনতে পাচ্ছি। আকাশে আধফালি চাঁদ থেকে জ্যোৎস্না ঝরে পড়ছে ধানক্ষেত ও গাছগুলোর উপর। চারিদিকে যেন মধ্যযুগের বাতাবরণ।
হঠাৎ একটা অস্ফুট কান্নার আওয়াজ কানে এলো। স্যারের কাছ থেকেই যে আসছে বুঝতে পারলাম। বয়সের ভারে ন্যুব্জ স্যারের থেকে একটু দ্রুতই হাঁটছি। ফলে ওনার সঙ্গে আমার দূরত্ব বেড়ে গেছে বেশ কিছুটা। থামলাম আমি। স্যারের পাশে গিয়ে বললাম,"আপনি কাঁদছেন স্যার..?"
"ভাবছি,সবাই খাওয়া দাওয়া করতেই আসে শ্রাদ্ধে। যে মানুষটা চলে গেল,তাকে ঘিরে কোনো আফসোস কারোর চোখে মুখে দেখি না। ভাবলাম তুই অন্যরকম..! কিন্তু তুইও অনিরুদ্ধ...?"
শুনে একটু দুঃখই হলো। পরক্ষনেই মনে পড়লো বিক্রমের কথাটা,"তিন চার রকমের মাছের পদ হবে শুনেছি...."
দুঃখ তৎক্ষনাৎ ভুলে গিয়ে হাসি মুখে বললাম,"স্যার...! 'জন্মিলে মরিতে হবে/অমর কে কোথা কবে..'। খাওয়া'র সঙ্গে তাই এই ছোট্ট জীবনে আপোষ করি না..."
"নিজেকে মৃত মানুষটার জায়গায় বসা জানোয়ার..! তখন বেদনাটা টের পাবি। যে লোকটা সারাজীবন সংসারটার জন্য প্রাণপাত করলো,সে যেন বয়সের ভারে মরে গিয়ে অপরাধ করেছে...! সবাই চব্যচোষ্য গিলছে,আর রান্নার সুনাম করে যাচ্ছে..! যেন মরে গিয়ে ওদের খাবার সুবিধা করে দিয়েছে..! ছিঃ..!"
স্যার প্রচন্ড রেগে গিয়েছেন বুঝতে পারছি।স্কুল লাইফের কথা মনে পড়ে গেল।
"স্যার, আপনি উত্তেজিত হবেন না,আমি ওইভাবে বলতে চাই নি...!"
শান্ত করার চেষ্টা করলাম স্যারকে।
"যাঃ....যাঃ.. , পেট পুরে খেয়ে আয়..!" ওঁর কথায় রাগের সঙ্গে যন্ত্রনাটাও অনুভব করছি ।
স্যারের উত্তেজনা প্রশমিত হচ্ছে না দেখে আমি হাঁটার গতি একটু বাড়িয়ে দিলাম।
চন্দ্রালোকে সাবালক সোনালী ধানের উপর বায়ুস্রোত নদীর তরঙ্গের মত লাগছে। এই দৃশ্য পরিহার করবে,এই দুঃসাহস পৃথিবীতে আর কারোর আছে বলে আমার জানা নেই। রূপকথার রাজ্যে চলে এসেছি যেন…!
এরই মাঝে হটাৎ কানে এলো স্যারের গুরুগম্ভীর, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে আবৃত্তি। শুনেই থমকে গেলাম। গায়ে কাঁটা দিচ্ছে..! বিশ্বকবির "মৃত্যুর পরে" কবিতাটি ওনার কণ্ঠে ছাত্রজীবনেও শুনেছি দু একবার। কিন্তু আজকের অনুভূতিটা অন্যরকম। হাওয়ায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ ওনার কন্ঠ...
"আজিকে হয়েছে শান্তি ,
জীবনের ভুলভ্রান্তি
সব গেছে চুকে ।
রাত্রিদিন ধুক্ধুক্
তরঙ্গিত দুঃখসুখ
থামিয়াছে বুকে ।
যত কিছু ভালোমন্দ
যত কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব
কিছু আর নাই ।
বলো শান্তি , বলো শান্তি ,
দেহ-সাথে সব ক্লান্তি
হয়ে যাক ছাই …."
কবিতার লাইনগুলো শুনতে শুনতে চোখে পড়লো সামনে দুর্গামন্দিরের আবছা আলো। বুঝলাম গন্তব্যস্থলে এসে পড়েছি প্রায়।
প্রথম স্তবক শোনার পরেই অদ্ভুত নীরবতা নেমে এলো।
"স্যার..,থেমে গেলেন কেন..?"
বলে পিছনে তাকাতেই চমকে উঠলাম,"স্যার আর নেই..!"
বুকের মধ্য দিয়ে একটা হাড় হিম করা স্রোত বয়ে গেল। ভয়ে গায়ের সমস্ত লোম খাড়া হয়ে যাচ্ছে...! খালি ভাবছি,স্যার হঠাৎ কিভাবে উধাও হয়ে গেলেন..? প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। গলা শুকিয়ে আসছে।
পিছনে হঠাৎ একটা হাতের স্পর্শ পেলাম।
"কে...?" চিৎকার করে উঠলাম আমি।
"আমি রনি...। কাকু পাঠিয়েছে আমাকে।আমার সঙ্গে আসুন...."
আমার সংবিত ফিরে এলো। তখনো ঘাড় ঘুরিয়ে গোপাল স্যারকে খুঁজছি..!
"কি ভাবছেন? চলুন,সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে.."
রনির কথায় সম্মতি জানিয়ে ওর সঙ্গে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললুম।
শ্রাদ্ধ বাড়িতে মানে বিক্রমের পিসির বাড়িতে পৌঁছে দেখি,সবাই হাসিমুখে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। বুঝতে পারলাম,আমার এখানে আসার কারণটা হয়তো বাড়িতে ভালোমতোই আলোচিত হয়েছে।
একটু লজ্জাই পেলাম। ঘড়িতে তখন পৌনে সাতটা। বুঝলাম,স্যারের সঙ্গে ধীরে ধীরে আসতে গিয়ে কুড়ি মিনিটের পথটা প্রায় পৌনে এক ঘন্টায় এসেছি।
"কি রে..? এত দেরী হলো?" বিক্রম প্রশ্ন করতেই ভাবলাম,স্যারের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টা বললে আমার সাড়ে সাতটার লাস্ট বাসটা তো মিস হবেই,বাড়িতেও গিন্নির সঙ্গে প্রবল অশান্তি কেউ আটকাতে পারবে না।
বেমালুম চেপে গিয়ে বললাম,"আসলে বাসটা খুব লেটে পৌঁছল বুঝলি..! তাই দেরী হয়ে গেল। আমাকে ফিরতে হবে ভাই। তুই ব্যবস্থা কর।"
ডাইনিং টেবিলে নত মস্তকে বসে শুধুই গোপাল স্যারের কথা ভাবছি। হঠাৎ মাথায় একটা নরম হাতের স্পর্শে হুঁশ ফিরলো। মুখ তুলে দেখি,'গোপাল স্যার...!'
আমি হতভম্বের মত ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। খাওয়া তখন মাথায় উঠে গেছে।এখানে উনি..? কিভাবে..?
"খেয়ে নাও বাবা...!" পরম স্নেহে স্যার বললেন। ওঁর দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলাম।পলক পড়ছে না আমার। এ কোথায় এসে পড়লাম...! আর, স্যারই বা হঠাৎ 'তুমি' বলছেন কেন আমাকে...? সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার..! যাহোক করে গিলে কুটে এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচি..!
আমি গোগ্রাসে খেতে শুরু করে দিলাম। ডাল আর পোস্ত দিয়ে যাহোক করে অল্প কিছু ভাত খেয়ে উঠে পড়লাম আমি।
"কি রে মাছের পদগুলো কে খাবে..?"
পাশে বিক্রম বসে আছে টেরই পাই নি।
"পেট খারাপ। খাবো না রে...। সাড়ে সাতটার বাসটা আমায় ধরতেই হবে। নাহলে গিন্নি.."
"চিন্তা করবে,না রাগ করবে..? কোনটা.?"
বিক্রমের রসিকতাটা এই পরিবেশে হজম হলো না। গম্ভীর মুখে বললাম, "আসলে ছেলে মামার বাড়ি গেছে। বাড়িতে ও একা। আমি ফিরবোই বলেছি ভাই.."
"ঠিক আছে,তোকে জোর করবো না। তবে চিন্তা করিস না। রনি তোকে বাইকে পৌঁছে দিয়ে আসবে জয়পুর মোড় অব্দি।"
বিক্রমের কথায় আশ্বস্ত হয়ে উঠে পড়লাম আমি।
বাড়ির সদর দরজার বাইরে রনির স্টার্ট দেওয়া বাইকে উঠতে যাবো,হঠাৎ পিছন থেকে শুনলাম,"বাবা দাঁড়াও...!"
দেখে আবার একবার বিস্মিত হলাম। গোপাল স্যার ডাকছেন...!
"এই প্যাকেটটা নিয়ে যাও। কিছুই তো খেলে না। বাড়িতে তুমি আর বৌমা মিলে খেয়ে নিও।কেমন..?"
স্থবির হয়ে রোবটের মতো ওনার কাছ থেকে খাবার প্যাকেটটা নিয়ে নিলাম। আমি পিছনে বসতেই রনি বাইক চালাতে শুরু করলো।
পরের দিন সকাল সকাল অফিস গেছি। সারারাত ঘুমাতে পারি নি। কিছুতেই অঙ্ক মেলাতে পারছিলাম না। খালি ভাবছি একই মানুষের এত অল্প সময়ের মধ্যে দুরকম আচরণ কি করে হতে পারে..?
নিজের ডেস্কে বসে কম্পিউটার স্ক্রিনে চোখ রেখে শুধুই ভেবে চলেছি। কিছুতেই উত্তর খুঁজে পাচ্ছি না। হঠাৎ কানে এলো বিক্রমের গলা, " কাল কখন পৌঁছলি রে..? গিন্নি বকে নি তো? শ্রাদ্ধ বাড়ির মাছের পদগুলো খেয়েছিস?"
"তোকে সব প্রশ্নের উত্তর দেব পরে। আগে তুই আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দে.."
আমি একটু রহস্য করেই বললাম।
"বল...!" আমার প্রশ্ন শুনে একটু থতমত খেয়েই বললো বিক্রম।
"তবে বন্ধু হিসেবে প্রথমেই আমি তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।" আমতা আমতা করে বললাম আমি।
"ক্ষমা চাইছিস..? হেতুটা শুনি..?"
" কাল পিসেমশাইয়ের প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে যে শ্রদ্ধা জানাবো.., সেটাই পরিস্থিতির কারণেই ভুলে গেছি রে...! যে মানুষটার শ্রাদ্ধে লোভে পড়ে খেতে গেলাম,তাকেই দেখা হলো না। ছি..,ছি..ছি...! কাল থেকে অনুতাপে মরে যাচ্ছি ভাই...।"
"আরে ছাড়...! ভনিতা না করে কি প্রশ্ন করবি বলছিলি..?"
"তাহলে তোকে সবটা খুলে বলতে হয়...."
আমি বাসে নামার পর গোপাল স্যারের সঙ্গে দেখা হওয়া থেকে শ্রাদ্ধ বাড়িতে ওঁর আচরণের পরিবর্তন, সবটা বিক্রমকে বিস্তারিত বললাম।
শুনে আমার সহকর্মী বন্ধু হেসেই অস্থির..!
"তুই হাসছিস....!" আমার একটু রাগই হলো বিক্রমের উপর।
"তোর সঙ্গে গোপাল স্যার মানে আমার পিসেমশাইয়ের কথা হয়েছে শুনে হাসি পাচ্ছে ভাই...!"
"আমি তোকে মিথ্যা বলছি...?"
"সত্যিই যে বলছিস না সেটা ভাবার নিশ্চয়ই কারণ আছে অনিরুদ্ধ।"
বলে পকেট থেকে মুঠোফোনটা বের করে সামনে ধরলো বিক্রম।
আমি দেখেই নির্বাক হয়ে গেলাম। চোখের পলক পড়ছে না।
স্ক্রিনে গোপাল স্যারের প্রতিকৃতি। চন্দনের ফোঁটা দেওয়া সারা মুখ। এ আমি কি দেখছি?"
"কি বলছিস বিক্রম..? স্যার মারা গেছেন? কবে?"
"আরে....তোর গোপাল স্যারেরই তো কাল শ্রাদ্ধ ছিল..!"
"হেঁয়ালি করবি না বিক্রম...! তাহলে তোদের বাড়িতে উনি কে ছিলেন যিনি আমাকে..."
"আরে ওটা পিসেমশাইয়ের যমজ ভাই..! তোর সঙ্গে ওঁর দেখা হয়েছে। বুঝলি বন্ধু..। বলে কিনা...."
বিক্রম বলে যেতে লাগলো। বুঝলাম,আমার একটা কথাও বিশ্বাস করে নি ও।
এর পরের অক্ষরগুলো আর কানে ঢুকছিল না আমার। বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল স্যারের আকুতিটা, "নিজেকে মৃত মানুষটার জায়গায় বসা জানোয়ার..! তখন বেদনাটা টের পাবি..."
ওই ঘটনার পরে কাউকে না বলে অফিস থেকে চুপি চুপি জয়পুর মোড়ে নেমে আঁধারে পথ হেঁটেছি বহুবার। কিন্তু স্যারের দেখা পাই নি।
যদি দেখা হতো, তাহলে ওঁর পা দুটো জড়িয়ে ধরে একবার বলতাম,"দহনে আমি রোজ পুড়ছি স্যার,পুড়ে ছাই হচ্ছি....। বিশ্বাস করুন...!"
সাহিত্যিক পাভেল ঘোষ
পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত