টা টা ইস্কুল ~ অন্তরা দাঁ'র মুক্তগদ্য


অন্তরা দাঁ'র মুক্তগদ্য 
টা টা ইস্কুল

ইস্কুলে তখন বেশ নীচু ক্লাসে পড়ি,ভাদ্রমাস গেলেই আশ্বিনের গোঁড়ায় গোঁড়ায়, মুড়ি ভাজতো যে পিসি, তাকে দেখতাম প্রতিবার আমাদের দরদালানের উঁচু লাল শান-বাঁধানো রোয়াকে বসে,ঠাম্মির কাছে কী সব ফরমায়েশ নিচ্ছে। বুঝতে বাকি থাকতো না, অঢেল মুড়কি, চালভাজা আর হরেক রকম নাড়ুর, যথেচ্ছ মচ্ছবের দিন সমাগত। ইস্কুল যাচ্ছি বটে কিন্তু মনে বেশ ফুরফুরে ভাব,পথচলতি কচুডাঁটা, শরের ডগা, ইচ্ছেমতন ভেঙে চিবোচ্ছি। বাড়িতে জোর বৈঠক, মুদিখানার মাসকাবারি থেকে পুজোর বাজার, দেয়া-থোয়া,লোক-কুটুম, পুজোর ফল-পাকুড় থেকে দশকর্মা, মাছ ধরার জন্য জেলে-খরচ, নবমীর খাসির মাংস,দশমীর মিষ্টিমুখের যোগাড়ের ব্যবস্থার ফাঁকে ফাঁকে কখন যে টুক করে মহালয়া চলে আসতো, সে টেরই পেতাম না। ততদিনে দু চারখানা জামা পেয়ে গেছি, হিসেবে আছে আরও ক'খানা। বহুবার পরে পরে সেসব দেখার ইচ্ছেয় রাশ টেনে মা কোথায় যে লুকিয়ে রাখতো, খুঁজে পাওয়া যেতো না। পায়ের চেয়ে বড় মাপের জুতো জুটতো, পা-ঢাকা সে জুতোর সামনের দিকে পুরনো ন্যাকড়া গুঁজে পায়ের মাপে আনার চেষ্টা করলেও, সে উপহার দিতো ফোস্কা, এবং ঠাকুর দেখার সন্ধ্যেয় অনিবার্য ছিলো জুতো হাতে করে খালি পায়ে প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা। সে এক ভারী লজ্জা লজ্জা ব্যাপার! সব্বাই জিজ্ঞেস করতো 'পায়ে ফোস্কা পড়েছে বুঝি?' আমি আরও জোরে চেপে ধরতাম জুতো দু-খানা, বুকের কাছে প্রায়। 
মহালয়ার দিন খার করতে নেই, মানে গরমজলে সাবান-কাচা। তাই দু'দিন আগে থেকে তোড়জোড় করে পর্দার কাপড়, বিছানার চাদর, টেবল-ক্লথ সব কেচেকুচে পরিষ্কার করা হতো,আর তার সাথেই পাল্লা দিয়ে কমে আসতো ইস্কুলে পিরিয়ডের সংখ্যা। রোজই কিছু না কিছু কারণে কমে আসছে ক্লাসের চাপ, দুপুরের পর রবিন-ব্লু আকাশে সাদা সাদা ক্যান্ডিফ্লস মেঘেরা যখন কিন্ডারগার্টেনের বাচ্চাদের মতো হুটোপুটি করতো, আমাদের ছুটি হয়ে যেত! সে যে কী আনন্দ! বাড়িতে তো জানেনা যে ছুটি, গুটগুট করে হাজির হতাম দুগ্গা আটচালায়, ঠাকুর গড়ছে যে! ছোট্ট ছোট্ট নারকেলের মালাই নিয়ে গিয়ে প্রায় ভিক্ষা করতাম, ---'ও দাদু, দাওনা এট্টু, এট্টুসখানি দাও।'
হাত নেড়ে তাড়িয়ে দিতেন পঞ্চাদাদু ---'যা, ভাগ এখান থেকে, যত্ত আপদ'। সে যতই কিনা আপদ বলুক দাঁড়িয়ে থাকতাম অনড়। শিল্পীর তুলির টানে ফুটে উঠতো মায়ের বরাভয় মূর্তি,তখন ইস্কুলের কথা আর মনে নেই! ব্যাগ-পত্তর মাটিতে নামিয়ে দিয়েছি কখন! দু'হাতে ধ'রে আছি বাখারির বেড়া,কচি শরীর আটকে আছে যথাসম্ভব মন্ডপের চারদিকের ব্যারিকেটের ছিটেবেড়ায়। আমি একা নই, পাশের বাড়ি নটে, কেলো, বুঁচকি থেকে ওপাড়ার মান্তু, খোকন, টুসি সব্বাই। তখন তো প্রাইমারি ইস্কুলে ড্রেসকোড ছিলোনা, যে যা খুশি পরে যেতাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলেই হতো, যদিও ইস্কুলফেরত তাতে ধুলোকাদা মাখিয়ে নিয়ে আসতাম! মা চটাস করে পিঠে এক ঘা দিয়ে বলতো ---'বাঁদর, পাজি, রোজ নোংরা করে নিয়ে আসবে '! বাবা শুধু প্রশ্রয় দিয়ে বলতো 'প্রাইমারি মানেই তো তাই, যেখানে প্রায়ই মারামারি হয় ', কাঁদতে গিয়েও হেসে ফেলতাম। বইপত্তর ছাঁদা বেঁধে তুলে ফেলতাম তখন। উঁচুক্লাসের দাদা দিদিরা মানে পিসি, জেঠামশায়দের ছেলে-পিলেরা লক্ষীপুজোর পর টিউশন গেলেও আমাদে, ফ্রি-প্রাইমারি ইস্কুলে পড়া ছানাদের, ভাইফোঁটা অবধি দেদার ছুটি! বিজয়ার পর আত্মীয়-স্বজনের আসা-যাওয়ার বেশ পাট ছিলো যে আমাদের ছোটবেলায়। আর পোস্টকার্ডে লেখা বিজয়ার চিঠি। হালকা-নীল। ইনল্যান্ডে লেখা চিঠি মানে সে বেশ অভিজাত ব্যাপার। পঞ্চমীর দিন ইস্কুল হয়ে ছুটি পড়তো, মানে এক পিরিয়ড, আরে রোল-কল হলেই, মাষ্টারমশাই দিদিমনিরা জাবদা খাতায় কী সব সইটই করে হাসিমুখে বলতেন ---'ঘন্টা পড়লেই সব ছুটি, বুঝেছ ছেলেমেয়েরা? দুগ্গাপুজো হয়ে গেলে পড়তে-টড়তে বোসো বাপধনেরা, পাট চুকিয়ে দিও না, ইস্কুল খুললেই কিন্তু পরীক্ষা, ঠাকুর দেখো সব ভালো করে '!
আর পরীক্ষা? সে মাথায় উঠতো, ঘন্টা বাজলেই দে দৌড়। ছুটিইইইইইইইইই! সেইসব ছুটির ঘন্টা বাজা দিনে বুকের ভেতর কেমন যেন করতো! কে যেন বুকের ভেতরে শীত-সকালের ঠান্ডা খেজুর-রস ঢেলে দিতো সুড়সুড় করে এমনই মনে হত। শিরশিরানি সেই শৈশব কোথায় গেল আমাদের? 
কেবল ছুটি হওয়ার পর যখন ফাঁকা হয়ে আসতো স্কুল-কম্পাউন্ড, মাষ্টারমশাইরা একে একে বেরিয়ে যেতেন, ঘরে ঘরে তালা পড়ে যেত, পাশের মাঠে তখন হয়তো দাঁড়িয়ে আছি বড়রাস্তার ওপারে, হঠাৎ মনে হতো গেটের বাঁ-দিকের অশত্থ গাছটা যেন নড়েচড়ে উঠলো, ইস্কুলবাড়িটা যেন সজল চোখে তাকিয়ে থাকতো।আমাদের দিকে। আমাদের চলে যাওয়ার দিকে। একমাস আর কেউ আসবে না সেখানে, হইহই করবে না, সকাল-দুপুর, গাছেরা দীর্ঘশ্বাসে পাতা ঝরাবে শুধু ! 
কালিপুজোর আগে আগেই তো উত্তর থেকে হাওয়া দিতো, বড়রা বলতেন ---'মা জলে পড়লেই উত্তুরে হাওয়া টানে।' ইস্কুলটার পাশ দিয়ে যেতে কতদিন দেখেছি গেটের ফাঁক দিয়ে খাঁ খাঁ করছে চত্বর, ঘুঘু ডাকছে, সড়সড় করে দৌড়ে যাচ্ছে গিরগিটি। তুঁতরঙ করা গ্রিলের ঠান্ডা গেটে হাত বুলিয়ে নিরুচ্চারে বলতাম 'টা টা ইস্কুল! '
আমার মনে হতো এত আলো, প্যান্ডেল, নতুন জামা-কাপড়, আনন্দ হইচই ছেড়ে কেউ আর এ'কদিন এই ধার মাড়াবে না ! বড্ড একা লাগবে যে ওর। ইস্কুলবাড়িটার জন্য খুব কষ্ট হতো আমার, আহা! ওরও তো পুজো, একা একা থাকতে দুঃখ হবে তো ওর। ভারী মনখারাপ হতো আমার... টা টা ইস্কুল মুখে বলতাম অস্ফুটে, মনে মনে বলতাম, ঝেঁপে কান্না আসতো... 

গদ্যকার অন্তরা দাঁ
কাঁটাপুকুর উত্তর, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ


 




 


0 Comments