নবজন্ম
"এ বাড়িতে আমি আর থাকবো না। নতুন ফ্ল্যাট কেনো" রান্নাঘর থেকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিল এষা।বাথরুম থেকে বেরিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গায়ে ডিও স্প্রে করছিল সাগ্নিক।গুগুলটা স্কুলে গেছে। ছুটির সময় ওর ঠাকুরদা যাবে আনতে।ওকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসা,নিয়ে আসার দায়িত্ব খুব আনন্দ সহকারে করে থাকেন ওর ঠাকুরদা শিবনাথ বাবু।এষা ছেলেকে স্কুল বাস ঠিক করে দিতে চেয়েছিল।এষার প্রবল আপত্তি কে আমল দেননি শিবনাথ বাবু।
"কি হল শুনতে পেয়েছো আমার কথা?" এবার গলার জোর একটু বাড়ল।
"হ্যাঁ শুনেছি।"এখুনি উত্তর না দিলে এষার গলা ষাট ডেসিবেল ছাড়িয়ে যাবে।"ফ্ল্যাট কেনা বললেই কেনা যায় না।একটু সময় লাগবে।"একইভাবে কথাগুলো ছুঁড়ে দিল সাগ্নিক।শিবনাথ বসুর একমাত্র সন্তান সে।একটা সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে শিক্ষকতা করে।সরকারি অফিসে কেরানীপদে চাকরি করে অনেক কষ্ট করেই ছেলেকে বড় করেছেন,মানুষ করেছেন শিবনাথ বাবু।ছেলে স্কুলে চাকরিটা পাবার পর হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন শিবনাথ ও তাঁর স্ত্রী অনিমাদেবী,এ সংসারের সব দায়িত্ব যিনি নিষ্ঠার সাথে পালন করেছেন।ঐ সামান্য রোজগারের মধ্যেই কি সুন্দর সংসার চালিয়েছেন।কোনদিন কাউকে অভাব টের পেতে দেননি। শিবনাথের মাঝেমাঝেই মনে হত এটাও একপ্রকার শিল্প।শিল্পীর তুলিতে তঁর সংসার এত উজ্জ্বল।ঝনঝন করে হাত থেকে বাসন পড়ার শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সাগ্নিক।এখন কিছুক্ষণ ধরে চলবে এই বাজনা।এষার সব রাগ গিয়ে পড়েছে বাসনের ওপর।চাকরি পাবার পর সে এষাকে একটা দামি স্মার্ট ফোন কিনে দিয়েছিল।সেখান থেকেই ফেসবুকে পাতানো বন্ধু সংখ্যা বাড়তে বাড়তে এখন তা হিসেবের বাইরে। সেই ফেসবুকের বন্ধুরা কেউ তাদের শ্বশুর শাশুড়ির সাথে এক ছাদের তলায়,এত পুরোনো বাড়িতে থাকে না।এখনও পর্যন্ত এষা তার শ্বশুর শাশুড়ির সাথে এক ছাদের তলায় আছে এ নিয়ে অনেক টিপ্পনি শুনতে হয় তাকে। তার নাকি কোনো স্ট্যাটাস থাকছে না।সে কারণেই তার এই জেদ বা চাহিদা নতুন ফ্ল্যাটে সে সাগ্নিক আর তার ছেলেকে নিয়ে থাকবে।শিবনাথ অনিমার প্রানভ্রোমরা গুগুল কিন্তু এসবের ধারে নেই।তার সাফ জবাব দাদু ঠাকুম না গেলে সেও নতুন ফ্ল্যাটে যাবেনা।গুগুল দাদুর হাত ধরে হৈ হৈ করে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখে তার মা রাগে গরগর করছে।
"দিন দিন অসভ্য হোচ্ছ।এভাবে হৈ হৈ করে কেউ বাড়ি ঢোকে?কোথা থেকে শিখছো এসব?কে শেখাচ্ছে? "শেষের বাঁকা কথাটা যে তার শ্বশুর শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলা সেটা শিবনাথ অনিমার গা সওয়া হয়ে গেছে বছর পাঁচেক ধরে।ছেলের হাত ধরে টানতে টানতে দোতলায় যেতে যেতে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরে একবার চোখ বুলিয়ে নিল।নাঃ,সাগ্নিক ঘরে নেই।নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছেন নবাবপুত্র।দুমদাম শব্দে দোতলায় উঠে নিজের ঘরে ঢুকে পাখাটা চালিয়ে ফোনটা নিয়ে চ্যাটে মেতে উঠলো সে। গুগুল এই অপেক্ষায় ছিল।এটাই রোজের ঘটনা। মা ব্যস্ত হয়ে পড়তেই গুগুল এক ছুটে দাদু ঠাকুমার কাছে।স্কুলের কত কথা জমে আছে তার। যতক্ষণ সে না বলছে আর দাদু ঠাকুমা না শুনছে কারুর যেন শান্তি হয় না।অনিমাদেবী গুগুলের কাছ থেকে নিত্য নতুন মজার ঘটনা শুনতে শুনতেই তাকে স্নান করিয়ে, খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে বালিশে হেলান দিয়ে মহাভারতটা খুললেন। এটা ওনার চিরকালের অভ্যাস। দুপুরে না ঘুমিয়ে বই পড়া।ছেলেকেও ছোট বেলায় গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। নাতিটাও প্রতিদিন গল্প না শুনলে ঘুমাতেই চায় না।মহাভারতের যুদ্ধের গল্প হাঁ করে শোনে সে। ধমাস করে দরজা বন্ধ হবার শব্দে বাইরে তাকাতেই অনিমা দেবী দেখতে পেলেন একটা বড় চারচাকা গাড়িতে এষা উঠে হুস করে বেরিয়ে গেল। বৌমার আচরণ তাঁর কদিন ধরেই খুব খারাপ লাগছে। কি যে পাল্লায় পড়ল মেয়েটা। কারুর কথা শোনে না। ওনাদের মেয়ে ছিল না বলে খুব কষ্ট পেতেন।এষাকে পেয়ে সে কষ্ট একদম ভুলে গিয়েছিলেন।কেন যে এষা ওনাদের আর সহ্য করতে পারছে না শিবনাথ অনিমা নিজেদের মধ্যে মাঝেমাঝেই আলোচনা করেন।কষ্ট পান।গুগুল ঘুম থেকে উঠে দাদুর হাত ধরে মাঠে খেলতে গিয়েছিল। ফিরে এসে দাদুর কাছে পড়তে বসেছে। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো।"হ্যালো,থানা থেকে বলছি "শুনেই চমকে উঠলেন শিবনাথ।কাঁপা গলায় বললেন,"বলুন"।
"আজ বিকেলে বাইপাসের কাছে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে।আহত একজন মহিলার মোবাইল থেকে আপনাদের এই নম্বর টা পেলাম।আপনারা থানায় আসুন।"
ওপাশের ফোন রেখে দেওয়ার আওয়াজ পেলেন।সাথে সাথে সাগ্নিক কে ফোন করলেন শিবনাথ।যতটা সম্ভব অনিমা আর গুগুল কে এড়িয়ে ছেলেকে সংক্ষেপে ঘটনাটি বলে থানায় আসতে বললেন। নিজেও হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন। পথেই দেখা উদভ্রান্তের মতো সাগ্নিকের সাথে।থানা থেকে জানলেন হাসপাতালের ঠিকানা।রাস্তায় যেতে যেতে ছেলের কাছেই বিস্তারিত সব জানলেন।বন্ধু দের সাথে আকন্ঠ মদ্যপান করে এষা।ড্রাইভার ছেলেটিও মদ্যপান করে গাড়ি চালাচ্ছিল।খুব জোরে গাড়ি ছুটছিল।বেসামাল হয়ে ডিভাইডারে ধাক্কা খেয়ে উল্টে যায় গাড়িটি।আর যেন শুনতে পাচ্ছেন না তিনি।
"এষার ডান হতটা বোধহয় বাদ যাবে" কান্নায় ভেঙে পড়ে সাগ্নিক। খুব ভেঙে পড়লেন শিবনাথ ও।মেয়েটাকে তাঁর ছেলেই পছন্দ করে বিয়ে করেছিল।কোনো আপত্তি করেন নি শিবনাথ অনিমা।বরং খুব খুশি হয়েছিলেন এষাকে পেয়ে। খুব ভালোভাবে ভালোবেসে গুছিয়ে সংসার করছিল সে।শিবনাথ এম এ পড়াতে চেয়েছিলেন তাকে।কিন্তু এষার পড়াশুনার বা চাকরি করার কোনও ইচ্ছে ছিল না।ছেলেটা বৌমার জন্য একটা দামি স্মার্ট ফোন কিনে আনলো। তারপর থেকেই একটু একটু করে পাল্টে যেতে থাকলো এষা।
"এষা বোসের বাড়ির কেউ এখানে আছেন?" কর্কশ আওয়াজে চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল।ছুটে গেলেন শব্দের উৎসস্হলে।একজন নার্স ডাকছেন।"আ- আমি এষা বোসের বাবা।" কোনোমতে বললেন তিনি। "এষা বোসের রক্ত লাগবে।রাতের মধ্যে জোগাড় করতে হবে।" কথাটা জানিয়ে চলে গেলেন নার্স। দিশেহারা সাগ্নিক শূন্য দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে।বিহ্বল হয়ে পড়লেন শিবনাথ।তারপরেই নিজেকে শান্ত করে ছেলের হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন। "আমি দেব রক্ত।গুগুল হবার সময় জেনেছিলাম এষা আর আমার রক্তের গ্রুপ এক।" এক নিমেষে কথাটা বললেন তিনি। রাতেই রক্ত দিয়ে সারারাত হাসপাতালের নীচে বসার ঘরে কাটিয়ে দিলেন বাবা ছেলে।এর মধ্যেই অনিমাকে ফোন করে সংক্ষেপে ঘটনাটা জানিয়ে শান্ত করেছেন তিনি।ঘটনাটা শুনে ডুকরে কেঁদে চলেছে অনিমা।গুগুল কিছু আন্দাজ করে একদম চুপ হয়ে গেছে।শূন্য দৃষ্টিতে সাগ্নিক দেখল, যে বাবাকে তারা একা করে নতুন ফ্ল্যাটে শান্তিতে থাকার ভাবনায় মেতে উঠেছিল আজ থেকে সেই বাবার রক্ত বইবে এষার শরীরে। বাবার কোলে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল সাগ্নিক।দীর্ঘ পনেরো দিন যমে মানুষে লড়াই করে এষা বাড়ি ফিরে এলো শ্বশুর শাশুড়ির সাথে। ডানহাত কনুইয়ের ওপর থেকে কাটা।বাড়ি ফেরার পর থেকেই গুগুল একদম মায়ের কাছে আসেনি।এষা অনেক খুঁজেছে ছেলেকে।ছোট্ট গুগুল যেন এই কদিনেই কত বড় হয়ে গেছে। গোঁজ হয়ে বই নিয়ে বসে নিজের পড়া নিজেই করছে।অনিমা দেবীর যত্নে সেবায় ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছে এষা।অনিমা দেবী এষাকে খাইয়ে, চুল বেঁধে দিয়ে, মুখে পরিষ্কার করে ক্রিম মাখিয়ে ছোট্ট মেয়ের মত কপালে চুমু খেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবেন ঠিক তখনই এষা ডাকলো--"মা" পাঁচ বছর পর এই প্রথম এষার মুখে মা ডাক শুনে অভিভূত অনিমাদেবী পিছন ফিরে দেখলেন এষা অঝোরে কাঁদছে।আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে তার পাশে বসে মাথায় হাত রেখে অনিমাদেবী বললেন,"তোদের নতুন ফ্ল্যাটে আমাদের নিয়ে যাস।"মা কে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো এষা। বলল--"আমার স্বর্গ ছেড়ে কোনও নরকে আমি যাব না।আমাকে তোমরা ক্ষমা কোরো। ঠাকুমাকে খুঁজতে গিয়ে গুগুল দরজার বাইরে থেকে নতুন করে খুঁজে পেল তার মাকে,ঠিক যেমনটা সে চাইতো।ঠাকুমার কোলে মাথা রেখে খুব হেসেহেসে গল্প করছে দুজনে। বিকেলের রক্তাভ সূর্যের আলোয় তার মায়ের মুখটা রক্তিম হয়ে উঠেছে।অপূর্ব সুন্দরী লাগছে তার মাকে। অতি কাঙ্ক্ষিত দৃশ্যটা মনের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রেখে একটু হেসে সে দৌড়ে গেল বাড়ির ছাদে।প্রশস্ত ছাদটা তার বড় প্রিয়।
1 Comments
এক কথায় অসাধারণ।
উত্তরমুছুনআরো লেখা আগামী দিনে পড়তে পারলে খুশি হবো।