শাস্তি
নিজেকে একটা ঘেরাটোপের মধ্যে আটকে রেখেছে তিতি।কি বলবে সে নিজের সম্বন্ধে!-কিই বা বলার আছে!তাই ঠিকানা,পরিচয় কিছুই জানা যায় না তার। কেবল তার নামটুকুই তাঁরা জেনেছেন মেয়েটির কাছ থেকে।অবশ্য ইরাদেবী বা ব্রতীনবাবু তেমন মানুষ নন,তাঁরাও বুঝেছেন সময় দিতে হবে তিতিকে,-সময়।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও ব্রতীনবাবু ও মিঃ চোপরা হাঁটতে বেরিয়ে ছিলেন। হঠাৎ একটা গোঙানির আওয়াজ শুনে দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন।খাদের দিকে ঝুঁকে দেখলেন খানিকটা নীচে ঝোপের মধ্যে একটি মেয়ে আটকে আছে।তাড়াতাড়ি স্থানীয় লোকেদের জড়ো করে তাকে তোলা হলো। শীতে আর পাথরের আঘাতে মেয়েটির অবস্থা বেশ সঙ্গীন।থানাতে ফোন করে সব জানালে,থানা-ইনচার্জ মিঃ তামাং এসে পড়লেন। তাঁর সাথে কথা বলে ব্রতীনবাবুই নিয়ে এলেন মেয়েটিকে তাঁর বাড়িতে।
স্ত্রী ইরাকে নিয়ে ব্রতীনবাবু থাকেন রিশ্যপ নামের এই ছোট্ট পাহাড় ঘেরা নির্জন সুন্দর যায়গাটিতে। বাগডোগরা থেকে রিশ্যপ প্রায় তিন ঘন্টার পথ। রাস্তার দুধারে দেবদারুর জংগল। তা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই মিলিটারি ব্যারাকস। এখানের ছোট্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার হয়ে এসেছিলেন তিনি,এক যুগ আগে। ভালোবেসে ফেলেন তিনি জায়গা আর এখানের সরল,সহজ মানুষদের। তাই চাকরি থেকে অবসর নিলেও এখানের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি। এখানের মানুষজনও তাঁকে যেমন সম্মান করে,তেমনই ভালোবাসে। আর অসুখ-বিসুখ এ তো তিনিই ভরসা। কারণ এখানে এসে কোন ডাক্তারই বেশীদিন থাকতে চায় না।
তিতি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলো। ঘরের টুকিটাকি কাজে হাত লাগাতেও আরম্ভ করলো। ইরাদেবীও তাতে কিছু বারণ করেন না। তাঁরা অপেক্ষা করছেন তিতি নিজে থেকে কবে বলবে তার জীবন কাহিনী। এদিকে চেহারায় স্পষ্ট মাতৃত্বের ছাপ ফুটে উঠছে তিতির। ইরাদেবী তাকে সাবধানে রাখেন,ভারী কাজ করতে দেননা।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় ইরাদেবীকে জড়িয়ে ধরে তিতি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ইরাদেবী তার মাথায় হাত বুলিয়ে অভয় দিলেন। বললেন-“আমাকে সব খুলে বল মা, তবেই হালকা হবি। তিতি বলতে শুরু করে তার ফেলে আসা অতীতের কথা।
ট্রেন-এক্সিডেন্টে বাবা-মা কে হারায় তিতি। তখন সে ক্লাস নাইনের ছাত্রী। কাকা-কাকিমা আর ছোট ভাইয়ের আদর,ভালোবাসায় ধীরে ধীরে শোক কাটিয়ে উঠতে থাকে সে। স্কুলের গন্ডী ছেড়ে কলেজে ভর্তি হয়। জীবন যখন স্বাভাবিক ছন্দে চলছে তখন তার আলাপ হয় অয়নের সাথে। কাকিমার বান্ধবীর ছেলে অয়ন তখন চাকরী নিয়ে এই শহরে। অয়নের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে তার। একদিন কাকা-কাকীমার অনুপস্থিতিতে তারা বেসামাল হয়ে পড়ে। তার অন্তঃসত্বা হবার খবরে অয়ন জোর করে তাকে লুকিয়ে ভ্রুণ নষ্ট করার জন্য। কিন্ত তার আগেই কাকিমা টের পেয়ে গেলেন। কাকিমাই জোর করলেন বিয়েটা করে ফেলার জন্য। তিতির জানতেও পারেনি ততদিনে অয়নের জীবনে অন্য মেয়ে এসে গেছে। বিয়ের পর তার অত্যধিক উচ্ছ্বাস তিতির মনের সব সংশয় কাটিয়ে দিয়েছিলো। আবার বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো সে অয়নকে। হনিমুনের ব্যবস্থা করে ফেললো অয়ন এই রিশ্যপে। ‘নেওড়া ভ্যালি রিসর্টে’ এসে উঠলো তারা। প্রকৃতির কোলে এই সুন্দর পরিবেশ, চারপাশে পাহাড় ঘেরা-তার মাঝে সবুজ উপত্যকা,চা বাগান,পাহাড়ি ঝর্ণা,তিতিরের মন ভরিয়ে দিয়েছিলো। সেদিন ঝর্ণা দেখে ফিরছিলো তারা,পথের ধারে সুন্দর নাম না জানা ফুল দেখতে গিয়ে সে পড়ে যায়- কিন্ত পড়ে যাওয়ার মূহুর্তে সে বুঝতে পারে দুটো হাত তাকে ঠেলে দিয়েছিলো।
ইরাদেবী তাকে স্বান্তনা দিয়ে কাকার বাড়ি পাঠানোর কথা বললে তিতি তার পায়ে ধরে বলে-“মা তোমার সংসারে আমার কি একটুও যায়গা হবেনা? বাচ্চাটা হয়ে গেলেই আমি কোথাও চলে যাব- এইটুকু দয়া করো। নিঃসন্তান ইরাদেবী সন্তান স্নেহে জড়িয়ে ধরেন তাকে।
আজ তিনবছর হতে চললো তিতি এখানেই আছে। ব্রতীনবাবুর চেষ্টায় গ্রামেই স্কুল খোলা হয়েছে, স্থানীয় দুটি মেয়েকে নিয়ে তিতি চালায় সেই স্কুল। ছোট্ট দিতি ব্রতীনবাবু আর ইরাদেবীর নয়নের মণি। ভাল আছে তিতি। মা,বাবার স্নেহ,দিতির মা ডাক,তাকে পুরোনো কথা ভুলিয়ে দিয়েছিলো। আর দিতি তাকে চুপ করে বসে থাকতে দিলে তো! সারাক্ষণই তো তার বকবকম। অবশ্য দাদান আর দিদানের সাথেই তার ভাব বেশী। দিন গুলো কেটে যাচ্ছিলো মসৃণভাবে।
কদিন পরেই দিতির জন্মদিন,তাই কিছু কেনাকাটা করার জন্যে তাঁরা বেরিয়েছিলেন।দিতি তো আগেই গাড়িতে উঠে বসে আছে। ড্রাইভার আংকেল যে তার প্রিয় বন্ধু। কিছুটা পথ যাবার পর হঠাৎ রাস্তার পাশে ভীড় দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন তাঁরা।দেখলেন স্থানীয় লোকেরা ধরাধরি করে একটা মৃতদেহ তুলে আনছে। অবাক বিশ্ময়ে তিতি তাকিয়ে থাকে অয়নের মৃতদেহের দিকে। তার মনে হয় অপরাধী অপরাধের জায়গায় ঠিক ফিরে আসে- কথাটা বড়ো সত্য। আর অপরাধীর শাস্তি বোধহয় এভাবেই নির্দ্দিষ্ট করেছিলেন ঈশ্বর।
0 Comments