কুকুরের কান্না
কুকুরটা কাঁদছে। একটানা কেঁদেই চলেছে। মনে হয়,গলির তিন চারটে বাড়ি টপকেই কান্নাটা ভেসে আসছে। শীতের রাত। সব নিস্তব্ধ। সেই নিস্তব্ধতাকে টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিচ্ছে এই কান্না।অশুভ লক্ষণ। কোন বাড়িতে মুমূর্ষ কেউ পড়ে থাকলে, কুকুরের কান্না বিপদের পূর্বাভাস। এমনটাই গৃহস্থে ধারণা।
প্রতি বছরই শীতের শুরুতেই হেমেন বাবু এইরকম অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্ত্রী অনুভা দেবী তাঁকে যথেষ্ট সাবধানে রাখেন,তবু যেন কিভাবে উত্তরের হাওয়া তাঁকে ছোবল মারে। আর সেই ছোবলেই দিন চারেক হল তিনি বিছানায় অসাড় হয়ে পড়ে আছেন। অবস্থা ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। বিকেল থেকে তাঁর হাতের ইশারায় জানলাটা খুলে রাখা হয়েছিল।কিন্তু সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডার ভয়ে তা বন্ধ। সেই বন্ধ জানলায় কুকুরের কান্নাটা এত বিশ্রীভাবে ঘা মারছে যে সারা ঘরে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।প্রত্যেকের বুকের ভেতর ভয়ের একটা চোরাস্রোত বয়ে যাচ্ছে। শুধু কয়েক মিনিটের জন্য,গলির কোন বাড়ি থেকে কারা যেন কুকুরটাকে লাঠি নিয়ে তাড়া দিতেই সে গা ঢাকা দিয়েছে।
---যাক্ বাবা বাঁচা গেল। ব্যাটা পালিয়েছে।হেমেন বাবুর বড় ছেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
দিনসাতেক নার্সিংহোম থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর হেমেনবাবুকে বাড়িতে আনা হয়েছে। তিন দিন বেশ ভালই ছিলেন।নিয়ম করে ওষুধ,খাওয়াদাওয়া সব ঠিক চলছিল।হঠাৎ করেই যেন সর্দিটা বুকে জাঁকিয়ে বসল।আজ সারা দিনে কয়েক চামচ ওআরএস ছাড়া কিছুই দেওয়া যায়নি তাঁকে।
---ডাক্তার সেনকে কল করা হয়েছে। আধঘন্টার মধ্যে এসে যাবেন। অসাড় অবস্থাতেই মেজ ছেলের কথা ছাপিয়ে, ডাক্তারবাবু নয়,হেমেন বাবুর মস্তিষ্কে এখন আগত যমরাজের কথাই ভেসে বেড়াচ্ছে। বিষয় আশয় বড় অগোছালো পড়ে আছে। আর কয়েকটা দিন সময়ের দরকার ছিল। তবে বাড়িটা অনুভার নামে লেখা আছে,এইটুকু শান্তি। তিনি হয়ত ভেবেছেন,তাঁর অবর্তমানে চার ছেলে মেয়ে বাড়ি দখলের জন্য,তাদের মাকে অনায়াসে কোর্টে টেনে নিয়ে যেতে পারে।
সাময়িক বিরতির পর আবার শুরু হল সেই কান্না,আর তা জানিয়ে দিতে চাইছে,যমরাজ মোড় অবধি এসে গেছেন।
কিন্তু হেমেন বাবুর বাড়ির গলিতে যমরাজের পা রাখার আগেই ডাক্তারবাবু এসে হাজির।
---ডাক্তারবাবু,বাবা ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ছেন। সকালে ভালই ছিলেন। দুপুরের পর থেকেই এই অবনতি।
---আমার শরীরের সব কলকব্জারই বারোটা বেজে গেছে। তার ওপর কুকুরের এই আর্তনাদ। তোমরা যতই বিজ্ঞানমনস্ক হও,কিছু কুসংস্কার এখনও বিজ্ঞানকে হারিয়ে চলেছে।এ যাত্রা আর রক্ষে নেই। তাঁর পায়ের শব্দ আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকেন হেমেন বাবু।
---বাবা কিছু বলছ?মেয়ে তাঁর মুখের কাছে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল।
---আর কোন ভয় নেই। ডাক্তারবাবু এসেছেন,এবারে আপনি একেবারে সুস্থ হয়ে উঠবেন। জামাইয়ের কথা শেষ না হতেই,কুকুরটার প্রাণপণ চিৎকার ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে গেল।সম্ভবত একটা ইঁটের টুকরো উড়ে এসে গায়ে পড়েছে।
ডাক্তার সেন বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট না করে হেমেনবাবুকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে বললেন,ঘন্টাখানেকের ভেতর অবস্থার উন্নতি হবে। ঠান্ডাটা একটু বেশিই লেগেছে। তবে ভয়ের কিছু নেই।
হেমেনবাবুর মনে হল,ওষুধটা বাঁ হাত হয়ে কলজে পর্যন্ত গিয়ে সারা শরীরে একটা অদ্ভুত বল সঞ্চার করছে। তবু এই ইঞ্জেকশন কি যুঝতে পারবে যমরাজের সঙ্গে? এক ঘণ্টার মধ্যেই যা হবার হবে।
ডাক্তার সেন ব্রিফকেস থেকে মাফলারখানা বের করে গলায় জড়িয়ে নিয়ে বললেন--একটু সাবধানে রাখবেন। বয়স হয়েছে ত!
---বাবাকে সাবধানেই রাখি। কোত্থেকে যে এত ঠান্ডা লাগে বুঝতেই পারি না।কথা শেষ করে ফিসটা এগিয়ে দেন হেমেনবাবুর মেজ ছেলে।
---যা রিণ্টু,ডাক্তারবাবুকে এগিয়ে দিয়ে আয়।ভাইপোকে তিনি আদেশ করলেন।
মিনিট পনের পর হেমেনবাবুর চোখে মুখে একটা আলগা সতেজতা লক্ষ্য করতেই,বাড়ির সবাই সামান্য নিশ্চিন্ত হলেন। মনে হয় বিপদটা কেটে গেল।তার ওপর কুকুরের কান্নাটাও থেমে গেছে।
ডাক্তার সেনকে গলির মুখে দাঁড়ানো গাড়িতে তুলে দিয়ে,রিন্টু ফিরে এসে জানাল,বড় রাস্তার ধারে একটা কুকুরের বাচ্চা গাড়ির চাকায় পিষে গেছে।তাই মা-টা অমন করে ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল। সন্তান হারানোর শোকে মানুষ পাগল হয়ে যায়। আর মানুষই আবার সেই শোকে অন্য কোন জীবকে কাঁদতে দেয় না। অমঙ্গল কিংবা বিপদের গন্ধ পায়। লাঠি অথবা ইঁটের প্রহারে সেই কান্নাকে থামাতে চায়। চোখের সামনে কোন প্রাণীর সন্তান যদি মারা যায়, আর সেই কষ্টে মা যদি দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে মনটাকে হালকা করতে চায়;তবে আর যাই হোক তার সেই বিলাপে মানুষের অমঙ্গল হতে পারে না। তাছাড়া মৃত্যু কোন কুসংস্কার মানে না। সময় অসময় কিছুই বোঝে না। মানুষ তার কাছে সম্পূর্ণ নতজানু এবং পরাজিত।
নাতির কথাগুলো কানে আসতেই, হেমেনবাবুর অন্তরের ঠোঁট দুটো নড়ে উঠল,--এ যাত্রায় যমরাজকে মানুষের পরিবর্তে কুকুরের বাচ্চাকে নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হল।
0 Comments