শৈবাল মুখোপাধ্যায়ের গল্প


দশ মিনিট সময়ের ব্যবধান

চিন্ময়বাবু আজ প্রথম পেনশন পাবেন। সকালের দিকে মোবাইলে মেসেজ এসেছে।
অবসরের তিন মাসের মাথায় ওনার পেনশন চালু হল।গতকাল রাত্রি থেকে একটা উৎকন্ঠা নিয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন চিন্ময়বাবু। তবে ওনার উৎকন্ঠার অংশীদার বা ভাগীদার ছিল পূর্নবয়ষ্ক আরও তিনজন। একজন ওনার স্ত্রী বিভা, ছেলে রঘু ও ছেলের বউ কেতকী। চিন্ময়বাবুর কোনও মোবাইল নেই। রঘুর নম্বরটা ব্যাঙ্কে দেওয়া ছিল।সকালে মেসেজের পি পি ধ্বনি বেজে উঠতেই কেতকী বলেছিল,বাবার পেনশনের মেসেজ এসেছে। রঘু তাড়াতাড়ি উঠে মোবাইল দেখে বলল- ঠিক বলেছ। বাবার পেনশনের টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে চলে এসেছে।

বিভার মুখে এক চিলতে হাসি দেখা গিয়েছিল। ছাব্বিশ সাতাশ বছরের যে সময়টা উনি সরকারকে দিয়েছিলেন তারই ফলশ্রুতি হিসেবে এটা একটা মস্তবড় পুরস্কার হিসেবেই যেন মনে হয়েছিল বিভার মনে।এখন যে কটা দিন লোকটা থাকবে এই পুরস্কার পেয়ে যাবে প্রতি মাসে।

বিভাদেরই তো টানতে হয় সংসারটা। সেই কবে লোকটার হাত ধরে এই বাড়িতে এসেছিল।
সে সব দিনগুলো আজ অনেকটা ফিকে হয়ে গিয়েছে।রঘুর জন্ম,ওর বড়ো হয়ে ওঠা,স্কুলে পড়া,রসুলপুর বাজারে একটা ছোট্ট রেডিমেটের দোকান।ছেলের বিয়ে দেওয়া।মানুষের সারাজীবন সুখ—এটা খুব কম লোকই পায়। অন্তত বিভা তো তাই মনে করে।

আজ পয়ঁত্রিশ ছত্রিশ বছর ধরে এই সংসারে বিভার জীবন। বাপের বাড়ি ছিল আর কতদিন? বিভার যখন বিয়ে হয় ওর বয়স মাত্র একুশ। চিন্ময় ছিল সাতাশ আঠাশ।
যদিও হিসেবগুলো সবটাই কাগজপত্রের নয়।আন্দাজ মাত্র।বাপের বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়িতেই মেয়েদের বেশি জীবন কাটে।কেটেও গেল বেশ সুখেই।

দুঃখ! নাহ,তেমন বিশেষ কিছু ছিল না। নিম্নমধ্যবিত্ত ঘর থেকে সরকারি কর্মচারী একজন পুরুষের স্ত্রী হিসেবে উঠে এসেছে বিভা।এটা কী কম কথা।
বাবা,জ্যাঠা,কাকা-কেউ সরকারি কর্মচারী ছিল না।অল্প কিছু জমি।চাষ আবাদ করে চালিয়ে নিত।

রঘুটাও তেমন একটা মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করল না। চিন্ময় বলেছিল- অন্তত মাধ্যমিক পাশটা কর, অফিসের স্যারকে বলে ইরিগেশনেই আমার মত গ্রুপ ডি কর্মচারী হিসেবে একটা ব্যবস্থা করে দেব। যদি কিছু দিতে হয় এদিক ওদিক করে হয়ে যাবে।

না, রঘু সে কথা রাখতে পারেনি। মাধ্যমিকে তিনবার বসে ছিল- তিনবারই ইংরাজীতে ব্যাক পেয়েছে।তারপর বছর দুই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে কাটিয়ে দিল।অবশেষে রসুলপুরে একটা রেডিমেট পোষাকের দোকান দিল।

বিভার জীবন গ্রামে।গ্রামেই জন্ম, বেড়ে ওঠা।আরেক গ্রামে বিয়ে। কিন্তু গ্রামে মানুষ হলেও তার বাস্তববোধ ছিল যথেষ্ঠ বেশি। সেটা পেয়েছে ওর ঠাকুমার কাছ থেকে। ঠাকুমা ছিল বৈষয়িক। তা না হলে ওর ঠাকুমা তিন ছেলে,তিন ছেলের বউ,নাতি নাতনিদের নিয়ে জীবনটা কাটাল কীভাবে।ছেলেদের রন্ধে রন্ধে দিয়ে গেছেন সেসব অভিজ্ঞতা।

বিভা দেখেছে বাবা থাকতে থাকতে কত ছেলে মেয়ে জাগা জমি ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে।কেউ কেউ কেস পর্যন্ত করেছে। অথচ তাঁর বাবা জ্যাঠাদের সঙ্গে
কোনওরকম মামলা বিবাদ পর্যন্ত হয় নি। ঠাকুমাই শেষ কথা।

বিভা একবার নিজের ঘর সংসার ঝালিয়ে নেয়- কোথাও সেরকম দুঃখ কষ্ট নেই।
হ্যাঁ,কিছু প্রাণ চলে গিয়েছে।এটা তো কালের নিয়ম।কাল নিয়ম মেনেই চলে-
একে তো রোধ করা যায়না।

আজ অফিস যাওয়ার মতই ব্যস্ততা চিন্ময়বাবুর। সকালে উঠে প্রাতঃকৃত সেরে দাড়ি কামিয়ে চুলে তেল দিয়ে স্নান সেরে নিলেন। বিভা আলমারি থেকে কাচা ধুতি পাঞ্জাবিটা বের করে দিল।এটাই ওনার পোষাক। সঙ্গে রাখলেন চশমা,বেতের হাতলযুক্ত ছাতা,একটা ব্যাগ।আগে ওই ব্যাগে মুড়ি তরকারি,শশা,টিফিনে যা দিয়ে দিত নিয়ে যেতেন।ফেরার পথে একটু সস্তায় যা কিছু পেতেন নিয়ে আসতেন।

চিন্ময়বাবু খেয়ে দেয়ে তৈরি। এবার বের হবেন।

কেতকী চিন্ময়বাবুর পোষাক দেখে বলল- বাবা, আপনি এইভাবে যাবেন? গতকাল আপনার ছেলে কী বলেছিল মনে নেই আপনার।

হ্যাঁ,রঘু কীসব যেন বুঝিয়েছিল।

আপনি এভাবে ধোপদুরস্তভাবে ব্যাঙ্কে যাবেন না।ব্যাঙ্কে অনেক বাজে লোক বসে থাকে।ওরা ঠিক বুঝে নেয় কে টাকা তুলবে আর কে টাকা জমা দেবে। আপনি এমনভাবে যাবেন যেন কেউ সন্দেহ করতে না পারে।অনেকগুলো টাকা তো।

ঠিকই বলেছ।ধুতিটা একটু এলোমেলোভাবে পরি আর পাঞ্জাবিটা–ওই ময়লা যেটা-
সেটাই না হয় পড়ি। কী বল-

কেতকী একটু লজ্জিত হয়ে ওঠে। ঠিকই তো তার শ্বশুরমশাই কোনওদিনও মাঞ্জা দেওয়া পোষাক পড়ে অফিস করেন নি। কাচা ধোওয়া অবশ্যই পড়েছেন কিন্তু তাই বলে মার দেওয়া,ইস্ত্রি করা...ওনার তো একটু সখ থাকতেই পারে—সেটাকে বারন করে কীভাবে? হাজার হোক সে পুত্রবধূ।

মিনিট কয়েক বাদে চিন্ময়বাবু পোষাক পালটে এসে বললেন—দেখ তো বউমা, এবার ঠিক আছে কিনা।

কেতকী মনে মনে বলল- ঠিকই আছে। এবার দেখে মনে হচ্ছে চাষাভুষো লোক ব্যাঙ্কে এসেছে কোনও লোন পাওয়া যায় কিনা জানতে।

কেতকী মুখে কোনও শব্দ না করে মাথা নেড়ে সায় দিল।

চিন্ময়বাবু বের হবার সময় ঘড়িটার দিকে একঝলক দেখে সময়ের হিসেব করে নিলেন।
এই ট্রেনেই তিনি দীর্ঘদিন ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন। রসুলপুরে টাইম সাড়ে দশটা।রেলের টাইম টেবিলে দশটা পঁচিশ হলেও সাড়ে দশটার আগে আসে না। বাড়ির ঘড়ি দশ মিনিট ফাস্ট থাকে। ফলে হাঁটা পথটুকু নিশ্চিন্তে যাওয়া যায়।
দীর্ঘদিনের এই অভ্যাস।

অবসর গ্রহণ করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অফিসের কো-অপারেটিভের টাকা ক’টা পেয়েছিলেন। কিছুদিনবাদে এসেছিল পি এফ এবং গ্র্যাচুইটির টাকা ক’টাও।
সার্ভিসবুক কলকাতায় গিয়ে পেনশন চালু হতে দু’দুটো মাস পার হয়ে গেল।এবার মেমারী থেকে রসুলপুরের ব্যাঙ্কে ট্রান্সফার করে নেবেন। রঘু বলেছে একটা এটিএম কার্ড করে দেবে।এতে অনেক সুবিধা। প্রয়োজন মতো টাকা তোলা যাবে। এখন এখান থেকেই দু’ তিনবার নেওয়ার পর ধীরে ধীরে সব ব্যবস্থা করবেন।

রসুলপুর স্টেশনে এসে কীরকম ফাঁকা ফাঁকা লাগল। কী ব্যাপার আজ হঠাৎ স্টেশন চত্বর এত ফাঁকা কেন! ডেলি প্যাসেঞ্জারদের কোনও ভিড় নেই। ট্রেনের কোনও গন্ডগোল ? ঠিক জানেন না চিন্ময়বাবু। আগে নিত্য যাওয়া আসা ছিল। আগাম খবর পেতেন। আর আজ তিনি দু’মাস পরে স্টেশনে এলেন। সামনের দোকানে এসে জিজ্ঞাসা করলেন—ভাই,সাড়ে দশটার লোকালের কী খবর?

কোথায় যাবেন?

মেমারী।

আবার একঘন্টা পর। ওটা চলে গিয়েছে।

চলে গিয়েছে!একটা অবিশ্বাসী সুর খেলে গেল চিন্ময়বাবুর গলাতে। উনি যে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় ঘড়ি দেখে বের হলেন।কোথায় যে কী গন্ডগোল হল তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।অগত্যা গাছতলার বাঁধানো বেঞ্চে এসে বসলেন।

দোকান বন্ধ করে রঘু ফিরতেই বিভা বলল- হ্যাঁরে রঘু,তোর বাবার ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন রে। আড়াইটে বেজে গেল।

আজ মাস পয়লা। ব্যাঙ্কে ভিড়। সেইজন্য হয়তো—

তাহলে তুই স্টেশনে চলে যা। লোকটা অতগুলো টাকা নিয়ে ফিরবে,যদি ট্রেনের মধ্যে–

তুমি অযথা টেনশন করছ।আড়াইটের লোকাল এতক্ষণে ঢুকে গিয়েছে।

রঘুর কথা শেষ হতে না হতেই দেখা গেল চিন্ময়বাবুকে। তিনি ধীর পদক্ষেপে এসে ব্যাগটা বিভাকে ধরিয়ে ঘড়িটাকে ভাল করে দেখছেন।

বিভা সেটা দেখে বলল- তুমি সাড়ে দশটার ট্রেনটা পাওনি,তাই না? গত সপ্তাহে ব্যাটারিটা শেষ হয়ে গেছিল। নতুন ব্যাটারি এনে কেতকীকে বললাম-তোর বাবার তো আর অফিস নেই যে দশ মিনিট ফাস্ট করে রাখতে হবে। তুই সঠিক টাইম করে রাখ।
ওই দশ মিনিট তো তোমার সঙ্গেই বাঁধা ছিল।কথা ক’টা বলতে গিয়ে কখন যেন বিভার চোখ জলে ভিজে উঠল।


    সাহিত্যিক শৈবাল মুখোপাধ্যায়
         সুকান্ত পল্লি, কালনা গেট, পূর্ব বর্ধমান

















0 Comments