সৌমী গুপ্ত'র মুক্তগদ্য



দ্রৌপদী

সূর্য অস্তগামী। গোধূলি বেলায় রামধনুর সাত রঙ মেখেছে আকাশ। রাজপ্রাসাদের নিভৃত গবাক্ষে দন্ডায়মান আবছায়া এক নারী...দ্রুপদ রাজার কন্যা...পাঞ্চালী...হস্তিনাপুরের রাজবধূ।চক্ষু দুটি নিমীলিত সম্মূখে। চোখের ভাষা দূর্বোধ্য। আনন্দ,দুঃখ, চাওয়া পাওয়ার আকাঙ্খার চিহ্ন মাত্র নেই। দূর দূরান্তে বলাকা সারিবদ্ধ হয়ে ফিরছে নিজবাসায়। নিজের অবচেতনে সময়ের পিছনে চলে যায় দ্রৌপদী। জীবন সায়াহ্নে এসে অনেক গুলো প্রশ্ন যুদ্ধ লাগায় নিজেদের মধ্যে মাথার ভেতর। রাজকন্যা হলেই যে কুসুম কোমল জীবন অতিবাহিত করা যায় না তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ সে নিজেই। উড়ন্ত পাখির মত স্বাধীন ডানা মেলতে ইচ্ছে হল। পরাধীনতা, দ্বন্দ্ব, প্রতিনিয়ত নিজের সাথে লড়াই...আর পেরে উঠছে না...বড্ড অবসন্ন লাগে তার, ক্লান্ত শরীর আর বিবশ মন সায় দেয় না।

যজ্ঞের আগুন থেকে সম্ভূতা যাজ্ঞসেনীর ললাট আগুনে পোড়া। অভিশপ্ত জীবন অতিবাহিত করেছে এত বৎসর ব্যাপী। অর্জুনকে মনে পড়লে হৃদয় অনুকম্পায় ভরে ওঠে।স্বয়ম্ভর সভায় যে বীরত্ব দেখিয়ে সহধর্মিণীর মর্যাদা দিলে সেই বীরত্ব কালিমালিপ্ত হয় ভাইদের সাথে নিজের স্ত্রীকে ভাগ করার নিদানে নীরব থাকায়। ক্ষত্রিয় বংশের রাজপুত্র তুমি.... বীরত্ব তোমার শিরায় উপশিরায়... অথচ একটি বারও  মনে হল না পাঞ্চালী ক্ষুধার মুখে কোন উপাদেয় বস্তু নয় যে একটি থালায় ভাগ করে নেবে। বীর অর্জুনের পৌরুষত্ব যা পাঞ্চালীর হৃদয়হরন করেছিল সেখানে ঘৃণা, ধিক্কার ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকলো না। কৃষ্ণা তোমাকে ভালোবাসবে কেমন করে অর্জুন? তোমার এই নমুনা ইতিহাসের পাতায় বিরল থেকে বিরলতম।
ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির তাকে বাদ দেব না সবার আগে। ধর্মের পথে সত্যের পথে যে কিনা সর্বদা চলে স্ত্রীর সম্মান রক্ষার সময় সমস্ত ধর্ম বিস্মৃত হয় অবলীলায়।তাই পাশা খেলায় সহধর্মিণীকে বাজি রাখতে দ্বিতীয়বারও ভাবে না।সভাশুদ্ধ পুরুষের লেলিহান লোলুপ বাসনার দৃষ্টিই ধর্ষণ করেছিল দ্রৌপদীকে সেই মুহূর্তেই। ঘৃণা হয় আজও তীব্র।মন শিউরে ওঠে। পঞ্চপান্ডবের উন্নত শির ন্যুব্জ হয় স্ত্রীর অপমানে নাকি পরাজয়ের যন্ত্রণায়! ছিঃ কুন্তী পুত্র অর্জুন তোমার বধিরতা, নীরবতা পৃথিবী মেনে নিতে পারেনা।

কৃষ্ণ লজ্জা নিবারণের বস্ত্রের যোগান না দিলে, সম্মান না বাঁচালে কি অসম্ভব পরিণতির ভয়ঙ্করতা গ্রাস করতো তখন, ভাবলে পাঞ্চালী আজও ভয়ে কুঁকড়ে যায়।এত লাঞ্ছনা,অপমান কেন পাওনা ছিল। কোন অপরাধে একপাল আগ্রাসী ক্ষুধার মুখে একটি নারী যে কিনা তোমাদের সহধর্মিণী তাকে বাজি রেখে এগিয়ে দিয়ে মজা দেখছিলে নীরবে? নাকি একটি বারও পরাজয়ের সম্ভাবনা মাথায়ও আসে নি। অথচ বীর মহাবীরের ভিড়েও প্রতিপক্ষের বিকর্ণ প্রতিবাদ করে পৌরুষত্ব দেখিয়েছিল।
আসলে যে নারীর তোমরা ছিলে সকলে দাবিদার তার গুরুত্ব ছিল শুধু অভিসন্ধির।একটা ব্যবস্থা বরাদ্দ করে তাকে ব্যবহার করেছিলে।আসলে কৃষ্ণাই তো তোমাদের কাছে এক ও অদ্বিতীয়া ছিল না। জীবনে প্রথম যার বাহুবেষ্টনীতে নিজেকে সমর্পণ করল সে তার চাওয়ার পুরুষ নয়। আকাঙ্খার পুরুষটি নির্দ্বিধায় নিজের জ্যেষ্ঠের হাতে তুলে দেয়। কেন অর্জুন কেন! একবারও মনে হয়নি তার শরীরের নিষ্পেষণ পাঞ্চালীর কাছে ধর্ষণ সমান। রাতের অন্ধকারে যাজ্ঞসেনীর নয়নের নোনা জল তার সাক্ষী। অথচ অর্জুন তুমি যখন সময় কাটাতে নিজের মত করে অন্য স্ত্রীদের সাথে অভিমান, ঈর্ষার আগুন তার হৃদয় জ্বালিয়ে দিত নিদারুণ ভাবে।

তবু ভীমের হৃদয়ে সবচেয়ে সম্মানের ভালোবাসার জায়গা ছিলো দ্রৌপদী।তাই  হিড়িম্বা পাঞ্চালীর পূর্বে স্ত্রী থাকলেও পরবর্তী সময়ে আর কেউ আসে নি তার জীবনে। বস্ত্রহরণের সময় একমাত্র তার ক্রোধ তাকে কিছুটা পুরুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। খাতায় কলমে সে দ্রৌপদীর স্বামী...চাওয়ার পুরুষ তো নয়।
যুগাগ্নির আগুন জ্বলে বুকে। দূর্বলতা তো সৃষ্টি হয়েছিলো কর্ণ কে প্রথম দর্শনেই। গলায় বরমাল্য দেবার সমস্ত গুণ থাকার সত্ত্বেও শুধু সূতপুত্র অজুহাতে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়েছিল।এর পশ্চাতেও ছিল অভিসন্ধি, কূটনীতি। জন্মই যার রহস্যাবৃত, প্রয়োজনের, রাজনীতির যূপকাষ্ঠে বলিপ্রদত্ত তার সারা জীবন যে বঞ্চনায়,স্বার্থসিদ্ধির জন্য অতিবাহিত হবে তা আশ্চর্য কি! অথচ দুজনের জীবনের কি মিল। দুজনেই বিনা দোষে বঞ্চনার,লাঞ্ছনার শিকার। ভাবতে ইচ্ছে করে যদি এক সূত্রে গাঁথা হত জীবন তবে এত অবিচার বর্তাত তার কপালে?চাই না রাজবধূর তকমা, চাই না ক্ষত্রিয় বংশের মহিমা! জীবন নিয়ে এমন টা তো ভাবে নি কখনও। যদি যদি যদি...একগুচ্ছ যদি ফেলে আসা জীবনকে ভাবায়।কর্ণও তো তাকে বাতিল করার প্রতিশোধে তীব্র অপমান করতে ছাড়ে নি। যে অর্জুনকে পুরুষ শ্রেষ্ঠ ভেবে গলায় মালা দিয়েছিল তাতেও নিয়তি ছাইভস্ম ঢেলে দিল। নিয়তির কি নিদারুন পরিহাস!রাগ,ক্ষোভ,ক্রোধ ঘৃণা মনকে দীর্ণ বিদীর্ণ করেছে প্রতিনিয়ত। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়েছে বারংবার। পিতা,স্বামী,আত্মীয় স্বজনের তুরুপের তাস যেন পাঞ্চালী। উঃ কি যন্ত্রণা,কি অপমান। দ্রৌপদীর রক্তবর্ণ চক্ষু দুটি বন্ধ হয়ে আসে।
রুক্ষ, শুষ্ক মরুভূমির ন্যায় জীবন তার। সন্তানহারা,সম্মানহারা এক নারী জীবনের শেষ প্রান্তে এসে হিসেব কষতে গিয়ে দেখে অপমানের জ্বালা তাকে পাথর করেছে। মাতৃগর্ভের জঠরযন্ত্রনা সহ্য করে যে সন্তানের জন্ম দেওয়া হয় তাকে হারানো যে কি শোকের তার সাক্ষী এই হতভাগ্য নারী।আর দায়িত্ব পালনে মন সায় দেয় না। বলাকার মত শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। গোধূলি বেলায় এসে মনে হয় ভোরের আলো কত দূরে! বিধ্বস্ত, অবসন্ন মন শরীরকে বোঝাতে অক্ষম।এক পেয়ালা স্বাধীনতা পান করতে ইচ্ছে হয় শেষ বেলায়।

সাহিত্যিক সৌমী গুপ্ত
১৬২, রাইফেল ক্লাব রোড, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ


ছবি ঋন- Pinterest























0 Comments