বোস্টন শহরের গাইড ~ অদিতি ঘোষ দস্তিদারের ভ্রমণ কাহিনি


অদিতি ঘোষ দস্তিদারের ভ্রমণ কাহিনি 
বোস্টন শহরের গাইড 

"ডাক ট্যুর" দারুণ জিনিস বলে বলে তো আনালি, জানিস নিজে জিনিসটা কি?" 
"বোস্টনে থাকি আর এটা জানব না? তুইও ইচ্ছে করলেই জানতে পারতিস গুগুল করে! আচ্ছা আমিই বলছি! ডাক মানে কী? হাঁস। ডাঙাতেও চরে, জলেও চরে -তাই তো ? এই ট্যুরটাও হচ্ছে সেরকম একটা গাড়িতে, যা উভচর!" 
প্রশ্ন করছে তিথি, উত্তর দিচ্ছে দীপা। কলকাতায় ওরা এক কলেজে পড়ত দুজনে। 
তিথি এখন থাকে একদম আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে। এসেছে একটা ইন্টারভিউ দিতে বোস্টন শহরের কাছের এক  ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে। গতকাল ইন্টারভিউ ছিল, তাই আজ দীপা বেরিয়েছে বান্ধবীকে বোস্টন শহর ঘোরাতে। আগামীকাল তিথি ফিরে যাবে।  
বোস্টন শহরটা অতলান্তিক মহাসাগরেরই শাখা ম্যাসাচুটেস্টস উপসাগরের ধারে। শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে চার্লস নদী।  ছোট্ট শহর হলেও আমেরিকার ইতিহাসে এই শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। 
সাইয়েন্স মিউজিয়ামের সামনের বিরাট টেরানোসরাস রেক্সের মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে গুগুলে চোখ বোলাল তিথি। ও:হো, এই ব্যাপার! গাড়িগুলো একরকমের পুনর্ব্যবহার বা রিসাইক্লিং।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে উভচর বা অ্যামফিবিয়ান মিলিটারি গাড়িগুলো জলে আর  ডাঙায় দুজায়গাতেই ব্যবহার হত, সেই রকমই চারটি গাড়ি নিয়ে শুরু হয়েছিল বোস্টনে ডাক ট্যুর। এখন অবশ্য অনেকগুলি সংস্থাই  ব্যবসা করছেন,  পুরোন গাড়িগুলিও আর এখন নেই, নতুন গাড়ি তৈরি হয়েছে সেই পুরোনো মডেলের আদলেই। 
গাড়ি এসে দাঁড়াল। সাধারণ গাড়ির থেকে বেশ উঁচু, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল। মনে হয় জলে ভাসার জন্যেই।
সিটে একে একে সব যাত্রীরা বসে পড়ার পর সামনে এসে দাঁড়ালেন এক ভদ্রলোক, হাতে মাইক্রোফোন। পরিচয় দিলেন নিজেকে conDucktor হিসেবে। বোঝা গেল ইনিই ট্যুর গাইড।  
এই সময় বোস্টনে পর্যটকের ভিড় উপছে পড়ছে। টিকিট পাওয়াই মুশকিল  হয়ে গেছিল প্রায়। তিথি আর দীপা বসেছে একদম শেষ সিটে।   
শুরু হল যাত্রা। বোস্টন শহরের রাস্তায় রাস্তায় ইতিহাস - আমেরিকার স্বাধীনতা আন্দোলনের। 
প্রথমেই ফ্রিডম ট্রেইল - তিন মাইল  লম্বা রাস্তা, তার মধ্যে সুন্দর বাগান, মরাল সরোবর, তারপর বিখ্যাত ফ্যানুয়েল হল, ১৭৪০ সালে তৈরী। চারতলায় মিউজিয়াম, নিচে দোকান বাজার, বোস্টনের বিখ্যাত কুইন্সি মার্কেট। পাশ দিয়ে যেতে যেতেই নাকে এল চিংড়ি রান্নার সুবাস!
"ফিরে এসে এখানেই লাঞ্চ করব! বোস্টনের সি ফুড জগদ্বিখ্যাত!'’ দীপা বলল।
এবার ব্যাংকার হিল মনুমেন্ট, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম যুদ্ধ হয় এখানেই।
এরপর সেই রাস্তা। কুখ্যাত ‘বোস্টন ম্যাসাকার’ ঘটেছিল এখানে। ব্রিটিশ পুলিশ গুলি চালিয়েছিল নিরীহ আমেরিকানদের ওপর। 
আমেরিকার ইতিহাস জানা নেই তেমন তিথির। দীপাকে ঠেলা মারল, "কেন রে গুলি চালিয়েছিল? গাইড তো তেমন কিছু বলছে না।”  
“ধুস আমি কী জানি, গুগুল কর।” 
"সব কি আর গুগুলে লেখা থাকে সিস্টার!"  
একটা ভারী খসখসে গলায় প্রশ্ন এলো।  
তিথি তাকিয়ে দেখল প্রশ্ন করেছেন পাশের ভদ্রলোক। তামাটে চেহারা, মুখটা ক্লিষ্ট। পোশাক ফিটফাট কিন্তু একটু পুরোনো। ওরা খেয়াল করেনি এতক্ষণ যে উনি পাশে বসে আছেন। নিজেরাই মত্ত  ছিল গল্পে। 
"আপনিও কি গাইড? বলুন না কারণটা!"
সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললেন ভদ্রলোক। ব্রিটিশ সরকার অন্যায়ভাবে নানা রকম ট্যাক্সের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল আমেরিকানদের ওপর, সেই নিয়েই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল রাজপথে। পুলিশ এসে গুলি চালায়। অনেকে আহত ও নিহত হন।  
"একই গল্প দেশে দেশে শহরে শহরে তাই না?" দীপার প্রশ্নে তিথি মাথা নাড়ে।
এবার সেই বিখ্যাত ‘বোস্টন টি পার্টির’জায়গা। গাইড বলছে কিছু কথা। পাশের ভদ্রলোকটি আবার কথা বলে উঠলেন, "ওর আবোল তাবোল কথা শুনতে হবে না। আমি বলি শুনুন। ব্রিটিশ সরকার চা এর ওপর কর বসাল।  অসম্ভব বেশি ট্যাক্স। ঠান্ডার দেশে চা ছাড়া চলে না ..” 
 “চা কোথায়? এদেশে তো শুধু কফি!”
কথা কাটল তিথি।
“এই ঘটনার পর থেকে ধরে নেওয়া হয়েছিল চা শুধু ব্রিটিশদের, তাই কফি ব্যবহার শুরু হল দেশাত্মবোধ দেখাবার জন্যে। জানেন, ৩৪২ সিন্দুক চায়ের পেটি ফেলে দেওয়া হয়েছিল জলে…আজকালকার হিসেবে এক মিলিয়ন ডলার, ভাবা যায়?”
"তাই? কারা ফেলল?" 
"সে একটা বিরাট প্রশ্ন! বিপ্লবীরা সব এই দেশের আদি বাসিন্দা নেটিভ আমেরিকানদের ছদ্মবেশে ছিল, তাই আসল লোকেদের ধরা যায়নি। আজ পর্যন্ত সেটা একটা ধাঁধাঁ। হতে পারে সাধারণ মানুষ এত ক্ষেপে গেছিল যে নিজেরা চা এতো দাম দিয়ে কিনতে পারছে না বলে  ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্ষতি চেয়েছিল কিন্তু তারা নেটিভ আমেরিকানদের ছদ্মবেশে গেল কেন বলুন? কাউকে খুঁজে না পেয়ে তাদের ওপর অত্যাচার আরো বেড়ে গেছিল। এটাও তো একটা অন্যায়। তবে এই আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনের অংশ বলে মানেননি দেশের তৎকালীননেতারা। তাঁদের মতে এতো জিনিস নষ্ট করে প্রতিবাদ, এ লজ্জার বিষয়।” 
“সে তো আমাদের দেশেও হয়েছে। বিলাতি কাপড়, চুড়ি মানে ব্যাঙ্গেল সব বর্জন করেছিল দেশবাসী। কত বিলাতি কাপড় পোড়ান হয়েছিল। মানুষ অত্যাচারিত হলে অমন হয়!” 
“কিন্তু নিজেরা অত্যাচারিত হয়ে অন্যদের অত্যাচার করবে, এ কেমন কথা?  এদেশের আদিবাসী মানুষকে মেরে মেরে আর রেখেছে বলুন? স্বাধীনতা কি শুধু বাইরে থেকে আসা শ্বেতাঙ্গ লোকেরা পাবে? আর যারা এদেশে ছিলেন তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবেশ? এ কেমন কথা?”
তিথি কী একটা উত্তর দিতে গেল, কিন্তু থেমে গেল জোর হল্লায়। উল্লাসে চিৎকার যাত্রীদের। গাড়ি জলে নামছে।  
“সত্যি দারুন অভিজ্ঞতা, ভাগ্যিস তুই নিয়ে এলি…” 
সামনের গাইড বলে চলেছেন, "আমরা এখন চার্লস নদীর ওপর, আমরা এখন নদীর কেমব্রিজ সাইডে। দেখুন জগদ্বিখ্যাত এম আই টি, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়…”
বিস্ময়ে তাকিয়ে যাচ্ছে তিথি, দীপা ওকে গল্প বলে যাচ্ছে অনেক। .
এবার আবার গাড়ি ডাঙায়।  ঘুরে ফিরে আগের জায়গায়। 
খেয়াল হল তিথির। 
“আরে সেই গাইড কোথায় গেলেন!” 
“উঠে সামনের দিকে গেছেন হয়ত। তুই খেয়াল করিসনি!”
 “অনেক নতুন কিছু জানলাম ওনার থেকে। আগ্রহ বেড়ে গেল।” 
নামার সময় সামনের গাইডকে দেখে দীপা জিজ্ঞেস করল, “আর একজন, ওনাকে তো দেখছি না?
“আর তো কেউ নেই আমি একাই গাইড।” 
“না আর একজন।” বর্ণনা দিলো তিথি ভদ্রলোকের।
মুখটা কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল ড্রাইভার আর গাইড দুজনেরই। 
"অনেকেই বলেন ওনাকে দেখতে পান, উনি  এ বাসেরই একজন গাইড ছিলেন। এদেশের লোক।  নেটিভ আমেরিকান। সব সময় বলতেন নিজেদের জাতির লোকদের ওপর অন্যায় অবিচারের কথা, যে কথা ইতিহাসে লেখা হয়নি। একবার একটি লোকের সঙ্গে প্রবল বচসা হয়।  লোকটি রেগে গিয়ে এই গাড়ির সামনেই গুলি করে মারে।  
বড় ভালো ছিলেন উনি। মৃত্যুর পর ও হাল ছাড়েননি।” ক্ষীণ বেদনার হাসি ফুটল গাইডের মুখে। 
“মাঝে মাঝেই যাত্রীদের দেখা দিয়ে বুঝিয়ে যান এদেশের আসল অদিবাসীদের ওপর অন্যায় আর অত্যাচারের কাহিনী।"

"অনেক কাহিনী ‘প্রতি ইঁটে  আছে লিখা’..বুঝলি?" 
ফিসফিস করে দীপা বলল।  তিথি উত্তর দিল না। ওর  মন এখনো সেই গাইডের  গল্পে - নতুন করে জানতেই হবে ইতিহাস।

সাহিত্যিক অদিতি ঘোষদস্তিদার 
১৮৯ জনসন রোড, নিউ জার্সি, আমেরিকা

















0 Comments