খুন ~ শৌভিক চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প


শৌভিক চট্টোপাধ্যায়ের ছোটগল্প 
খুন 

এখন চৈত্র।সূর্যের আলো কে আর রোদ মনে হচ্ছে না মানিকের।রোদ তপ্ত পারদের মত নেমে আসছে পৃথিবীতে।মানিকের মত দুর্বল মানুষজনকে গলিয়ে নিঃশেষ করে দেওয়াই কি গ্রীষ্মকালের উদ্দেশ্য! প্রখর তাপে পুড়ে চলেছে মানিক।আধপোড়া চ্যালাকাঠের মত চেহারা হয়েছে ওর।এমনিতে গায়ের রঙ একটু বেশিই চাপা মানিকের।মানিকের নাম কেন মানিক রাখা হয়েছিল,সে খবর জানেনা সে।ওদের মত ঘরে সাধারণত নামের অর্থ বুঝে নাম রাখা হয় না।মানিকের নাম রেখেছিল ওর মেসোমশাই।ওর মেসোমশাই লোকটা খারাপ ছিল না।ভদ্রলোক শিয়ালদা স্টেশনের কাছে ব্রিজের নিচে পুরিয়া বেচত।হ্যাঁ নেশার জিনিস।রাংতা ধরনের একটা কাগজের ওপরে সাদা পাউডারের মত কিছু একটা থাকে;আর কাগজের নিচে দেশলাই ধরিয়ে সেই আগুনে সেঁকতে হয় কাগজটা। উপরের পাউডার থেকে উঠতে থাকে ধোঁয়া।প্রান ভড়ে সেই ধোঁয়া টেনে নিতে থাকে সুখের,সখের আর অসুখের ঝোঁকে আসা নেশারুর দল।নাসিকারন্ধ্রের ভিতর দিতে ফুসফুসের রক্তজালিকার অন্তস্থঃতল পর্যন্ত এক বা দুই নিশ্বাসে টেনে নিতে পারলেই ইহ জগতের সমস্ত দুর্দশাপ্রাপ্তি থেকে নিষ্কৃতি। নেশার শুরুর দিক ভীষণ অস্বস্তিজনক। একবার মশলা টানলে তারপরের চব্বিশঘণ্টা চরমদশা।গা পাকিয়ে ওঠে।মাথা ঝিমঝিম।মনে হবে এই পৃথিবীর সমস্ত গরল নির্যাস পেটের ভিতর থেকে রক্তবমি হয়ে উগড়ে উঠবে বুঝি।
     মানিকের মেশোমশাই হল ব্রিজের নিচের,সাবওয়ের বিভিন্ন পাতাখোর দলে পুরিয়া সরবরাহকারী।নিয়মমতো,সময় করে ব্রিজের নিচের বিভিন্ন অন্ধকার কোণে পৌঁছে দিতে হয় এই মারণ গুঁড়ো।ছোট্ট ছোট্ট চিন কাগজের পাউচে ভরা থাকে সাদা মৃত্যু গুঁড়ো।এমন নেশারু দল ওই তল্লাটে প্রায় পনেরো কুড়িটা আছে।কিছু শীর্ণকায়, অভুক্ত,অভাবী, ঘোলাটে মানুষের জমায়েত অধীর আগ্রহে বসে থাকে হত্যে দিয়ে।মনে হয়,চাতক জলের জন্য বসে কিংবা যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি বসে, আপনজনের চিঠির অপেক্ষায়।বুভুক্ষু বুনো শেয়াল যেমন মোরগের ছানা দেখে ঝাঁপিয়ে পরে ঠিক তেমন সাবওয়ের অন্ধকার কোণা থেকে এগিয়ে আসে নেশাগ্রস্থ চোখ,কালচে হাত আর হলুদ দাঁত।আপাত দুর্বল মানুষও যে ভীতিপ্রদ হতে পারে, এদের না দেখলে জানাই হত না মানিকের।মানিক বছর খানেক মেসোমশাই এর কাজে যোগ দিয়েছে।কাছ থেকে দেখছে অন্ধকার দুনিয়ার আরো অন্ধকার ঘর গুলোর বিভিন্ন বন্ধ কূপ।এমনিতে কাজটায় ঝামেলার কিছুই নেই।খুবই সহজ সাদামাঠা ব্যপার।বিকেলের দিকে আপের ট্রেন ধরে পার্ক সার্কাসে নামতে হয়।ওভারব্রিজ পেরিয়ে নেমে এসে স্টেশন থেকে বেরিয়ে কয়েকগজ হেঁটে এসে কোটোদার গারাজে দাঁড়াতে হয়।খানিকটা পর বসির আসে।বসির নাকি জেল খেটেছে দু পাঁচ বার।তবে পেটি কেস।বসিরের হাতেই টাকা দিতে হয়।কুড়িটা পাউচের জন্য, এক হাজার পাঁচশো আশি টাকা দিতে হয় বসিরের হাতে।এই একবছরে বসির মাত্র দেড় খানা কথা বলেছে মানিকের সঙ্গে।একদিন বলেছিল,'জলদি!'শুনেই খুব তাড়াতাড়ি টাকা চালান করে দিয়েছিল মানিক।আরেকদিন পঞ্চাশ টাকার নোট তুলে বলেছিল,'পালটে দাও!'নোট টা ঈষৎ ফুটো ছিল।মানিকও নিশব্দে পালটে দিয়েছিল।
      বসিরকে টাকা দিয়ে আরো আধঘন্টা টানা প্রতিক্ষা করতে হয় মানিককে।কোটোদার গ্যারাজের উলটো দিকে,রাস্তার ধারেই একটা শহুরে  ধুলো মাখা ছাতিম গাছ আছে।কে কবে কেনই বা এমন একটা গাছ এখানে পুঁতেছিল কেইবা খবর রাখে।ছাতিমগাছটার পায়ের কাছে একজন মাঝবয়সী মহিলা কীসব শেকড়বাকড় বিক্রি করে।গাছটার গায়ে পেরেক ঠুকে লাগিয়ে রাখে ছোট্ট সাইনবোর্ড। শ্বেতচন্দন, অনন্তমূল সহ ইত্যাদিতে ঠিক কী কী ভাবে আপনার সুসময় আসবে।কোটোদার গ্যারাজের ধাতব শব্দ খুব বিচ্ছিরি লাগে মানিকের। ভদ্রমহিলার শেকড়ের দোকানের পাশেই ছাতিমগাছের একটা বসবারযোগ্য মোটা শেকড়ের ওপরে গিয়ে বসে মানিক।উনি জল দেন কখনো ।মাঝেমধ্যে বাতাসা দেয়।সুখদুঃখের গল্প শোনায়।ওঁকে দেখলেই বেশ একটা মা মা বোধহয় মানিকের।ভদ্রমহিলার সঙ্গে মানিকের আলাপটাও কেমন করে হল বলা মুশকিল।ভদ্রমহিলার মুখের বলি রেখা গুলোকে অভিজ্ঞতার গ্রাফ বলে মনে হয় ওর।উনি জিজ্ঞেস করেন,
'বাপ,তোর বাড়ি কোথায়?'
'নবদ্বীপ ..মানে আরো যেতে হয়।ঠিক নবদ্বীপ নয়!তবে এখন কলকাতায় থাকি।'
'অ,তা বেশ! আমার বর থাকত নবদ্বীপে।'
'থাকত মানে? আর নেই? মরে গেছে নাকি?'
'ধুর,মরবে কেন র‍্যা! স্বভাব ভালো ছেল না মরদের।জেল খাটল।এখন তো শুনি কলকাতায় কোথাও থাকে!'
'কলকাতায় কোথায় গো? তোমার সাথে যোগাযোগ নেই!'
'কুমোরটুলির ওদিকটায়!নাহ্!সেভাবে নেই!তবে সিঁদুরটা ওই মিনসেরই পরি!'
'কুমোরটুলি! আমিও তো শোভাবাজারে থাকি গো!বলো তো আমি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিচ্ছি!'
'না বাপ তোকে কিছু করতে হবে নি। তা তোর বাড়িতে আর কে আছে?'অন্যকথায় চলে যান ভদ্রমহিলা।
'কেউ না!আমি আর বউ।'
'তোর মা নেই? বাপ?'
'শুনেছি আমি হতে গিয়ে মা মারা গেসলো!আর আমার যখন তিন কি চার তখন বাপ চলে যায় কোথায় কে জানে!'
মানিকের কথা শুনে উনি ক্ষনিকের জন্য কোথায় যেন হারিয়ে যান।গ্লকোমা ছড়ানো ঘোলা চোখের মণি দুটো ভীষণ গভীর মনে হয় মানিকের।
এমনই বিভিন্ন দরকারি বা অদরকারি কথাবার্তা চলতে থাকে।দূরের মসজিদ থেকে পবিত্র আজানের সুর ভাসতে থাকে শহরের সূর্যাস্তের আকাশে।লালচে আভা দিয়ে পড়ন্ত সূর্য ভরিয়ে দিয়ে যায় এক আকাশ ক্যানভাস।স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নেমে আসে দিলীপ।বসির,দিলীপ এগুলো আদৌ এদের আসল নাম কিনা জানে না মানিক।গোধূলি হাওয়ায় নিজেকে মাঝেমাঝে খুব উষ্কখুষ্ক লাগে মানিকের।এই মৃত্যুবীজ সরবরাহের কাজে নিজেকে অতি নিকৃষ্ট ধরনের কীটাণু বলে মনে পরে ওর। গৌরিকে মনে পড়ে মানিকের।


গৌরি মানিকের স্ত্রী। মানিক ওর স্ত্রীকে আকাশ কিনে দিতে চায়।আকাশ কোথায় কিনতে পাওয়া যায় জানে না মানিক।কত টাকা হলে এক আকাশ সুখের মালিক হওয়া যাবে,তাও বলতে পারে না ও।কত সহস্র স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে এক আঁচল গোধূলি এনে রাখতে পারবে গৌরির পায়ে,সে চিন্তায় উদাস হয় যখনতখন। গৌরির প্রেমে মানিক ছিল না কখনো। মানিক যেন জন্মাবধি গৌরি নামক একটা আস্ত সমুদ্রের নিচে কোনও এক মায়া নগরীর নীলচে প্রাসাদে বাস করে আসছে।সারাদিন ধরে হকারি করবার পর।ঘরে ফিরে গৌরির কাঁধে মাথা রাখে মানিক।মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে।চুলে বিলি এঁকে দিয়ে,কখনো আঁচলে মুখটা মুছিয়ে দেয়। গৌরির দুই স্তনের মাঝে মুখটা রাখে মানিক।কোমল স্নেহের মত যৌবনা স্পর্শে মনে পড়ন্ত সূর্যের উষ্ণ আভা জল রঙের মত চুঁইয়ে নেমে আসছে মানিকের মুখে।
মানিকের এক কামরার খুপরি।এক পাল্লার কাঠের দরজা। একটা রান্নাঘর।মাথার ওপর টিনের চাল।একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ফ্যান।সেদিনও কাজ থেকে ফিরে গৌরির কাছেই বসেছিল মানিক।গৌরি স্বভাব মিতবাক মানুষ।চোখের ভাষা তাঁর মুখের ভাষার চেয়েও বাঙ্ময়।সেই কোন ছোটবেলা থেকে গৌরি মানিক একসাথে।ইস্কুল পালিয়ে গৌরিকে বিয়ে করেছিল মানিক।মানিক যে নিজে কিছু করতে চায়।বাঁচতে চায়।তার যথাযথ কারণ আছে একটা। তাহল,গৌরি।খারাপ হোক বা ভালো,এই কাজটুকু মেসোমশাই ব্যবস্থা করে দিয়েছে।ইদানীং ওর কমিশন হঠাতই বাড়িয়ে দিয়েছে মেসোমশাই।ছোটবেলায় মানিক নবদ্বীপে মেসোমশাই এর পাইকারি পানের দোকানে  কাজ করত।কাজ করত না ঠিক।দশবছরের বাচ্চা আর কী বা কাজ করতে পারে।তারপর মেসোমশাই একদিন আকস্মিক দোকান তুলে দিয়ে কোথায় যেন চলে গেল!তারপর বেশ কয়েক বছর পর।একদিন মেসোমশাই আবার এসে হাজির।ততদিনে মানিক বিয়ে করে নিয়েছে।মানিক তখন রাখি কারখানায় কাজ করছে।মজুরি দিনে একশো আশিটাকা।হপ্তায় চারদিন কাজ।চলত খারাপ না।তবে আকাশ কেনার বড় কাছাকাছি ছিল ওরা।মেসোমশাই তখন বলেছিল,'আর এখানে থেকে কী করবি।আমার ওখানে চল।ভালো কাজে ঢুকিয়ে দেব!'
গৌরি আসতে চায়নি।বলেছিল,'কী হবে ওসব কলকাতায় গিয়ে।এখানে তো বেশ আছি গো!'
গৌরির কথা শোনেনি মানিক।কলকাতা আর মেসোমশাই হাতছানি দিয়েছিল।সুখে থাকার লোভ হয়েছিল।ফুটপাতে মানিকের প্লাস্টিকের সরঞ্জামের একটা ছোট্ট দোকান আছে।যেটা সারাদিন খোলা রাখে।সমাজের চোখে ও হকার।আর সন্ধে হলে সাপ্লাই করে আসে পুরিয়া।এসব বন্দোবস্ত করে দিয়েছে মানিকের মেসোমশাই।
    'শোনো না,একটা কথা বলি!'অন্ধকার খাদের কোনো এক অসহায় গভীরতা থেকে যেন ভেসে আসে গৌরির গলা।বেশ কয়েকমাস যাবৎ গৌরিকে যেন খুব অন্যমনস্ক লাগে মানিকের।যেন আছে কিন্তু নেই।সবই করে কিন্তু করে না।জলজ্যান্ত মানুষটা কোনও একটা অজানা ভিড়ে রাস্তা হারিয়ে এলোমেলোমি ঘুরপাক খাচ্ছে।রাত্রে শুয়ে,মানিক যখন বলে,'এদিকে ঘুরে শোও না!'দুচারবার বললে নিশ্চয় ওর দিকে ঘুরে শোয়।কিন্তু ঠিক ভাবে মুখ তুলে চায়ও না।'কী হয়েছে গৌরির?কেন এমন হয়ে গেল ও!'এই চিন্তাও ঠোকরায় মানিককে মাঝেমধ্যে। গৌরির ডাক শুনে মানিক বলে 'কী হয়েছে?বলো তুমি!'
'তোমাকে অনেকদিন ধরেই বলব ভাবছি।আমি আর পারছিনা সহ্য করতে।'বড় কাতর শোনায় গৌরিকে।
'এই,কী হয়েছে!কী হয়েছে!'প্রদীপ শিখাকে যেমন দুহাতে আগলায় ঠিক তেমন করে দুহাতে গৌরির মুখটা সামনে তুলে ধরে মানিক।দুচোখ বেয়ে নেমে আসছে জল।চোখের কোণা কালীবর্ণ।
'তুমি যখন বাড়ি থাক না।সকালের দিকে হকারিতে যাও,তখন দিলীপ আসে।তুমি যে কীসব হেরোইন নাকি সাপ্লাই এর কাজ কর।আমাকে বলেছে দিলীপ।দিলীপ তো এমনি তে কথাই বলে না,সে এতদূর এলো কী করে?ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি মানিক।আরও বলতে থাকে গৌরি,'আমি শরীরটা না দিলে তোমায় মেরে দেওয়ার ভয় দেখায়।বলে ওকে করতে না দিলে,তোমাকে মার্ডার করে দেবে।আর প্রত্যেকদিন সন্ধেবেলা আসে মেসোমশাই।বলে তোমায় ফলস্ কেসে ফাঁসিয়ে দিতে ওর দুমিনিট লাগবে।দুজন মিলে আমায় শুষে শেষ করে দিচ্ছে।তুমি এসব কাজে কেন ঢুকলে? কেন? কেন?কেন?'চিৎকার করে কাঁদতে থাকে গৌরি।শোক,হতাশা আর যন্ত্রণা ফেনিল জলপ্রপাতের মত আছড়ে পড়ছে মানিকের বুকে।মানিকের বুকে ঘৃণার আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়ছে অবশ্যম্ভাবী বিস্ফোরণে।


এখন চৈত্র মাসের বিকেল।অনেকক্ষন ধরে প্রিজন ভ্যান চলছে।রাস্তাঘাট ভিড়ভাট্টা অনেক।দোকানে দোকানে সেল চলছে।মানিকেরও প্লাস্টিকের সরঞ্জামের দোকান। দোকান ছিল।আর দোকান খোলা হবে না কোনদিন।রাস্তাটা মোড় ঘুরে যাওয়ায় এখন সূর্যটা উলটো দিকে।রোদটা লাগছে না আর।কিছুক্ষণ আগে অব্দি রোদটাকে তপ্ত পারদের মত লাগছিল।গৌরির কথা মনে পড়ছে ওর।এতক্ষণে ও জলপাইগুড়ি পৌঁছে গিয়ে থাকবে।
   সেদিন ঘটনা শোনার পর মানিক সময় নষ্ট করেনি।সোজা চলে গিয়েছিল কুমোরটুলি।মেসোমশাই এর বাড়ি।ভড়দুপুরে,মেসোমশাই এর দরজায় বেল বাজায়।দরজা খোলে নিজেই।
'আমার সাথে কেন এটা করলে?তোর তো মেয়ের মত গৌরি।দিনের পর দিন...শুয়োরের বাচ্চা।দুনিয়ার সবচে নোংরা বেশ্যাও তোকে জন্ম দেওয়ার আগে দুবার ভাববে..'
'সব যখন জেনেই ফেলেছিস!কী বা বলি বল!তোর বউ তোরই।আমি তো শুধু মাঝেমধ্যে একটুআধটু খাচ্ছি!'কথা গুলো বলে।একটা গা ঘিনঘিনে ধরণের মুচকি হাসে মেসোমশাই।কথা বলে পকেট থেকে দুচারটে পাঁচশো টাকার নোট সামনের টেবিলে ছুঁড়ে দেয়।তারপর হাসতে হাসতে বলে,'নে,টাকা কটা নিয়ে মাথা ঠান্ডা কর।মাল আনতে যাওয়ার সময় হল তো!' মেসোমশাই এর নির্লিপ্তি ব্যবহারে হতবাক হয় না মানিক।বরঞ্চ ক্রোধে মাথায় খুন চেপে যায়।দরজার পাশে পড়ে থাকা খিলটা চকিতে তুলে নেয় ও।ব্রহ্মতালু বরাবর সজোরে চালিয়ে দেয়।ফিনকিরি দিয়ে রক্ত ছিটকে বেরিয়ে আসে প্রথমেই।তারপর রক্তের স্রোতোবহা ধারায় ভিজে যায় মেঝে।মানিকের মনে হয় বদরক্তে কি ধুয়ে যাচ্ছে মৃত্যুব্যবসার পাপ? 
             পাশের ঘরে গিয়ে বেসিনে হাত ধোয় মানিক।হাতে লেগে থাকা বদরক্ত ধুয়ে যায়।টেবিলে ফেলে রাখা টাকাগুলো তুলে নেয়।গুনে দ্যাখে পুরো দুহাজার।নিঃশব্দে পিছনের লোহার ঘোড়ানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে সবার অলক্ষ্যে।বাড়ির পিছন দিকটায় লোকজন বরাবর কমই থাকে।নিজের বাড়ি আসে মানিক।গৌরিকে জানায় না কিছুই।সেদিন আর পুরিয়া আনতে যায় না মানিক।সন্ধে হয় ধীরেসুস্থে বাড়ি থেকে বেরোয় ও।লক্ষ্য কালুর ঠেক।কালুর শিয়ালদা অঞ্চলের মাঝারি মাপের সমাজবিরোধী। ছোট দুএকটা ছিনতাই কেসে জেল খেটেছে।মানিকের সঙ্গে বেশ কিছু দিনের আলাপ।মানিককে দাদা বলে।সম্মান করে খানিকটা বলেও মনে হয়।
'কী গো মানিকদা!কী ব্যপার গো!লেন ভুলে এ গলিতে নাকি গো!'
'সময় কম।আমার খুব আর্জেন্ট একটা পাইপগান লাগবে।লাগবেই।তুমি না করতে পারবে না ভাই।ধরো কারো জীবনের ব্যপার!'
'অ্যাঁ!কী বলছ বস!শরীরটরীর ঠিক আচে তো? '
'সব ঠিক আছে।তোমাকে দিতেই হবে।খুব দরকার।তুমি কোনো চাপে পড়বে না।কথা দিচ্চি।'
'কিন্তু মাল লাগবে।পুরো পাঁচহাজার।আছে?'
'আছে।এই নাও।'দশটা পাঁচশোটাকা কালুর পকেটে ভরে দেয় ও।
কালু ওর খুপরি ঘরের ভিতরে যায়।খবরের কাগজ মুড়িয়ে মেশিন নিয়ে আসে।
'দ্যাখো তোমায় একটা ভালো মাল দিচ্চি।এটা লোকাল মেড রিভালবার।ছটা দানাই থাকবে।আর শ পাঁচেক লাগবে ছটা দানার জন্য।'
আরো পাঁচশো দিয়ে দানাও নিয়ে নেয় মানিক।
বাড়ি ফেরে।তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পরে।স্বামীস্ত্রী তে বিশেষ কথাবার্তা হয়না।স্থিরপ্রতিজ্ঞ সশস্ত্র বিপ্লবীর মত দৃঢ়ভাব জেগে ওঠে মানিকের  রক্তজালিকার কোষে কোষে।মন্দিরের ঘণ্টাধ্বনি,কাকের ক্যাকোফনি আর কলতলার বস্তিসুলভ ক্যাঁচোরম্যাচোঁরে সকাল হল।চোখ রোগড়ে,হাই তুলে তাকাল মানিক।দেখল গৌরিও স্নান সেরে ঠাকুরের তাকে ধুপ জ্বেলেছে।চা চাপিয়েছে স্টোভে।গৌরিকে দেখে খুব মলিন মনে হয় মানিকের।বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে গৌরির পাশে দাঁড়ায়। দুহাত রাখে গৌরির কাঁধে।গৌরির চোখ দুটো জলে থইথই করছে।বিষাক্ত সত্যের সহসা উন্মোচন সমস্ত স্বপ্নালু আবেগ ভেঙে বাস্তবের কাছে এনে দাঁড় করিয়েছে মানিককে।
'এদিকে তাকাও।তাকাও আমার দিকে।'মানিকের গলার স্বর হীরক খন্ডের মতই কঠিন।কাচের মেকি প্রাসাদ কেটে কুটিকুটি ক'রে দিতে চায় যেন।
গৌরির চিবুকে আঙুল ঠেকিয়ে আলত করে ওর মুখটা সামনে ধরে।ওর দুই ঠোঁটের মাঝে ডুবিয়ে দেয় ঠোঁট।দুটো আদিমতম যুগল সমস্ত প্রেমশক্তিতে ভরে ওঠে দুটি জিভ।আষ্টেপৃষ্ঠে একে ওপরের নিখাদ ভালবাসা শুষে নেয় সারাজীবনের মতো।দরজায় দুমদুম করে কেউ ডাকে।'মানিকদা,মানিকদা...'
মানিক ধীরেসুস্থে গিয়ে দরজা খোলে।বস্তির এক কিশোর হাঁপাচ্ছে।'খবর শুনেছ?'...
'বল শুনি..'মানিক অভিপ্রেত খবরের অপেক্ষাতেই ছিল যেন।
'আরে,তোমার মেসো গো;কী যেন নাম! নিতাই হালদার।মালকে কে যেন মার্ডার করে গেছে।'
'ও..'বড়ই নির্লিপ্ত লাগে মানিককে।
'তুমি যাবে না? আমি যাচ্ছি।'
'তুই এগো।আমি যাচ্ছি।'
দরজা বন্ধ করে মানিক।গৌরি শুনেছে সবটুকু।তার চোখে জিজ্ঞাসা।
'পাপ।পাপের খেসারত!'
'আর এক পাপি যে এখনো...'গৌরির কথায় ভিতরে ভিতরে চমকে ওঠে।
গৌরির হাতে ভাত আর মসুরির ডাল আর আলুভাতে ভাত ভালোবাসে মানিক।
'একটু মসুরির ডাল ভাত খাওয়াবে?আমি চান করে আসি।'
খুব তৃপ্তি ক'রে বেশ পরিপাটি করে ভাত কটা খায় মানিক।তারপর টিনের ট্রাঙ্ক খোলে।জমানো টাকা থেকে দুহাজারের নোট বার করে মানিক।গৌরির হাতে টাকাটা দেয়।'আমি বেরচ্ছি।কবে কীভাবে আবার আমাদের দ্যাখা হবে বলা মুশকিল।ধর্মতলা থেকে বাস ধরে জলপাইগুড়ি যাবে।যদি কখনো আমি ফিরতে পারি।তবে জলপাইগুড়িতেই যাব।'জলপাইগুড়িতে গৌরির পিসিমার বাড়ি।গৌরির নিজের বলতে মানিক ছাড়া একমাত্র ওই পিসিমাই রয়েছেন।
গৌরি মাথা নাড়ে।গৌরিকে আড়াল করে রিভলভারটা কোমরে গোঁজে মানিক। 'আসছি' বলে দরজার দিকে পা বাড়ায়। 'শোনো' পিছু ডাকে গৌরি।এগিয়ে এসে  হয়ত শেষবারের মতই মানিকের গলা ধরে নিজের মুখের কাছে নামিয়ে এনে মানিকের কপালে চুমু খায় গৌরি।'সাবধানে থেকো গো।আমি অপেক্ষা করব।'
'বেশ।আসি।'একটা নতুন মাস্ক পরে মানিক বেরিয়ে আসে।এবার মানিক ওর মেসোমশাই নিতাই এর বাড়ির সামনে আসে। থিকথিক করছে পুলিশ।প্রচুর সাধারণ মানুষও জড়ো হয়েছে।সহানুভূতি হাওয়ায় ভাসছে।'আহা গো,কীই ভালো মানুষ ছিল গো!' 'কারো সাতে পাঁচে থাকত না লোকটা!'একজন ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়িওয়ালা বললেন,'কলকাতার ল অ্যান্ড অর্ডার দিন কে দিন যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে!
এরই মাঝে এক ভদ্রমহিলা বললেন,'ওনার স্ত্রী ছিলেন..ঠিক খবর পেয়ে চলে এসেছিল! '
কথাটা কানে আসতেই কেমন যেন খটকা লাগল মানিকের।সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে যায় মানিক।হাত ঘড়ি দ্যাখে।দুপুর দুটো কুড়ি।ভিড় এড়িয়ে,ধীরেসুস্থে শিয়ালদা স্টেশনে হাজির হয়।একটু ইতিউতি ঘুরে নির্দিষ্ট ট্রেনের সময় হয়।ট্রেন এলে চেপে বসে।গন্তব্য পার্কসার্কাস।ট্রেন পৌঁছায়।নেমে গিয়ে কোটোদার গ্যারেজ;বসিরও আসে।চলেও যায়।'আচ্ছা এরা কি জানে না কিছু?'মনে প্রশ্ন আসে মানিকের।মনের প্রশ্ন মনেই থাকে।কারণ এ লাইনের গলিঘুঁজি ভীষণরকম কানা।পয়সা ছাড়া কিছুই চেনে না।উলটো দিকের ছাতিম গাছটা আজকেও ধুলো মাখছে।কিন্তু ভদ্রমহিলা আসেনি আজ।'ভালোই হয়েছে একদিক থেকে!'
নির্দিষ্ট সময়ে দিলীপ দেখা দেয়।দিলীপকে স্টেশনের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে শিরদাঁড়া সোজা করে বুক টানটান করে দাঁড়ায় মানিক।আসপাশের পৃথিবীটা নিজের ছন্দে চলেছে।পঙ্গু ভিখিরি ভিক্ষা করছে।ঘটি গরম বেচছে মধ্যবয়সী ভদ্রলোক।কোটোদা মোটরসাইকেলের স্পার্কিংপ্লাগে ফুঁ দিচ্ছে।দিলীপ সামনে এসে দাঁড়ায়।'ও কি কিছুই জানে না?না জানুক।আমি জানি এর বাঁচার অধিকার নেই!'মানিক দৃঢ়কায়। দিলীপ প্যান্টের টিকিট পকেটে আঙুল পুরে দেয়,মাল বের করবে বলে।মাথা ঝুঁকে আছে।সময় নষ্ট করার সময় নেই মানিকের।রিভালবারের লক খোলাই ছিল।ব্রহ্মতালুতে নল ঠেকিয়ে ট্রিগার চেপে ধরে।ফুল চেম্বার খালি।উপচে পড়ছে রক্ত।দিলীপ খুন হয়ে গেল।মানিকের অদ্ভুত হালকা লাগছে।পশ্চিমের আকাশে লালচে আভা বলছে দিন শেষ হয়ে এলো।স্টেশনের জি আর পি র দল ছুটে এসেছে।মানিককে বিনা বাধায় গ্রেপ্তার করল।সাধারণ মানুষ 'খুন খুন' চিৎকারে ভয় ওড়াচ্ছে হাওয়ায়।সারারাত জি আর পি লক আপে মানিক।সত্যিকার বয়ান দিয়েছে সে।সবটুকু বলেছে সে।পাতা সাপ্লাই নিয়েও যা জানে সব বলেছে ও।তবে রিভালবার কোথা থেকে জোগাড় করল,তা বলেনি কোনভাবে।কারন কালুকে কথা দিয়েছে কালু কোনভাবে সমস্যায় পড়বে না। কোটোদা,বসির,রাতেই গ্রেপ্তার হয়েছে।পরদিন সকাল হয় ঢিমেতালে।হাতকড়া পরিয়ে প্রিজন ভ্যানে তুলছে।অদূরে দাঁড়িয়ে ভদ্রমহিলা।ভিড় ঠেলে কাছে এগিয়ে আসে,কানের কাছে বলে,'আমি সব শুনেছি।ঠিক করেছিস বাপ!যার যেমন পাপ তেমন পরিণতি'চোখ ছলছল করছে ওঁর।খুব অস্বাভাবিক রকমের খটকা লাগে মানিকের 'উনি কী শুনেছেন?কার পাপ?কারই বা পরিণতি! উনি কীভাবে চেনেন মেসোমশাইকে?আচ্ছা ভদ্রমহিলা থানই বা পড়ে কেন?ওর স্বামী কি হঠাতই মারা গেলেন!ঘুরপাক খায় প্রশ্ন।যদি জেল থেকে ফিরি জিজ্ঞেস করব!'মানিকের মনে প্রশ্ন আসে।কিন্তু মানিক জেল থেকে ফেরেনি এখনো।

শৌভিক চ্যাটার্জী 
কালনা, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ











0 Comments