রবীন বসুর অণুগল্প
শূন্যতা
"ডাক্তারবাবু,আজ কেমন দেখলেন আমার ছেলেকে?'' করিডর দিয়ে দৌড়ে যায় রমেন বোস, ডাক্তার তমাল ব্যানার্জীর কাছে।
"একই রকম।আসলে ওর আঘাত খুব গুরুতর। মাথার মধ্যে আর কিডনিতে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।"
এবার রমেনবাবু বেশ ঝাঁঝিয়ে ওঠেন, "সেতো আজ চারদিন ধরে শুনে আসছি। এতবড় নামকরা হসপিটাল আপনাদের, এত বড় বড় ডাক্তার আপনারা, রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে পারছেন না? কী চিকিৎসা হচ্ছে?এদিকে বিল তো চারদিনে চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে। আপনারা না পারেন ছেড়ে দিন। আমরা অন্য হসপিটালে নিয়ে যাই।"
"দেখুন,আমি ডাক্তার হিসেবে যা বলার বলেছি,এবার আপনারা ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলুন,স্যরি।"
ডাক্তারবাবু চলে গেলেন।
পড়াশোনায় ভালো ছিল কৌশিক। খড়গপুর আই আই টি থেকে পাশ করার আগেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে সে চাকরি পেয়ে গিয়েছিল ইনফোসিসে। কয়েকমাস আগে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভের অফিসে জয়েন করেছিল।
প্রতিদিনের মত সকালে খেয়ে নিজের বাইক নিয়ে বেরিয়ে ছিল।পরমা আইল্যাণ্ডের কাছে বাঁক নিতে গিয়ে রংরুটে আসা এক টাটাসুমোর সঙ্গে মুখোমুখি অ্যাক্সিডেন্ট। মাথা আর পেটে প্রচণ্ড আঘাত।
সবে অফিসে বসে জলের বোতলের ছিপিটা খুলেছেন রমেনবাবু এমন সময় থানা থেকে ফোন,"আপনার ছেলের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।চলে আসুন শিগ্গির।" তারপর বাইপাসের ধারের একটা হসপিটালের নাম বলেছিল অফিসার।
সেই থেকে চারদিন স্বামী-স্ত্রী হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন এখানে।প্রথমে আই সি ইউতে পরে ভেন্টিলেশনে নিয়ে গেছে। ছেলের মুখটাও ঠিক মত দেখতে পাননি তাঁরা। রমেনবাবু আর ধৈর্য রাখতে পারলেন না,স্ত্রীর হাত ধরে সোজা ম্যানেজমেন্টের দরজায়। এক জাঁদরেল মহিলা বসেছিলেন, সিইও।
"আপনারা না পারেন ছেড়ে দিন,আমরা অন্য জায়গায় নিয়ে যাই।"
"আসলে অপারেশন করা দরকার,কিন্তু আপনার ছেলের শরীরের যা কণ্ডিশন তাতে আপারেশন করা যাচ্ছে না,তাই—"
"তাই আপনারা আমাকে মিথ্যে স্তোক দিচ্ছেন।আমার ছেলেকে বিনা চিকিৎসায় ভেন্টিলেশনে রেখেছেন। আর প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বিল ধরাচ্ছেন।"
ভদ্রমহিলা এবার উঠে দাঁড়ালেন। বিকৃত রূঢ় স্বরে বললেন,"আপনার ছেলে এক্সপায়ার করেছে। বকেয়া বিল মিটিয়ে বডি নিয়ে যান—"
রমেনবাবুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সন্তান হারানোর বেদনার সাথে সাথে এই বেসরকারি হসপিটালগুলোর অমানবিক ব্যবহার তাঁকে আরও বেশি আহত করল। তিনি অবশ্য হাল ছাড়েন নি।অভিযোগ জানিয়েছিলেন সরকারের কাছে। সরকারী তদন্ত কমিশন রিপোর্ট দিল,কৌশিককে যেদিন হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছিল,সেদিন রাতেই তার মৃত্যু হয়েছিল অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে।অথচ সেকথা চেপে কর্তৃপক্ষ তিন দিন ভেন্টিলেশনের বডি রেখে লাখ লাখ টাকা বিল করেছে। জল অনেক দূর গড়াল। সরকার ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় তার জন্য বিধানসভায় বিল আনল। বেসরকারী হসপিটালগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য।
আর রমেনবাবু ও সুধাদেবী এখন সন্তানহীন বাড়িতে খাঁ খাঁ শূন্যতার মাঝে মুখোমুখি বসে থাকেন।
1 Comments
আন্তরিক ধন্যবাদ আর অভিনন্দন জানাই। সুন্দর সংখ্যা হয়েছে।🙏
উত্তরমুছুন