๛ সুকান্ত মণ্ডল 🔹মালদা 🔹
☘ গ্রীষ্মকাল। এমনিতেই খুব গরম। বিকেলের চা খাচ্ছি। চা খেতে খেতে ঘেমে একেবারে স্নান করে নেওয়ার মতো অবস্থা। বাবা বললেন, 'চল্ নদীর দিক থেকে ঘুরে আসি, শরীরও ঠান্ডা হবে আর মনও।' হাঁটতে হাঁটতে আমরা দু'জনে নদীর পাড়ে গিয়ে হাজির। ঘাট থেকে একটু দূরে ঘন দূর্বাঘাস খুঁজে বসে পড়লাম। ঘাটের দিকে লক্ষ্য করতেই দেখি একটি মাঝি তার সারাদিনের কাজ শেষে ডিঙিটাকে ডাঙায় বাঁধছে। সারাদিনের মৈথুন শেষে সূর্য তার লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা মুখ পাহাড়ের খাঁজে লুকোচ্ছে। আকাশে পাখিরা নিজের বাসায় ফিরে আসার যাত্রা শুরু করেছে। চারিদিক নিঃশব্দ ও নিস্তব্ধ। শুধু নদী তার নিজস্ব শব্দে ও ছন্দে প্রবাহিত। স্নিগ্ধ প্রকৃতির বুকে আমরা বিভোর হয়ে আত্মমগ্ন। হঠাৎ সমস্ত নিস্তব্ধতাকে ছিন্ন করে বাবা বলে উঠলেন, "ওরে তোরা কি জানিস কেউ / জলে কেন ওঠে এত ঢেউ / ওরা দিবস-রজনী নাচে, / তাহা শিখেছে কাহার কাছে...।" দীর্ঘ আবৃত্তিটি শেষ হতেই আমি জিজ্ঞেস করি, 'বাবা এটা কার লেখা?' একবুক ঠান্ডা বাতাসে দম নিয়ে বললেন, "রবীন্দ্রনাথ।"
এই রবীন্দ্রনাথের সাথে আমার প্রথম পরিচয় বাবার হাত ধরেই। সেইদিনটির কথা এখনও খুব স্পষ্ট মনে পড়ে। আমাদের গ্রামের লাইব্রেরীতে ২৫ শে বৈশাখ উপলক্ষ্যে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল। বাবা ছিলেন তখন সেই লাইব্রেরীর সেক্রেটারী। আমার বয়স তখন তিন বা সাড়ে তিন। স্কুল যাওয়া তখনও শুরু হয়নি। বাবা আমাকে "মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি" ছড়াটি মুখস্ত করিয়েছিলেন। আমি হাত নেড়ে নেড়ে মঞ্চের উপর আবৃত্তিটি করেছিলাম। মঞ্চের একপাশে টেবিলের উপর সাদা চুল ও সাদা দাড়িওলা বুড়ো মানুষটার ছবিতে মালা দেওয়া দেখে আমি বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলাম বুড়োটা কে। বাবা একগাল হাসি নিয়ে বলেছিলেন, "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইনিই হলেন আমাদের বিশ্বকবি, রবীন্দ্রনাথ।" স্কুলে ভর্তির পর যত উপরে উঠেছি রবীন্দ্রনাথকে তত নতুন করে জানতে শিখেছি।
অনেক পরে জানলাম শান্তিনিকেতনের কথা। রবীন্দ্রনাথ একটি লেখায় বলেছেন, "অন্ন চাই, প্রাণ চাই, চাই মুক্ত বায়ু / চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ উজ্জ্বল পরমায়ু।" পরিবেশ অনুকূল না হলে তাঁর ওই চাওয়া যে পাওয়ার রূপ নেবে না তা তিনি ভালোভাবেই বুঝেছিলেন। আর এজন্যই প্রকৃতির মাঝে গড়ে তুলেছিলেন 'ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড়' শান্তিনিকেতন। শহুরে মানুষেরা রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে চিনতে শিখলেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ভালোবাসতে শিখলেন প্রকৃতি। না, আমাকে নতুনভাবে প্রকৃতিকে চিনতে হয়নি। 'ছায়া-সুনিবিড়' ভূতনী দিয়াড়ার প্রাকৃতিক পরিবেশেই আমার বেড়ে ওঠা। বাবার হাত ধরে আমি অনুভব করতে শিখেছি প্রকৃতিকে। রবীন্দ্রনাথের মতো করে ভালোবাসতে শিখেছি প্রকৃতিকে। না, আমি কখনও শান্তিনিকেতন যাইনি। কখনও কোপাই নদীর কূলে ঘুরিনি, ময়ূরাক্ষীতে স্নান করিনি। তবে বাবার হাত ধরে আমি ফুলাহারের পাড়ে ঘুরেছি। গঙ্গার স্নিগ্ধ জলে স্নান করেছি, সাঁতার কেটেছি, গামছা দিয়ে মাছ ধরেছি। আমি শান্তিনিকেতন দেখিনি ঠিকই, তবে ভূতনী দিয়াড়ার মাটিতে বসে খুব স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারি শান্তিনিকেতনকে।
মনের শান্তি নিয়ে তো শুধু বড় হওয়া যায় না। বড় হতে গেলে দরকার সঠিক শিক্ষা। আর এই শিক্ষা গ্রহণের জন্য 'শান্তিনিকেতনে' না পারলেও বাবা আমাকে ভর্তি করলেন 'শিক্ষানিকেতনে' (মানিকচক শিক্ষানিকেতন উচ্চ বিদ্যালয়)। নামদুটোর মধ্যে সিমিল্যারিটি দেখে আমার মন নেচে উঠেছিল। "হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে...।" অনেকটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। ক্লাস সিক্সের বাচ্চা ছেলেটি প্রথম 'ঘর' থেকে 'বাহির' হলো। একটি মেসে আমার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সেই সময় রবিঠাকুরের 'জীবনস্মৃতি' উপন্যাসটি কিনে দিয়ে বলেছিলেন, 'কখনো ভালো না লাগলে বইটি পড়িস।' বাড়ি ছেড়ে প্রথম একা। এমনিতেই মন খারাপ। বাবা বলেছেন মন খারাপ করলে বইটি পড়তে। সত্যি বলতে বইটির 'ঘর ও বাহির' অধ্যায়টি পড়ে আমার মন আরও খারাপ হয়েছিল। বাড়ি যাওয়ার জন্য কেঁদেছিলাম। এইভাবেই একটু একটু করে রবীন্দ্রনাথ ও আমার বাবাকে আমি জেনে যাচ্ছি।
'ঘর ও বাহির' করতে করতে আজ আমি এখনও 'বাহিরে'। বাড়ি গেলেই বিভিন্ন বিষয়ে বাবার সাথে আলোচনা করতে আমার ভালো লাগে। তিনি বই-পাগলা মানুষ। কখনও কখনও মা একপ্রকার রাগ ও অভিমান বসত বলে ফেলেন, 'তোর বাবা মাধ্যমিক দেবে---ফাইনাল ক্যান্ডিডেট।' বাবার টেবিলে বিশেষত মার্ক্সবাদের বইপত্রই বেশী। আমি তখন ক্লাস নাইন বা টেনে পড়ি। একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, 'বাবা, মার্ক্সবাদ কী?' তিনি আমাকে বললেন, "রবি ঠাকুরের 'দুইবিঘা জমি' পড়েছিস?" ----হ্যাঁ। "এই 'দুইবিঘা জমি'র জমিদার হলো 'ব্যুর্জোয়া' আর উপেন হলো 'প্রোলেট্যারিয়েট' মানে সর্বহারা। এই ব্যুর্জোয়াদের কাছ থেকে সর্বহারাদের মুক্তির মতবাদই হলো মার্ক্সবাদ।"
এই রকমই এক কথা প্রসঙ্গে আমি বললাম, 'বাবা, রবীন্দ্রনাথকে অনেকে কিন্তু দানবীয় আত্মার সাথে তুলনা করেন। এতে তোমার মতবাদ কী?' বাবা যে কথাগুলো বললেন তার সারসংক্ষেপ ঠিক এইরকম---- এটি সত্য যে বিশ্বের সমস্ত ঋষির কোনো একটি গুণ হল ঈশ্বর-সদৃশ হয়ে ওঠা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো ঈশ্বর-সদৃশ ব্যক্তির কাছে সব জায়গায় তাঁর প্রতিভা এবং ব্যপ্তি প্রকাশের জন্য তাঁর ভারতের অন্য কোনো ঈশ্বর-পুত্রের অনুকরণ করার প্রয়োজন ছিল না। তাঁর জীবন-যাত্রা মরুভূমির মতো অন্তঃসার শূন্য শুধুই একজন তপস্বীর মতো ছিল না। তপস্যা-ব্রত এবং কঠোর সাধনা স্ব-মুক্তিলাভের এক পুরাতন পদ্ধতি, এবং প্রকৃত তপস্যা-ব্রত আজও গভীর শ্রদ্ধার অবকাশ রেখে যায়। এই সাংসারিক জগতে থেকেও সারাজীবন তাঁর নিজের কর্ম এবং কর্তব্যের সমাধান করা খুবই কঠিন এবং তা সমানভাবেই সাধক-তুল্য জীবন-ধারণ। রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের দৃঢ় বিশ্বাসে এই পৃথিবীর সমস্ত বস্তু-কেন্দ্রিক মায়ার মধ্যে থেকেও সারা-জীবন এইসবের অনেক ঊর্ধ্বে বিচরণ করে গিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা কবিতাগুলির মধ্যে থেকে একটি পংক্তি মনে করে বাবা বললেন, "বৈরাগ্য সাধনে মুক্তি, সে আমার নয়"; এই পংক্তিটিতেই তাঁর জীবন-দর্শন কী স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত, ভাবলে আমাদের অবাক হতে হয়। তাঁর জীবনের মূল কথা ছিল, জীবন কোনো ত্যাগ বা বিসর্জন নয়, বরং অধিকার ও বিজয়।
রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে আমি একটু একটু করে আবিষ্কার করি তেমনভাবে বাবাকে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবার ঈশ্বর, ঠাকুর। বাবার মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথকে যেভাবে জানি, রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে বাবাকে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথই আমার ঈশ্বর, আমার ঈশ্বরই আমার বাবা আর আমার বাবা-ই আমার রবীন্দ্রনাথ।
"ওরে বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর,
এখনি, অন্ধ, বন্ধ কোরো না পাখা।"
-------------------------------------------
2 Comments
Excellent expression of personal experience merged with the life of a great man and a father.
উত্তরমুছুনExcellent expression of personal experience merged with the life of a great man and a father.
উত্তরমুছুন