⛣ ছেলেটা ফিরল না ⛣



🔸ছোট গল্প:

          ໑ চয়ন কুমার রায়🔹পূর্ব বর্ধমান🔹




🔵লকডাউন ঘোষিত হ‌ওয়ার পর অনেকদিন শিবুকাকার খোঁজ নেওয়া হয়নি। শিবু বাগদি আমার বাবার আমলের এক হতদরিদ্র বর্গাদার। বছরে দু'একবার পৈতৃক ভিটেয় সশরীরে হাজির হ‌ওয়া ছাড়াও শিবুকাকার বড় ছেলের ফোনে যোগাযোগ রক্ষা হয়। বরাবর ফোন করলেই সবার খবরা-খবর দেওয়া নেওয়া,আমার পৈতৃক সম্পত্তি কীভাবে দশভূতে লুটেপুটে খাচ্ছে,সেসব রেকর্ড বাজানোই তার প্রথম আলাপ।
আজ ফোন ধরে তার ধারে কাছে না গিয়ে হাউহাউ করে কাঁদতে শুরু করল ।
"আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে বাপ, সর্বনাশ হয়ে গেছে! "
বারবার জিজ্ঞাসা করেও সর্বনাশটা কী জানা গেল না। ও প্রান্ত থেকে কাকির গলা শোনা গেল।"কে ফোন করেছে? দাও আমাকে। তুমি বসে বসে কাঁদো, তাহলেই ছেলে ঘরে ফিরে আসবে! "কাকির ধমকে কান্না উচ্চগ্রাম থেকে অনেকটা নিম্নগামী হলো। একসময় মহিলা সমিতি করত। তাই কাকার থেকে কাকি অনেক বেশি স্মার্ট। কথাবার্তা স্পষ্ট, কাটকাট।
"কে বলছ? সুমন! এতদিন পরে কাকা কাকির কথা মনে পড়ল বাবা! লকডাউনে আমরা কেমন আছি, কী খাচ্ছি, কোন খবর তো নিলে না! "
আমার মুখ দিয়ে কোন সদুত্তর বেরল না। আমতা আমতা করে যেটা বলতে চাইলাম, সেটা দিয়ে কিছু বোঝানো গেল না।
কাকি বলে, "তোমার আর কী দোষ।যারা কাছে আছে তাদের কাছ থেকেই  কোন
সাহায্য মেলে না, আর তুমি তো অনেক দূরে থাকো! "
আমি বিস্মিত হয়ে বলি, "সেকি!
রেশন -টেশন পাচ্ছো না কিছু? "
কাকি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলে, "রেশন তো পাচ্ছি, দু'বেলা নুন ভাত ও জুটছে। কিন্তু মনে শান্তি নেই বাবা! "
আমি বলি, "ঠিকই বলেছ। কী যে এমন ভাইরাস ঢুকল, সারা বিশ্বের লোককে একেবারে ঘর ঢুকিয়ে ছাড়লো! "
"আমার ছোট ছেলেটা যে ঘর ঢুকতে পারলো না বাপ! "
কাকির গলাটা ধরা ধরা লাগলো। মনে হল মুখে আঁচল চাপা দিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, "কী হয়েছে?কাঁদছ কেন? কী হয়েছে নবীনের?"
উত্তর পেতে একটু সময় লাগলো। হয়তো চোখ মুখ মুছে নিজেকে সামলে নিচ্ছিল।
"তুমি তো অনেকদিন কোন খবর রাখো না। নবীন ঠিকাদারের সঙ্গে চেন্নাই -এ রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে গিয়েছিল ওখানে মজুরী বেশি। টাকাও পাঠাচ্ছিল মাসে মাসে। তারপর লকডাউনের জন্য আটকে পড়েছে। "
আবার গলা দিয়ে যেন একটা প্রচণ্ড কষ্ট ঠেলে বেরিয়ে আসে। আমি সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করি,
"কাকি, অত দুশ্চিন্তা করছো কেন? নবীন কয়েকদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে। "
"তুমি জানোনা সুমন, কি নিদারুণ কষ্টে আছে ছোটটা!
থাকার জায়গা নেই, খাবার নেই। একজায়গায় গাদাগাদি করে অনেক লোক আছে। খাবারের সন্ধানে রাস্তায় বেরোলে পুলিশ মারছে!"
"তুমি ভেবনা, পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর জন্য ট্রেন চালাবে সরকার। "
কাকি অবাক হয়ে বলে, "পরিযায়ী শ্রমিক! বাপের জম্মে এমন কথা শুনিনি বাপ। চিরকাল দেশের খেটেখাওয়া মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় কাজ করে বেড়ায়। অফিস বা কারখানার কাজ তো নয় যে একজায়গায় বসে বসে করবে? "
কাকি আমার মগজে একটা গুরুতর প্রশ্ন ঢুকিয়ে দিল। পরিযায়ী পাখি, জন্তুজানোয়ার বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে আবহাওয়ার কারণে বা খাদ্যের সন্ধানে আসে।কয়েক মাস কাটিয়ে আবার পুরোনো জায়গায় ফিরে যায়। কিন্তু এই সব অসংগঠিত শ্রমিকদের সঙ্গে কি তুলনা চলে? ওরা তো দেশের-‌ই মানুষ!

"ট্রেনের কথা বলছ ?স্টেশনে ট্রেনের খবর নিতে গিয়ে পুলিশের হাতে খুব মার খেয়েছে। সাতদিন আগে ফোন করে বললো, যেভাবে হোক ওরা ঘরে ফিরবে। তারপর থেকে আর কোন খবর নেই। "
কাকি আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। বুকের যন্ত্রণা দুর্বারবেগে বেরিয়ে এলো।
"কাকি, তুমিও এভাবে ভেঙ্গে পড়ছো? হয়তো দেখো, ফোনের ব্যাটারি বা ব্যালেন্স নেই। তাই ফোন করতে পারছে না। "
"না, তা নয়। আমি মা, সব বুঝতে পারি। আমার ছেলেটা হারিয়ে গেছে। রোজ টিভি তে খবর দেখি, আর ছোটটাকে খুঁজি। দেখি কতলোক পায়েহেঁটে, সাইকেলে কতভাবে আসার চেষ্টা করছে। আমার ছেলেকে দেখতে পাই না! দুর্ঘটনায়, না খেতে পেয়ে কত মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে! "কথাটা বলেই যেন শিউরে উঠল। গলা দিয়ে সেরকম একটা শব্দ বেরিয়ে এলো।
আমি বলি, "ভগবানের কাছে প্রার্থনা করো। "
"তুমি জানোনা সুমন, আমি কোন কিছু ভগবানের হাতে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকি না। নেতাদের কাছে গেছি, বি. ডি. ও-র কাছে গেছি, এম. ‌এল. ‌এ-র হাতে পায়ে ধরেছি, কেউ সাহায্য করেনি। নাঃ, আমার ছেলেটা আর ফিরবে না! "কথাটা হয়তো ভুল নয়। তবু কোন মা এভাবে বলে না। আমৃত্যু বিশ্বাস করে যে তার ছেলে আবার ঘরে ফিরবে। একজন অশিক্ষিত গ্রাম্য মহিলা এমন রূঢ় বাস্তববাদী কীভাবে হয় ভেবে পাই না।
"শোন সুমন, আমার কি মনে হয় জানো, হয়তো গরীব খেটেখাওয়া মানুষের বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা হয়তো সমাজের বোঝা! তাই নিকেশ করে দিতে চায় আমাদের। তবে এটাও শুনে রাখো, সহজে আমাদের শেষ করতে পারবে না। একদিন সব ষড়যন্ত্রের হিসেব আমরা চুকিয়ে দেব। "
সন্তান শোকাতুরা এক মা এরকম একটা ভয়ঙ্কর কথা বলেই ফোনটা কেটে দিল ।

0 Comments