সৌমী গুপ্ত'র গল্প


ফিনিক্স পাখির গল্প

কোলকাতার সকালগুলো অন্য বেলার তুলনায় কেমন যেন আলাদা। রাত্রির নিয়ন আলো গুলো নিভে যেতেই ভোরের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে  পড়ে ট্রাম লাইন এর উপর। ল্যাম্পপোস্টের কালো তারে দোল খেতে খেতে দোয়েল রানীর চোখে শহর জেগে ওঠে। ট্রাম লাইন এর পাশে হলুদ স্কুল বাস গুলো খাঁচাবন্দী ভবিষ্যতকে নিয়ে এগিয়ে চলে। সাফসুতরো হয় ঝাড়ু আর ঝাড়ুদার পাখির দৌলতে কালো পিচের রাস্তা। গনগনে রোদ্দুর আর থমথমে আকাশ নিজেকে উপুড় করে দেয় উঁচু প্রাসাদ থেকে চিলেকোঠার উপর। মাথার উপর অনেক উঁচুতে উড়ে যায় ধূসর চিল— অনেকটা ফিনিক্স পাখির মত। ফিনিক্স —ধূসরতার সাথে দগ্ধ হয়ে যাওয়া  পুনর্জন্ম নাকি আরো কিছু! সম্পর্কের সমীকরণ এর মৃত্যু নাকি পুনর্জন্ম শহর ঠিক করতে পারেনা দুটোর মধ্যে অমিল কোথায়?

(১)

লাল লেদারের ব্যাগটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে নীহারিকার। গড়িয়াহাটের চার মাথার মোড়ে ঠিক ট্রেডার্স  অ্যাসেম্বলির নিচে বসা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে দরদাম নিয়ে টানাটানি করতে করতে বারবার বাঁ হাতের কব্জি উল্টে সময়টা কতটা তাড়া লাগাল দেখে নিচ্ছিল নীহারিকা। যমে মানুষে টানাটানি পর নীহারিকা শেষে আড়াইশো দামে জিতে গেল। লাল কুর্তির সাথে  লাল লেদারের মত ফোমের ব্যাগ খারাপ লাগবে না নিজেকে। মনে মনে একবার নিজেকে ঝালিয়ে নিল। কাঁধে ঝোলানো কালো স্লিঙে কেউ সমানে পিং করে যাচ্ছে। সময় নেই বাবা,  তিন্নির ছুটি ঠিক এগারোটায়। সকাল থেকে ঘোড়দৌড়ের মত দম না ফেলে ছুটে এসেছে টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া হাট। মাঝে মাঝে ভাবে কেন এত দূরের স্কুলের দিয়েছে তিন্নিকে নীহারিকা। অনুভব অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকে দিন গড়িয়ে রাত পর্যন্ত। নিজেকে নিয়ে আলাদা করে ভাবার ফুরসত কবেই বা পেয়েছে সে। এই টুকটাক বন্ধুবান্ধব গড়িয়াহাট মোড় উইকেন্ড শেষে বরের সাথে কোন শপিংমলে ঢুঁ মারা এর বাইরে যে কোন এক সময় নিজের জগৎ ছিল তা যেন জোরালো ইরেজার দিয়ে কেউ মুছে দিয়েছে।
একটা কালো প্লাস্টিক এ লাল ব্যাগটা ঢুকিয়ে দুলিয়ে দুলিয়ে হন হন করে হাঁটা লাগাল নীহারিকা। বাতাসে প্রচন্ড আর্দ্রতা, ঘামে সপসপ করছে তার সালোয়ারের পিছনটা। রুমাল দিয়ে কপাল থেকে নাকে গড়িয়ে আসা ঘামটা মুছে নিলো নীহারিকা। হাঁটতে হাঁটতে একবার আকাশের দিকে তাকালো সে। আজ কি বৃষ্টি হতে পারে? বৃষ্টি পড়লে অনেক অসুবিধা ছাতাটা সঙ্গে করে আনে নি সে। সুবিধা অবশ্য একটা আছে —বৃষ্টিতে ভিজলে কান্না লুকানো যায় কোন কষ্ট না করেই, শেষ যেন কবে বৃষ্টিতে ভিজে কেঁদেছিল নীহারিকা!
"এইযে নীহারিকা কতক্ষণ ধরে ফোন করছি  তোকে, হনহন করে হাঁটছিস" সুমিতা দৌড়ে এসে ধরে ফেলে তিন্নিদের স্কুল ক্যাম্পাসে
"তাই নাকি টের পাইনি তো?"
"কোন জগতে থাকিস রে!"
"আরে এগারোটা বেজে গেছে তাড়ায় ছিলাম তাই হয়তো খেয়াল করিনি।"
"চল চল ওদিকে আবার ছাড়তে শুরু করলে দুটোতে আমাদের দেখতে না পেলে কাঁদতে শুরু করবে ,বাই দ্যা ওয়ে তোরা পরশু বেরোচ্ছিস তো?"
"হ্যাঁ"
"গোছগাছ কমপ্লিট?"
"নারে সব গোছানো হয়নি এখনো"
"তোরা শুধু ডুয়ার্সে ঘুরবি?"
"হ্যাঁ ছুটি নেই তো অনুভব এর ,মাঝে মাত্র তিনটে দিন, তিন্নি তো খুব বায়না করছে বলছে আরো দুদিন থাকবো!"
"সেই তোরা তো তাও বেরোচ্ছিস, আমি যে কতদিন থেকে কুমড়োর ঘ্যাঁট আর মাছের ঝোলে হাবুডুবু খাচ্ছি সেখান থেকে বেরোনোর কোন স্কোপ নেই।"
"হাহাহা ভাল বলেছিস!"
পাঁচ বছরের  তিন্নিকে নিয়ে যখন নীহারিকা মেইন রাস্তায় এসে দাড়ালো তখন আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে, নীহারিকা মহা মুশকিলে পড়লো,ওলা বা উবার বুক করতেই হবে। মাঝরাস্তায় অটোতে বৃষ্টিতে ভিজলে দুদিন পর ঘুরতে যাওয়া পুরো বানচাল হয়ে যাবে। তিন্নিটার বড় ঠান্ডা লাগার ধাত। ওলা বুক করার জন্য ফোনটা হাতে নিল নীহারিকা। ফোনের পাসওয়ার্ড দিতে অতীতের চেপে রাখা ভুলে যাওয়া পাসওয়ার্ড চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠলো। রুপায়ন পরপর মেসেজ করেছে বেশ কয়েকটা। নীহারিকা ঢোক গেলে দু-একবার। হৃদপিন্ডের রক্ত যেন খরস্রোতা নদী। অলিন্দ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে এক্ষুনি। নীহারিকার হাত দুটো ঘামতে শুরু করলো ভীষণ। রুপায়ন নামটা তো ভুলেই গেছিল এতদিন ,কেন এতদিন পর চোখের সামনে যত্ন করে মোছা অতীত এসে দাঁড়ালো সামনে। তিন্নি পাশ থেকে তাড়া লাগায় ,"মা বৃষ্টি পড়ছে তো!"
নীহারিকা নির্বাক হয়ে নিজের মধ্যে হারিয়ে গেছে যেন ।কালো রাস্তার ধারে ছাতিম গাছের তলায় কালো মেঘের যন্ত্রণা উপুড় করে দিল মুষলধারা। নীহারিকার চোখ বাষ্পীভূত হয়ে উঠলো, শেষ‌ যেদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিল সেদিন ওএমনি করে   কান্না লুকিয়ে ছিল নীহারিকা।

(২)

ঠাম্মার ঘরে ঢুকলেই মিষ্টি জর্দা পানের গন্ধ পেতো নীহারিকা। উত্তর কলকাতার বানতলা লেন ,৭৯/৬। পুরনো সুড়কি  দেওয়া জানালা ছাদ দেওয়াল। ঘেঁষাঘেঁষি ইতিহাসকে বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দোতলা কালচে দেওয়ালের বাড়ি। ছাদ থেকে নিচে সরু রাস্তার ওপর সিমেন্টের ফাটল আর গর্ত গুলো স্পষ্ট বোঝা যেত। দুদিনের বেশি বৃষ্টি পড়লে শ্যাওলা পড়া রাস্তায় পা টিপে টিপে চলতে গিয়ে ছাদের কার্নিশ থেকে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নীহারিকার কাঁধে এসে পড়ে শিহরন জাগাতো। উপর দিকে তাকালেই দেখা যেত ছোট্ট বারান্দায় ঠাম্মা বদ্রি পাখি দুটোকে খাবার দিচ্ছে। পুরোপুরি টা অবশ্য দেখা যেত না শুধু পাকা কাঁচা  এলোচুলের ডগা আর সাদা সরু পাড় দেওয়া আঁচলের কিয়দংশ। বাবাকে হারানোর পর নীহারিকা ছিল ঠাম্মার বড় কোলঘেঁষা। কলেজ থেকে ফিরে ক্লান্ত মাথায় ঠাম্মা বিলি কেটে দিত আর পাশের বাড়ির চিনি এসে গল্প জুড়তো আধো আধো গলায়। নীহারিকার চোখ জুড়িয়ে আসত।কত রকমের গল্প বলতো ঠাম্মা। একটা বাঁধানো নীল মলাটের খাতা থেকে পড়ে পড়ে গল্প শোনাত ঠাম্মা। রাজপুত্র রাজকন্যা পুরান সব রকমের। আর একা থাকলে কল্লোল সেন নামক লেখক এর উপন্যাস পড়তো। নীহারিকা একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল," ঠাম্মু এত ভাল লেখক এর লেখা থাকতে তুমি কল্লোল সেনের লেখা কেন পড়ো?"
ঠাম্মা জর্দা মাখানো গন্ধে নিবিড় করে হেসে বলতো "নিজেকে খুঁজে পাই রে"
"সেতো রবি ঠাকুর শরৎবাবু কতজন আছেন নিজেকে খোঁজার জন্য কল্লোল সেন দরকার পড়ল কেন?"
সবুজ জানালার দরজা ফাঁক করে পানের  পিক ফেলে ঠাম্মা আবার উত্তর দিত ,"সবাই কি মনের ভাষা খুঁজতে পারে সবকিছুর মধ্যে?"
নীহারিকা বুঝতো না শুধু ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে বলতো ,"রূপায়ন ও তাই বলে জানো, রুপায়ন নাকি কি সব হাবিজাবি লেখে আর লেখার সময় আমাকে খুঁজে পায়।"
"তাই বুঝি, তোরা কিন্তু কখনো গল্প হোসনা, জীবন ই ভাল জানিস দিদি ভাই!"
"সে আবার কি রকম সবার জীবনেই তো গল্প থাকে, তোমার আমার সবার জীবন ।তাহলে গল্প হবো না কেন?"
"ফিনিক্স পাখির গল্প জানিস দিদি ভাই !গল্প হতে গেলে পুড়তে হয় ,ক্ষয় হতে হয় ,আবার নতুন জন্ম নিতে হয় ।নতুন করে গল্প শেষে পুনর্জন্ম হলে তুই আর তুই থাকবি না দিদিভাই তুই তখন অন্য মানুষ।"
"কি যে বলো তুমি ঠাম্মু কিচ্ছু বুঝিনা!"
সুরো বালা দেবী তখন চশমা খুলে আঁচলের খুঁট দিয়ে চোখ এর কোন মুছে বলত," ঘুমিয়ে পড় দিদিভাই ,ক্লান্ত বেলা যখন আসবে তখন বুঝবি আমরা সবাই ফিনিক্স পাখি।"
নীহারিকা জানালার ফাঁক থেকে দেখে তিন-চারটে সাদা কালো লাল ঘুড়ির পাশে একটা বড় চিল উড়ে  যায়— ফিনিক্স পাখি কি ওইরকম দেখতে? আচ্ছা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেলে কি করে আবার জন্ম নেয়া যায় ?চোখের পাতা দুটো ভারী হয়ে আসে নীহারিকার।

(৩)

কলেজ পড়াকালীন রূপায়ন নীহারিকার খুব কাছের ও প্রানের বন্ধু ওই যেমন জলের উপর জল ছবি ঠিক তেমন। নীহারিকা অবশ্য ভালোবাসতো প্রথম থেকে। তাই যেদিন তিন্নিকে নিয়ে যখন বৃষ্টি তে আর কান্নায় ভিজে ছিল তখন কলেজে পড়া রূপায়ণ কে প্রথম মনে পড়েছিল নীহারিকার। ছোট ছোট তিনটে মেসেজ উলটপালট করে দিয়েছিল সামনে চলার বাঁকগুলো। সম্বিৎ ফিরে ছিল সুমিতার ঝাঁকুনিতে। ততক্ষণে কাক ভেজা হয়ে গেছিল নীহারিকা। সুমিতা হাত টেনে ট্যাক্সিতে উঠিয়ে নিয়েছিল নীহারীকা আর তিন্নিকে। বাড়ি ফিরে কোন কাজে মন লাগছিল না তার ।শুধু মানুষকে অভিনয় তো করতে হয়। দুপুরে তিন্নি ঘুমিয়ে যাবার পর মেসেঞ্জার খুলে বারবার পড়েছিল তিনটে মেসেজ—'কেমন আছো মেঘ? চিনতে পারছো? ভুলে যাও নি তো?'
স্ত্রীর গালের কাছে গাল ঠেকানো রূপায়নের প্রোফাইল পিকচার টা ছোট হয়ে গিয়েছিল নীহারিকার চোখে। মনে হচ্ছিল কেউ যেন পোড়া ঘায়ের উপর তাড়িয়ে তাড়িয়ে  সময় নিয়ে চাবুক মারছে অবিরত। টাইপিং অপশনটা খুলেও অনেক না বলা কথার মধ্যে কথা হারিয়ে যায় তার। শুধু ডিলিট অপশন টা সায় দেয় আপাদমস্তক সমস্ত কনভারসেশন মুছে ফেলতে। তারপর মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে পড়েছিল রূপায়নের সাথে কাটানো মুহূর্ত, খুনসুটি, পড়ন্ত বিকেল,  রোদের গন্ধ ,চেনা পুরুষের ঘ্রান। তবুও  তো অস্বীকার করেছিল রূপায়ণ। যখন মরিয়া হয়ে নীহারিকা বলেছিল," যাস না রূপায়ণ তুই চলে গেলে আমি মরে যাব"
রুপায়ন অত্যন্ত কঠিন স্বরে উত্তর দিয়েছিল ,"বাঁধতে যাস না আমায়, আমি সংসার করার মানুষ নই রে ,কিছু কিছু মানুষ প্রেম করার জন্য জন্মায় ।তুই বাড়ির সম্বন্ধের সাথে বিয়ে করে ফেল ।আমার জন্য নিজের জীবনটা নষ্ট করিস না।"
অবুঝ বালিকার মতো নীহারিকা খামচে ধরে ছিল কাঁধের সাদা শার্ট,"তুই তবে অভিনয় করে ছিলি? তুই নিজের পরিচিতি পেলি তখন অস্বীকার করছিস আমায়?"
"তোকে স্বীকার করব এমন ক্ষমতা আমার নেই, আর তোকে অস্বীকার করবো এমন সাহস আমার নেই। শুধু জানি আমার ভবঘুরে জীবনের সাথে তোকে জড়ালে তোর বিপদ বাড়বে, তোকে শান্তি দিতে পারব না।"
"আর এখন কি আমি শান্তি পাবো ?তোর সৃষ্টি নিয়ে তোর এত অহংকার?"
"কিসের সৃষ্টি দু'চারটে কবিতা গল্প লিখি তাই ?ধুস তুই অমন করে অনুভব এর যোগান না দিলে কেমন করে লিখতাম?"
"নাটক করছিস ?আসলে তুই আমাকে কোনদিন ভালোবাসিস নি!"
"না পাওয়াতেই ভালোবাসা থাকে রে, আমাকে আর জোর করিস না মেঘ!"
হিস হিস করে কাঁদতে কাঁদতে নীহারিকা উত্তর দিয়েছিল ,"ডাকিস না ওই নামে আর ,তুই তো কখনো শেষ অব্দি ডাকতে পারবি না আমাকে। চোখের সামনে অন্যের হয়ে যেতে দেখেও তোর সুখ।"
"সুখ নয়রে দুঃখ, দুঃখ থেকে সৃষ্টি হয় অনেক সৃষ্ট জানিস তো?বিনাশ থেকে যেমন করে শুরু হয়।"
ক্রুদ্ধ বিড়াল যেমন নরম মাটি আঁচড়ায় ঠিক তেমনি নীহারিকার ভেতরটা যেন কেউ আঁচড়ে দিয়েছিল ।কলেজ বিল্ডিং থেকে ক্যাম্পাসের রাস্তাটা শূন্য একাকী লেগেছিল নীহারিকার। বাবার জন্য ভীষণ কষ্ট হয়েছিল তখন আরো বুঝতে পেরেছিল মানুষের যখন কষ্ট হয় তখন ভালোবাসার গন্ধ খোঁজে মানুষ ,সুখে আনন্দে তো নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় না যতটা প্রয়োজন হয় দুঃখে।
ঠিক যেমন নীহারিকার এখন কাঁদতে ইচ্ছে হলে যতক্ষণ খুশি ।নয় নয় করে অনুভব কে একটা ফোন করল,"কি করছো?"
ও প্রান্ত থেকে অনুভব একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করে ,'ঘুমাওনি?'
'না'
'কেন?'
"এমনি ভালো লাগছে না!'
"কেন কি হয়েছে?"
মানুষের যখন মনের মধ্যে বারুদ জমা হয় তখন একটা স্ফুলিঙ্গের প্রয়োজন হয় ঠিক যেমন অনুভব এর কি হয়েছে এইটুকু শব্দ কাজ করলো। নীহারিকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল। অনুভব ও প্রান্ত থেকে বোঝার চেষ্টা করল কি হয়েছে !সকাল থেকে তো ওয়েদার ঠিকই ছিল তাহলে অবশ্য তেমন পরিবর্তনের কারণ কি। তবু অনুভব কাঁদতে দিয়েছিল নীহারিকাকে মাঝে শুধু একবার জিজ্ঞাসা করেছিল," তিন্নির স্কুলে কিছু হয়েছে?"কারণ অনুভব জোর করতে পারেনা। নীহারিকা আর্দ্র গলায় বলেছিল ,"মাঝে মাঝে কেন এত কষ্ট হয় কিছু ভালো লাগে না!"
অনুভবের ক্লায়েন্ট তখন উল্টো দিকে বসে ফ্যালফ্যাল করে  তাকিয়ে ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে। অনুভব বোকার মত হেসে ও প্রান্তে থাকা নীহারিকাকে বুঝিয়েছিল," পরশুই তো বেরোচ্ছি ঘুরতে ,এখন বরং রেস্ট নাও ফিরে কথা বলছি।"
ফোনটা রেখে নীহারিকা তখন চোখ বুজেছিল অনিচ্ছাসত্ত্বেও। তিন্নির গায়ে পাতলা চাদরটা টেনে দিয়ে ভাবছিল আচ্ছা ভালোবাসা কি কাউকে দেওয়া যায় —একজনের ভালোবাসা অপরজনকে? ঠাম্মা বলতো সবাই নাকি ফিনিক্স পাখি সত্যি কি ফিনিক্স পাখির মতো পুনর্জন্ম হয়েছে রূপায়ণ কে ছেড়ে এসে !দমকা হাওয়ায় জানালার পাল্লা গুলো বন্ধ হয়ে যায় আওয়াজ করে!!

(৪)

মাঝের তিনটে দিন কেটেছে স্বপ্নের মত। পাহাড়ি বাঁক, রঙ্গীত নদী ,উপত্যকা, মেঘের স্পর্শ জঙ্গলের সোঁদা গন্ধ। তার মাঝে রুপায়ন কে যে মনে পড়েনি তা নয়। তবে মনে পড়লেও নীহারিকা মেনে নিয়েছে যা কোনদিন তার ছিল না তার জন্য আর পিছন ফিরে তাকাবে না সে। এক পুরুষের ভালোবাসা অন্য পুরুষকে দেওয়া যায় কিনা তার পরীক্ষা তুলনায় নামবে না ও। শুধু ঠাম্মাকে ফোন করে যখন কথা বলেছিল তখন মনটা অনেক হালকা হয়ে গেছিল। আজকাল কানে ভালো করে শুনতে পায় না বলে বেশিক্ষণ কথা বলা যায়না। তবুও এটা ওটা কথা বলে ঠাম্মা ঠিক বুঝেছিল নীহারিকার মন খারাপ। তাই ফোন রাখার আগে ঠাম্মা বলেছিল ,"ঘুরে এলে একবার বানতলা লেনে দেখা দিয়ে যাস অনেকদিন কড়ি বর্গার সংখ্যাগুলো আড়াআড়িভাবে গুনিস নি আঙ্গুল দিয়ে।"
ট্রেন ছাড়লো নটায়। এসি  থ্রি কামরার আপার বার্থ ও মিডল বার্থে জায়গা হয়েছে নীহারিকা অনুভবের। নীহারিকা তিন্নিকে নিয়ে শুয়ে পড়ল ওপরে। অনুভব এর উদ্দেশ্যে বলে," উল্টোদিকের আপার টা খালি আছে তুমি দেখো যদি ম্যানেজ করা যায়।"
"না না মালদা থেকে উঠবে মাঝরাতে ঝামেলা করলে মুশকিল!"
দুজন রাত্রের খাবার শেষ করে বিছানা করে শুয়ে পড়ে লাগেজগুলো চেইন দিয়ে বেঁধে  দেয় অনুভব।
ঘুমটা ঠিক আসে নি তখনো ,দোল দোল দুলুনি কামরায় নীহারিকার দু'চোখের পাতা এক হয় না। তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে থাকে  কিছুক্ষণ। রাত্রি গড়ায়। ট্রেন থামে কোন অজানা স্টেশনে। আবার বার্থ থেকে দেখতে পায়না নীহারিকা। কোন স্টেশন যাত্রী ওঠে। একজন সুঠাম লম্বা চাপ দাড়ি মোবাইলে খুঁজে টিকিট মিলিয়ে আবছা অন্ধকারে এগিয়ে আসে উল্টোদিকের  আপার বার্থে। নীহারিকার গোটা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যায়— রূপায়ণ!! বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে ঘুম উড়ে যায়! উল্টো দিকের মানুষটি ব্যাকপ্যাক রাখে মাথার কাছে। একটা লাইট জ্বালায়। ঘুরে তাকায় চোখাচোখি হয় নীহারিকার। শুধু চোখ বন্ধ করে নীহারিকা ,কোন কথা খুঁজে পায় না। চেনা গন্ধ পারফিউমের গন্ধের তলায় চাপা পড়ে ,তবুও মনে করায় সমস্ত অতীত। হাজার ওয়াটের আলোর ঘরে ঝাঁকে ঝাঁকে  ফিনিক্স  পাখি উড়ছে ,আলোর ঝলকানিতে পড়ছে আবার সৃষ্টি হচ্ছে ছাই পোড়া আগুনের ভেতর থেকে ।ছোট ছোট রংবেরঙের চিলের  মত ডানা, ঠোঁট সূচালো, দৃষ্টি প্রখর।
উল্টো দিকে শুয়ে পড়ে রূপায়ণ দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে ওপারের দুটি চোখে। বহু যুগ পরে যেন মুক্ত খোঁজার চেষ্টা। পলক পড়ে না জীবন যেন থমকে যায়। তাকিয়ে থাকাও দুষ্কর না তাকালেও মনে পোড়ে দাবানলের আগুনে। নীহারিকা কান্না চাপতে পিছন ফিরে ঘুমায়। ফোঁপাতে থাকে ভ্যাপসা গন্ধের কম্বলে মুখ ডুবিয়ে। নিজের মনে বলে হা  ঈশ্বর তুমি কেন এত নিষ্ঠুর তুমি কেন এত অন্তর্যামী।
রুপায়ন আস্তে আস্তে নেমে আসে, নীহারিকার মাথায় হাত রেখে ফিসফিস করে বলে," কাঁদিস  না মেঘ আমি আছি তোর সাথে!"
তড়িত্গতিতে তিন্নির পাশ থেকে উঠে বসে নীহারিকা। রাগে-ক্ষোভে আগুন চোখে তাকায় রূপায়নের দিকে," সিন করিস না প্লিজ লিভ"
রূপায়ণ নীরবে আবার শুয়ে পড়ে তাকিয়ে থাকে উল্টোদিকে সারারাত না ঘুমিয়েই।অথচ ডানপাশে একহাতে শুয়ে ঘুমনোর ভান করে পড়ে থাকে নীহারিকা।
সকালে শিয়ালদা স্টেশন ঢোকার আধঘন্টা আগে অনুভব তাড়া লাগায়। নীহারিকা বাথরুমের কাছে এসে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দেয়। সারারাত না ঘুমিয়ে কেঁদে কেঁদে চোখের মনি গুলো অসম্ভব ব্যথা করছে। পিছন ফিরতেই মুখোমুখি হয় রূপায়নের,"কখনো ঘুম থেকে উঠে দেখি নি তো তোকে আজ দেখলাম!'
নীহারিকা পাশ কাটাতে চায়।
"যোগাযোগ বন্ধ করতে চাস বরাবরের মত!'
নীহারিকা থামে সেটা তুই বন্ধ করে ছিলি বহুদিন আগে। দূরত্ব থেকে বন্ধ যোগাযোগ তার জন্য দায়ী কে?"
"যত খুশি আঘাত কর আমায়, শুধু প্লিজ যোগাযোগ রাখ তোকে আজ ও আমি...."
কথাটা শেষ করতে দেয় না নীহারিকা," বিয়ে করেছিস দেখলাম!"
রুপায়ন আমতা আমতা করে ",মা মারা গেল শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করতেই হলো রে ,তুই তোর ফোন নম্বর দে ডিটেইলস কথা বলব।"
নীহারিকা হাসে অল্প ,"নতুন কোন খেলা না লেখা?'
রুপায়ন মরিয়া হয় ,"বিশ্বাস কর আমি আজও নিজেকে ক্ষমা করিনি ,অনুশোচনার চোরকাঁটা আমাকে যন্ত্রণা দেয় ,প্লিজ আচ্ছা তুই মেসেঞ্জারে যোগাযোগ রাখিস।"
নীহারিকা বিদ্রুপ করে বলে," সাহিত্য জগতের শ্রেষ্ঠ লেখক রুপায়ন সেন সে কিনা প্রাক্তন প্রেমিকার জন্য নিজেকে ক্ষমা করেনি, এসব নাটক আমাকে দেখাতে আসিস না।"
নীহারিকা ভারী কাঁচের দরজা টেনে চলে আসে তিনটে সারি পেরিয়ে অনুভব এর কাছে। শরীরের ভেতর কফিন দেওয়া মন দাফন নিয়ে পুড়তে  থাকে, পুড়ে ছাই ছাই হতে থাকে।

(৫)

মাঝে দুটো দিন জামাকাপড় কাচাকাচি, পরিষ্কার আলমারিতে তোলা এসব করতেই সময় পেরোয়। গরমের ছুটি পড়েছে। রুপায়ন এর উপর জমাট বাঁধা রাগটা আস্তে আস্তে স্তিমিত হয় ফেলে রাখা তপ্ত লোহার বেড়ীর মত। দু একটা কথা এগোয় মেসেন্জারে। ছোঁড়া ছোঁড়া, ভাসা ভাসা  কোনটা, কোনটা প্রত্যুত্তর'' না দিয়ে কোনটার উত্তর দিয়ে।
আজও দুপুরবেলা গনগনে রোদে ঘামতে ঘামতে রান্না ঘরের সমস্ত কাজ সামলে নীহারিকা এসি অন করে তিন্নিকে নিয়ে শুয়ে পড়েছিল। তিন্নি ঘুমিয়ে যায়। নীহারিকা অপেক্ষা করতে থাকে। পুরনো নীহারিকাকে নতুন নীহারিকা বাঁচিয়ে তুলতে চায়। রূপায়নের প্রোফাইল ঘাঁটে ।অপেক্ষার অবসান হয়।
'ঘুমোচ্ছিস?'
'না জেগে'
'কি ভাবছিলি?'
'কিছু না ভাবলেও অনেক কিছু ভাবা যায়!"
"যেমন কিছু না বলে অনেক কিছু বলা যায়!"
'না বলা কথা শোনা যায়!"
'থাক রুপায়ন পুরনো খেলায় মাতিস না ,কথায় কথা মিলিয়ে পরের কথা বুঝে নেওয়া ,না বলা কথা বলে দেওয়া এসব আর এগিয়ে নিয়ে গিয়ে লাভ কি।"
'ক্ষমা করিস নি আমায়?'
'না করিনি আমার জায়গায় তুই থাকলে ক্ষমা করতিস?"
'ভুলেও তো যাসনি?"
"ভুলে গেলে বেঁচে যেতাম ,বেঁচে আছি মরে গিয়েও!"
'এমন করে তুই বলতে পারিস, জানিস আমি লিখি পাঠকের জন্য আর তুই বলিস আমার জন্য তোর লেখা যেদিন লিখব সেদিন হবে সার্থক কলম!"
'তার জন্যই কি ফিরে আসা?'
"ফিরে এসেছি আদৌ?"
"না ফিরে আসিস নি মনে করাতে এসেছিস যে তুই চিরকাল আমাকে কষ্ট দিয়েছিস!"
'কষ্ট সহ্য করিস বলেই তো কষ্ট দিই মেঘ!"
"এতদিন পর আমায় এভাবে ডাকিস না তুই!"
"ডাকলেই কি আসতে পারা যায় তুই পেরেছিস কখনো?"
'তাহলে ডাকলি কেন?"
"অভ্যাসটা আবার পোক্ত করতে!"
"সেই ,অভ‍্যেসে কাউকে আমরা  ভালোবাসি আর কাউকে না বুঝে!"
নীহারিকা যেন সেই কলেজে পড়ার সদ‍্য প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া তরুণী হয়ে যায় মনে মনে। সংসারী পত্নী মাতা নীহারিকা ঘুমিয়ে পড়ে অবচেতনে। মনে-মনে আবিষ্কার করে পরিবর্তনটা নিজের জন্য করলে সুখ নেই অন্যের জন্য নিজের বিবর্তনে অনেক আনন্দ।
এলোচুলে আয়নার সামনে দাঁড়ায় নীহারিকা। উল্টোদিকে নিজের অবয়বকে রুপায়ন ভাবতে ইচ্ছে করে। অনুভব এর কথা মনে হয়। কি করছে ও !অন্যায় করছে না তো? অনুভব এর কাছে মৃত হয়ে রূপায়নের কাছে  জীবন্ত হয়ে ওঠা এ কোন সর্বনাশী খেলায় মেতেছে নীহারিকা।ঠাম্মার কথা মনে হয়। খয়ের জর্দা পানের গন্ধে মাখানো ঠাম্মার মুখের কখনো রাজপুত্রকে রাজকন্যার না পাওয়ার গল্পের কথা মনে হয়। আরো একবার বৃষ্টিতে ভিজতে   ইচ্ছে হয় নীহারিকার। মানুষ যখন মনের খোরাক চায় তখন পাপ-পুণ্যের বিচার করে না বহ্নিশিখার পরোয়া করো না। মনের খিদে মেটাতে সশরীরে আগুনে ঝাঁপ দিতেও পিছপা হয় না। নীহারিকা তেমনি সর্বনাশী খেলায় মেতে উঠল। সারাদিন অপেক্ষা করে একটা ফোনে র। সেকেন্ড মিনিট ঘন্টা পেরিয়ে যায় ‌। দুদিকে দুটো সংসার দুজন মানুষ কাফনে ঢাকা দিয়ে নিজেরা চলতে থাকে ভবিষ্যৎ লক্ষ্যহীনভাবে।
প্রতিমুহূর্তে নীহারিকার এটা ভেবে শান্তি হয় যে এই পৃথিবীতে কেউ আছে যে ওকে ওর মতো করে বোঝে। শরীর ছাড়িয়ে মনের খিদে মেটানোর কেউ আছে ভাবলে আজও শিহরণ জাগে তা র। আজ উত্তর কলকাতার এঁদো গলিতে পা টিপে টিপে রূপায়নের হাত ধরে কার্নিশের টুপ করে খসে পড়া জলে ঠোঁট ভেজাতে ইচ্ছে হয়। ঠোঁটের ভেতর চেনা ঠোঁটের বাসস্থান তৈরি করতে ইচ্ছে হয়। রুপায়ন এর উপর যতটা রাগ ছিল সবটা উগরে দিয়ে শান্তি হয়েছে ওর।
তাই যখন রুপায়ন বলেছিল ,"যত খুশি গাল দে আমায় আঘাত কর এগুলো আমার প্রাপ্য!"
নীহারিকা আরো অভিমানী সুরে বলেছিল," তুই তো বিয়েও করলি ,আমি কি দোষ করেছিলাম?"
'কখনো ভাবি নি রে বিয়ে করবো পরিস্থিতি মানুষকে শিকার বানায়!'খানিকটা থেমে গিয়ে রূপায়ণ ভীষণ আদুরে গলায় নীহারিকাকে শুধিয়েছিল ,"কখনো ছুঁতে ইচ্ছে করেনা আর ?"
নীহারিকা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল," নারে আসলে যেদিন অনুভব এর কাছে পুরোপুরিভাবে মেঘের মৃত্যু হয়েছিল সেদিন শুধু আমি তোকে খুঁজে ছিলাম।"
'সেটাও সম্ভব?'
"তুই যদি সত্যিই আমাকে ভালবাসিস কোনদিন তো এমনই হবার কথা, আসলে আদরের একটা গন্ধ থাকে, যেমনটা ভালোবাসার গন্ধ চেনায় নিজের মানুষকে, গন্ধ তো উবে যায় না শুধু মানুষটার পরিবর্তন হয়, এক গন্ধ দিয়ে আর একজন মানুষকে সারাজীবন অপরের মধ্যে খুঁজে বেড়ানো।  একজনের ভালোবাসা অপরজনকে দিয়ে নিজেকে মেরে ফেলা নিজের জন্ম দেওয়া। "
""নিজেকে জন্ম দেওয়া যায় কখনো?"
"আমাদের ভালোবাসা হলো ফিনিক্স পাখির মতো ফিনিক্স পাখির ইতিহাস জানিস তো আগুনে পুড়ে পুড়ে নতুন ভালোবাসার জন্ম হয়!"
"আরো বল মেঘ আরো বল আজ তুই বল আমি শুনি তোর কথায় আমার লেখা খুঁজে পাই,তুই তো একই আছিস মেঘ।"
"সবকিছুর পরিবর্তন হয় !নাকি পরিবর্তন করলে নিজেকে ফিরে পাওয়া যায়! তুই যেদিন ছেড়ে চলে গেলি আমায় সেদিন আমি বৃষ্টিতে আর কান্নায় একসাথে ভিজে ছিলাম অথচ দেখ বৃষ্টিতে ভেজার কোন পরিবর্তন হয়? শুধু বৃষ্টির মধ্যে নিজের অশ্রুকে মেশানো যায়, পরিবর্তনে আছে সুবিধাও আছে ,ক্ষয় ও আছে,সে তুই যেমন করে খুশি বৃষ্টি মাখ, ভেজাটা আল্টিমেট রেজাল্ট,এর কোন পরিবর্তন নেই।"
"এত যন্ত্রণা কোথায় লুকিয়ে রেখেছিলি তুই কি বেঁচেছিলি পাষাণ হয়ে!'
"নিজের অনুভব এর কষ্টগুলো ঝর্ণার মত পাহাড়ের চূড়ায় আটকে থাকে, প্রকাশ করলে অপরপক্ষের কতটা ক্ষয়ক্ষতি হয় কে জানে কিন্তু নিজের ক্ষয় অবশ্যম্ভাবী!"
"অনুভবকে ভালোবাসিস না তুই?"
"বাসিতো একসাথে দুজনকে ভালোবাসা বারণ কোথাও? অভ্যাসের ভালোবাসা আর অভাবের ভালোবাসা! থাকতেই তো পারে কেন তুই ভালবাসিস না কুহেলি কে?"
"বাসি মেঘ খুব ভালোবাসি প্রতিনিয়ত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবি ওকে ঠকাচ্ছি, আমি তোকে ঠকাচ্ছি অকারনে!"
"তাহলে কেন আসিস বারবার কষ্ট দিতে তোর চিরকাল ভালো লাগে!"
"তোকে কষ্ট দিতে গেলে মনে হয় এটা আমার অধিকার ,আর কুহেলিকে কষ্ট দিতে গেলে ভেতরটা ছারখার হয়ে যায়। ওকে আমার ওর মতো করেই আদর করতে ইচ্ছে করে বিশ্বাস কর। আমি কিন্তু দুজনকে কখনো গুলিয়ে ফেলি না প্রতিযোগী হিসেবে ও দেখিনা।'
প্রচণ্ড ঈর্ষার আগুন নীহারিকাকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে মারল। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে উত্তর দিল অনুভবকে আমি ভালোবাসি রুপায়ন, কখনো ওর জায়গায় তুই নিজেকে নিয়ে যাস না ভালোবাসার থেকেও ভরসাটা অনেক দরকার, সেটা তোর কোনো দিন নেই।"
রুপায়ন নীহারিকার কঠিন কণ্ঠস্বরের চমকে উঠলো ,"কি হলোরে হঠাৎ আমিতো তোকে বাস্তবটা মেনে নিতে বলছি।"
"তাই বুঝি আর দিনের পর দিন এই যে প্রেম প্রেম খেলা খেলছিস সেটা বুঝি তোর গল্পের কোন প্লট?""
নীহারিকা ফোনটা কেটে দেয়। ব্লক করে দেয় মেসেঞ্জারে হোয়াটসঅ্যাপে। ফোন নম্বর মুখস্থ আছে কিনা মনে ঝালিয়ে নিয়ে ইচ্ছে করেই ডিলিট করে দেয় কন্টাক্ট থেকে।
সারাটাদিন মাথাটা ঝিমঝিম করে। মাঝে দুটো সপ্তাহ নীহারিকার নিজেকে জড় ভরত মনে হয়। তিন্নির খেলনার পুতুলগুলো ওকে যেন পরিহাস করছে অনবরত। প্রতিমুহূর্তে বলছে তুমি পুতুল তুমি বঞ্চিত তুমি মিথ্যার জালে আবার প্রতারিত।

(৬)

আরো দুটো সপ্তাহ কেটে যায় ঘড়ির কাঁটা কে সঙ্গে করে। নীহারিকা আবার বেঁচে ফিরে আসে অনুভবের হয়ে। অনুভব টেরও পায় না পাশাপাশি থাকা মানুষটি কত শত যোজন দূরত্বে বাস করছে। উল্টো দিকের মানুষের মনে কি দুর্বিষহ কালবৈশাখী বয়ে গেছে, ‌ সাংসারিক কার্যাবলী গুলো যন্ত্রের মতো কাজ করে চলে নীহারিকা। জীবন্ত পরিণত নীহারিকা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে বেরিয়ে এসেছে যন্ত্র হয়ে।
আজ একবার কলেজস্ট্রিট যাওয়া খুব দরকার। তিন্নির কতগুলো বই নিজের কতগুলো গল্প বই খুঁজতে খুঁজতে চোখে পড়ল প্রায় সমস্ত দোকানে রূপায়নের লেখা' ফিনিক্স পাখির খোঁজে'।
দোকানদার উৎসাহ দ্বিগুণ করে বলে," দারুন চলছে দিদি বেস্ট সেল হয়েছে মাসে!"
নীহারিকা কিনে নেয় বইটা ,বাড়িতে ফিরে দুপুরবেলা বইটা খোলে। প্রথম পাতায় লেখা 'মেঘ'কে উদ্দেশ্য করে লেখা ফিনিক্স পাখির খোঁজে।
নীহারিকা চোখ বোজে ভাবে এও কি সম্ভব। গোগ্রাসে গিলতে থাকে ২৭০ পাতার গল্প। প্রথম থেকে শেষ অব্দি শুধু তার রূপায়নের অতীত জীবন এমনকি গত কয়েক দিন আগেকার ঘটনা ছত্রে ছত্রে বসানো। তার মুখের ভাষা পাঠকের মন কাঁদিয়েছে। আর নীহারিকা নিজে! নীহারিকার ভেতর হু হু করে! কষ্টে ভীষণ ছটফট করে সে। কেন? রূপায়ণ কেন তাদের একান্ত ভালোবাসাকে এমন করে সবার মাঝে বিলিয়ে দিলো। তার কাছ থেকে সবটুকু নিয়ে নিজের খ্যাতিতে স্থান দিল। চিরকাল কি ঠকবার জন্যে জন্মেছে নীহারিকা। ফোনটা তুলে নেয় সে দু'বার রিং হওয়ার পর রুপায়ন ধরে বলে,"হঠাৎ কি মনে করে?"
নীহারিকা কটাক্ষের হাসি হেসে বলে," তোর ফিনিক্স পাখির খোঁজে পড়লাম!"
রুপায়ন নীরব থাকে ।নীহারিকা আবার যোগ করে "নতুন গল্প লিখতে বুঝি তুই আজকাল পুরনো সমাধি ঘাঁটিস?"
'গল্পের রসদ দরকার মেঘ রসদ দরকার, তার জন্য দুঃখ পেতে হবে ।সবাই তো দুঃখ দিতে পারেনা নতুন দুঃখ না এলে পুরনো দুঃখের ঝালাই দরকার সর্ষে দানার মত নিংড়ানো দরকার যতটা নিংড়ে দেওয়া যায়।"
"শুধু কি খ্যাতির জন্য এত নিষ্ঠুর তুই? এত স্বার্থপর? ছি!"
"শুধুই কি খ‍্যাতি? না তুই আমাকে বুঝিসনি ,মরে আমিও গেছি বারবার। আমরা সবাই ফিনিক্স পাখি জানিস তুই বলেছিলি না? খ্যাতি নয় দিনের শেষে আপন জায়গায় নিজেকে খুঁজে পাওয়া, নিজেকে খুঁজে পেতে গেলে নিজের ভালোবাসাকে হাতিয়ার বানাতে হয় বৈকি ,প্রয়োজনে পোড়াতে হয় চোখের সামনে,তবেই সোনা তৈরি হয় মেঘ!"
নীহারিকার হাত থেকে ফোন পড়ে যায় , কাঁদতে থাকে আয়নার উপর দুটো হাত রেখে। মুঠো শক্ত হয়। শব্দহীন কান্নার মাধ্যমে লাল ঠোঁট দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পিপাসার লালা।

অনেকদিন পর নীহারিকা আজ বানতলা লেনে এসেছে। না বৃষ্টি পড়েনি আজ, তবে দোতলার ঘরে ঠাম্মার ঘরটা এক আছে। চশমার কাঁচটা ঘষা ঝাপসা হয়ে গেছে বড্ড। শুধু মেঘলা। তিন্নিকে নিচের ঘরে রেখে এসে ঠাম্মার মুখোমুখি বসে নীহারিকা।
"হ্যাঁরে রাজপুত্র বুঝি জিয়নকাঠি চুরি করেছে?" ঠাম্মা ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করে
নীহারিকা নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে সব টা খুলে বলে ঠাম্মাকে। তারপর বলে," বলতে পারো ঠাম্মি কেন রুপায়ন এখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে এমন করল?"
সুরবালা দেবী মন্থর গতিতে আলমারির দিকে এগিয়ে যায় তারপর একটা ডায়েরী ও একটা বই তুলে দেয় ,"এগুলো কাল পড়িস, পরশু কথা বলব আমরা এই নিয়ে।
 "এগুলো কি?"
"মন দিয়ে পড়িস তাহলে সব উত্তর পাবি!"
নীহারিকা পড়তে থাকে রাত জেগে বহুদিন আগের লেখা ডায়েরীর পাতা যেনো কল্লোল সেনের বইয়ের পাতার অক্ষর। এ কী করে সম্ভব,এ তো  ঠাম্মির লেখা।বহুকাল আগের। ঠাম্মার দেওয়ার তারিখ অনুযায়ী ঠাম্মার বিয়েরও আগে। কিন্তু কল্লোল সেন তারপরের লেখক, জট পাকিয়ে যায় মাথায় ‌।পরের দিনই নীহারিকা ঠাম্মার কাছে এসে বসে।"এবার বুঝলি কেন আমি কল্লোল সেন এর লেখা পড়ি?"
"তোমার সব লেখাই  এইভাবে উনি নিয়ে নিয়েছেন তুমি কিছু বলনি?"
"নেয় নিরে বোকা আমি দিয়েছি যেমন টা তুই দিয়েছিস রুপায়ন কে।"
ঠাম্মি!
"হ্যাঁরে দিদিভাই, আমি তোকে ফিনিক্স পাখির গল্প বলেছিলাম না ?আমরা আসলে সবাই ফিনিক্স পাখি। আমরা বাঁচি মরি মরি-বাঁচি। এই বাঁচাতে সুখ না থাকলেও বাঁচাতো যায়। কোন কোন সময় বেঁচে থেকে নিজের মৃত্যু দেখাটাও জীবনের লড়াইয়ের একটা অংশ। কখনো এটা ভেবে এগোতে নেই যে আমি কি পেলাম। এটা ভেবে বাঁচো তুমি কতটা দিতে পারলে সে কতটা ঋণী হলো তোমার কাছ থেকে। নিজেকে তো তার থেকে আলাদা ভাবার কোন দরকার নেই ।যখন তুমি দেখবে তোমার দেওয়া সম্পত্তিতে কেউ ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠেছে ,তোমার তখন তার চেয়েও নিজেকে বড় ধনী মনে হবে। সে তখন নিঃস্ব তোমার কাছে।"
"তুমি তো কম কষ্ট পাও নি এসব দিতে ঠাম্মি?"
"মনের সম্পদ সবার কাছে থাকে না দিদিভাই, থাকলেও দেওয়ার ক্ষমতা কজনের আছে আর নিয়ে যত্ন করে রাখার লোকটা কেও তোযোগ্য হতে হবে বৈকি।"
"কিন্তু অনুভব কে আমি আগের মত ভালবাসতে পারব ঠাম্মি?"
বদ্রি পাখির ফাঁকা খাঁচার দিকে তাকিয়ে ঠাম্মি বলে,"কত বছর হল পাখিগুলো আর নেই কাউকে উড়িয়ে দিয়েছি কেউ এমনি মরে গেছে, তাই বলে কি ওদেরকে ভালোবাসিনি ?কষ্ট হয় না ওদের জন্য দিদিভাই ?কষ্ট হয় ,অনুভবকে ছাড়তে পারবে না বলেই রুপায়নকে ছেড়েছ আবার রূপায়ণ কে বাঁধতে  পারবে না জেনেই তুমি নিজেকে ছেড়ে এসেছো,এ  তো আমাদের সবার গল্প দিদিভাই।"
নীহারিকা সবুজ জানালার দরজা ফাঁক করে দেখে ফিনিক্স পাখির মতো চিল  টা আজও উড়ে যাচ্ছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে।।

সাহিত্যিক সৌমী গুপ্ত
১৬২, রাইফেল ক্লাব রোড, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ 


*অলংকরন: অরিজিৎ ঘোষ 













































0 Comments