𒄰 চৈতালি নাগ🔸সুত্রাগড়,নদীয়া🔸
লকডাউনের আগে ছোট একটা কোচিং সেন্টারে পড়াতো অনিমেষ, মাসের শেষে যৎসামান্য আয়ই তুলে দিত বাবা মায়ের হাতে। মা বাবা ছোট একটা বোন আর সে এই তাদের ছোট সংসার, মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে অনিমেষ, দু চোখে এখনো অনেক স্বপ্নপূরণ বাকি তাঁর, একটা ভালো চাকরি পেয়ে মা বাবার পাশে দাঁড়াতে হবে,ছোট বোনটার একটা ভালো বিয়ে দিতে হবে, ইত্যাদি হাজারো রকমের স্বপ্ন ।ছোট বোনটার যত আবদার তার কাছে ,আগে সন্ধেবেলায় বেরোলো কিছু না কিছু না আনলেই একেবারে চিৎ কার করে রেগে বাড়ি মাথায় করতো। বড়ো ভালো বাসে সে তার দাদাভাই কে।
কিন্তু আজ ক'দিন ধরে লক ডাউন চলাতে কোচিং সেন্টারটাকে ছুটি দিতে হয়েছে ওদের, এ মাসের মাইনেটাও হয়তো পাবে না, কি করে চাইবে ওই কচি কচি মুখগুলোর কাছ থেকে, ওদের অবস্থা ও তো অনিমেষের মতোই তথৈবচ। নিস্তব্ধতা যেন শুধু বাইরে নয় ভেতরেও গ্ৰাস করেছে সবাইকে,মা বাবার মুখের দিকে তাকাতে পারেনা অনিমেষ, একটা ভয়, অনিশ্চয়তা আতঙ্কের ছবি যেন ফুটে ওঠে ওদের মুখে, অথচ জোর করে একটা প্রসন্নতার হাসি বজায় রাখার চেষ্টা করে সবসময়,এটা যে নেহাতি অনিমেষকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য সেটা বুঝতে বাকি থাকেনা অনিমেষের।
বোনটাও আজকাল আর কোনো আবদার করেনা, শুধু বেরোনোর সময় মুখে একগাল হাসি নিয়ে বলে"আজ আর যেন কিছু আনিস না দাদা পেট পুরো ভর্তি,উফফ কাকিমা পুরো পেট ভরে খাইয়ে দিয়েছেন জানিস তো, কিছুতেই কোন কথা শুনলেই না"। বোনের বন্ধু শিল্পা ওর বাবা সরকারি অফিস চাকরি করে , ফেরার সময় রোজ কিছু না কিছু নিয়ে আসে মেয়ের জন্য। কিন্তু অনিমেষ বোঝে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা হাসি, উভয়ই যে সহোদর সহোদরা। তবে ওর বোনের পেট না ভরলেও অনিমেষের দু চোখ ভরে যায় নোনা জলে।
তবে না হার মানেনি অনিমেষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে নিজের মতো করে, যে হাতে এতদিন কলম ছিল সেখানে ঠাঁই পেয়েছে দাড়িপাল্লা। রোজ সকালে বাড়ির পাশের বস্তিটা পেরিয়ে বড় রাস্তার ধারে বাজার বিক্রি করতে শুরু করেছে অনিমেষ, সঙ্কুচিত হয়নি, লজ্জিত হতে দেয়নি তাকে তার শিক্ষা। ছোটবেলা থেকেই বস্তির এই রাস্তা টার সাথে পরিচিত সে, সকল থেকে রাত পর্যন্ত বস্তির যে নানা রকম নিজস্ব ছন্দ আছে তা ও আজ নিশ্চুপ, শুধু একটানা একটা বিষন্নতার সুর বেজে চলেছে নিরন্তর।বস্তির রাস্তাটা এমনিতে শুনশান হলেও বস্তির একটা ঘর থেকে প্রায় যেতে আসতে একটি শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনতে পায় অনিমেষ, শিশু টির মা কোলে নিয়ে একফালি বারান্দায় পায়চারী করে আর কান্না থামানোর চেষ্টা করে। অনিমেষ যেতে আসতে প্রায় এ ঘটনা দেখতে পায়, মনে মনে কৌতুহল হলেও কোনদিন কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করলেও একদিন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোকের কাছ থেকে জানতে পারে ,শিশুটির বাবা ভিনরাজ্যে কাজে গিয়ে আটকে পড়েছে আজ কদিন হলো, মা লোকের বাড়ি কাজ করে সোনারপুরের ওদিকে,ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় কদিন ধরে তাও বন্ধ ঘরে যা জমানো ছিল বা ত্রাণ সামগ্রীর জিনিস ও প্রায় শেষের মুখে,তাই দুধের বদলে মোটা চালের ভাতের ফ্যান খাইয়েই প্রবোধ দেয়ার চেষ্টা করছে সে শিশু টিকে।
বেশ কয়েকদিন এইভাবে চলার পর কিছু টাকা আসে অনিমেষের হাতে, সেদিন তাই বাড়ি ফেরার পথে আসতে আসতে ই ঠিক করে নিয়ে ছিল আজ হাতে করে কিছু একটা নিয়ে যাবে বোনের জন্য, আর বাকি টাকাটা তুলে দেবে বাবা মায়ের হাতে, অনেকদিন পর তাদের সেই হাসি মাখা মুখটা আবার দেখতে পাবে। চকলেট খেতে খুব ভালো বাসে ছোট বোনটা, রাস্তার ধারে অধেক দরজা খোলা একটা মুদির দোকানে ঢোকে চকলেট কেনার জন্য,
"হ্যাঁ বলুন দাদা , কি নেবেন"?
প্রশ্ন টা শুনে যেন সম্বিত ফেরে অনিমেষের।" আরে বলুন বলুন তাড়াতাড়ি আমাকে আবার দোকান বন্ধ করতে হবে। যা কদিন ধরপাকড় শুরু হয়েছে। সব সারলে বাঁচা যায়, উফফ ,রাধে রাধে। বলুন বলুন"।
"আজ্ঞে ইয়ে মানে একটা....একটু গুঁড়ো দুধ দিনতো।"
সমস্ত দ্বিধা ত্যাগ করে পর্দা সরিয়ে ঢুকে পড়ে ছিল বস্তির সেই একচিলতে ঘরে । হঠাৎ আগন্তুকের আগমনে থতমত হয়ে মহিলা বলে ওঠে "আপনি"?
"আর কতক্ষন না খাইয়ে রাখবেন বাচ্চা টিকে নিন এটুকু খাইয়ে দিন , কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে দুধের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে ছিল শিশুটির মায়ের দিকে।
"কিন্তু"
"না কিন্তু করবেন না দিদি ,আপনার নিজের ভাই দিলে নিতেন না? ধরে নিন না আপনার আরেক ভাই দিলে"।
কোনো কথা বলতে পারেনি অনিমেষের নতুন দিদি শুধু দু'চোখ দিয়ে অসময়ের শ্রাবণের ধারা গড়িয়ে পড়ে ছিল তার।
এমনি সময় তুমি এলে ভাই তোমাকে যে কিছু....
"না না আজ আর কিছু খাবো না দিদি, আজ আসি অন্য একদিন এসে পেটভরে খেয়ে যাবো , কথা দিলাম,"।
" আসবে তো?"
নিশ্চয়ই আসবো।"
"তাহলে সামনের মাসেই তোমাকে একবার আসতে হবে ভাই । সামনের মাসে খোকার মুখে ভাত দেব। বেশি কিছু না সামান্য কিছুই আয়োজন করবো।ভাত শাক তরকারি আর পায়েস। ওই দিন তোমাকে এসে কিন্তু একটু পায়েস খেয়ে যেতে ই হবে ভাই।,"
"খোকার বাবাও ততদিনে চলে আসবে নিশ্চয়। শুনেছি সরকার থেকে নাকি বাইরে থেকে শ্রমিকদের আনার ব্যবস্থা করেছে। খোকার বাবা আমার হাতের তৈরি পায়েস খেতে খুব ভালো বাসে।"
"নিশ্চয় আসবে দিদি। আর আমিও আসবো তোমার খোকার মুখে ভাতে পায়েস খেতে।" কথাটা বলতে বলতে গলাটা ধরে আসে অনিমেষের, ছুটে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে, পেছন থেকে শুনতে পায় তাহলে ওই দিন
"আসবো দিদি....নিশ্চয়ই আসবো....চিৎকার করে বলতে থাকে অনিমেষ। পিছনে ফিরে দেখে দরজায় দাঁড়িয়ে তার দিদি , চোখ দুটো অন্ধকারে ও চিকচিক করছে।
না সেদিন বেশি পয়সা ছিলো না অনিমেষের কাছে তাই কোনো নামি কোম্পানির বেবিফুড নিয়ে যেতে পারেনি তার ভাগ্নের জন্য । নিয়ে যেতে পারেনি তার বোনের বড্ডো প্রিয় চকলেটটা ও; শুধু তার এই দিদি র মধ্যেই দেখতে পেয়ে ছিল তার বোন কে; হয়ে উঠে ছিল তাদের আত্মার আত্মজন।
সেদিন সেই নিস্তব্ধ নিরালা রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সর্ব শক্তি মান ঈশ্বরের কাছে একটাই প্রার্থনা করে ছিল অনিমেষ..." হে ভগবান সারা জীবনে আমার সমস্ত পুণ্যের বিনিময়ে এই অনাহারে,অর্ধাহারে থাকা মানুষ গুলোর দু চোখের স্বপ্ন আশা যেন পূর্নতা পায়, পৃথিবী আবার ফিরে পাক নিজের ছন্দ" ।
0 Comments