🔰 ডঃ রমলা মুখার্জী🔹বৈঁচী,হুগলি🔹
🔴 বেশ কয়েক মাস হল ছোট ছেলে দীপ্তদীপ সরকারি চাকরি পেয়ে সুন্দরবনের গোসাবাতে পোস্টিং।ওর মুখে খুব সুন্দরবনের গল্প শুনি।খুব যাবার ইচ্ছে।ছেলে বলল,শীতের সময় লঞ্চে সুন্দরবন ভ্রমণের টিকিট কেটে রাখব মা, তোমাকে নিয়ে ঘুরবো; গরমে লঞ্চ ছাড়ে না।তাছাড়া গরমে গোসাবাতে জলেরও বেশ কষ্ট।পানীয় জল কিনে খেতে হয়।ভূগর্ভস্থ জল মোটেই ভালো নয়,বেশির ভাগই নোনতা।অবশেষে এল সেই দিন,হল আমার প্রতীক্ষার অবসান।ছেলের ফোনে বলল,"মা তুমি আমার রুম-মেট সুদীপের সাথে চলে এসো গোসাবায় আমার বাসায় এক সপ্তাহের জন্য"।
ডিসেম্বরের ছয় তারিখ ভোর পাঁচটায় আমি মোবাইলে নেটে বৈঁচী থেকে ক্যানিং ভায়া হাওড়া পঁচিশ টাকার একটা টিকিট কেটে চেপে বসলাম হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইন লোকালে।হাওড়াতে নেমে সুদীপের সাথে চাপলাম শিয়ালদাগামী বাসে।শিয়ালদা কোর্ট স্টপেজে নেমে আমরা শিয়ালদা স্টেশনে এসে ক্যানিং লোকালে উঠলাম।সুদীপের মায়ের তৈরি লুচি,আলুর দম,আর শীতের বিখ্যাত খেজুর গুড়ের রসগোল্লা দিয়ে টিফিন সারলাম।জানলার ধারের সিটে বসে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে একটু তন্দ্রা এসেছে,কারণ ভোর সাড়ে তিনটেতে উঠতে হয়েছে।এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট পর সুদীপের ডাকে ঘুম ভাঙল,দেখি ক্যানিংএ পোঁছে গেছি।ক্যানিংএ নেমে গদখালির বাসে চেপে সব ঘুম ছুটে গেল,রাস্তা বহুত খারাপ।ঘন্টা খানেক পরে পৌঁছালাম গদখালি। পথে মাতলা,বাসন্তি,হোগল নদী দেখে সব ক্লান্তি ধুয়ে মুছে গেল। গদখালি থেকে বিদ্যেধরী নদীর ওপর নৌকা-বিহার করতে করতে আমরা গোসাবায় পৌঁছে গেলাম।নদীর দুই তীরের শোভা অতুলনীয়।গোসাবায় ছেলের বাসায় পৌঁছে স্নান-খাওয়া সেরে বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বেরুলাম গোসাবার বিখ্যাত হ্যামিলটন সাহেবের বাংলো দেখতে।বাসার খুব কাছেই বাংলোটি।আমি খুবই ভাগ্যবতী,কারণ ঐদিনই ছিল হ্যামিলটন সাহেবের জন্মদিন।সারা দিন নাচ, গান, আবৃত্তি,কুইজ প্রতিযোগিতা চলছিল,বাসা থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম।বাংলোটি আলো দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।বাংলোর ভেতরে ঢুকলাম। ড্যানিয়েল হ্যামিলটনের ছবি,বসার,শোয়ার,স্নানের ঘরগুলি ঘুরে ঘুরে দেখলাম।গোসাবার উন্নতিতে ঐ সাহেবের অবদান নিয়ে গীতি-আলেখ্য শুনে গোসাবা বাজারটায় গেলাম।বেশ বড় বাজার,হীরে থেকে জিরে সব কিছুই পাওয়া যায়।বাসায় ফিরে খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে স্নান সেরে পোঁছালাম গোসাবার ইউনিয়ান ঘাটে।সেখান থেকে লঞ্চে করে রওনা দিলাম সুন্দরবনের নানা দর্শণীয় স্থান ভ্রমণের উদ্দেশ্যে।সেখানে প্রথমেই প্রাতরাশ সেরে নিলাম। তারপর কফি খেতে খেতেই গোসাবার বিডিও ঘাটে লঞ্চ এসে থামল।আমরা গেলাম বেকন বাংলোতে।কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বেকন বাংলোতে ১৯৩২ সালে ৩০থেকে ৩১শে ডিসেম্বর অবস্থান করেছিলেন।রবীন্দ্রনাথ বই পাঠরত এইখানের মূর্তিটি খুব সুন্দর ও একদম অন্যরকম।তবে বাংলোটি ছোট,জীর্ণ-দশা।ভালোভাবে রক্ষণাবেক্ষণ খুবই দরকার,বিশ্বকবির অমূল্য স্মৃতিটি বাঁচিয়ে রাখা অতি আবশ্যক।বাংলোটির অনতিদূরে একটি অনুকুল ঠাকুরের সুন্দর আশ্রম ও বিদ্যালয় দেখলাম।আবার লঞ্চে এসে একটু ঠাণ্ডা কোল্ডড্রিংকস খেতে খেতে ইরিগেশন ঘাট,পুলিশ ঘাট,টাইগার ঘাট ইত্যাদি দেখতে দেখতে বিদ্যাধরী নদীর ওপর দিয়ে ভেসে যাওয়ার যে কি আনন্দ তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।চারিপাশে ম্যানগ্রোভ গাছের সারি,লঞ্চ চলেছে ধীর গতিতে পাখিরালয়ের দিকে।কিন্তু পাখিরালয়ে গিয়ে হতাশ হতে হল। আগের মত পাখি আর এখানে নেই। হোটেল,দোকান,শব্দদূষণের করালগ্রাসে পাখিরা ক্রমবিলীন। আমাদের সহযাত্রীরা ভীষণ সাংস্কৃতিক মনভাবাপন্ন থাকায় সারাটা পথ হাসি,আনন্দ,গানে ভরে উঠেছিল।আমার ছেলে আর আমিও ওদের অনুরোধ সংগীত পরিবেশন করলাম।লঞ্চ ঢুকল পাখির জঙ্গলে,এখানে সারস, পানকৌড়ি, মাছরাঙা পাখির দেখা মিলল, তবে পরিযায়ী পাখিরা আরও শীত পড়লে তবেই আসে।বিশ্বউষ্ণায়নের কারণে ডিসেম্বরেও তেমন শীতের দেখা নেই।
গোসাবার জটিরামপুর ঘাটের কাছাকাছি এই পাখির জঙ্গলে গোসাপ, নানারকম বড় আকারের গিরগিটি জাতীয় প্রাণী দেখলাম।বাজ, চিল আকাশে উড়ছিল, মাছরাঙা মাছ শিকার করেই উড়ে গাছের ডালে গিয়ে বসছিল।পানকৌড়ির জলে ডুবে ডুবে জলজ প্রাণী শিকার করা দেখতে দেখতে আর সোনারপুর,বারাসত থেকে আসা সহযাত্রীদের সঙ্গে ছোটিসি মুলাকাৎ করতে করতে চলেছি। দুপুরের খাওয়া সেরে লঞ্চের নিচের তলায় নেমে সুন্দর করে পাতা বিছানায় একটু গড়াগড়ি দিয়ে নিলাম।বিকেলে পাখিরালয়ের বেশ সুসজ্জিত হোটেল 'আরামে' আমরা সবাই উঠলাম।ঐ হোটেলের নিজস্ব ঘাটে লঞ্চটি সারা রাত আমাদের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে রইল।
সন্ধ্যায় 'আরামে' আমাদের বিনোদনের জন্য আদিবাসী সম্প্রদায়েরা ঝুমুর নৃত্য পরিবোশন করল,ঐ অপরূপ নৃত্যের তালে তালে আমরাও পা মেলালাম।ঐ অনুষ্ঠানের পর আবৃত্তি,নাচ ইত্যাদি নানান শিল্পকলা প্রদর্শন করলেন লঞ্চের সব পর্যটকরা মিলে।আমার ছেলের সুমধুর সংগীতে আমরা সবাই যেন কোন স্বপ্ন-লোকে পৌঁছে গেলাম। গাছ-গাছালিতে ঘেরা বেশ নিরিবিলি পরিবেশে মনেও যেন সবুজের ছোঁয়া লাগছিল।
পরদিন খুব তাড়াতাড়ি উঠে স্নান সেরে সবাই লঞ্চে চেপে গেলাম সজনেখালি। সজনেখালির বনাঞ্চলকে ১৯৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছিল। সজনেখালিতে আমরা প্রথমেই গেলাম পর্যটন অফিসে।সেখানে পারমিশন করিয়ে আমরা গেলাম ম্যানগ্রোভ ইন্টারপ্রিটেশন সেন্টারে।এটি একটি মিউজিয়াম।ম্যানগ্রোভ সম্বন্ধে বেশ সমৃদ্ধ হয়ে এখান থেকে আমরা গেলাম ওয়াচ টাওয়ারে।কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছও বাঘের দেখা না পেলেও বন-বিড়াল,হরিণ,গোসাপ ইত্যাদি দেখলাম।তারপর কুমীর-পুকুর,কচ্ছপ পুকুর,বনবিবির মন্দির দেখে অনেক মুগ্ধতা নিয়ে লঞ্চে উঠলাম।ম্যানগ্রোভ গাছের তলায় গোঁজের মত শ্বাসমূলগুলি আমাকে খুবই আকৃষ্ট করছিল।
সুন্দরবনের আর একটু ভেতরে সুধন্যখালিতে লঞ্চ এসে পৌঁছালো। ম্যানগ্রোভ গাছের বড় উদ্যানে প্রতিটি গাছের নাম লেখা থাকায় আমরা এতক্ষণ ধরে যে সমস্ত গাছ দেখতে দেখতে আসছিলাম, প্রায় প্রত্যেকটির নাম জানতে পারলাম।কত রকমের লবনাক্ত মাটির গাছ, যেমন-বাণী, কাঁকড়া, গড়ান, হেতাল, কেওড়া, সুন্দরী, গেঁওয়া, হোগলা,ধুন্দুল আরও কত গাছ বলে শেষ করা যাবে না।স্রোতের টানে উৎপাটিত না হওয়ার জন্য এদের বেশিরভাগেরই ঠেশমুল থাকে।এখানকার লবনাক্ত মাটিতে অক্সিজেন কম থাকায় মূলগুলি মাটির ওপরে উঠে এসেছে।এদের শ্বাসমূল বলে।এগুলোর গায়ে ছোট ছোট শ্বাসছিদ্র থাকে বায়ু থেকে অক্সিজেন নেওয়ার জন্য।ম্যনগ্রুভ পার্কটি দেখার পর সুধন্যখালি ওয়াচটাওয়ারে গেলাম। মিষ্টি জলের পুকুর দেখলাম,সেখানে বাঘেরা জল খেতে আসে।হরিণ,লালমুখো বানর অনেক দেখলাম।বানরগুলো দেখে বাচ্চারা খুব মজা পাচ্ছিল।আমরা লঞ্চে ফিরে লাঞ্চ সারতে সারতেই দোবাকিতে এসে পৌঁছালাম।এখানকার পাঁচমুখি নদীতে মাতলা, বিদ্যেধরী,সরস্বতী, রায়মঙ্গল ও আর এক নাম না জানা নদী এসে মিশেছে।পুরুষের সাথে মহিলারাও জীবন বাজি রেখে হাঙ্গর,কামোট,কুমীর উপেক্ষা করে চিংড়িমাছের মীন থেকে চিংড়িমাছ তুলছে।হরিণ কাদায় পা ডুবিয়ে গাছের পাতা টেনে খাচ্ছে।কাঁকড়ার ইতিউতি ছোটাছুটি আর গর্তে ঢুকে পড়ার লুকোচুরি খেলা দেখতে বেশ মজার।দোবাকি ওয়াচটাওয়ার থেকে প্রায়ই বাঘের দেখা মেলে,আমারা দক্ষিণরায়ের মানে বাঘের পায়ের ছাপ দেখলাম,কিন্তু বাঘমশায়ের দেখা পেলাম না। প্রচুর হরিণ,বন্য শূকর দেখে লঞ্চে উঠলাম। পথে বেশ বড় একটা কুমীরকে কাদার সঙ্গে রঙ মিলিয়ে শুয়ে থাকতে দেখলাম।বনমোরগের অপরূপ রঙের শোভা দেখে একেবারে সবাই মুগ্ধ।এবার ফেরার পালা।সহযাত্রীরা বাড়ি ফিরে গেল।আমি কিন্তু গোসাবাতে ছেলের বাসাতে ক'দিন থেকে কাঁকড়ার ঝোল আর টাটকা গলদাচিংড়ির মালাইকারি খেয়ে তবেই ছেলের সাথে শনিবার বাড়ি ফিরলাম,সাথে ছিলেন গোসাবা হাইস্কুলের দুই মাস্টরমশাই।ছেলের বাসার পাশেই বেশ বড় গোসাবা হাইস্কুল। ওনাদের কাছে জানতে পারলাম প্রায় বারশো ছাত্র-ছাত্রী এখানে পড়ে। শহরের মত ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর ঢেউ এখানে এখনো আছড়ে পড়ে নি।গ্রামের সরলতা আছে বলেই এখানকার মানুষেরা বড় আন্তরিক।মাঝে গোসাবাতে দুদিন সুন্দরবন উৎসব উপলক্ষে নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখেছিলাম।বাড়ি ফিরতে তাই ইচ্ছে করছিল না,তবু তো ফিরতেই হয়।বিদায় সুন্দরবন,বিদায় গোসাবা।
-----------------------------------------
0 Comments