"শোলে-এক ইতিহাস"
ভারতীয় সিনেমার শতবর্ষ অতিক্রান্ত।বহু অগণিত উত্থান এবং কিছু পতনের অলিন্দ নিলয় ঘুরে ভারতীয় সিনেমার যে স্বপ্নবীজ সেই ১৯১৩ সালে বপন করা হয়েছিল,তা আজ ভারতীয় দর্শক মননের রূপ,রস,গন্ধ,বর্ণে সিঞ্চিত হ'য়ে এক মহীরুহ তে পরিণত হয়েছে।ভারতীয় সিনেমা,হিন্দি সিনেমা সহ যে কয়েকখানি সৃষ্টি সময়ের সীমিত চৌকাঠ পার হয়ে এসে ক্লাসিকের চেহারা নিয়েছে,পথের পাঁচালি,মাদার ইন্ডিয়া এবং আরো বিভিন্ন ভাষার সিনেমার মধ্যে 'শোলে'যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, একথা বলাই বাহুল্য।'শোলে'যেন এক রহস্যাবৃত ক্লাসিক, যা নিয়ে আজো মানুষের আগ্রহের শেষ নেই।১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিটি কে ঘিরে আজও রোমান্টিসিজম এর অন্ত নেই দর্শক মনে।যে সিনেমার বয়স আজ পঁয়তাল্লিশ বছর,কী ছিল এই সিনেমার আবেদনে,যা মোহিত করে আসছে ভারতীয় দর্শককে দশকের পর দশক ধরে!
মনে রাখতে হবে সালটি ১৯৭৫,জরুরি অবস্থার ভারতবর্ষ। আধুনিক ভারত আর চিরাচরিত ভারতের মধ্যিখানের এক অদ্ভুত সময় দোলাচলে,রাজনৈতিক টানাপোড়েনে, বেকারত্বে,এক আস্ত যুব সমাজ ভিতরে ভিতরে ফুঁসছে।ঠিক সেই সময় তদানীন্তন প্রথাগত ঘরানার একেবারে বাইরে,অনেক ঝুঁকি নিয়ে রমেশ সিপ্পি নামের এক তরুন,বানিয়ে ফেললেন ৭০মিমি স্ক্রিন দৈর্ঘ্যের,আক্ষরিক অর্থেই এক দীর্ঘ বিস্ময়-চলচ্চিত্র 'শোলে'।১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মুক্তি পেল 'শোলে'।কয়েকদিনের মধ্যেই ইতিহাস তৈরি হতে শুরু হলো।অধুনা বোম্বের মির্নাভা থেয়েটারে একনাগারে পাঁচ বছর প্রদর্শিত হল 'শোলে',প্রত্যেক শো হাউসফুল।ভারতবর্ষের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সর্বকালের সব রেকর্ড যেন একের পর এক চূর্ণবিচূর্ণ হতে থাকলো 'শোলের'হাত ধরে।ইংরাজিতে একটি শব্দ আছে,খুব শক্তপোক্ত শব্দ,সাহিত্য সমালোচনার অতি ব্যবহৃত একটি শব্দ 'নেমিসিস' এবং একটি অতি চর্চিত শব্দ-বন্ধ আছে,'পোয়েটিক জাস্টিস'।'শোলে'সম্ভবত এই দুই ধারনার বাস্তব চিত্রায়ন ঘটিয়েছিল,তার পরতে পরতে।ভারতবাসী, মূলত যুব সম্প্রদায় এই কঠোর ভাবে 'দুষ্টের দমন ও সৃষ্টের পালনে' যারপরনাই আবিষ্ট হয়েছিল।নিজেদের সমস্ত পরাজয়,গ্লানি আর হেরে যাওয়া গুলোর দুর্দমনীয় প্রতিশোধ দেখে তৃপ্তি পেয়েছিল,মনে মনে।জয় আর বীরু নামক দুই অতি সাধারণ, সাদামাটা চরিত্রের মধ্যেই নিজেদের খুঁজে পেতে শুরু করে তারা।কোমল চলচ্চিত্রের স্বপ্নবিলাশ ছেড়ে ভারতীয় দর্শক জয় আর বীরুর মধ্যে খুঁজে পাচ্ছিল প্রতিবাদ।সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদেহী ছিপছিপে চেহারার জয় রূপী অমিতাভ যখন পর্দায় বলে উঠতেন,'গব্বর আপনি আদমিঁয়ো ক্যাহে দো বন্দুকে ফেঁক্ দে!'তখন যেন কোথাও গিয়ে চোয়াল শক্ত হত,দর্শকের, সমস্ত অন্যায়ের চোখে চোখ রেখে বলার সাহস তৈরি হত,এনাফ ইস্ এনাফ!
সালটা ১৯৭৩।জিপি সিপ্পি সাহেবের পুত্র রমেশ সিপ্পি বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ, স্থির করলেন এমন এক সিনেমা তৈরি করবেন যা প্রচলিত ঘরানার একেবারেই বাইরে।এর আগেই তাঁর তৈরি,'সিতা অউর গীতা'বক্স অফিসে তুমুল জনপ্রিয়।তাই ধমেন্দ্রজি ও হেমা মালিনি জির আসন পাকা, প্রধান হিরো আর হিরোইন হিসেবে।একটু ফ্ল্যামবয়েন্ট চরিত্রের বীরু ও গ্রাম্য প্রাগলভ্য নারী চরিত্র বসন্তি তে অন্য কোনো অভিনেতা অভিনেত্রী দের ভাবার অবকাশই ছিল না।স্তিমিত ধরনের চরিত্রে জয়াজিও ভীষন মানানসই ভাবেই পছন্দ ছিল পরিচালক প্রযোজক এর।সমস্যার সূত্রপাত হয়,জয় চরিত্রটি নিয়ে।প্রথম নাম আসে সেই অতি জনপ্রিয় অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহা জির,ডিস্ট্রিবিউটারদেরও প্রবল পছন্দ ছিলেন তিনিই। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত কারণেই আগ্রহ দেখালেন না শেষ পর্যন্ত।যদিও গল্পের কাহিনীকারদ্বয় সেলিম ও জাভেদের পছন্দ ছিল অমিতাভ। মনে রাখতে হবে,এই মনোনয়ন পর্ব যখন চলছে,তখনও 'জঞ্জির' মুক্তি পায়নি।অমিতাভ এর নামের পাশে শুধুই ফ্লপ নামক শব্দ জুড়ে গিয়েছে।কিন্তু আজীবন জহুরির ধর্ম,রত্ন চেনা,তাই সেলিম-জাভেদ এবং অবশ্যই রমেশ সিপ্পি সমস্ত ভিন্নমত এবং বাঁধাকে গুরুত্ব না দিয়ে,একপ্রকার ঝুঁকি নিয়েই অমিতাভকে রাখলেন 'জয়'এর ভূমিকায়।অন্যদিকে সিকিম থেকে আসা,আর এক তরুন শক্তিশালী অভিনেতা ড্যানি ডেনজোংগাপ্পা।যিনি ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সিনেমায় তার অভিনয় প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেই ছিলেন।তিনি গব্বরের ভূমিকায় মনোনীত এবং স্বাবাভিক ভাবেই ড্যানিজি নিজেও ভীষণই আগ্রহীও ছিলেন প্রথম থেকেই।কিন্তু শেষ মূহুর্তে তৈরি হল এক অদ্ভুত জটিলতা।ফিরোজ খানজি ঠিক সেই সময় তৈরি করছিলেন,'ধর্মাত্মা'যা কিনা ফ্রান্সিস ফোর্ড কাপোলার ক্লাসিক 'দি গডফাদার'এর আদলে। শ্যুটিং এর জন্য ড্যানি কে যেতে হল,আফগানিস্তান। শুরু হলো ডেট নিয়ে সমস্যা।এবং কোনো ভাবেই বাকি অভিনেতাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ডেট দিতে পারলেন না ড্যানি।ড্যানিজি কে পিছিয়ে আসতেই হলো।তখন গব্বরের জন্য বিভিন্ন নাম হাওয়ায় ভাসছে।কিন্তু কাউকেই পছন্দ হচ্ছে না সিপ্পি জির।অবশেষে একদিন সেলিম-জাভেদ জুটির সেলিম বান্দ্রা বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রায় পাকড়াও করে আনলেন আমজাদ খান নামক এক প্রায় অপরিচিত অভিনেতাকে।বাকিটা ইতিহাস।
বস্তুত শুরু থেকেই সেলিম-জাভেদ চাইছিলেন,শুভ-অশুভ,সুর-অসুরের লড়াই এর এক মহাকাব্যিক অ্যাডভেঞ্চার লিখতে।অবশ্যই হলিউডি চলচ্চিত্রের কাহিনীতে প্রভাবিত হয়ে।এপ্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য,'বুচ কাসিডি এ্যানড্ দি সানডান্সড্ কিড,'দি ম্যাগফিসেন্ট সেভেন',আর সারগিও লিওনির 'স্পাগেটি ওয়েস্টার্ন'এবং অতি অবশ্যই আকিরা কুরোসোয়ার 'সেভেন সামুরাই'এর নামক সিনেমার গুলির নাম।এই বিদেশী চলচ্চিত্র গুলি থেকে 'শোলে'র কাহিনী ভীষণ ভাবেই প্রভাবিত। অতঃপর ব্যাঙ্গালোর থেকে কিছু দূরে রামনগরাম এ তৈরি হল,সুবিশাল সেট।দুমাসেরও অধিক সময় ধরে চললো শ্যুটিং।
কার্যত'শোলে'বোধহয় এমন এক চলচ্চিত্র যা নিয়ে কথা শেষ হবার নয়।ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অর্থাগমের দিক থেকে(সে সময় 'শোলে'র উপার্জনের পরিমান আনুমানিক ৩৫০মিলিয়ন বা তার অধিক)অন্য অনেক সিনেমা হয়তো কালের নিয়মে 'শোলে'কে পিছনে ফেলেছে কিন্তু বিনোদনধর্মী কিংবদন্তি একটিই, 'শোলে'।ফ্লিম সমালোচকরা বলে থাকেন,ভারতীয় সিনেমার,মূলত হিন্দি সিনেমার দুটি অধ্যায়,SholayAD এবং Sholay BC,অর্থাৎ প্রাক শোলে যুগ ও শোলে পরবর্তী যুগ।শত সৌধের মধ্যেও 'শোলে'বোধহয় তার নিজ উজ্জ্বল্যে তাজমহলের মতই সতত মৌলিক,যা যুগান্তরেও মলিন হয় না,যা ঘিরে প্রজন্মান্তরেও ভালোবাসা আর শিহরণ আবর্তিত হয়।
এই শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ নায়ক,অমিতাভের পূর্ণমাত্রায় মাথা তুলে দাঁড়ানো 'শোলে'র হাত ধরেই।'শোলে'সত্যিই এক অগ্নিগর্ভ যেখান থেকে জন্ম নিয়েছেন জ্যোতিষ্ক আর ইতিহাস।
তথ্যসূত্র -Sholay,The Making Of Classic - Anupama chopra
Wikipedia ও বিভিন্ন সাক্ষাৎকার থেকে সংগৃহীত তথ্য
প্রবন্ধকার শৌভিক চ্যাটার্জী
0 Comments