পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অণুগল্প


মূষিক বৃত্তান্ত 

একটা ইঁদুর ঘরময় ছুটোছুটি করছে । এরপর একে একে আরও অনেকগুলো এসে জুটবে। রাত যত বাড়বে তত দলে ভারী হবে তারা।বেলাগাম ঔদ্ধত্য আর কাকে বলে! সারা রাত ধরে কী যে লাফালাফি দাপাদাপি! রোজই করে। অন্ধকার ঘরে আমার একচিলতে বিছানা। শুয়ে শুয়ে রোজই ওদের উপদ্রব সহ্য করতে হয়। অগত্যা! শরীরে তো এমন বল নেই যে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা ছাড়া ওদেরকে তাড়ানোর জন্যে উঠেপড়ে লাগব। ইঁদুরের দল আমাকে গ্রাহ্যির মধ্যেই আনে না। মনে করে একটা ফালতু। 
রাত আরও গভীর হলে একসময় দেওয়াল থেকে নেমে আসে সন্ধ্যা। প্রায়ই আসে। মাথার কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করবে, "আজও কিছু খেলে না তো? "
"ইচ্ছে হয়নি। রোজ রোজ দু'মুঠো মুড়ি চিবিয়ে বালিশে মাথা পাততে হবে এমন হক আছে নাকি ? এরপর তো সারা রাত ধরে যত্ত হাবিজাবি চিন্তা !  দূর ! দিনরাত্তির সবই এক। জীবনভর ওই ইঁদুরগুলোর মতো এত লাফালাফি-দাপাদাপি করে কী এমন হল ! এখন আর হিসেব কষতেও পারি না।"
 "কী দরকার! তোমার হাতে তো কিছু নেই।"
  "কিন্ত তুমি এমন আদিখ্যেতা দেখাতে আসো কেন বলো তো? নিজের আখেরটা বেশ গুছিয়ে নিয়ে দিব্যি তো কেটে পড়লে !... আমার অবশ্য এখন দুঃখ-টুঃখ কিছু  নেই। আবার আনন্দও নেই। এমনকী, ক্ষোভ, অভিমান, খুশি, তৃপ্তি, অভিযোগ.... না, সেসবও নেই। এরকমই আরও অনেক 'নেই'গুলোকে একসঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে আমি রাত্তিরে একা ঘরে শুয়ে শুয়ে শুধু অন্ধকারে গোল গোল বৃত্ত আঁকি।"
        ওই ইঁদুরগুলো বড্ড জ্বালাচ্ছে। দুপুরের দিকে একবার পাড়ার দোকানে গেলাম। হাঁটতে বেশ কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু না গেলে ইঁদুর-মারা বিষটা কে এনে দেবে ? সাধারণত সকালে কাউকে আমার মুখ দেখাতে চাই না। লোকে বলে, আমি অপয়া। এ-মুখখানা দেখলেই নাকি মহা অনর্থ। কেন ? না, ছেলেপুলের বাপ হতে পারিনি, তাই। আহা, কী রসিকতা একটা মানুষের সঙ্গে ! আড়াল-আবডালে এসব নিয়ে কত যে ঠাট্টা-তামাশা ! মরুকগে! 
      বিষের প্যাকেটটা মাথার কাছে রেখেছি। পাশে একবাটি জলও। দোকানের ছেলেটা বলেছে, "আট-দশটা দানা রয়েছে। একটা করে খেলেও একসঙ্গে গোটাকয়েক ছটফটিয়ে মরবে।"
      রাত ক্রমশ বাড়ছে। আমি তো ঘুমই না। পাল্লা দিয়ে  ইঁদুরের দলও জেগে থেকে তাদের রাজত্ব চালায়। ওরা এখন ঘরময় ছুটোছুটি করছে। একটা দানাতেই একটা খতম ! তাহলে সবকটা দানা একসঙ্গে পেটে পড়লে....? 
       ছটফটে ইঁদুরগুলো নিশ্চয়ই খুব দাপাদাপি করবে। শক্ত কাঠ হয়ে যাওয়া একটা মানুষের ঠাণ্ডা দেহটার ওপর দিয়ে দৌড়োদৌড়ি করলেও তখন এতটুকুও বাধা পাবে না। 

        লেখক পুলককুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
মসাগ্রাম, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ 












    

0 Comments