আলো আঁধারের খেয়া
একটা বইয়ে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে দিয়া। রাত নেই, দিন নেই বই পড়ছে সে। কখনও পড়ার বই কখনও গল্পের বই। বাবা মারা যাবার পর থেকেই এমনটা হয়েছে দিয়ার। সারাক্ষণ মন খারাপ। এক বিষণ্ণতার অন্ধকারে সে যেন ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে একটু একটু করে। বই ছাড়া কিছুই আর ভালো লাগে না দিয়ার। না বন্ধুদের ইয়ার্কি ঠাট্টা, না সিনেমা, না বাইরের জগত। সে যেন নিজেকে একটা একলা দ্বীপে বন্দী করে ফেলেছে।
কলেজের পড়া শেষ হয়েছে তার কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়নি সে। মা বলতে এলে মাকে বলেছে চাকরির জন্য চেষ্টা করবে সে। কী হবে মিছিমিছি একটা সার্টিফিকেট দিয়ে? কিন্তু চাকরির জন্যও পড়াশুনো করে না দিয়া। তার বদলে গল্পের বই পড়ে। মা এসে মাঝে মাঝে দাঁড়ায় ওর ঘরে। চারদিকে বইয়ের পাহাড়। তার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে বসে আছে দিয়া। মা চুলের জট ছাড়িয়ে দেয়।
''চোখ মুখের কী হাল করেছিস রে! চোখের তলায় কালি! গায়ে খড়ি উঠছে!''
দিয়া বাবার আরাম চেয়ারটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে বলে
''রাতে আমার ঘুম আসে না। মাঝে মাঝেই বাবাকে দেখতে পাই জানো!''
মা শুনে ঠোঁট টিপে কাঁদে।
''কই এতদিন পাশে থেকেছি, আমি তো একদিনের জন্যেও দেখলাম না তাকে!''
দিয়া মনে মনে হাসে। বাবা একেবারে তার নিজস্ব। বাবার স্বভাবও পেয়েছে সে। বাবাও এমন আরাম চেয়ারে বসে নানা রকমের বই পড়ত। রিটায়ারমেন্টের পর এটাই ছিল বাবার একমাত্র নেশা। দিয়ার দিকে ফিরে মা যাবার আগে বলে,
''রাতদিন শোক নিয়ে থাকতে নেই। কাল আমার এক বান্ধবীকে বাড়িতে খেতে ডেকেছি। বই মুখে বসে থাকিস না। লোকে নিন্দে করবে।''
সকালবেলা মা এসে ডাকল দিয়াকে। দিয়া ঘুমাচ্ছিল না, জেগেই ছিল। কী এক মনখারাপের অসুখ গ্রাস করেছে দিয়াকে। রাতদিন বাবার সঙ্গে আপন মনে কথা বলে।
''যা স্নান সেরে আমার বালুচরীটা পরে আয় সোনা মা! আমি চুল বেঁধে দেব।''
"কেন? আমি সাজতে টাজতে পারব না।''
''বেশ সাজিস না। তবে পেত্নীর মতও থাকিস না। এত সুন্দর চুল তোর! একটু আঁচড়ে নিস অন্তত!''
মায়ের বান্ধবী শীলা মাসি আর তার ছেলে দেবার্ক এসেছে। দিয়া জানে না, দেবার্ক আসলে দিয়াকে দেখতে এসেছে। মায়েরা সব পাকা কথা বলে রেখেছে আগেই। দেবার্ক দিয়ার পড়ার ঘরে এল। দরজার কাছ পর্যন্ত বইয়ের স্তুপ দেখে দেবার্ক অবাক। ওর চোখে মুগ্ধতা।
''এই এত বই আপনি পড়েন!''শুনে দিয়া অবজ্ঞার হাসি হাসল।
"বিভূতিভূষণের কোন উপন্যাস আপনার প্রিয়?''
"দৃষ্টিপ্রদীপ। পড়েছেন?''
"না ওটা পড়িনি। আমার প্রিয় বই আরণ্যক। জঙ্গল খুব ভালো লাগে।''
"বাবাও জঙ্গল ভালোবাসত।''
"তাই বুঝি?''
গল্প বেশ জমে ওঠে ওদের। দিয়া অবাক হয়, পৃথিবীর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সে, কিন্তু দেবার্ক যেন সবার থেকে আলাদা! অনেকটা যেন তার বাবার মত! ওরা ফোন নম্বর দেওয়া নেওয়া করল।
রাতে শুতে এসেছে দিয়া। রোজ শুয়ে শুয়ে বই পড়ে দিয়া। আজ বই ভালো লাগল না। দেবার্ক যাবার সময় ওর হাতটা একবার ধরেছিল, সেই স্পর্শটা এখনও যেন হাতে লেগে আছে ওর। দিয়া চোখ বুজে দেবার্কর মুখটা মনে করতে লাগল। কখন বাবার মুখ আর দেবার্কর মুখটা এক হয়ে গেল। রাতে আর ওর সঙ্গে গল্প করতে বাবা এল না দিয়ার কাছে। দেবার্কর মুখটা মনে করতে করতে কখন সব মনখারাপ আর বিষণ্ণতা ভুলে গিয়ে দিয়া ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল।
গল্পকার নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী
মধ্যমগ্রাম, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ
0 Comments