সমাজ বসু'র ছোটগল্প


ফেরা,না ফেরার গল্প

ঘুম চোখে দরজা খুলে দেয় সুপর্ণা।
--- এত রাত হলো যে?
---আর বোল না,অফিসের একটা জরুরী আলোচনা করতে গিয়ে এত রাত হবে ভাবতে পারিনি। এ জানলে কাল সকালে অনিন্দ্যর বাড়ি যেতে পারতাম। ঝিমলি ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই?
---আমি তো বললাম,একটু কিছু খেয়ে শুয়ে পড়। বললো, না বাপি আজ আমার জন্য চাউমিন আর চিলি চিকেন আনবে বলেছে। এখন কিছু খেলে আর খেতে পারব না।
--- দাঁড়াও,জামা কাপড় বদলে ওকে তুলছি
--- যাও, তুমি বাথরুমে চলে যাও। আমি খাবারগুলো গরম করছি।
--- একটা কথা বলবো? রাগ করবে না?
--- কী কথা?
--- তোমাকে আজ সেজেগুজে দারুণ লাগছিল। অনুষ্ঠান দেখব, না তোমায় দেখব? সত্যি বলছি।
--- রাত সাড়ে দশটায় আদিখ্যেতা হচ্ছে? তোয়ালে রেখেছি, সোজা বাথরুমে যাও, তারপর...
--- তারপর কী?
--- তারপর ডিনার,আবার কি!
বাথরুম থেকে বেড়িয়ে মানবেন্দ্র সোজা ঝিমলির ঘরে ঢুকে পড়ে।
 ---ঝিমলি,ওঠ্ মা;খাবি চল।তোর ফেভারিট ডিশ এনেছি।
অনেক সাধাসাধির পর চোখ খোলে ঝিমলি।
 --- এত রাত করলে কেন? যাও আমি খাব না। ঝিমলির গলায় অভিমানের সুর।
 --- আমার অন্যায় হয়েছে। মাফ্ করে দে। এবার চল। মানবেন্দ্র হাত ধরে ঝিমলিকে খাবার টেবিলে এনে বসায়। এতক্ষণে টেবিলে খাবার সাজিয়ে ফেলেছে সুপর্ণা। ঘুমের চোখে বসতে গিয়ে, ঝিমলির হাত লেগে জল ভরা কাঁচের গ্লাসটা পড়ে যাওয়ার আওয়াজে সুপর্ণার আচমকা ঘুম ভাঙতেই ধড়ফড় করে উঠে পড়ে সে। দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটে না সুপর্ণার। ভয়ে, আতংকে ঝিমলিকে ডাকে। মায়ের এক ডাকে ঝিমলি উঠে বসে। 
 --- কী হয়েছে মা? হাঁপাচ্ছ কেন? মায়ের পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে জানতে চায় ঝিমলি। ডিভানের পাশে রাখা জলের গ্লাসটা এগিয়ে দেয়।
জলে চুমুক দিয়ে সুপর্ণা বলে, তোর বাপি এসেছিল, পরিষ্কার দেখলাম। একেবারে সেইরকম।
--- মন খুব দুর্বল আর বিষন্ন থাকলে মানুষ এইরকম দুঃস্বপ্ন দেখে। এখন অনেক ভোর,আর একটু শুয়ে থাকো। ঝিমলি মাকে বোঝায়।
--- হ্যারে, ভোরের স্বপ্ন সত্যি হয় তাই না? এখন আর শোব না। চল,দেখি ফুলটার কী হলো! পায়ে পায়ে মা-মেয়ে ড্রইংরুমের দিকে এগিয়ে যায়।
নৈহাটির জ্যোতিষির দেওয়া চন্দ্রমল্লিকা ফুলটা,ড্রইংরুমে সেন্টার টেবিলে একটা চিনেমাটির ফুলদানিতে পরশু রাতে সুপর্ণা অনেক বিশ্বাস আর যত্নে সাজিয়ে রেখেছে। তিন রাত কেটে যাবার পর যদি সাদা চন্দ্রমল্লিকার পাপড়িগুলো সতেজ থাকে, তবে মানবেন্দ্রর বেঁচে থাকার এবং ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রবল। মানুষটা ফিরবেই, জোর দিয়ে বলেছেন নৈহাটির তন্ত্রসাধক। এই ফুলটাই যেন সুপর্ণার জিয়নকাঠি। এখন সেই তৃতীয় রাতশেষের ভোর।
 --- দ্যাখ,দ্যাখ পাপড়িগুলো একইরকম আছে!তাহলে কী...
ঠিক সেই সময় ঝিমলির চোখে পড়ল,ব্যালকনির বাইরের রাস্তায় কাল রাতে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া নিস্তেজ চন্দ্রমল্লিকাটায়। ফুলদানির পরিবর্ত নতুন চন্দ্রমল্লিকা(হুবহু একইরকম)কাল সন্ধ্যেয় সেই কিনে এনে সাজিয়ে রেখেছে। ঝিমলি এই ভেবে নিজেকে স্বান্ত্বনা দিল যে তার এই ছলনায়,মা অন্তত কয়েকটা দিন বাপির ফিরে আসার রঙীন স্বপ্ন বুনবে। কয়েকটা দিন সে মাকে একটু স্বাভাবিক দেখবে। প্রায় আট বছর পর ঝিমলির ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠল,তার বাপির ফেরা, না ফেরার আশায়।

  গল্পকার সমাজ বসু 
              মিলন পার্ক, গড়িয়া, কলকাতা                           
















0 Comments