হৃদস্পন্দন

  • Home


  • Download

  • Social

  • Feature


এসপি কি নেই আর ! 

স্বর্গের অমরাবতী নগরী ঠিক কতটা দোলাচলে দোদুল্যমান তা বলা মুশকিল!বজ্র তার তেজ কতটাইবা কমিয়ে নিয়ে নিষ্প্রাণ নিস্পন্দিত নিষ্প্রভ অন্ধকারে ডুব  দেয় শোকে,যখন স্বর্গরাজ ইন্দ্রের মহাপতন ঘটে? একথাও কি লেখা আছে পুরাণের সহস্র বছর পুরনো পাতার ছত্রে!তবে রত্ন গর্ভা ভারত মা যে পুত্রহারা শোকের বিষাদে ভেঙে চুরমার হয়ে আসছে রোজ একথা বলাই বাহুল্য। 

উত্তর থেকে দক্ষিন,পূর্ব থেকে পশ্চিম এই আসমুদ্রহিমাচল এর রক্তপ্রবাহে যে ধ্রুপদী ঐতিহ্যের স্রোত বয়ে চলে,সেই স্রোতস্বতী জোয়ারের একটা ঢেউ এর নাম এসপি বালাসুব্রাহ্মণ্যম বা এসপি বালু।১৯৪৬সালের উত্তাল ভারতের অগ্নিযুগের কোলে,জন্ম নেবে এক বিস্ময় সন্তান,যে আগামী দিনের ভারতকে বার বার প্রেমে ডুবিয়ে দিয়ে যাবে তাঁরই স্বরের সুরে,একথা ইতিহাস জানত না নিজেও।
      
গতকাল চলে গেলেন এসপি বালু।অকস্মাৎ মৃত্যু সংবাদ আর অকস্মাৎ মনে হয় না।এই বিষাক্ত বছরের ক্রমায়াত বিষাদ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বেঁচে থাকাটাই বিলাসিতা।মৃত্যুযোগ যেন ভাগ্যের বড় স্বাভাবিক প্রবণতা।কোভিডে চলে গেলেন এসপি।'মেরে রঙ্ মেঁ রঙণে ওয়ালি..'র সুরে আবিষ্ট করেছেন বহুদশকের প্রেমিক মন,সেই মানুষটা আর নেই! মেনে নিতেই হয়।তাছাড়া উপায় কী আর? 
       
১৬টি ভাষায় প্রায় ৪০০০০ গান গেয়েছেন এসপি।একদিনে,সর্বাধিক ২১টি গান রেকর্ড করার কৃতধী এই মানুষটি।'এক্  দুজে কে লিয়ে','হাম আপকে হ্যায় কোন','রোজা'এবং বিভিন্ন সিনেমায় ঠিক কী মনমোহিনী কাণ্ডকারখানা ঘটিয়ে ছিলেন,এ কারও অজানা নয়! ভাবা যায়,পদ্মশ্রী,পদ্মভূষণ সহ মা সরস্বতীর এই বরপুত্র ছ-ছবার জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।
     
'তেরে মেরে প্যায়ার কা ইয়ে ক্যায়সা হ্যায় ইয়ে বন্ধন্' একথা বোধহয় বলে বা লিখে বোঝান যাবে না! অনুভূতি প্রবণ সঙ্গীত বা যেকোনও প্রেমের সূত্রধার এই সুর।আটের দশকের কিশোর মনের ইনফ্যাচুয়েশনের কুয়াশা কাটিয়ে যে সুর এনে দিয়েছিল আলো,বলে দিয়েছিল ভালবাসি,সে যে এসপির কন্ঠ; এ বোধহয় ভোলার নয়।'ইয়ে হাঁসি ওয়াঁদিয়ার' কাশ্মীরী নৈস্বর্গের চিরপিপাসিত নয়ন বেদনা,খুঁজতে থাকবে,রিফ্লেক্ট করতে থাকবে কান্না,'আঁখো মেঁ তু হ্যায়,আঁসুয়ো মেঁ তু হ্যায়,আঁখে বন্দ্ করলু,তো মনমে ভী তু হ্যায়..'
এসপির মৃত্যু নেই!

শৌভিক চ্যাটার্জী 
কালনা, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ






















পর্দার এপার ওপার 

আমরা সকলেই জানি পর্দার ওপারে দেখায় রঙিন স্বপ্ন,আর এপারে কঠিন বাস্তব।যে বাস্তব চলে সময়ের সাথে,যেখানে মানুষের অতীত চাইলেও ফিরে আসে না আর ভবিষ্যৎ ইচ্ছে করলেও দেখতে পায় না...
সবই নির্ধারিত হয় বর্তমানে আমাদের কর্মফল দিয়ে।
কিন্তু পর্দার ওপার হলো রামধনুর মত। যেখানে সময় বাঁধা যায়,যেখানে অতীতকে ইচ্ছে মত সাজানো যায়,যেখানে ভবিষ্যৎকে বাস্তবের রূপ দেওয়া যায়,যেখানে ফেলে আসা ভালোবাসা ফিরে পাওয়া সম্ভব।
পর্দার ওপার আসলে আমাদের জীবনের প্রতিবিম্ব।রোমান্স,নাটক,সংসারের প্রতিলিপি,সুখ-দুঃখ, নস্টালজিয়া সব যেন একসুতোয় বাঁধা থাকে।যাতে আমাদের ফ্ল্যাশব্যাক হয়।
সেরা ডিরেক্টর,যা কে বলা যেতেই পারে,"বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ এর সেরা"।সত্যজিৎ রায়।"পথের পাঁচালি" র মত চলচ্চিত্রে অপু-দূর্গা আর গেরীমাটি দিয়ে রচিত তাদের সংসার যেন আর পাঁচটা সংসারের অনুভূতিকে একছাতার নিচে উপস্থাপনা করেছে।"জনঅরণ্য","মহানগর" এর মত চলচ্চিত্র প্রমাণ করে আমাদের জীবনের ছোট্টো একটা 
অধ্যায়কে।
ঋতিক ঘটক পরিচালিত-"সুবর্ণরেখা",''মেঘে ঢাকা তারা"।মৃণাল সেন পরিচালিত "২২শে শ্রাবণ","পদাতিক"।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত "মন্দমেয়ের উপাখ্যান",
"উত্তরা"।এমন অনেক উদাহরন পাই।তাছাড়াও "বেলাশেষে"," অলীক সুখ","এক যে ছিল রাজা" ইত্যাদি...
আদতে চার দেওয়ালের মাঝে কয়েক ঘন্টায় ক্যামেরার রিলে থাকা মানুষের ইমোশন,
আবেগ,অনুভূতি,নাচ,গান,যুদ্ধ,প্রেম-ভালোবাসা, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের স্বপ্নের এক কোলাজ তৈরী করে।যে রিল এক বৃহৎ জীবন আর সময় কে আটকে রেখে জীবনের বিনোদন সঞ্চালন করে।আর সেই পর্দায় ফুটে ওঠে জীবনের রূপ।
কিন্তু কথায় আছে "বন্যেরা বনে সুন্দর,আর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে"....ঠিক তেমনই রিলের এপার আর ওপারের ব্যবধান অনেক।জীবন আদতে খরস্রোতা নদী।সাদা কালো রাঙতায় মোড়া এক বৃহৎ উপহার এই পৃথিবীর।।

গদ্যকার তানিয়া ইসলাম 
ক্ষুদিরামপল্লী, বাহির সর্বমঙ্গলাপাড়া, পূর্ব বর্ধমান   




























রাক্ষসী

নদীর পায়ে শেকল দাও,আজ--
এখনই,
বাসি ফুল,পোড়া কাঠ আর--
যাবতীয় উচ্ছিষ্ট খাঁমচে ধরে পালিয় যাচ্ছে
নদী--
দু একটা বেওয়ারিশ লাশ নিয়ে যাচ্ছে কী এক উল্লাসে--
উল্লাসেই গিলে খায় পাড়ের জমি--
একরাম আলির দরজা জানলা,এমনকি
অনেক অনেক দিনের আটচালা,জেটি সব ভেঙে গুঁড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছে নদী--
আর এক মুহূর্তও নয়--
এইবার নদীর পায়ে শেকল দাও,আজ
এখনই।

  কবি সমাজ বসু 
 মিলন পার্ক, গড়িয়া, কলকাতা


 






অপভ্রংশ

মধ্যাহ্ন ভোজন সেরে,পাল মশাই সবে একটু গা এলিয়ে দিয়েছেন বিছানায়। একটু ঝিমুনি ধরেছে, ঠিক তখনই একটা ফেরিওয়ালার বাজখাঁই হাঁকে সেটা চটকে গেল।
অদ্ভুত ব্যাপার । কী হাঁকছে লোকটা? ভালো করে কান খাড়া করে ঝিমুনি কাটিয়ে শুনলেন,,,
হ্যাঁ,,ঠিকই শুনেছেন,,ওইতো হাঁকছে,,,
মনুষ্যত্ব চাই মনুষ্যত্ব,,,,,,
বলি, শুনছ ,,, একবার এদিকে আসবে,,,,,
গিন্নি তখন টিভিতে সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত। এখন সেই মোক্ষম সিন টা চলছে।
যাতে তার ছেলে,মানে ওই বউ এর বর,সেই পায়েস খেয়ে যাচ্ছেতাই করে অশান্তি করে তার বউ এর সঙ্গে।
শুধু তাই নয়। বাড়ি শুদ্ধ লোকের মাঝে,বউয়ের মুখে ঝামা ঘষা হবে ভবিষ্যতে কোনদিন যাতে ওই বউ আর রান্নাঘরে ঢুকতে না পারে,তার ব্যবস্থা পাকা করতে হবে।
এইসময় বুড়ো ডাকে কেন ? যত্তসব।
দেখি কী হলো আবার,,,,গজগজ করতে করতে গিন্নি এলেন,,,,
কি হলো কি। বেশ তো খেয়েদেয়ে ঘুমোচ্ছিলে,,,
পাল মশাই হতভম্ব হয়ে বললেন ,,,
হ্যাঁ গো,,,একটা পাগল মনে হয় বাড়িতে ঢুকে পরেছে,,,!
গিন্নির মাথায় আগুন জ্বলে গেল।
বলি,, ভীমরতি হয়েছে নাকি? কথা নেই বাত্তা নেই,,, বাড়িতে পাগল ঢুকে পরেছে ?স্বপ্ন দেখলে না কি বলতো ?
কথাটা বলে এমন ভাবে তাকিয়ে রইলেন,যেন শার্লক হোমস,অপরাধের ক্লু খুঁজছে।
পালমশাই মিনমিন করে বললেন,,,
না না,,নিজের কানে শুনলুম যে,,,পরিষ্কার,,
গিন্নি মুখঝামটা দিয়ে বললেন,,,,,
এই সেরেছে,ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে 
পরিষ্কার শুনলে ?,,
কি শুনলে শুনি,,,বাড়িতে পাগল ঢুকে পরেছে?মাথাটা গেছে মনে হচ্ছে,,,।
শেষের কথাটা বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলেন। সেটা পালমশাই এর কান পর্যন্ত পৌঁছলো না।
পাল মশাইয়ের হতভম্ব ভাব কাটছেনা।বললেন,,
না না,,, হাঁকছে ,,,বারবার হাঁকছে,,
গিন্নি ঝাঁঝিয়ে বললেন,,,,,
কে হাঁকছে ,,পাগল নাকি ভূত?
পাল মশাই জুলজুল করে এদিক ওদিক তাকিয়ে বললেন,,,,,
না না,,,,মানে মনে হলো,,,কে যেন চিৎকার করে বলছে,,,,মনুষ্যত্ব চাই,, মনুষ্যত্ব,,,
গিন্নি চটাস করে নিজের কপালে চাপড় মেরে বললেন,,,,,
হায় কপাল আমার ,,,,ওরে বাবা,,,মনুষ্যত্ব নয়,,।
ফেরিওয়ালা চেঁচাচ্ছে ।আমসত্ত্ব বিক্রি করছে।
বলেই ফোকলা হাসির ছটা। হা হা হা,,,,,
বলছে আমসত্ত্ব ,উনি শুনছেন মনুষ্যত্ব,,,,,হা হা হা। ছেলে ফিরুক ওকে বলতে হবে,ভারী মজার কান্ড।
ও বৌমা শুনে যাও তোমার শ্বশুরের কান্ড,,,,
গিন্নি হাসতে হাসতে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
পাল মশাই বালিশ হেলান দিয়ে বসে বসে ভাবতে লাগলেন,,,, তাইতো,, সত্যিই তো,,,,মনুষ্যত্ব কি ফেরি করবার জিনিস! 
এ তো পণ্য নয়।এ যে ঈশ্বরের সর্বোচ্চ দান।মনুষ্যত্ব,,, মনুষ্যত্ব,,,।
সন্তর্পণে। লুকিয়ে। ধরা না পড়ে যায় শেষে।
ধরা পড়লেই সর্বনাশ।মুখোশ খুলে যাবে।মনুষ্যত্বের মুখোশ।
আরে,পাগল মনেহয়। তবুও মনে সংশয়। গিন্নি কে ডাকলেন,,, 
বউকে জব্দ করতে, তার রান্না করা পায়েসে নুন মিশিয়ে দিচ্ছে শ্বাশুড়ি 
মোক্ষম সিন। টানটান উত্তেজনা। টপ ক্ল্যাইম্যাক্স।

টিভি সিরিয়ালে এখন শাশুড়ি,বৌমার যত্নে রাঁধা পায়েসের বাটিতে নুন মেশাচ্ছে।

সাহিত্যিক সুজিত চট্টোপাধ্যায়
৯৩বি, সীতারাম ঘোষ স্ট্রিট, কলকাতা 


















সম্পাদকীয়: 

সব শহরইতো কিছু কথা বলে। আসলে সবারই থাকে কিছু ইতিহাস। বহু পুরনো,ইতিহাসের ভারে জরাজীর্ণ শহর বেনারসের কথা মনে পড়লেই যেমন ভেসে ওঠে - পুন্যাত্মা গঙ্গা,দশাশ্বমেধ ঘাট,গঙ্গারতি,মন্দির,সাধু - মহাত্মা,গলির ভেতর তস্য গলি,বেনারসি জর্দার গন্ধ , সত্যজিত রায়ের জয়বাবা ফেলুনাথ সিনেমার কথা,  ...আরো কতো কি ! আবার মুর্শিদাবাদ শহরের হাজার দুয়ারী দেখি যখন, তখন মনে পড়ে - সেই অষ্টাদশ শতাব্দীর সমৃদ্ধির নগরকে। সমগ্র বাংলা,বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ। এটি ছিল বাংলার বংশগত নবাবের রাজ্য। সেইসঙ্গে ভারাক্রান্ত হয় মন পলাশির যুদ্ধের কথা ভেবে - যেখানে লেখা আছে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। দিল্লী শহরের ঐতিহাসিক সৌধগুলো দেখে মনে পড়ে যায় মুঘল সাম্রাজ্যের কথা। আর আগ্রাতো প্রেমের শহর। তাজমহল দেখে কে নস্টালজিক হয়ে পড়েনা ? স্রষ্টা শাজাহানকে নিয়ে লেখা রবীন্দ্রনাথের সেই অসামান্য কবিতাটা মনে পড়ছে -
"চলে গেছ তুমি আজ মহারাজ, 
রাজ্য তব স্বপ্নসম গেছে ছুটে, 
সিংহাসন গেছে টুটে, 
তব সৈন্যদল
যাদের চরণভরে ধরণী করিত টলমল
তাহাদের স্মৃতি আজ বায়ুভরে
উড়ে যায় দিল্লির পথের ধূলি পড়ে।
      ••••••••••••••••••••••••••••••••
তুচ্ছ করি রাজ্য - ভাঙা গড়া ,
তুচ্ছ করি জীবনমৃত্যুর ওঠাপড়া ,
যুগে যুগান্তরে কহিতেছে একস্বরে
চিরবিরহীর বাণী নিয়া
ভুলি নাই, ভুলি নাই,ভুলি নাই প্রিয়া।"

কর্মসূত্রে যারা কলকাতার বাইরে,তারা যত দূরেই থাকুক - কোনোদিন ভুলতে পারবে কলেজস্ট্রিটকে ? বইয়ের গন্ধ আর কফিহাউসের আড্ডাকে ?একসময় ময়দানে মোহনবাগান - ইস্টবেঙ্গল দেখে ফেরার পথে অনাদির মোগলাইয়ের স্বাদ মনে পড়বেই,কিংবা বড়দিনের মায়াবি আলোয় পার্কস্ট্রিটকে।

আর এইসব ফেলে আসা শহরে যদি থেকে থাকে কোনো মন দেওয়া - নেওয়ার স্মৃতি,হোকনা তা ব্যর্থ প্রেম। টাটকা স্মৃতি নিয়ে ঠিক ফিরে আসে সেই শহরে এলে। যা আমাদের উদ্বেলিত করে,আচ্ছন্ন করে,  ভারাক্রান্ত করে। থমকে দাঁড়াই,ডুব দিই অতীতে। কলকাতায় এমন কতো প্রেমের জায়গা ছড়িয়ে আছে। তিলোত্তমার বুকে নির্জন প্রেমের সেরা ঠিকানা সেন্ট্রাল পার্ক। আবার ভিক্টোরিয়ার প্রেম জমে বাদাম ভাজার সঙ্গে। কতো হারিয়ে যাওয়া প্রেমের সাক্ষী আছে প্রিন্সেপ ঘাটও।

সাহিত্যেও দেখি বহুবছর পর গ্রামে ফিরে কুমুদিনীকে  না পাওয়ার দুঃখে মন ভরে ওঠে হীরেনের। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপধ্যায়ের "অরন্ধনের নিমন্ত্রণ" গল্পটার কথা বলছি। হয়তো অনেকেই পড়েছেন।শহরের কাজের চাপে ব্যস্ত হীরেন গ্রামে এসেছে কুমুদিনীর অরন্ধনের নিমন্ত্রণে। পিসিমার বাড়িতে অনেক বছর পর দেখা হয় দুজনের ! দুজনেই অন্যত্র বিবাহিত। গ্রাম্য কুলীন প্রথার বিধি নিষেধে বিয়েটা হয়নি ওদের। তবু ওরা আবিষ্কার করে এতো বছরে হারায়নি ওদের প্রেম। বিভূতিভূষণের মর্মস্পর্শী লেখায় তা ফুটে উঠেছে অনবদ্যভাবে। আসলে কিছু হারায়না বোধহয়, থেকে যায় মনের গভীরে। কখনো অনুকূল পরিবেশে রুদ্ধ সেই স্মৃতি ফিরে আসে হু হু করে। এইরকম অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত -
"স্মৃতি পিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে
আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা ;
যে ভুলে ভুলুক কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিবনা,আমি কভু ভুলিবনা"
আবার জীবনানন্দ দাশ তাঁর "হায় চিল " কবিতাতে হারিয়ে যাওয়া প্রেমের কষ্ট ভুলতে চেয়েছেন -
"হায় চিল,সোনালি ডানার চিল,
এই ভিজে মেঘের দুপুরে
তুমি আর উড়ে উড়ে কেঁদো নাকো ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে
তোমার কান্নার সুরে বেতের ফলের মতো তার ম্লান চোখ মনে আসে।
পৃথিবীর রাঙা রাজকন্যাদের মতো সে যে চলে গেছে রূপ নিয়ে দূরে;
আবার তাহারে কেন ডেকে আন ?কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালবাসে।"

বিষয়টা লিখতে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম। এবার থামব। আশা করি আপনারাও ভালোবেসে নস্টালজিক হয়ে পড়বেন এই সংখ্যাটা পড়ে। সবাই ভালো থাকুন। সাহিত্যে থাকুন। অনেক শুভেচ্ছা , ধন্যবাদ সবার জন্য।


*এবারের সম্পাদকীয় লিখে সহায়তা করেছেন সাহিত্যিক বন্ধু সুমিতা চক্রবর্তী। 


সূচিপত্র:


কবিতা: ॥ নাসির ওয়াদেন ॥ দেবার্ঘ সেন ॥ সজল কুমার টিকাদার ॥ নিমাই জানা ॥ নাসিম বুলবুল ॥ তুলসীদাস ভট্টাচার্য ॥ মীরা মুখোপাধ্যায় ॥ তুহিন কুমার চন্দ ॥ সাইফুল ইসলাম ॥ চিরঞ্জিৎ  বৈরাগী ॥ শৌভিক চ্যাটার্জী ॥ শুভ্রাশ্রী মাইতি ॥সাত্যকি ॥ লিজা লিনকন ॥ মহুয়া গাঙ্গুলী ॥ অমিত কুমার সাহা ॥ সোমা ঘোষ ॥ ঐন্দ্রিলা মজুমদার ॥ নিশিকান্ত রায় ॥ মিলি মন্ডল রায় ॥ তুষার ভট্টাচার্য ॥ সুজিত কুমার মালিক ॥ পার্থ প্রতিম পাল ॥ 

গল্প: ॥ সমাজ বসু॥ শৈবাল মুখোপাধ্যায় ॥ পাভেল ঘোষ ॥ ঋভু চট্টোপাধ্যায় ॥ দীপক বেরা ॥ সৌমী গুপ্ত ॥ উত্তম সিংহ ॥ সোমা সাহা ॥ অমিত কুমার জানা ॥ শুভ্রশোভন রায় অর্ক ॥ শুক্লা মুখার্জি ॥ বিকাশ বর ॥ সুষ্মিতা রায়চৌধুরী ॥ সুদীপ পাঠক ॥ অঞ্জনা গোড়িয়া ॥ অভিষেক ঘোষ ॥ 

মুক্তগদ্য: ॥ সোমনাথ বেনিয়া ॥ প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ  ॥ অরিজিৎ পাঠক ॥ দেবদাস কুণ্ডু ॥ 
অনিন্দ্য দত্ত ॥ রুচিরা দাস ॥ নন্দিতা মিশ্র চক্রবর্তী ॥ 

স্মৃতি আলেখ্য: ॥ চমক মজুমদার ॥ চন্দন বিশ্বাস ॥ আশিস মুখার্জ্জী ॥ বিকাশরঞ্জন হালদার ॥ 

খোলা চিঠি: ॥ অন্তরা দাঁ ॥ সৌমী আচার্য্য ॥ সুকুমার হালদার ॥  

নিবন্ধ: ॥ বারিদ বরন গুপ্ত ॥ 

আত্মকথন: ॥ সুমিতা চক্রবর্তী ॥ 











ভালো থেকো রূপকথারা 

অনেককিছুই শহর জানে। অনেককিছুই। সেই যে আপনি শহর ছাড়লেন নতুন চাকরি জয়েন করার পর, শহর জানে সেসব কথা। শহর জানে আপনার সাইকেলের সামনের রডে বসে যে মানুষটা শহর চিনলেন তিনি আসলে আপনার গলিপথে ফেলে আসা অতীত। শহর জানে বাসস্টপের থিকথিকে ভিড় পেরিয়ে নিভৃতে আপনি কেমন জোনাকি হয়ে উঠতেন, আলো হয়ে জ্বলতে জ্বলতে পেরিয়ে যেতেন অন্ধকার গলিঘুঁজি। অবলীলায়। বৃষ্টি হবার খানিক পরে মনের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি জন্ম নিত আপনার। আপনার প্রেম আছে সুতরাং আপনার রাজ্যের রাজা আপনিই। বাসস্টপের কোণায় সরু রেলিং দিয়ে ঘেরা জায়গাটাতে, পাশের পাবলিক টয়লেটের সুগন্ধ সহ্য করে আপনি কীসের (পড়ুন কার) অপেক্ষায় রবিবাসরীয় গল্পের পাতা শেষ করে দিতেন সেই খবর কেউ জানুক না জানুক আপনার ফেলে আসা শহর ঠিক জানে। টাইমমেশিনে পনেরো  বছর আগে ফিরতে পারলে আপনি ঠিকই দেখতে পাবেন সেই ফেলে আসা শহরের রাজপথ ধরে আপনারা হেঁটে চলেছেন বীর বিক্রমে,পার্কের কোণায় গার্ডের মৃদু ধমক খাচ্ছেন,সাইকেলের পাংচার সারাতে দিয়ে আপনারা নার্সারিতে গাছ দেখতে যাচ্ছেন, কমদামি আইসক্রিম চুষতে চুষতে আপনারা ঢুকে যাচ্ছেন নির্ভেজাল রূপকথার জগতে।সেই জগতে লজিক নেই,আবেগ আছে। ক্যালকুলেশন নেই, অনুভূতি আছে।সাইকেল সেখানে রথ,সওয়ারি সেখানে স্বপ্নের রাজকুমারি !কেউ মনে না রাখলেও আপনার শহর  কিন্তু সেইসব ক্যালকুলেশনবিহীন অনুভূতিগুলোকে হার্ড ডিস্কে লোড করে রেখে দিয়েছে। একবার বর্তমানকে নিয়েই যান না দেখবেন যখন পছন্দের বাসের পছন্দের সিটে গিয়ে বসছেন বা বাসস্টপে ঢোকার মুখে বাসজুড়ে অন্ধকার নেমে আসছে তখনই স্মৃতি হিসেবে আপনার হার্ড ডিস্কে সুচারুরুপে ট্রান্সফার করে দেবে  সবকিছু। পুরনো অথচ সতেজ। আপনি বুঝতে পারবেন, না থেকেও সব আছে, অন্ধকার হয়ে। একটু কষ্ট করে অন্ধকার ভেদ করতে পারলেই দেখবেন এক মায়াবী রূপকথার দেওয়ালজুড়ে হাজার হাজার জোনাকির আনাগোনা। নিভছে, জ্বলছে। জ্বলছে, নিভছে।

গদ্যকার প্রাণকৃষ্ণ ঘোষ 
আলিশা, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ 






















অবশেষে গল্পটা..

"মনা, ওঠ রে….. সুবলকাকা এসেছে.."
মায়ের আদরমাখা কণ্ঠে চোখ মেলে মনোজ।
ঘুমের আবেশে একটা লম্বা হাই তুলে বলে ওঠে,  "সুবলকাকা...? বসতে বলো...।"
বাবা চলে যাওয়ার পর সুবলকাকাই ওর লোকাল গার্জেন। ক্লাস থ্রিতে পড়তে মনোজের বাবা হঠাৎ ব্লাড ক্যানসারে মারা যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত  যে কোনো প্রয়োজনে এক ডাকে ওদের বাড়িতে চলে আসে সুবলকাকা।
আদ্রা শহরের পাশে জিয়ারা গ্রাম। এখন জিয়ারাতেই মাকে নিয়ে একটা ছোট্ট একতলা বাড়িতে থাকে মনোজ। সঙ্গে বছর দেড়েকের ছোট্ট কুকুর 'লালু'।
বাবা চলে যাওয়ার পর আদ্রা শহরে মামার বাড়িতেই থাকতো মনোজ।সারাটা দিন শহরের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত সাইকেল নিয়ে পাক খেত সে। 
বাবা'ই ওকে হাত ধরে হঠাৎ একদিন আদ্রা থানা পেরিয়ে শিব মন্দিরের কাছে লালডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলো।ছোট থেকেই দুষ্টুমিতে কারোর থেকেই কম যেত না মনোজ।ওর ঠাকুমা বলতেন,'নাতির আমার হাতে,পায়ে সমানে বয়।' শুনে সবাই হাসতো।
প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরোনোর পর আশ্রম স্কুল থেকে কষ্ট করে মাধ্যমিকটা যাহোক করে পাস করেছিলো মনোজ। 
তারপর সবার অমতে একপ্ৰকার জোর করেই ভর্তি হয়েছিলো ইলেভেনে। 
"কি রে মনা..? তোর সুবলকাকা কখন থেকে বসে আছে....!"
মায়ের ডাকে নিজের জগতে ফেরে মনোজ। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে ওর এই আদ্রা শহরে। জন্ম থেকে বাইশটা বছর।ভাবা যায়..!
"যাই মা... " চোখে ঘুম নিয়ে জোর করেই উঠে পড়ে মনোজ।কাল অনেকরাত পর্যন্ত ঘুম হয় নি ওর।জোনাকীদের সঙ্গে কাল সারা রাতই প্রায় জেগে কেটেছে ওর।মহালয়া আসলেই নয়নের কথা মনে পড়ে খুব।  ওর চুলে জড়িয়ে থাকা লাল ফিতেটা নাকের কাছে নিয়ে মাঝে মধ্যেই গন্ধ নেয় ও। নয়নের চুলের তেলচিটে গন্ধটা এখনো যেন লেগে আছে ফিতেটায়।
"শোন মনা, এবার কিন্তু 'না' করবি না তুই।করোনার চোটে এবার কলকাতা যাওয়া বন্ধ।পূজোয় এবার আদ্রায় কাজ।" সুবলকাকার কণ্ঠে সংবিত ফেরে মনোজের। বুঝতে পারছে,আজ বারবার আনমনা হয়ে পড়ছে ও।
"আদ্রা আমায় যেতে বলো না কাকা। গোটা শহর জুড়ে অনেক স্মৃতি..!আর পিছন ফিরে তাকাতে চাই না আমি...!খুব কষ্ট হয় গো।"
"শোন,এই পূজো তোদের পাড়া থেকে অনেক দূরে..। আদ্রা কি আর একটুখানি শহর রে খ্যাপা...!" সুবলকাকা হাতটা ধরে ফেলে মনোজের।
"আমি যাব না কাকা..."
মাথা নীচু করে 'না' তে অনড় থাকে মনোজ। চোখের কোনে বেদনার বিন্দুজল জমা হয়।
"যা না মানিক...তোর কাকা এত করে বলছে..." মনোজের মা ছেলের পিঠে স্নেহভরা হাত বুলিয়ে বলে ওঠে।
"যেতে পারি...কিন্তু একটা শর্তে...!"
হঠাৎ কান্নাভেজা চোখদুটো মেলে বলে মনোজ।
"আচ্ছা,ঠিক আছে...তোর সব শর্ত না শুনেই মঞ্জুর করলাম। তুই যাবি বলেছিস,এতেই আমি খুশী..।"
"কিন্তু দাদা,শর্তটা শুনবে না...?" মনোজের মা জিজ্ঞাসা করে সুবলকাকাকে।
মায়ের কথায় চোখের জল মোছে মনোজ।
বিদ্যুতের মতো এক ঝিলিক হাসি খেলে যায় ওর মুখে।
"দুদিন আগে চলে যাবো আদ্রা..।মানে চতুর্থীর দিন...."
"ঠিক আছে যাবি.. কিন্তু ওখানে থাকবি কোথায়?"
"মলয়ের বাড়ি..। আমি জানি ও না করবে না। বরং আনন্দ পাবে কাকা।"
মনোজের কথা শুনে সুবল স্বস্তি পায় ঠিকই,কিন্তু একটা অজানা চিন্তায় মন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে ওর।
হাতদুটো মুঠি করে খুশিতে উঠে পড়ে মনোজ।
"দাঁড়া..। এবার তুই মনে হয় রিকশাওয়ালা সাজবি।চাপ নেই।সারাক্ষন বসে থাকা।তবে দৃষ্টি স্থির,আর ক্লান্তিটা যেন  চোখে মুখে ফুটে ওঠে....। মনে থাকবে?"
"মনে থাকবে কাকা..।" হাসিমুখে চোখ বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে যায় মনোজ।

দেখতে দেখতে চতুর্থীর সকালটা চলে আসে। শিউলি ফুলের তীব্র গন্ধে ঘুমটা ভেঙে যায় মনোজের। মনোজের আদ্রা যাওয়ার দিন আজ।জানালা দিয়ে দূরে চোখ চলে যায় ওর। আকাশ জুড়ে 'মেঘের নৌকাগুলো' পাড়ি দিচ্ছে যেন অজানা কোন পথে। কাশ ফুলের দল হাওয়ার ছন্দে এক অজানা আনন্দে মেতে উঠেছে এই সময়।
চাপা আনন্দে কাল সারা রাত ঘুম হয় নি মনোজের।ভিতরে একটা আনন্দধারা বইছে।আবার আদ্রা...! একসময় স্বপ্নের মতো মনে হওয়া সেই রেলওয়ে কলোনি, পলাশ বন,খোসলা বাঁধ- সব যেন হাতের তালুর মতো মুখস্থ ছিল ওর। মা একটা ছোট্ট চায়ের দোকান চালিয়ে কোনোরকমে মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দিতো।
কিন্তু রঙিন পৃথিবীর রং এত তাড়াতাড়ি ফিকে হয়ে যাবে,বুঝতে পারে নি মনোজ। ক্লাস  টুয়েলভ পড়ার সময় মায়ের হঠাৎ শরীর খারাপ হলো একদিন। মনোজ সেদিনই বুঝেছিল এবার তাকে কোমর বেঁধে সংসারের হাল ধরতে হবে। কোনোরকমে উচ্চমাধ্যমিকটা পাস করে ঢুকে পড়েছিলো সুভাষদার গ্যারেজে।
বেশ নির্বিঘ্নেই চলছিলো মা-বেটার জীবন।হঠাৎ ধূমকেতুর মতো হাজির হলো নয়ন। খুব মনে আছে,আলাপ হয়েছিলো ওদের অকাল শ্রাবনের এক বৃষ্টিস্নাত দিনে।
আধ ভেজা নয়ন আশ্রয় নিয়েছিলো ওদের গ্যারেজে। নয়নের মিষ্টি ঠোঁটের ছোট্ট কথাটা আজও মনে পড়ে মনোজের।
"হতচ্ছাড়া বৃষ্টিটা কিছুতেই ছাড়ছে না..." নয়ন বলতেই নিজের ছাতাটা ওকে এগিয়ে দিয়েছিলো মনোজ। সেই শুরু..! তারপর ভালোলাগা ভালোবাসায় পরিণতি পেতে বেশী সময় লাগেনি ওদের। সপ্তাহে একটা দিন রবিবার ছুটি পেতো মনোজ। সুভাষদার স্কুটিটা নিয়ে বেরিয়ে পড়তো ওরা। কোনোদিন শহরের বিভিন্ন প্রান্তে শিমুল-পলাশের তলায়,কোনোদিন আবার শহরের বাইরে মেঠো পথ ধরে অনাবিল আনন্দে সারাটা দিন কাটিয়ে দিতো ওরা।ওদের জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো রূপকথা হয়ে ধরা পড়তো রবিবারে। মনোজের মা'ও মেনে নিয়েছিলো নয়নকে।
কিন্তু দুর্ভাগাদের ললাটে সুখের লিখন মনে হয় বেশিদিন স্থায়ী হয় না।মনোজেরও হলো তাই। মলয়দের বাড়িতে সত্যনারায়ন পূজোর প্রসাদ খেয়ে ভাঙা স্কুটিটা  দ্রুত গতিতে চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলো ও টিভিতে  'চাঁদের পাহাড়' সিনেমাটা দেখবে বলে।
এক চিলতে ঘরে ঢুকেই মায়ের গম্ভীর অবসন্ন মুখটা দেখে ও চমকে উঠেছিলো অজানা আশঙ্কায়। 
গাড়িটা যাহোক করে দাঁড় করিয়ে মা'কে  মন খারাপের কারণটা জিজ্ঞাসা করতেই অঝোরে কেঁদে ফেলেছিলো মনোজের মা।
"নয়নকে ধোবি তালাওতে অত্যাচার করে ফেলে দিয়ে গেছে শয়তানেরা...!" 
মায়ের কথা শুনে সেদিন বোবা হয়ে গেছিলো মনোজ। 
পরের দিন সকালে এক ছুটে হাসপাতাল।নয়নের ঘোলাটে চোখ দুটোর দিকে তাকাতে পারে নি বেশীক্ষন ও। নিষ্ঠুর অত্যাচারের ছাপ  সারা শরীর জুড়ে। ঠোঁটে জমাট বাঁধা রক্ততে বসা মাছিটাকেও তাড়ানোর ক্ষমতা ছিলো না নয়নের।
ঘটনার পর মাস তিনেক ঘুমাতে পারে নি মনোজ। বিছানায় ছটফট করে কাটিয়ে দিয়েছে একটার পর একটা বিনিদ্র রাত।
ছেলের ধারাবাহিক যন্ত্রনায় চুপ করে থাকা মুখটা দেখে সিদ্ধান্তটা নিতে বাধ্য হয়েছিল মনোজের মা।সুবলকাকার উদ্যোগেই মা মনোজকে নিয়ে চলে এসেছিল এই জিয়ারা গ্রামে।গ্রামেই শিল্পী সংঘে একটা কাজও পেয়ে গেছিলো ও।প্রথম প্রথম বড় অসুবিধা হতো মনোজের।তিন চার ঘণ্টা স্ট্যাচু হয়ে থাকা।এখন অবশ্য খুব নাম করেছে এই কাজে। স্মৃতিগুলো আজ বড্ড ভিড় করছে মনোজের মনের আকাশে।
"খেয়ে যাস..আমি রান্না চাপিয়েছি.."  মায়ের কথায় স্নান করতে যায় মনোজ।

দেখতে দেখতে চতুর্থী ,পঞ্চমী পেরিয়ে আজ ষষ্ঠীর সকালটাও চলে এলো। এই দুদিন সারা শহর ঘুরে বেরিয়েছে মনোজ।ওর হারানো দিনের গল্পগুলো কষ্টের আড়ালে স্মৃতির ছোঁয়ায় ফিরে এসেছে দুদিন ধরে অবিরত। যাপনচিত্র তো স্মৃতির পাতায় এভাবেই নিভৃতে বাঁচে। 
মণ্ডপে যাওয়ার আগে আয়নায় নিজের মুখটা দেখে অবাক হয় মনোজ।যন্ত্রণাগুলোকে কৃত্রিমতার ছোঁয়ায় কিভাবে নিখুঁত এঁকেছে মুখ জুড়ে সুবলকাকা...!আনন্দকে নিয়ে এভাবেই তো আছে মনোজ নয়ন চলে যাবার পর থেকে।
"মনা চলে আয়, সময় হয়ে গেছে...."
সুবলকাকার কথায় নিজের জগতে ফেরে মনোজ।
"চলো কাকা,আমি রেডি.."
নদীর স্থির জলের মতো স্থবির হয়ে বসে পড়ে মনোজ মূর্তি হয়ে। 
"চোখের পলক পড়ছে না দেখ..."
একটি বাচ্ছার কথা কানে যায় মনোজের। আমল দেয় না ও। অস্থির,এলোমেলো পরিবেশে নিজেকে কিভাবে নির্বাক মোমের মূর্তির মতো থাকতে হয়,সুবলকাকার কাছেই নিরবচ্ছিন্ন অনুশীলনে শিখেছে মনোজ।
গোধূলির মুহুর্ত থেকে 'মনোজের চুপকথা' ঘন্টার চৌকাঠ পেরিয়ে যায় ধীরে ধীরে।সন্ধ্যার  ভিড় ক্রমশঃ পাতলা হতে থাকে।
হঠাৎ দূরে দৃষ্টি চলে যায় ওর। বড় চেনা মুখ..! পরনে শতচ্ছিন্ন শাড়ি।ধুলো বালির নকশা সারা শরীর জুড়ে। ছেঁড়া আঁচলটাকে  মাঝে মাঝে টেনে মজা নিচ্ছে কচি-কাঁচার দল।আলো থেকে অনেক দূরে চলে যাওয়া,আঁধারে ডুবে থাকা নির্বাক একটা মুখ। 
"নয়ন না...?" যন্ত্রণাগুলো পোকার মতো কিলবিল করতে থাকে মনোজের।বুকের বামদিকে একটা অসহ্য যন্ত্রনা অনুভব করে ও।
কিন্তু নয়ন তো বেঁচে নেই..! সুবলকাকার মুখে নয়নের মৃত্যুর খবরটা এখনো  কানে বাজে ওর.."তোর নয়ন চিরদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়েছে রে মনা.."
খবরটা যে "ডাহা মিথ্যা" সেটা এখন বিলক্ষণ বুঝছে মনোজ। 
আরো কাছে এসে পড়েছে নয়ন।
"মনোজ,আমাকে বাঁচাও..! ওরা মেরে ফেলবে আমাকে..!বাঁচাও আমাকে ...!" একটা অস্ফুট আওয়াজ শুনতে  পায় মনোজ। 
ধীরে ধীরে দৃষ্টির বাইরে ঝাপসা হতে থাকে  নয়নের মুখ। বুঝতে পেরেও মনোজ যন্ত্রণাটাকে ধূপকাঠির মতো পোড়াতে থাকে বুকের মধ্যে।
ইতিমধ্যে ম্রিয়মাণ মণ্ডপে মানুষের আনাগোনা কমতে শুরু করে।আলোপোকারা মনোজের স্থির চোখদুটোতে আছড়ে পড়তে থাকে ঢেউয়ের মতো...!
"খেতে চল মনা..."  মনোজের পিঠে সুবলকাকা হাতের টোকা মারতেই ওর নিষ্প্রাণ দেহটা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে...!

সাহিত্যিক পাভেল ঘোষ 
শক্তিগড়, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ



















বিবর্ণ অথচ প্রিয় চাঁদ মুখ

একটি প্রেম কালবৈশাখীর ধুলো শহরে বাজনা বাজায় 

দেওয়াল ঘড়ির ধুলো জমছে বয়স্ক চোখে
অপারেশন টেবিলে শুধু লেন্সের বিবর্ধন 
এখন শুধু ঋণাত্মক সারিতে বেড়ে যাচ্ছে দৃষ্টিভ্রম
অবারিত দ্বার চৌকাঠ পেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছি অব্যবহৃত মুদ্রার মতো
ভেসে যাচ্ছি বন্যার জলে, জড়িয়ে উঠছি গুল্ম রেখায়
উর্বর পলিমাটি পায়ের নিচে
আলগা হচ্ছে ক্রমশ চোখের কনীনিকা
এসব শৈশবের কথা নয়, এ কৈশোরের কথা নয় এ এক জন্মান্তর অথবা মৃত্যুর কথা
আসলে নৌকায় সমুদ্র মোহনায় ধাবিত হই 
ফুলের কুঁড়ির মত
বিবর্ণ ঝিঙে ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেউ মোমের মত ক্ষয়ে যাওয়া এক মুখ
ফুল অথবা ডাইরির পাতায় মন্দির হচ্ছে ক্রমশ উইপোকার নিঝুম শহরে বড় একা লাগে
মাথার উপর চাঁদ এসে ফুলের কাঁটা পরায়
আমি শুধু হেঁটে যাই গভীর অরণ্য তটরেখায়

গভীর রাত হলে আমি পর্ণমোচী হয়ে যাই 
তারাদের সাথে 

কবি নিমাই জানা
রুইনান, সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর



















ওয়াকিং স্টিক

বাইশ বছর পর এই  শহরে এসে মনে হচ্ছে, দোয়েলের সেই ঘাড় কাত করা বিকেল নেই।  জোনাকির আধো আলো আধো ছায়ার নীল নির্জনে ভালবাসার কথা নেই। সাদা কাগজে  ভাঁজ করা মনের  অস্থিরতা নেই। সব হারিয়ে গেছে। কোন্ মাতাল হাওয়ায় ঝরাপাতার মত উড়ে গেছে। এত বদল হয়েছে এই শহরে? পথঘাট, জীবনযাপনের ছবি থেকে ভালবাসার সাজ। 
শীতপাখির মত সাঁতরাগাছির ঝিলে ফিরে আসার কোন ইচ্ছেই ছিল না। শুধু ঝিমলির ঋণের টানে,বাইশ বছর পর ফেরা। ঝিমলির জীবনে এতটুকু ছায়া না ফেলেই  রায়গঞ্জে পা বাড়াব। যদিও অবিনাশ আর তার ছেলে রূপক কিছুতেই ফিরে যেতে দেবে না। কিন্তু ফিরতেই হবে।
হ্যাঁ, অবিনাশ এই ঠিকানাটাই বলেছিল। ৩২/১,ফার্ন রোড।

যাচ্ছি যাচ্ছি...হুড়মুড়িয়ে দোতলা থেকে নেমে আসে ঝিনুক।বাড়িতে একা। আই হোলে চোখ রাখে। লম্বা চওড়া এক মধ্যবয়স্ক মানুষ দাঁড়িয়ে। আগে কোনদিন মানুষটাকে দেখেছে বলে মনে করতে পারছে না।
--- কাকে চাই? আগন্তুকের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ঝিনুক।
--- ঝিমলির সঙ্গে দেখা করতে চাই। দরজার ওপাশ থেকে উত্তর ভেসে আসে।
--- না, ঝিমলি নামে এ বাড়িতে কেউ থাকে না।
--- একটা জিনিষ দেবার ছিল।
--- আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। হয়তো ভুল ঠিকানায় এসেছেন। ঝিনুকের বিনীত জবাব।
--- ঠিক আছে। মনে হয় আমারই ভুল হয়েছে। 
আগন্তুক ফিরে যেতেই, দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ডান হাতে ওয়াকিং স্টিকের সাহায্যে মানুষটাকে ফুটপাত ধরে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সে। 
খুব খারাপ সময়। চারপাশে খারাপ মানুষের অভাব নেই। চেনাজানা না হলে দরজা খুলবি না। আগে আইহোলে দেখে নিবি। মায়ের এই একঘেয়েমি কথায় ঝিনুক মাঝে মাঝে রেগে যায় বটে, কিন্তু আজ সে মায়ের সতর্ক বাণী পালন করে ঠিকই করেছে।
স্কুল থেকে ফিরে মেয়ের মুখে ঝিমলি নামটা শুনে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে যায় মালবিকা। এই নামটা তো সে কোনদিন কারো কাছে প্রকাশ করেনি। দীর্ঘ বাইশ বছর বুকের ভেতর এই নাম লুকিয়ে রেখেছে। তাহলে কি সময়ের ঝরাপাতা সরিয়ে সেই ভন্ড প্রতারক তমাল ফিরে এলো এই শহরে? এই ঠিকানা সে পেল কোথায়?
--- মা, ঝিমলি নামে তুমি কাউকে চেনো? মেয়ের প্রশ্নে তার চমক ভাঙে।
--- নারে, আমার তিন কুলে ওই নামে কেউ আছে বলে মনেই করতে পারছি না। একটু হেসে অস্বস্তি আড়ালের চেষ্টা করে।
---  যা একটু চা কর দেখি! মেয়েকে খুব কমই আদেশ করে মালবিকা এখন ঝিমলিকে এড়াতেই এই ফরমান।
--- আমার বন্ধুবান্ধবের ভেতরেও তো ঝিমলি বলে কেউ নেই।
--- আহ্ থাক না,ওই নাম ঘেঁটে লাভ কী? চায়ে চিনি দিয়ে ফেলিস না যেন?
--- ঝিমলিকে কী একটা জিনিষ দিতে এসেছিলেন। চায়ের কাপটা সেন্টার টেবিলে রেখে ঝিনুক বললো।
--- এসব ভন্ডামি বুঝলি! দুষ্টের ছলের অভাব হয় না। এখন বুঝলি তো,কেন দরজা খুলতে বারণ করি। 
কী সব ভাবছে মালবিকা? হয়ত সত্যিই অন্য কোন এক মানুষ তার আদরের ঝিমলিকে উপহার দিতে  ভুল ঠিকানায় চলে এসেছে। তমাল তো  কবেই হারিয়ে গেছে। তবু আজ কেন শুধু সেই-ই এসে দাঁড়াচ্ছে?বাইশ বছর আগে কোন এক ফিরে যাওয়া নিস্তেজ সূর্যের ঝিম ধরা বিকেলে রায়গঞ্জ থেকে বাবার অসুস্থতার খবর আসতেই সেদিন ছুটে গিয়েছিল তমাল। তারপর চার মাস কোন খবর নেই। মায়ের চোখকে কোনমতেই এড়ানো যায় না। মা বাবার আদরের মলিও পারেনি। এমনিতেই অসবর্ণে আপত্তি ছিল। এই চরম প্রতারণার সুযোগটুকু কাজে লাগিয়ে একমাত্র মেয়ের  সম্বন্ধ করে ফেলেছিলেন, মানবেন্দ্র সেন। মালবিকার বাবা। নামী কোম্পানির সিইও অরিন্দম রায়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন তাঁর একমাত্র আদরের মেয়েকে। আজ আবার নতুন করে সবকিছু মনে  পড়ছে। এত বছর পর বুকের গভীরে লুকিয়ে রাখা নামটা যে এইভাবে তারই আত্মজার মুখে শুনতে হবে,স্বপ্নেও ভাবেনি সে।

--- কিরে, এত দেরি হল? মালবিকার গলায় উৎকণ্ঠার সুর।
---- আর বোলো না মা,আজ রূপক হঠাৎ জোর করেই ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল। ওর বাবার এক বন্ধুর সাথে আলাপ করাতে। ওনাকে দেখে আমি তো অবাক! উনিই ত পরশু সকালে ঝিমলির খোঁজে এখানে এসেছিলেন। উনি বাইশ বছর পর কলকাতায় এলেন। রূপক বলছিল,বাইশ বছর আগে নাকি রায়গঞ্জে ওনার অসুস্থ বাবাকে দেখতে গিয়ে বিরাট দুর্ঘটনায় পড়েন। তাতেই ওনার ডান পা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তিন মাস হাসপাতালে ছিলেন। মেয়ের কথাগুলো  ভেতর থেকে মালবিকাকে ভাঙতে শুরু করল। দমকা বাতাসে মনের জানালাগুলো খুলে যাবার আগেই বন্ধ করে দিতে হবে।
---- মানুষটা ভীষণ প্রাণবন্ত, জানো তো মা! কত গল্প করলেন। আমাকে ত ছাড়তেই চাইছিলেন না। ওনাকে দেখে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
---- কেন মন খারাপের কী হল?
--- এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পথে বাইকের ধাক্কায় পড়ে গিয়ে ওয়াকিং স্টিকটা ভেঙে গেছে। এখন ভাবলে এত খারাপ লাগছে। ঝিনুক অনুতাপের সুরে বলল।
--- তা হ্যারে, তোর আঙ্কেলের নামটা তো বললি না।
---- তমাল...পদবিটা যেন কী,মনে পড়ছে না।
--- ঠিক আছে, এবার তুই যা ফ্রেশ হয়ে নে। আমি চা বসাচ্ছি।
--- ওহ্ মা,তোমায় বলতে ভুলেই গেছি, সামনের শুক্রবার ওনার জন্মদিন। উনি বারবার যেতে বলেছেন।
--- হ্যা যাবি। পারলে একটা ওয়াকিং স্টিক কিনে নিয়ে যাস। বার্থডে গিফট।
--- তুমি তো দারুন সাজেশন দিলে মা! এতে আমারও মনটা কিছুটা হালকা হবে। আমি এক্ষুনি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি চা বসাও। ঝিনুক চটপট বাথরুমে ঢুকে পড়ে।

আজ বাইশ বছর পর তমাল নামটা যেন হাওয়ায় উড়তে উড়তে মালবিকা ওরফে ঝিমলির পায়ের কাছে এসে পড়ল। কুঁড়িয়েও নিল সে। বুঝল, সেদিন তমাল তার ঝিমলিকে কোন কিছু ফিরিয়ে দিতেই এসেছিল। তমালের কিইবা আছে,তাকে ফিরিয়ে দেবার মত। তাহলে কি সেই পাঁচ হাজার টাকা? বাবার অসুস্থতার প্রয়োজনে যা সে চেয়ে নিয়েছিল। 
আর ভাবতে পারে না। হঠাৎ যেন মনের ভেতর অনেক দিনের জমে থাকা কষ্ট মুক্তোদানার মত ঝিমলির গাল বেয়ে নামতে থাকে। পাড় ভাঙা নদীর মত কাঁদতে ইচ্ছে করে । কিন্তু ঝিমলিকে আজ কান্না লুকোতেই হবে। তা নাহলে একটু পরেই মেয়েটা এসে গলা জড়িয়ে ধরে বলবে,মা তুমি কাঁদছ কেন?

  গল্পকার সমাজ বসু 
 মিলন পার্ক, গড়িয়া, কলকাতা


































রি-ইউনিয়ন

প্রায় বছর সাতেক পর এই চত্বরে আসা। রাস্তায় আসতে আসতে গোলাপবাগ মোড়  থেকে যখন নতুন তৈরি হওয়া ইউনিভার্সিটি গেট টা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব এলাকায় ঢুকে পড়েছিল ঐন্দ্রী একবারও মনে হয়নি তখন যে মাঝের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে স্রোতের মতো। মনে পড়ে যাচ্ছিল ট্রেন থেকে নেমেই পড়িমড়ি করে বাস ধরার জন্য দৌড়াতো আর ভিড়ে ঠাসা মিনিবাসে ঝুলতে ঝুলতে গোলাপবাগ মোড় পর্যন্ত এলেই সেকেন্ড গেটে  নামার প্রস্তুতি নিতে হতো। চারিপাশের চেনা রাস্তা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের ভেতরে গাছ গাছালীতে ভরপুর বলা ভালো অরণ্যানীর মধ্যে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিংগুলো ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো।লাল, পিয়াল,আম,জাম মেহগনির মাঝে মাঝে কৃষ্ণচূড়ার লাল মাথা গুলো আগুন ছড়ায় উর্ধ্বপানে।আর বেলা বাড়লে সূর্যস্নাত হয় মাথা উঁচু বিল্ডিং গুলো। চারিদিক টা সরু পরিখা দিয়ে ঘেরা।আর ও প্রান্তে বাগান দিয়ে সাজানো হাওয়া মহলে পাড়ি দেবার জন্য ছোট্ট ডিঙি বাঁধা থাকে এপাড়ে।ঐন্দ্রীর মনে পড়ে যায় জিষ্ণুর কথা।
আজ ঐন্দ্রী দের রি- ইউনিয়ন। সব ডিপার্টমেন্ট পেরিয়ে ওদের বিভাগ একদম শেষে। বাংলা বিভাগের যে কজন সোশ্যাল মিডিয়ার  দৌলতে যোগাযোগে যুক্ত তাদের সকলেরই আসার কথা। এমনকি জিষ্ণুর ও। এই কথাটাই সকাল থেকে শুধু সকাল থেকে নয় মাস খানেক  আগে থেকে যখন দিন ঠিক হয়েছে তখন থেকে মনের মধ্যে ধাক্কা মারছে বারবার। তবুও এত বছর পর ইউনিভার্সিটির আসার সুযোগ টা ,ইচ্ছেটা দমন করতে পারেনি ঐন্দ্রী। তমাল ও বাধা দেয়নি। তমালের এত সময় কোথায়? ঐন্দ্রীর মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তমালের সাথে সংসার করতে করতে। তমালকে দেখে মনে হয় টাকা রোজগারের মেশিন। ঐন্দ্রী আর তমোঘ্নর দিকে নজর দেওয়ার ফুরসত মেলেনা তার। সংসারটা ঐন্দ্রীর কাছে  ভীষন একাকীত্বের জায়গা। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা বড় মরুভূমি পেরোনোর পরীক্ষায় নেমেছে ও। এত বড় বালির শহর কি করে পেরোবে কুল কিনারা পায় না। মনের সাথে যুদ্ধ যে বিষম বালাই। মনে পড়ে জিষ্ণুর কথা। চিন্তাটা প্রকট হয়। জিষ্ণুর সাথে কাটানো সময়গুলো জল ছবির মতো মনে ভেসে ওঠে।
ফার্স্ট গেটটা এলে ওই টোটো কে  জানায় "দাদা এটা নয় পরের গেটটা"।
দূরে বনবীথি মাঝে কালো রাস্তা ধরে টোটো চলে ডিপার্টমেন্টের সামনে। বাংলা ডিপার্টমেন্ট।  ঐন্দ্রী কে দেখে সকলে হৈ হৈ করে ওঠে। মোটামুটি সকলে হাজির। ইন্দ্রানী ,দীপালি ,দেবব্রত সহ এমনকি ওদের ব্যাচের ফার্স্ট বয় দেবাঞ্জন ও। ঐন্দ্রী নিজেকে গুছিয়ে টোটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেল সবার দিকে।
কি অপূর্ব  সাজিয়েছে বিল্ডিং টা। ঐন্দ্রী র মনে পড়ে গেল সামনের সিঁড়িতে বসে কতদিন জিষ্ণু আর ঐন্দ্রী আসন্ন পরীক্ষার নোট বানিয়েছে। দুজনে  মিলে গল্পে মশগুল হতে হতে চলে যেত  বিশাল দিঘির পাড় বেয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে। কেন এমন হচ্ছে আজ! এতগুলো বছর যা চেপে ছিল মনের ভিতর তা বারবার কেন গাজোয়ারি করে স্মৃতির ঝোলা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখের সামনে।
"কিরে ঐন্দ্রী কেমন আছিস?"দীপালি গলা জড়িয়ে ধরল।
"ভালো রে। কত দিন পর দেখা হল বল"
"হ্যাঁরে কেমন নস্টালজিক হয়ে পড়ছি বারবার।"
"সেই ক্লাস গুলো একই আছে জানিস এমনকি লাইব্রেরীটাও।"
ইন্দ্রানী যোগ করল"আরে আমার তো মনে হচ্ছে আবার ক্লাস করি ফার্স্ট সেমের মত।"
দেবব্রত হাসলো"হ্যাঁ তা তো মনে হবেই—তোর কর্তা তো তোর পাশে বসে ক্লাস করতো।"
"এই দেবু ফাজলামি মারিস না, সত্যি বলছি ক্লাস গুলো দেখে মনে হচ্ছে আবার এস এম, এস বির ক্লাস করি।"
দীপালি হঠাত বলল"এই ঐন্দ্রী মনে আছে একবার এসবির ক্লাস করছিলাম আর তোকে বাইরে বের করে দিয়েছিলেন  স্যার"!
ঐন্দ্রী হেসে লুটিয়ে পড়লো,"সে আর বলতে! তুইতো যত নষ্টের গোড়া।"
ইন্দ্রানী কৌতুহল দেখালো,"কেন রে?"
"আর বলিস না। দীপালি এসবি কে দেখে ছড়া লিখেছিল"চোখে চশমা আহা চুলের কি বাহার/দেখে মনে হয় কতদিন হয়নি আহার"। তার সাথে বিটকেলি একটা ছবি এঁকেছিল যার মাথায় চুল ছিল গোটা কয়েক একদম রোগা মত। আর কনুই দিয়ে খুঁচিয়ে আমায় ছড়াটা পড়িয়েছিল। স‍্যার  তখন নীলদর্পণ পড়াচ্ছেন। আমি হেসে ফেলেছিলাম। স্যার আমাকে বের করে দিয়েছিলেন ক্লাস থেকে।"
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।

সকলে ধাপে ধাপে সিঁড়িতে সাজানো বেঞ্চে বসে পড়ল। ক্লাস রুমটা গ্যালারি টাইপের। ঐন্দ্রীর চোখ দুটো অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছিল সকলের মধ্যে অন্য একজনকে। জিষ্ণু এসেছিল বেশ দেরী করে। সম্বর্ধনা শুরু হবার বেশ খানিকক্ষণ পর।
ঐন্দ্রী প্রথম যখন জিষ্ণু কে দেখল মনে হল পরিবর্তন শুধু  সময়ে নয় এসেছে চেহারাতেও। এই ক'বছরে ছেলে থেকে জিষ্ণু লোক লোক হয়ে গেছে। অমন ঘন পশমের মত চুল পাতলা হয়ে সামনের জমি ফাঁকা করে দিয়েছে। রংটাও হয়েছে তামাটে বর্ণ।
জিষ্ণু এসে অব্দি পুরনো ক্লাসরুমে খেয়াল করেনি ঐন্দ্রী কে। নাকি ঐন্দ্রী আছে জেনে নিজের মতো দেবাঞ্জন এর পাশে গিয়ে বসে থেকে বাধ্য ছাত্রের মতো ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়েই থাকে। তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। যে রাস্তায়  ওরা দুজন মিলে চলেছিল সেই রাস্তা থেকে অন্য একটি সমান্তরাল রাস্তা বেছে মাঝ পথে চলে গেছিল ঐন্দ্রী ই। তবুও আজও কেন জিষ্ণু কে দেখলে এত বছর পরেও ঐন্দ্রী র ফেলে আসা রাস্তায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। সমান্তরাল রেখা দুটো তির্যক করে মিলিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো মনে হয়।
"জিষ্ণু এসেছে দেখেছিস?"দীপালি ঠেলা দিল।
"দেখছি তাই"।
"আরে জিষ্ণুর এখন হেভি পসার। এলাকার সব টিউশন ওর কাছে প্লাস কলেজের প্রফেসর সোনায় সোহাগা।"
"ছাড় তো ওকে  নিয়ে মাথাব্যথা নেই।"
"সত্যি নেই ঐন্দ্রী? তোদের তো ব্যাপারটা সিরিয়াস ছিল বলেই শুনেছি!"
"দীপা তুই তো জানিস বাবা কেমন? তমালের সম্বন্ধটা আসার পরে এত জোর করেছিল ভালো  ছেলে হাতছাড়া করতে চায়নি বাবা। জিষ্ণু তো তখন কিছুই করত না"
"আর তুই? তুই কেন রাজি হয়ে গেলি? জিষ্ণু কে তুই কোনদিন ভালোবাসিস নি?"
"এসব কথা ছাড় দীপা। পুরনো জিনিস ঘেঁটে লাভ নেই"।
"জানিস ঐন্দ্রী জিষ্ণু চাকরি পাওয়ার পরও অনেকদিন বিয়ে করতে চাইনি। লাস্ট ইয়ার মনে হয় বিয়েটা হয়েছে ।প্রোফাইল ঘাঁটিস দেখতে পাবি কি মিষ্টি ওর বউটা।"
ঐন্দ্রী এবার খুব রেগে গেল,"তুই কি চুপ করবি? নাকি আমি শিফট করব।"
"আরে খেপছিস কেন এই দেখ মুখে সেলোটেপ লাগালাম।"জিষ্ণুর প্রোফাইলটা তখনই ঘেঁটেছে ঐন্দ্রী যখন রিকোয়েস্ট এসেছিল। একবার নয় বারবার বহুবার।
দেবাঞ্জন আজও বেশ নেতা নেতা ভাব করে সকলকে বলল-"এই শোন সকলে মিলে আজ চল রতনদার দোকানের পরোটা আর ঘুগনি খাব আর সঙ্গে মাটির ভাঁড়ে চা।"

অনুষ্ঠান শেষ হতে আরো ঘন্টাখানেক লাগলো। একে একে সকলে মিলে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। পুরনো বিল্ডিং ,পুরনো লাইব্রেরী ,সিঁড়ি ঘরের কমনরুম, সামনের ছোট্ট বাগান ,টিচার্স রুমের সামনে বড় ঘড়ি, আবার একটা স্মৃতি হয়ে থাকল উপস্থিত সকলের মনে।
জিষ্ণু ই এগিয়ে গেল ঐন্দ্রী র দিকে"কেমন আছো?"
ঐন্দ্রী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল" ভালো আর তুমি"?
"চলে যাচ্ছে ।কোন স্কুলে পড়াচ্ছো?"
"কোলকাতাতে ই"।
"থাকবে এখন ক দিন?"
"দেখি— চলো ক্যান্টিনে যাচ্ছে সকলে"।

সেই রতনদার ক্যান্টিন। ঐন্দ্রী আর জিষ্ণু  ছিল রতন দার বাধা কাস্টমার
দেবাঞ্জন জিষ্ণুকে নিয়ে এগিয়ে গেল,"কি রতনদা চিনতে পারছো?"
রতনদা অনেকক্ষণ মনে করার চেষ্টা করলো। মনে পড়ল  কিনাকে জানে। হাসল অল্প।
"দাও সকলকে পরোটা আর ঘুগনি।"
জিষ্ণু যোগ করল "একটা ঘুগনি ঝাল ছাড়া।"
দেবাঞ্জন প্রশ্ন ছুড়লো "তুই ঝাল খাস না?"জিষ্ণু অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিল," না আসলে ওটা ঐন্দ্রীর জন্য । ঝাল ছাড়াটা ওকে পাঠিয়ে দিস।"
দেবাঞ্জন মুচকি হাসলো,"বস তোরা কেন বিয়ে করলিনা কে জানে এই ক'বছরে তো কিছুই ভুলিস
নি।"

খাবার চলে এল। দেবাঞ্জন ইচ্ছে করেই এক প্লেট ঘুগনি ঐন্দ্রীর সামনে এনে যোগ করল" তুই নাকি ঝাল খাস না জিষ্ণু অর্ডারের সময় মনে করালো"।
ঐন্দ্রী থতমত খেয়ে গেল,"কই নাতো আমি এখন ঝাল খাই। সবকিছু কি এক থাকে?"
একটু জোরেই গলা চড়িয়ে রতনদা কে ডেকে বলে,"রতনদা এখানে একটু কাঁচা লঙ্কা কুচি দিয়ে যেও"।
জিষ্ণুর গান দুটো গরম হয়ে যায় অপমানে। সে মাথা নিচু করে খাওয়াতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করে। একসময় যে ঘুগনি দুজন মিলে পরম তৃপ্তিতে খেত আজ কেমন পানসা মনে হচ্ছে যে জিষ্ণুর।
হঠাৎ হেঁচকি তুলে চোখ মুখ লাল হয়ে যায় ঐন্দ্রীর। জিষ্ণু এগিয়ে আসে জলের গ্লাস নিয়ে"জলটা খেলে মনে হয় ভালো লাগবে।"
ঐন্দ্রী র তখন জিভ জ্বলে যাচ্ছে অনভ্যাসের কারণে। এক নিঃশ্বাসে জল শেষ করে ঐন্দ্রী।

বেলা পড়ে আসে সকলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়। ঐন্দ্রী হাঁটতে হাঁটতে এগোয় সেকেন্ড গেটের দিকে। জিষ্ণু ধরে ফেলে ওকে। মুখোমুখি হয় অতীত বর্তমান।
"এখন ঠিক আছো?"জিষ্ণু প্রশ্ন করে।
"কোন দরকার ছিল কি এই সিচুয়েশন ক্রিয়েট করবার?"
"তোমার কষ্ট হবে ভেবেই তো আমি অর্ডার টা দিয়েছিলাম।"
"সত্যি যদি কষ্টটা বুঝতে!"
"তুমি কি বুঝে ছিলে?"
বুকপকেটে ঠিক সেই সময় ফোনটা বেজে ওঠে। জিষ্ণু কানে ফোনটা ধরে,"হ্যালো.... বল"
হুম ফিরবো এখনি রেডি থাকো ফিরেই বেরোবো।"
ঐন্দ্রী তির্যক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে জিষ্ণু কে,"বউ?"
"হ্যাঁ"
"কতদিন হলো বিয়ে করেছ?"
"এই বছর খানেক"।
"ভালোই আছো তাহলে নতুন সংসারে?"কটাক্ষ করে ঐন্দ্রী ।
জিষ্ণু অন্যমনস্ক হয়ে হাসলো,"ভালো থাকাটা তো আপেক্ষিক আবার নির্ভরশীল ও বটে। তুমিও তো ভালো আছো। বড়লোক বর। ছেলে স্বামী নিয়ে দিব্যি সংসার করছো।"
ঐন্দ্রী কথার খেই হারায়,"বর্ধমানেই আছো?"
"অতীতেই আছি"।
 বিদ্রুপ করে হাসে জিষ্ণু।
"মানে?"
"মানে বর্তমানে আর চললাম কোথায়?"
"আমি জিজ্ঞাসা করলাম বর্ধমানেই আছো?"
"ও আমি বর্তমান শুনলাম। হ্যাঁ মোটামুটি এখানেই থাকা হয়।"
ঐন্দ্রী এই প্রথম জিষ্ণুর দিকে মুখ তুলে চোখে চোখ রেখে তাকালো। দুই জোড়া চোখ এক হয়ে যায়। অনেক সময় শুভদৃষ্টি ছাড়াও চোখদুটো দুজনের ভাষা খোঁজে। মাঝের সময়টাএকটা বড় ব্যবধানের মরীচিকা মনে হল। কি ক্লান্ত চোখ দুটো ঐন্দ্রীর‌। কেন এত শ্রান্ত লাগছে ভাবে জিষ্ণু। ঐন্দ্রী চিন্তা করে জিষ্ণুর চোখদুটো যেন যুদ্ধে পরাজিত অথচ অভিযোজিত দুই নয়ন যেখানে এর আগে শুধুই ভালোবাসা দেখেছে ঐন্দ্রী। নীরবতা ভাঙে ঐন্দ্রী ই। ..."কোন উপায় ছিলোনা জিষ্ণু। বাবাকে তো তুমি  জানো। বাবার অমতে গিয়ে আমার বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি আমি। এত তাড়াতাড়িই সব হয়ে যাচ্ছিল শেষ অব্দি আর আটকাতে পারিনি।"
জিষ্ণু যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। লুফে নিল ঐন্দ্রীর কথাটা।"কোন কষ্টের কথা বলছো তুমি? হ্যাঁ তুমি চলে গেছিলে। লড়াইটা আমার একার ছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে গোটা শহর যেখানে দুজন মিলে হেঁটে বেড়াতাম আনাচে কানাচে, সেখানে আমাকে একা হাঁটতে বেগ পেতে হয়েছে বৈকি। আরো কষ্ট হতো এই ক্যাম্পাসে এলে। রতন দার দোকানে আজো ইচ্ছে করছিল ডানদিকে জানালার পাশের টেবিলটাতে বসি তুমি আমি। যখন তোমাকে খুব প্রয়োজন ছিল ঠিক তখনই একা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছিলে তুমি , কোনো ধারনা আছে সেই কষ্টটা কেমন?"
জিষ্ণুর আরো বলতে ইচ্ছে হলো উর্মি মানে ওর সদ্যবিবাহিত বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু ঐন্দ্রী কে খুঁজে গেছে নিয়ত প্রতিনিয়ত। ভেতরে সব ক্ষোভ উগরাতে  না পেরে মুখ ফিরিয়ে নেয় জিষ্ণু।
ঐন্দ্রী এতোক্ষন চুপ করে থাকে। আস্তে আস্তে উত্তর দেয়,"তুমি কি ভাবো জিষ্ণু? দিব্যি সংসার করছি আমি? আজো ক্যাম্পাসটা আমাকে ডাকে, সাত বছরের এই দূরত্ব টা মুছে গেছে মন থেকে? ফেরার কোন উপায় নেই আমার, কারোর কারোর জায়গাটা নির্দিষ্টভাবে তারই হয়ে যায় জিষ্ণু। কেউই সেই জায়গা নিতে পারে না। একলা বসে থাকি পিছু টান মারে পুরনো স্মৃতি।."..... একটু থেমে যোগ করে,"অভিযোগ যত করা হয় মাঝের দূরত্বের ফাঁকটার দৈর্ঘ্য বাড়ে বৈ কমে না"
জিষ্ণু মাথা নামায়.... নিজের মনে বলে,"এই ক'বছরে যে অনেক কথা জমে আছে তার কি হবে?"
অকারনে কেন যে এত চোখে জল আসে আজ ঐন্দ্রীর। অন্য দিকে তাকায় সে..."আসলে কথাটা অনুভূতির মত। দুটোরই তো মৃত্যু নেই.... আসলে মৃত্যু হয় না। অভিমান ,রাগ ,অভিযোগ, জোর করে চেপে রাখতে। হৃদয় খুঁড়লে সময়-সুযোগমতো বেরিয়ে আসে নিজের থেকেই।"

দুজনেই চুপ করে থাকে মুখোমুখি। টোটো চলে আসে। ঐন্দ্রী উঠে পড়ে। আবার ছেড়ে চলে যেতে হয়। "আসি জিষ্ণু। তোমার ফোন নম্বরটা মেসেঞ্জারে পাঠিও। তোমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তো আমি নেই।"
"তুমি তো এখনো আমায় একসেপ্ট করোনি?"
"এবার করে নেব।"আলতো হেসে উত্তর দেয় ঐন্দ্রী। চোখ দুটো ভারী হয়ে আসে। জল জমে কোনে।
জিষ্ণু তাকিয়ে থাকে নীল শাড়ি পরিহিতা ঐন্দ্রীর দিকে। ঐন্দ্রী কে জিষ্ণু নীলা বলে ডাকত। তার জন্যেই কি আজ ও নীল শাড়ি পড়েছিল? সে ও পড়েছে মনে করে ঐন্দ্রীর পছন্দের সাদা শার্ট ব্লু জিন্স। যতদূর দেখা যায় জিষ্ণু তাকিয়ে থাকে।

ঐন্দ্রী টোটোয় বসে ফোনটা বার করে। প্রায় তিন চার মাস  আগের যে রিকুয়েস্ট টা ইগনোর করে ফেলে রেখেছিল আবার রিমুভ ও করতে পারেনি তাকে খুঁজে খুঁজে বার করে কনফার্ম করে দিল। মনের ভিতরটা হালকা লাগছে বড্ড। নিজের প্রতি নিজেকে দোষারোপের  যেখচখচানি তা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল। জিষ্ণুর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যাওয়াটা যে নীরব ভাবে মেনে নিয়েছিল জিষ্ণু ,সেটা খোঁচা মারত বড্ড। জিষ্ণুর কাছ থেকে কথাগুলো শুনে মনের ,ভারী গুমোট ভাবটা কেটে গেছে। অন্য কিছু নয় জিষ্ণু থাক মনের বন্ধু হয়ে। এমন বন্ধুত্ব তো সবার জোটে না। জিষ্ণু ওকে বুঝবে ওর মত করে। উল্টোদিকে ও তাই। এইটুকু গণ্ডীর মধ্যে সম্পর্কটা বাধা থাক। তাহলে তাদের সাথে জড়িত মানুষগুলো ভালো থাকবে। ভালো রাখতে হবে তাদেরই।
স্টেশন চলে এলো। হাতের কব্জি উল্টে সময় দেখল  ঐন্দ্রী। ট্রেনের সময় হয়ে  গেছে। ফোনে টুং করে মেসেঞ্জারে দশডিজিটের নম্বর আসে জিষ্ণুর। সঙ্গে ছোট্ট মেসেজ,"শুধু বন্ধুত্ব টুকু থাক, ভালো থেকো ঐন্দ্রী।"

সাহিত্যিক সৌমী গুপ্ত
১৬২, রাইফেল ক্লাব রোড, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ




















নবীনতর পোস্টসমূহ পুরাতন পোস্টসমূহ হোম

ব্লগ সংরক্ষাণাগার

  • আগস্ট (3)
  • জুলাই (22)
  • জুন (8)
  • নভেম্বর (15)
  • অক্টোবর (5)
  • সেপ্টেম্বর (81)
  • আগস্ট (66)
  • জুলাই (55)
  • জুন (56)
  • মে (57)
  • এপ্রিল (46)
  • মার্চ (15)
  • জানুয়ারী (14)
  • ডিসেম্বর (73)
  • নভেম্বর (103)
  • অক্টোবর (97)
  • সেপ্টেম্বর (101)
  • আগস্ট (120)
  • জুলাই (88)
  • জুন (76)
  • মে (63)
  • এপ্রিল (11)

🔴বিজ্ঞপ্তি:

পাঁচ মাসের বিরতি কাটিয়ে আবার ও ফিরছি আমরা। খুব শীগ্রই আসছে আমাদের প্রত্যাবর্তন সংখ্যা।

অনুসরণ করুণ

এক মাসের সর্বাধিক পঠিত পোস্টগুলি:

  • শেষ শোকসংগীত ~ গোবিন্দ মোদকের কবিতা
  • দুটি কবিতায় ~ গৌতম কুমার গুপ্ত
  • ব্রাত্য ~ বিদ্যুৎ মিশ্র'র কবিতা
  • দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প
  • আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা
  • গুচ্ছ কবিতায় ~ অসীম মালিক
  • সুমিত রায়ের গল্প
  • সে প্রেম পবিত্র~ প্রেমাংশু শ্রাবণের কবিতা
  • সুব্রত মাইতির কবিতা
  • তিনটি কবিতায় ~ রাগীব আবিদ রাতুল

বিষয়সমূহ

  • Poetry speaks 2
  • অণু কথারা 21
  • আবার গল্পের দেশে 8
  • উৎসব সংখ্যা ১৪২৭ 90
  • একুশে কবিতা প্রতিযোগিতা ২০২১ 22
  • এবং নিবন্ধ 3
  • কবিতা যাপন 170
  • কবিতার দখিনা দুয়ার 35
  • কিশলয় সংখ্যা ১৪২৭ 67
  • খোলা চিঠিদের ডাকবাক্স 1
  • গল্পের দেশে 17
  • ছড়ার ভুবন 7
  • জমকালো রবিবার ২ 29
  • জমকালো রবিবার সংখ্যা ১ 21
  • জমকালো রবিবার ৩ 49
  • জমকালো রবিবার ৪ 56
  • জমকালো রবিবার ৫ 28
  • জমকালো রবিবার ৬ 38
  • দৈনিক কবিতা যাপন 19
  • দৈনিক গল্পের দেশে 2
  • দৈনিক প্রবন্ধমালা 1
  • ধারাবাহিক উপন্যাস 3
  • ধারাবাহিক স্মৃতি আলেখ্য 2
  • পোয়েট্রি স্পিকস 5
  • প্রতিদিনের সংখ্যা 218
  • প্রত্যাবর্তন সংখ্যা 33
  • প্রবন্ধমালা 8
  • বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা 10
  • বিশেষ সংখ্যা: আমার প্রিয় শিক্ষক 33
  • বিশেষ সংখ্যা: স্বাধীনতা ও যুবসমাজ 10
  • ভ্রমণ ডায়েরি 1
  • মুক্তগদ্যের কথামালা 5
  • রম্যরচনা 2
  • শীত সংখ্যা ~ ১৪২৭ 60

Advertisement

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.

মোট পাঠক সংখ্যা

লেখা পাঠাবার নিয়মাবলী:

১. শুধুমাত্র কবিতা, মুক্তগদ্য অথবা অণুগল্প পাঠাবেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং অন্যান্য বিষয়ক লেখা সম্পূর্ণ আমন্ত্রিত। ২. লাইনের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ৩. লেখা মেইল বডিতে টাইপ করে পাঠাবেন। ৪. লেখা মৌলিক ও অপ্রকাশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্য কোনো ব্লগ, ওয়েবজিন অথবা প্রিন্টিং মিডিয়ায় প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ৫. মেইলে আপনার লেখাটি সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত, কথাটি উল্লেখ করবেন। ৬. লেখার সাথে আবশ্যিক ভাবে এক কপি ছবি ও সংক্ষিপ্ত ঠিকানা পাঠাবেন।  ৭. লেখা নির্বাচিত হলে এক মাসের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হবে। এক মাসের মধ্যে কোনো উত্তর না এলে লেখাটি অমনোনীত ধরে নিতে হবে। ৮. আপনার লেখাটি প্রকাশ পেলে তার লিঙ্ক শেয়ার করাটা আপনার আবশ্যিক কর্তব্য। আশাকরি কথাটি আপনারা মেনে চলবেন। আমাদের মেইল- hridspondonmag@gmail.com
blogger-disqus-facebook

শান্তনু শ্রেষ্ঠা, সম্পাদক

আমার ফটো
পূর্ব বর্ধমান, India
আমার সম্পূর্ণ প্রোফাইল দেখুন

সাম্প্রতিক প্রশংসিত লেখা:

সুজিত রেজের কবিতা

সুজিত রেজের কবিতা

চন্দ্রানী গুহ রায়ের কবিতা

চন্দ্রানী গুহ রায়ের কবিতা

দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প

দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প

আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা

আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা

কবি সুধাংশুরঞ্জন সাহার কবিতা

কবি সুধাংশুরঞ্জন সাহার কবিতা

হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন

© হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন। শান্তনু শ্রেষ্ঠা কর্তৃৃক পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে প্রকাশিত।

Designed by OddThemes | Distributed by Gooyaabi Templates