রি-ইউনিয়ন
প্রায় বছর সাতেক পর এই চত্বরে আসা। রাস্তায় আসতে আসতে গোলাপবাগ মোড় থেকে যখন নতুন তৈরি হওয়া ইউনিভার্সিটি গেট টা পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব এলাকায় ঢুকে পড়েছিল ঐন্দ্রী একবারও মনে হয়নি তখন যে মাঝের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে স্রোতের মতো। মনে পড়ে যাচ্ছিল ট্রেন থেকে নেমেই পড়িমড়ি করে বাস ধরার জন্য দৌড়াতো আর ভিড়ে ঠাসা মিনিবাসে ঝুলতে ঝুলতে গোলাপবাগ মোড় পর্যন্ত এলেই সেকেন্ড গেটে নামার প্রস্তুতি নিতে হতো। চারিপাশের চেনা রাস্তা ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের ভেতরে গাছ গাছালীতে ভরপুর বলা ভালো অরণ্যানীর মধ্যে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের বিল্ডিংগুলো ইতস্তত ছড়ানো ছিটানো।লাল, পিয়াল,আম,জাম মেহগনির মাঝে মাঝে কৃষ্ণচূড়ার লাল মাথা গুলো আগুন ছড়ায় উর্ধ্বপানে।আর বেলা বাড়লে সূর্যস্নাত হয় মাথা উঁচু বিল্ডিং গুলো। চারিদিক টা সরু পরিখা দিয়ে ঘেরা।আর ও প্রান্তে বাগান দিয়ে সাজানো হাওয়া মহলে পাড়ি দেবার জন্য ছোট্ট ডিঙি বাঁধা থাকে এপাড়ে।ঐন্দ্রীর মনে পড়ে যায় জিষ্ণুর কথা।
আজ ঐন্দ্রী দের রি- ইউনিয়ন। সব ডিপার্টমেন্ট পেরিয়ে ওদের বিভাগ একদম শেষে। বাংলা বিভাগের যে কজন সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে যোগাযোগে যুক্ত তাদের সকলেরই আসার কথা। এমনকি জিষ্ণুর ও। এই কথাটাই সকাল থেকে শুধু সকাল থেকে নয় মাস খানেক আগে থেকে যখন দিন ঠিক হয়েছে তখন থেকে মনের মধ্যে ধাক্কা মারছে বারবার। তবুও এত বছর পর ইউনিভার্সিটির আসার সুযোগ টা ,ইচ্ছেটা দমন করতে পারেনি ঐন্দ্রী। তমাল ও বাধা দেয়নি। তমালের এত সময় কোথায়? ঐন্দ্রীর মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তমালের সাথে সংসার করতে করতে। তমালকে দেখে মনে হয় টাকা রোজগারের মেশিন। ঐন্দ্রী আর তমোঘ্নর দিকে নজর দেওয়ার ফুরসত মেলেনা তার। সংসারটা ঐন্দ্রীর কাছে ভীষন একাকীত্বের জায়গা। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা বড় মরুভূমি পেরোনোর পরীক্ষায় নেমেছে ও। এত বড় বালির শহর কি করে পেরোবে কুল কিনারা পায় না। মনের সাথে যুদ্ধ যে বিষম বালাই। মনে পড়ে জিষ্ণুর কথা। চিন্তাটা প্রকট হয়। জিষ্ণুর সাথে কাটানো সময়গুলো জল ছবির মতো মনে ভেসে ওঠে।
ফার্স্ট গেটটা এলে ওই টোটো কে জানায় "দাদা এটা নয় পরের গেটটা"।
দূরে বনবীথি মাঝে কালো রাস্তা ধরে টোটো চলে ডিপার্টমেন্টের সামনে। বাংলা ডিপার্টমেন্ট। ঐন্দ্রী কে দেখে সকলে হৈ হৈ করে ওঠে। মোটামুটি সকলে হাজির। ইন্দ্রানী ,দীপালি ,দেবব্রত সহ এমনকি ওদের ব্যাচের ফার্স্ট বয় দেবাঞ্জন ও। ঐন্দ্রী নিজেকে গুছিয়ে টোটো থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেল সবার দিকে।
কি অপূর্ব সাজিয়েছে বিল্ডিং টা। ঐন্দ্রী র মনে পড়ে গেল সামনের সিঁড়িতে বসে কতদিন জিষ্ণু আর ঐন্দ্রী আসন্ন পরীক্ষার নোট বানিয়েছে। দুজনে মিলে গল্পে মশগুল হতে হতে চলে যেত বিশাল দিঘির পাড় বেয়ে সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে। কেন এমন হচ্ছে আজ! এতগুলো বছর যা চেপে ছিল মনের ভিতর তা বারবার কেন গাজোয়ারি করে স্মৃতির ঝোলা থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে চোখের সামনে।
"কিরে ঐন্দ্রী কেমন আছিস?"দীপালি গলা জড়িয়ে ধরল।
"ভালো রে। কত দিন পর দেখা হল বল"
"হ্যাঁরে কেমন নস্টালজিক হয়ে পড়ছি বারবার।"
"সেই ক্লাস গুলো একই আছে জানিস এমনকি লাইব্রেরীটাও।"
ইন্দ্রানী যোগ করল"আরে আমার তো মনে হচ্ছে আবার ক্লাস করি ফার্স্ট সেমের মত।"
দেবব্রত হাসলো"হ্যাঁ তা তো মনে হবেই—তোর কর্তা তো তোর পাশে বসে ক্লাস করতো।"
"এই দেবু ফাজলামি মারিস না, সত্যি বলছি ক্লাস গুলো দেখে মনে হচ্ছে আবার এস এম, এস বির ক্লাস করি।"
দীপালি হঠাত বলল"এই ঐন্দ্রী মনে আছে একবার এসবির ক্লাস করছিলাম আর তোকে বাইরে বের করে দিয়েছিলেন স্যার"!
ঐন্দ্রী হেসে লুটিয়ে পড়লো,"সে আর বলতে! তুইতো যত নষ্টের গোড়া।"
ইন্দ্রানী কৌতুহল দেখালো,"কেন রে?"
"আর বলিস না। দীপালি এসবি কে দেখে ছড়া লিখেছিল"চোখে চশমা আহা চুলের কি বাহার/দেখে মনে হয় কতদিন হয়নি আহার"। তার সাথে বিটকেলি একটা ছবি এঁকেছিল যার মাথায় চুল ছিল গোটা কয়েক একদম রোগা মত। আর কনুই দিয়ে খুঁচিয়ে আমায় ছড়াটা পড়িয়েছিল। স্যার তখন নীলদর্পণ পড়াচ্ছেন। আমি হেসে ফেলেছিলাম। স্যার আমাকে বের করে দিয়েছিলেন ক্লাস থেকে।"
সবাই হো হো করে হেসে উঠলো।
সকলে ধাপে ধাপে সিঁড়িতে সাজানো বেঞ্চে বসে পড়ল। ক্লাস রুমটা গ্যালারি টাইপের। ঐন্দ্রীর চোখ দুটো অনেকক্ষণ ধরে খুঁজছিল সকলের মধ্যে অন্য একজনকে। জিষ্ণু এসেছিল বেশ দেরী করে। সম্বর্ধনা শুরু হবার বেশ খানিকক্ষণ পর।
ঐন্দ্রী প্রথম যখন জিষ্ণু কে দেখল মনে হল পরিবর্তন শুধু সময়ে নয় এসেছে চেহারাতেও। এই ক'বছরে ছেলে থেকে জিষ্ণু লোক লোক হয়ে গেছে। অমন ঘন পশমের মত চুল পাতলা হয়ে সামনের জমি ফাঁকা করে দিয়েছে। রংটাও হয়েছে তামাটে বর্ণ।
জিষ্ণু এসে অব্দি পুরনো ক্লাসরুমে খেয়াল করেনি ঐন্দ্রী কে। নাকি ঐন্দ্রী আছে জেনে নিজের মতো দেবাঞ্জন এর পাশে গিয়ে বসে থেকে বাধ্য ছাত্রের মতো ব্ল্যাকবোর্ডের দিকে তাকিয়েই থাকে। তাকিয়ে থাকতে বাধ্য হয়। যে রাস্তায় ওরা দুজন মিলে চলেছিল সেই রাস্তা থেকে অন্য একটি সমান্তরাল রাস্তা বেছে মাঝ পথে চলে গেছিল ঐন্দ্রী ই। তবুও আজও কেন জিষ্ণু কে দেখলে এত বছর পরেও ঐন্দ্রী র ফেলে আসা রাস্তায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। সমান্তরাল রেখা দুটো তির্যক করে মিলিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো মনে হয়।
"জিষ্ণু এসেছে দেখেছিস?"দীপালি ঠেলা দিল।
"দেখছি তাই"।
"আরে জিষ্ণুর এখন হেভি পসার। এলাকার সব টিউশন ওর কাছে প্লাস কলেজের প্রফেসর সোনায় সোহাগা।"
"ছাড় তো ওকে নিয়ে মাথাব্যথা নেই।"
"সত্যি নেই ঐন্দ্রী? তোদের তো ব্যাপারটা সিরিয়াস ছিল বলেই শুনেছি!"
"দীপা তুই তো জানিস বাবা কেমন? তমালের সম্বন্ধটা আসার পরে এত জোর করেছিল ভালো ছেলে হাতছাড়া করতে চায়নি বাবা। জিষ্ণু তো তখন কিছুই করত না"
"আর তুই? তুই কেন রাজি হয়ে গেলি? জিষ্ণু কে তুই কোনদিন ভালোবাসিস নি?"
"এসব কথা ছাড় দীপা। পুরনো জিনিস ঘেঁটে লাভ নেই"।
"জানিস ঐন্দ্রী জিষ্ণু চাকরি পাওয়ার পরও অনেকদিন বিয়ে করতে চাইনি। লাস্ট ইয়ার মনে হয় বিয়েটা হয়েছে ।প্রোফাইল ঘাঁটিস দেখতে পাবি কি মিষ্টি ওর বউটা।"
ঐন্দ্রী এবার খুব রেগে গেল,"তুই কি চুপ করবি? নাকি আমি শিফট করব।"
"আরে খেপছিস কেন এই দেখ মুখে সেলোটেপ লাগালাম।"জিষ্ণুর প্রোফাইলটা তখনই ঘেঁটেছে ঐন্দ্রী যখন রিকোয়েস্ট এসেছিল। একবার নয় বারবার বহুবার।
দেবাঞ্জন আজও বেশ নেতা নেতা ভাব করে সকলকে বলল-"এই শোন সকলে মিলে আজ চল রতনদার দোকানের পরোটা আর ঘুগনি খাব আর সঙ্গে মাটির ভাঁড়ে চা।"
অনুষ্ঠান শেষ হতে আরো ঘন্টাখানেক লাগলো। একে একে সকলে মিলে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। পুরনো বিল্ডিং ,পুরনো লাইব্রেরী ,সিঁড়ি ঘরের কমনরুম, সামনের ছোট্ট বাগান ,টিচার্স রুমের সামনে বড় ঘড়ি, আবার একটা স্মৃতি হয়ে থাকল উপস্থিত সকলের মনে।
জিষ্ণু ই এগিয়ে গেল ঐন্দ্রী র দিকে"কেমন আছো?"
ঐন্দ্রী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল" ভালো আর তুমি"?
"চলে যাচ্ছে ।কোন স্কুলে পড়াচ্ছো?"
"কোলকাতাতে ই"।
"থাকবে এখন ক দিন?"
"দেখি— চলো ক্যান্টিনে যাচ্ছে সকলে"।
সেই রতনদার ক্যান্টিন। ঐন্দ্রী আর জিষ্ণু ছিল রতন দার বাধা কাস্টমার
দেবাঞ্জন জিষ্ণুকে নিয়ে এগিয়ে গেল,"কি রতনদা চিনতে পারছো?"
রতনদা অনেকক্ষণ মনে করার চেষ্টা করলো। মনে পড়ল কিনাকে জানে। হাসল অল্প।
"দাও সকলকে পরোটা আর ঘুগনি।"
জিষ্ণু যোগ করল "একটা ঘুগনি ঝাল ছাড়া।"
দেবাঞ্জন প্রশ্ন ছুড়লো "তুই ঝাল খাস না?"জিষ্ণু অপ্রস্তুত হয়ে উত্তর দিল," না আসলে ওটা ঐন্দ্রীর জন্য । ঝাল ছাড়াটা ওকে পাঠিয়ে দিস।"
দেবাঞ্জন মুচকি হাসলো,"বস তোরা কেন বিয়ে করলিনা কে জানে এই ক'বছরে তো কিছুই ভুলিস
নি।"
খাবার চলে এল। দেবাঞ্জন ইচ্ছে করেই এক প্লেট ঘুগনি ঐন্দ্রীর সামনে এনে যোগ করল" তুই নাকি ঝাল খাস না জিষ্ণু অর্ডারের সময় মনে করালো"।
ঐন্দ্রী থতমত খেয়ে গেল,"কই নাতো আমি এখন ঝাল খাই। সবকিছু কি এক থাকে?"
একটু জোরেই গলা চড়িয়ে রতনদা কে ডেকে বলে,"রতনদা এখানে একটু কাঁচা লঙ্কা কুচি দিয়ে যেও"।
জিষ্ণুর গান দুটো গরম হয়ে যায় অপমানে। সে মাথা নিচু করে খাওয়াতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করে। একসময় যে ঘুগনি দুজন মিলে পরম তৃপ্তিতে খেত আজ কেমন পানসা মনে হচ্ছে যে জিষ্ণুর।
হঠাৎ হেঁচকি তুলে চোখ মুখ লাল হয়ে যায় ঐন্দ্রীর। জিষ্ণু এগিয়ে আসে জলের গ্লাস নিয়ে"জলটা খেলে মনে হয় ভালো লাগবে।"
ঐন্দ্রী র তখন জিভ জ্বলে যাচ্ছে অনভ্যাসের কারণে। এক নিঃশ্বাসে জল শেষ করে ঐন্দ্রী।
বেলা পড়ে আসে সকলে সবাইকে বিদায় জানিয়ে গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়। ঐন্দ্রী হাঁটতে হাঁটতে এগোয় সেকেন্ড গেটের দিকে। জিষ্ণু ধরে ফেলে ওকে। মুখোমুখি হয় অতীত বর্তমান।
"এখন ঠিক আছো?"জিষ্ণু প্রশ্ন করে।
"কোন দরকার ছিল কি এই সিচুয়েশন ক্রিয়েট করবার?"
"তোমার কষ্ট হবে ভেবেই তো আমি অর্ডার টা দিয়েছিলাম।"
"সত্যি যদি কষ্টটা বুঝতে!"
"তুমি কি বুঝে ছিলে?"
বুকপকেটে ঠিক সেই সময় ফোনটা বেজে ওঠে। জিষ্ণু কানে ফোনটা ধরে,"হ্যালো.... বল"
হুম ফিরবো এখনি রেডি থাকো ফিরেই বেরোবো।"
ঐন্দ্রী তির্যক দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করে জিষ্ণু কে,"বউ?"
"হ্যাঁ"
"কতদিন হলো বিয়ে করেছ?"
"এই বছর খানেক"।
"ভালোই আছো তাহলে নতুন সংসারে?"কটাক্ষ করে ঐন্দ্রী ।
জিষ্ণু অন্যমনস্ক হয়ে হাসলো,"ভালো থাকাটা তো আপেক্ষিক আবার নির্ভরশীল ও বটে। তুমিও তো ভালো আছো। বড়লোক বর। ছেলে স্বামী নিয়ে দিব্যি সংসার করছো।"
ঐন্দ্রী কথার খেই হারায়,"বর্ধমানেই আছো?"
"অতীতেই আছি"।
বিদ্রুপ করে হাসে জিষ্ণু।
"মানে?"
"মানে বর্তমানে আর চললাম কোথায়?"
"আমি জিজ্ঞাসা করলাম বর্ধমানেই আছো?"
"ও আমি বর্তমান শুনলাম। হ্যাঁ মোটামুটি এখানেই থাকা হয়।"
ঐন্দ্রী এই প্রথম জিষ্ণুর দিকে মুখ তুলে চোখে চোখ রেখে তাকালো। দুই জোড়া চোখ এক হয়ে যায়। অনেক সময় শুভদৃষ্টি ছাড়াও চোখদুটো দুজনের ভাষা খোঁজে। মাঝের সময়টাএকটা বড় ব্যবধানের মরীচিকা মনে হল। কি ক্লান্ত চোখ দুটো ঐন্দ্রীর। কেন এত শ্রান্ত লাগছে ভাবে জিষ্ণু। ঐন্দ্রী চিন্তা করে জিষ্ণুর চোখদুটো যেন যুদ্ধে পরাজিত অথচ অভিযোজিত দুই নয়ন যেখানে এর আগে শুধুই ভালোবাসা দেখেছে ঐন্দ্রী। নীরবতা ভাঙে ঐন্দ্রী ই। ..."কোন উপায় ছিলোনা জিষ্ণু। বাবাকে তো তুমি জানো। বাবার অমতে গিয়ে আমার বিয়ে করা সম্ভব ছিল না। তোমায় কষ্ট দিতে চাইনি আমি। এত তাড়াতাড়িই সব হয়ে যাচ্ছিল শেষ অব্দি আর আটকাতে পারিনি।"
জিষ্ণু যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। লুফে নিল ঐন্দ্রীর কথাটা।"কোন কষ্টের কথা বলছো তুমি? হ্যাঁ তুমি চলে গেছিলে। লড়াইটা আমার একার ছিল। ইউনিভার্সিটি থেকে গোটা শহর যেখানে দুজন মিলে হেঁটে বেড়াতাম আনাচে কানাচে, সেখানে আমাকে একা হাঁটতে বেগ পেতে হয়েছে বৈকি। আরো কষ্ট হতো এই ক্যাম্পাসে এলে। রতন দার দোকানে আজো ইচ্ছে করছিল ডানদিকে জানালার পাশের টেবিলটাতে বসি তুমি আমি। যখন তোমাকে খুব প্রয়োজন ছিল ঠিক তখনই একা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছিলে তুমি , কোনো ধারনা আছে সেই কষ্টটা কেমন?"
জিষ্ণুর আরো বলতে ইচ্ছে হলো উর্মি মানে ওর সদ্যবিবাহিত বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শুধু ঐন্দ্রী কে খুঁজে গেছে নিয়ত প্রতিনিয়ত। ভেতরে সব ক্ষোভ উগরাতে না পেরে মুখ ফিরিয়ে নেয় জিষ্ণু।
ঐন্দ্রী এতোক্ষন চুপ করে থাকে। আস্তে আস্তে উত্তর দেয়,"তুমি কি ভাবো জিষ্ণু? দিব্যি সংসার করছি আমি? আজো ক্যাম্পাসটা আমাকে ডাকে, সাত বছরের এই দূরত্ব টা মুছে গেছে মন থেকে? ফেরার কোন উপায় নেই আমার, কারোর কারোর জায়গাটা নির্দিষ্টভাবে তারই হয়ে যায় জিষ্ণু। কেউই সেই জায়গা নিতে পারে না। একলা বসে থাকি পিছু টান মারে পুরনো স্মৃতি।."..... একটু থেমে যোগ করে,"অভিযোগ যত করা হয় মাঝের দূরত্বের ফাঁকটার দৈর্ঘ্য বাড়ে বৈ কমে না"
জিষ্ণু মাথা নামায়.... নিজের মনে বলে,"এই ক'বছরে যে অনেক কথা জমে আছে তার কি হবে?"
অকারনে কেন যে এত চোখে জল আসে আজ ঐন্দ্রীর। অন্য দিকে তাকায় সে..."আসলে কথাটা অনুভূতির মত। দুটোরই তো মৃত্যু নেই.... আসলে মৃত্যু হয় না। অভিমান ,রাগ ,অভিযোগ, জোর করে চেপে রাখতে। হৃদয় খুঁড়লে সময়-সুযোগমতো বেরিয়ে আসে নিজের থেকেই।"
দুজনেই চুপ করে থাকে মুখোমুখি। টোটো চলে আসে। ঐন্দ্রী উঠে পড়ে। আবার ছেড়ে চলে যেতে হয়। "আসি জিষ্ণু। তোমার ফোন নম্বরটা মেসেঞ্জারে পাঠিও। তোমাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে তো আমি নেই।"
"তুমি তো এখনো আমায় একসেপ্ট করোনি?"
"এবার করে নেব।"আলতো হেসে উত্তর দেয় ঐন্দ্রী। চোখ দুটো ভারী হয়ে আসে। জল জমে কোনে।
জিষ্ণু তাকিয়ে থাকে নীল শাড়ি পরিহিতা ঐন্দ্রীর দিকে। ঐন্দ্রী কে জিষ্ণু নীলা বলে ডাকত। তার জন্যেই কি আজ ও নীল শাড়ি পড়েছিল? সে ও পড়েছে মনে করে ঐন্দ্রীর পছন্দের সাদা শার্ট ব্লু জিন্স। যতদূর দেখা যায় জিষ্ণু তাকিয়ে থাকে।
ঐন্দ্রী টোটোয় বসে ফোনটা বার করে। প্রায় তিন চার মাস আগের যে রিকুয়েস্ট টা ইগনোর করে ফেলে রেখেছিল আবার রিমুভ ও করতে পারেনি তাকে খুঁজে খুঁজে বার করে কনফার্ম করে দিল। মনের ভিতরটা হালকা লাগছে বড্ড। নিজের প্রতি নিজেকে দোষারোপের যেখচখচানি তা থেকে মুক্তি পাওয়া গেল। জিষ্ণুর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চলে যাওয়াটা যে নীরব ভাবে মেনে নিয়েছিল জিষ্ণু ,সেটা খোঁচা মারত বড্ড। জিষ্ণুর কাছ থেকে কথাগুলো শুনে মনের ,ভারী গুমোট ভাবটা কেটে গেছে। অন্য কিছু নয় জিষ্ণু থাক মনের বন্ধু হয়ে। এমন বন্ধুত্ব তো সবার জোটে না। জিষ্ণু ওকে বুঝবে ওর মত করে। উল্টোদিকে ও তাই। এইটুকু গণ্ডীর মধ্যে সম্পর্কটা বাধা থাক। তাহলে তাদের সাথে জড়িত মানুষগুলো ভালো থাকবে। ভালো রাখতে হবে তাদেরই।
স্টেশন চলে এলো। হাতের কব্জি উল্টে সময় দেখল ঐন্দ্রী। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে। ফোনে টুং করে মেসেঞ্জারে দশডিজিটের নম্বর আসে জিষ্ণুর। সঙ্গে ছোট্ট মেসেজ,"শুধু বন্ধুত্ব টুকু থাক, ভালো থেকো ঐন্দ্রী।"
সাহিত্যিক সৌমী গুপ্ত
১৬২, রাইফেল ক্লাব রোড, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ