অনিন্দ্য পালের অণুগল্প


বেস্ট টিচার

"বাবা, তোমার কোন সাবজেক্টটা সবচেয়ে ভালো লাগতো? " মেয়ে পদ্মার প্রশ্নে অঞ্জন একটু হেসে বললেন জীবন বিজ্ঞান। পদ্মা একটা কে.জি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। বাবার কাছে পড়তে বসে তার হাজারো প্রশ্ন। অঞ্জন হাসি মুখে সব প্রশ্নের উত্তর দেন। "বাবা, তুমি কখনো বকা খেয়েছ? কখনো হেড-ডাউন হয়েছ? জানোতো সেদিন আমি পায়েলের সঙ্গে চুপি চুপি গল্প করছিলাম, আর ম্যাথ স্যার আমাকে হেড-ডাউন করে দিয়েছে। " মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে যায় পদ্মার। অঞ্জন হেসে বলেন, " তাই নাকি, তবে আর কখনো ক্লাসে গল্প করো না। "হঠাৎ অঞ্জনের চোখে ভেসে ওঠে ছোট বেলার সেই দিনটার কথা। 
ছোট্ট অঞ্জন তখন ক্লাস এইটে পড়ে। পড়াশুনো একেবারেই করে না। রোজ মায়ের পিটুনি আর বাবার বকাবকিই সার। যদিও ফেল করেনি কখনো। ক্লাসের শেষ বেঞ্চে বসে শ্যাম দাস আর টাকির সঙ্গে গল্প করেই কেটে যেত, পড়া শোনা আর হত না। কিন্তু সেদিন হঠাৎ করেই জীবন বিজ্ঞান ক্লাসে পার্থ স্যারের বদলে এলেন মাইতি স্যার। ভাজক কলা পড়ানো শুরু করলেন। ব্লাকবোর্ডে ছবি আঁকছিলেন। অঞ্জন যথারীতি গল্পে মশগুল হয়ে পড়লো। হঠাৎ স্যার পিছন ফিরে তাকেই ডাকলেন, " এদিকে উঠে এস তো তুমি। নাম কি তোমার? "                                  বোর্ডের কাছে এল অঞ্জন। ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করছিল সেদিন। কিন্তু অবাক হয়ে গেল, যখন স্যার তাকে কিছু না বলে, একটা জীবন বিজ্ঞান বই তার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, "তুমি একটু ভাজক কলাটা শুরু থেকে রিডিং পড়ে যাও তো।"                            পা কাঁপছিল তখন অঞ্জনের। এরকম শাস্তি সে কোনদিন পায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও বেশ ভালো করেই রিডিং পড়লো। তার পড়া হয়ে গেলে স্যার তাকে বোর্ডের ছবিটাতে ছড়ি দিয়ে সমস্ত কিছু বুঝিয়ে দিলেন। আর এর পরেই অপেক্ষা করছিল সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা। স্যার এবার সমস্ত ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বললেন, "তোমরা তো খুব ভালো স্টুডেন্ট! এতক্ষণ খুব সুন্দর মনোযোগ দিয়ে শুনলে সব কিছু। কিন্তু দেখ, আমি এত ভালো বোঝাতে পারতাম না, যদি না অঞ্জন এত ভালো করে রিডিংটা পড়তো। তোমাদের আজকের ক্লাসের ক্রেডিট আমি অঞ্জনকে দিলাম। ওর জন্য একবার সবাই হাততালি দাও তো, তবে একটু আস্তে। "স্যারের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ক্লাস সেদিন ফেটে পড়েছিল হাততালিতে। আর অঞ্জন। তার দুচোখ  থেকে গড়িয়ে নেমেছিল আনন্দ। তারপর আমূল বদলে গেল অঞ্জন। পাড়ার মাঠে নিখোঁজ হয়ে পড়ার টেবিলেই কেটে গেল বাকি সময়। আর স্কুলে বি সেকশন থেকে মাঝে মাঝেই চলে যেত এ সেকশনে মাইতি স্যারের ক্লাস করতে। 

"বাবা, তোমার বেস্ট টিচার কে ছিল? বলনা, চুপ করে আছ কেন? বলনা? "পদ্মা বায়না জুড়েছে, অঞ্জন খেয়াল করেননি, স্মৃতিতে ডুবে ছিলেন। একটু হেসে বললেন, "আমার বেস্ট টিচার! তাকে তুমি চিনবে না মা। " পদ্মা নাছোড়, "বলো না, বলো না, বাবা। 
"অঞ্জন মেয়ের মাথায় একটা হাত রেখে বললেন, " আমার বেস্ট টিচার ছিলেন শ্রী নিতাই মাইতি, আমরা ওনাকে ডাকতাম মাইতি স্যার বলে। " 
---কি গো বেরোবে না আজ?  
চম্পা ঘরে ঢুকতেই পদ্মা লাফিয়ে মার কোলে, "জানোতো মা বাবার ও বেস্ট টিচার ছিল!মাইতি স্যার।"
মেয়েকে একটু আদর করে চম্পা বলে, " ন'টা বাজে তো, স্কুলের দেরি হয়ে যাবে যে!" নাহ, আজ আর স্কুলে যাবো না। আজ আমরা সবাই একটা মন্দিরে যাবো। 
--মন্দিরে? সে কি, কোন মন্দিরে? কই আগে তো বলোনি! চম্পা অবাক হয়। 
অঞ্জন একটু হেসে বলে, "এই তো এখুনি পদ্মা আমাকে  মনে করালো, সেই ঠাকুরের কথা, চল আজ আমার ঈশ্বর কে দেখে আসি।"
অঞ্জন মনে মনে একবার মাইতি স্যার কে প্রণাম করে নেয়। 

     সাহিত্যিক অনিন্দ্য পাল               জাফরপুর, চম্পাহাটি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা 



















0 Comments