হৃদস্পন্দন

  • Home


  • Download

  • Social

  • Feature


জমানো যন্ত্রণা গুলো উড়িয়ে

হেমন্তের মেঘের সাথে 
জমানো যন্ত্রণা গুলো উড়িয়ে দিলাম 
অনেক দিন পর আমার প্রাইমারি স্কুলের
পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি তিনটে চপের দোকান আর দুটি মুদিখানা 

ওই মুদির দোকান থেকে কাঠপেন্সিল  কিনে
নিখিলের ছবি আঁকতাম 

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি 
সোয়া দশটা বেজে গেছে 

একে একে শিশু ছাত্র স্কুলে ঢুকছে 

মনে পড়ে যায় 
সেই ছোটবেলার পিঠে
বেতের সে কি মার 

এই ভাসমান ছবি গুলি 
আমার জমানো যন্ত্রণা গুলো উড়িয়ে দিল 
প্রকান্ড বটের সবুজ রঙের দিকে

কবি বর্ণজিৎ বর্মন 
গোসানিমারি, কোচবিহার, পশ্চিমবঙ্গ





স্মৃতি 

সব স্মৃতিই  আকাশে-বাতাসে-অবকাশে ফ্যাকাশে বীজাণুর মতো  উড়ে বেড়ায়। তার ডানা থেকে নিয়ত বাবলা আঠা নিঃসরণ।

স্মৃতির খুচরো সঙ্কট নেই। ছোটো এক টাকার কয়েনও পর্যাপ্ত।

স্মৃতি আলোচালের মতো গন্ধবিধুর। যে-গন্ধে প্রতিটি  মধ্যরাত্রি পৃথুল।

কৈশোর-স্মৃতির রেখাচিত্র চলনবিলের নৈর্ঋত কোণে পা ছড়িয়ে বসে থাকে।

মৃত্যুর পাখায় স্মৃতির রামধনু- আলোয় জীবনের মায়াঘোর মঞ্চস্থ হয়।

সজল স্মৃতি শিশিরের পাপ ধুয়ে দেয়।

কবি সুজিত রেজ
                        চুঁচুড়া, হুগলি, পশ্চিমবঙ্গ












                  হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন
জমকালো রবিবার ৫
প্রথম বর্ষ ~ নবম সংখ্যা

সূচিপত্র:

কবিতা:
জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ॥ নিমাই জানা ॥ শুভ্রাশ্রী মাইতি ॥ জয়ন্ত মিশ্র ॥ অভিনন্দন মাইতি ॥ ড: করণ দেবদ্যুতি ॥ চন্দন বিশ্বাস ॥ লক্ষ্মণ দাস ঠাকুরা ॥ পলাশ পোড়েল ॥ পার্থ সারথি চক্রবর্তী ॥ বৃন্দাবন নস্কর ॥ বিশ্বদীপ ঘোষ॥

গল্প:
সমাজ বসু ॥ শৈবাল মুখোপাধ্যায় ॥ সৌমী গুপ্ত ॥ বিকাশ বর ॥ দীপক বেরা ॥ সুকুমার হালদার ॥ অনিন্দ্য পাল ॥ স্বাতী রায় ॥ শুক্লা মুখার্জি ॥ সুমিত রায় ॥ অনুরঞ্জনা ঘোষনাথ ॥

মুক্তগদ্য: অনিন্দ্য দত্ত ॥ অন্তরা দাঁ

প্রবন্ধ: বারিদ বরন গুপ্ত

স্মৃতি আলেখ্য: বিকাশরঞ্জন হালদার 


সম্পাদক কথা:

বহমান যা কিছু তাদের কথা কেউ মনে রাখে না। কৃষক রা অনেকটা সেই বহমান নদীর মত,যারা  অনন্তকাল ধরে বয়ে চলে শুধু আমাদের জন্য অথচ অবহেলিত ই থেকে যায় চিরটাকাল। তাদের জন্য বরাদ্দ থাকেনা কোনো বিশেষ দিন,সিনেমার ট্রাজিক চরিত্রের মত শুধু শেষ দৃশ্যে তাদের জন্য চোখের জল পড়ে।

তাদের জন্য গল্প ও কবিতায় কী কোনো উৎসর্গ পৃষ্ঠা থাকে ? যেটুকু থাকে তাদের জন্য তাতে প্রকাশ্য নয় কিছুই,শুধুই নিরাপদ দুরত্ব থেকে একটু ছুঁয়ে থাকা। তাদের বরাদ থেকে শুধু কিছু কাঁচা সড়ক শহরের দিকে ছুটে যায়।ব্যাস,এই টুকুই শুধু তাদের জন্য ! 

কিন্তু গল্পটা অন্যরকম তো হতে ই পারতো। যাদের পরিশ্রমের জন্য আমাদের সভ্যতার বুনিয়াদ দাঁড়িয়ে আছে,যারা প্রকৃত অর্থেই আমাদের অন্নদাতা তাদের  জন্য অন্যরকম চিত্রনাট্য তো লেখা হতে ই পারতো? কিন্তু সব চিত্রনাট্য প্রকাশক পায় না আর কৃষকরা পায় শুধু ঐচ্ছিক সমবেদনা। 

দু'একটা গুছিয়ে লেখা শব্দ দিয়ে আমরা আর 
কাঁহাতক কিছু বদলাতে পারি! সেই তো আবার মোমবাতি মিছিলে আরো একটা কৃষক মৃত্যুর শিরোনাম! 
তবু ভাল থাকুক সব কৃষক সম্প্রদায়।আপনাদের ভালথাকা তেই যে আজ ও আমাদের উদর টিকে আছে। 

পরিশেষে ধন্যবাদ সকল লেখকবৃন্দ কে যাদের অবদান ছাড়া আমাদের এই ছোট্ট অথচ ঐকান্তিক প্রচেষ্টার বাস্তবায়ন সম্ভবপর ছিলনা। ভাল থাকুন আপনারা, সাহিত্যে থাকুন।বুকের কোনো এক কোণে 'হৃদস্পন্দন' কে রাখুন। 
















নবান্নের স্বাদ 

কলের ধোঁয়া ওঠা বন্ধ হলে পায়ে পায়ে
ফিরেছিল সেই বিঘৎ ভূমির কাছে।
দীর্ঘ অভিমানে জমা জঞ্জাল ভেঙে বুকে
শুয়ে থাকে চিৎ হয়ে,সবুজ হয়
আশালতা সাবেক শিকড়ের তাপে।

হেমন্তের মধ্যাহ্নে নবান্নের স্বাদ দিতে
ঘন শ্রাবণে কাম জ্বরে সিক্ত হলে মাটি 
সন্তানের অন্নপাত্র বন্ধক রেখে
গিয়েছিল বীজ হাতে গর্ভ সাজাতে। 

অনাহারের লম্বা ফিতেয় প্রতিদিন 
জরিপ করে বৃদ্ধি,সোনা রোদে দেখে
বুকের সবুজ শিরায় জমা দুধ,আলপথে
শিশির ভেজা ঘাস ফড়িংয়ের নাচ। 

একদিন বাতাসে ওত পাতা বিষ ঢুকে যায়
নিরাপদ বুকে। 

সোনালী শস্য ঝরে অনাদরে।

হিমেল দুপুরে শ্বেত বস্ত্রে সন্তান নেয়
সবুজ পাতায় অর্পিত নবান্নের ঘ্রাণ। 

কবি জয়ন্ত মিশ্র 
খিলা, উদয়নারায়ণপুর, হাওড়া 

















 


 
উর্বর সঙ্গের মাঠে

উর্বর মাটি ভাঙছে বলরাম চাষী
কাজল চোখে আলপথে ঘুমিয়ে পড়ছে সীতা
সারি সারি দুঃখগুলো পোঁতা আছে
জীবনের বক্ররেখায়

শিশুর আদর্শ লিপি স্বরবর্ণ লিখছে
মলাট ছেঁড়া বর্ণপরিচয়ের নিরক্ষর পুরুষ
উদোম গায়ে মাত্রাহীন ভিজে যাচ্ছে
অনুর্বর উদ্ভিদের তলায় কাদামাটি মেখে
দাঁড়িয়ে আছে জৈব উঠোনে

নীল রঙের বিপ্লব এখন
নবান্ন শাড়ি পরে দাঁড়িয়েছে কাক
লাল জবা ফুল ভাতের থালার কাঁকর
ভেজে খাচ্ছে রেপসিড তেলে

শ্রীহীন তুমি যক্ষার পাঁজর
কালকেতুর শান্তি নেমে আসছে সারিগানে
রাতের বেলায় ভাগচাষী একা কীটনাশকের বাগানে
পায়ের তলায় চন্দ্রবোড়া ঘুরে বেড়ায়

গর্ভবতী ধানের মতো নারী ও গর্ভবতী হয়
মাথার কাছে অলীক স্বপ্ন নিঃশব্দে ঘুমায়
গুগল আলপথে সহজ সাম্রাজ্য শুয়ে আছে
মাটির তলায় কি প্রকারের উর্বরতা

ক্রমশ , হাড়ের গুঁড়ো ক্ষয়ে যেতে থাকে
পুরুষানুক্রমিক চাষজীবনে
কষ্ট কথা মানেই মাঠের গোপন কালাজ্বর  

কবি নিমাই জানা
রুইনান, সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর













পোস্টমর্টেম 

নিখোঁজ ভাগচাষী ডহর কিস্কু'র ডেডবডি পাওয়া গেল স্বেদসিক্ত ক্ষেতের কাদায়!

রাষ্ট্র বললো--"সুইসাইড"।
বিরোধীরা বলল--"অপুষ্টি"।

নামজাদা সংবাদপত্রগুলো কোন্ অভিনেতা বিগত সাতদিন ধরে কোষ্ঠকাঠিন‍্যের সমস্যায় ভুগছেন--সেই দিকে নজর ঘোরালো!

আমার বাবা ডহর কিস্কু যাঁর কষ বেয়ে এখনো জেগে আছে গরলের নীল গ‍্যাজলা--
তাঁর ডেথ সার্টিফিকেট আজ বাতাসের বুক পকেটে টাঙিয়ে দিয়ে যাবো।

অপরিমেয় ঋণের কালাপাহাড় বাবা উপড়েছেন ফলিডল চুমুকে।

সান্ধ‍্য টেবিলে পন্ডিতরা তুলেছে চায়ের কাপে তুফান,
অন্ধ দর্শকরা দেখছে।

কীর্ণ বাতাসের কন্ঠে 
বিষের গোঙানি বেজেই চলে...

কবি অভিনন্দন মাইতি 
লুটুনিয়া, সবং, পশ্চিম মেদিনীপুর 






























দাঁড়কাক 

তারক হালুই আর তার স্ত্রী নয়নতারা,ছেলেকে নিয়ে মহা দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। পুজোর ছুটিতে বাড়িতে আসার পর থেকেই ছেলেটা কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে। কিছু বললেই ঝাঁঝিয়ে উত্তর দেয়। কি হয়েছে কে জানে? কিছু ত বলছেও না। কারণ জানতে চাইলে ওই এক হুঙ্কার,তোমরা চুপ করো,আমাকে একা থাকতে দাও। আমার কোন ব্যাপারে তোমাদের নাক গলাতে হবে না। নিজেদের চরকায় তেল দাও। সন্তানের কথা মা বাবা ভাববে নাতো কে ভাববে? অথচ বাংলা নতুন বছরে সাতদিনের ছুটিও বেশ হৈ হৈ করে কাটিয়ে গেছে ছেলেটা। কিন্তু এবার কি হয়েছে কে জানে? 
         
প্রায় দশটা বাজতে চললো,বাবু এখনও বিছানায়। মানুষটা সেই কোন্ ভোরে চাষের কাজে বেরিয়েছে। যাবার সময় বলে গেছে, কোন অশান্তি কোর না। এই তো আর ক'দিন পরেই ছেলেটা শহরে ফিরবে। কিন্তু মায়ের মন কি আর মানে? দিনের পর দিন ছেলে যদি এইভাবে মনমরা হয়ে পড়ে থাকে,সেকি ভাল লাগে?
      
--- বিজু,এবার উঠে পড় বাবা। একটু চা খেয়ে বই নিয়ে বোস। এবারে তো একদিনও বইয়ের পাতা খুলতে দেখলাম না। নয়নতারা ছেলের পড়ার টেবিলখানা গোছাতে গোছাতে বললেন।
         
মায়ের কথায় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল বিজু।
---আমার লেখাপড়ার কথা তোমার না ভাবলেও চলবে। আমায় বিরক্ত কোর না।   

---তুই এইভাবে কেন বলছিস? তোর কি হয়েছে বল তো? কলকাতার হোস্টেলে কি কারো সাথে কোন গন্ডগোল হয়েছে? আমায় বল।

---তুমি জেনে কি করবে শুনি। আমার কিছু হয়নি। এখন তুমি যাও। ছেলের মেজাজের পারদ আরো চড়তে পারে ভেবে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন নয়নতারা।

---বিজন হালুই তুমি ফার্স্ট টার্মে কোন সাবজেক্টেই পাশ করতে পারোনি। পুজোর ছুটির এক মাস পরে সেকেন্ড টার্ম। তোমাকে অনেক খাটতে হবে।

---স্যার,বলছিলাম পেপারগুলো বাংলায় লেখা যায় না? ইংরেজি লেকচার আমি একেবারেই ফলো করতে পারি না।

---না,বাংলায় উত্তর লেখা চলবে না। তাছাড়া তুমি তো ইংরেজিতে ফর্ম ফিলাপ করেছিলে। যদিও পদবীর বানানটা ভুল লিখেছিলে।
       
প্রিন্সিপ্যালের রুম থেকে বেরনো মাত্রই বিজন হালুইকে ক্লাসের সবার তির্যক কথায় বিদ্ধ হতে হয়েছে। গ্রামের ছেলে,তাই প্রতি পদে হেনস্থা ছাড়া কিছুই জোটেনি। 
      
বাবার দু বিঘার জমি বেচার টাকায় জোর করে শহরে পড়তে যাওয়া ভুল ছিল। গ্রামের পড়াশোনাটাই ঠিকমত হয়নি। ইংরেজির ই শেখা হয়নি তার। মাটি তো মায়ের আর এক রূপ। এই মাটিই তাকে জীবন দেবে।
      
---কিরে,এত সকালে উঠে পড়লি? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন নয়নতারা।
     
--- আমাকে এই গ্রামেই থাকতে হবে। এখানে অনেক কাজ,যা বাবা এই বয়সে একা করে উঠতে পারে না। অঘ্রাণ মাস পড়ল,আলুচাষের মরশুম। আরো মাসখানেক আগে আসতে পারলে, দু দফা জমিচাষে বাবার কিছুটা সাহায্য হত। 
    
---কিন্তু তুই কলেজের লেখাপড়া ছেড়ে চাষবাস করবি? তোর কি হল,বলতো?
     
---না,চারপুরুষের পেশাকে অসম্মান করে শিক্ষিত হতে চেয়ে আমি ভুল করেছি মা। তাছাড়া গ্রামের মাস্টারমশাইদের আমি ফাঁকি দিয়েছি। কিছুই শেখা হয়নি।এই বিদ্যায় শহর আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে। কিন্তু আমার জন্মভূমি,গাঁয়ের মাটি বুকে টেনে নেবে। যে চাষের জমি আমাদের বাঁচিয়ে রাখে,বাবা হাসি মুখে সেই জমি বেচেছে। আমিই তাকে বাধ্য করেছি। আর সেই টাকায় কিছু পালক কিনে আমার ময়ূর সাজার শখ হয়েছিল। ভুলে গিয়েছিলাম আমি দাঁড়কাক। আমাকে চিনতে পেরে শহরের মানুষ ঠুকরে ঠুকরে বলে দিয়েছে,আমি কে?আমি এখন থেকে রোজ বাবার সঙ্গে মাঠে যাবো। আলুর বীজ ছড়ানোর কাজ সবে শুরু হয়েছে।এরপর চাষ। অমানুষিক পরিশ্রম। বাবাকে সেইসময় আমি বিশ্রাম দেব। 
তারক হালুই হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন। 
     
---তোর বাবা এখনও আগের মতই খাটতে পারে। তবে বছর তিনেক পরে আবার চন্দ্রমুখী লাগাচ্ছি বুঝলি বিজু। সে তো আবার ফুলবাবু,আদরযত্ন একটু বেশিই চায়। সাত দিন অন্তর তার দেখভাল করা চাই। নইলে তার গোঁসা হয়। বাবার কথায় বিজু হো হো করে হাসতে থাকে।
     
---ঠিক আছে,ওই সাতদিন অন্তর আমি একা যাব। তুমি দেখে নিও মা, এইবার বাবা আর ছেলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিঘে প্রতি ষাট থেকে সত্তর বস্তা আলুর ফসল ফলাবই। সব্বাইকে তাক লাগিয়ে দেব।
    
---নে,এবার চল দেখি। বেলা কিন্তু গড়াচ্ছে। ছেলের একটা হাত পরম মমতা আর ভরসায় ধরে ফেলেন তারক হালুই।
          
দুটো মানুষ পায়ে পা মিলিয়ে জমির দিকে এগিয়ে চলেছে। নয়নতারা চোখ মেলে দেখেন,সূর্যের আলো যেন নতুন করে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। অঘ্রাণের নরম উষ্ণতা জড়িয়ে পথের দুধারে গাছগুলো তারই মত চেয়ে আছে দুই আত্মজনের দিকে।

  সাহিত্যিক সমাজ বসু 
 মিলন পার্ক, গড়িয়া, কলকাতা
















ফসলের ঘ্রাণ 

(১)

বেলাশেষের রোদ্দুর টা তখনও পুরোপুরি নিভে যায় নি।সোনালী আলোর টুকরো টুকরো কালি ছড়িয়ে পড়েছে মেঘের আস্তরণে।মেঠো রাস্তার দু'ধারে আল বেয়ে যে পথ সবুজ গালিচায় পা ফেলে চলে গেছে দিকচক্রবালের শেষের কিনারে ঠিক সেইখানে দুটো খেজুর গাছের ফাঁকে সোনার মত সূর্য পশ্চিমে দুয়ারের গন্তব্যে পা বাড়িয়েছে।পুজোর পর এই সময়টায় হিম হিম হাওয়ায় ঝরা পাতাগুলো ধুলোর সাথে উড়তে থাকে দু-একটা। আমন ধানের পাকা রং ধরেছে ফসলে— শিশির মাখে সারারাত্তির জুড়ে। শেষবেলার মৃদু আলোয় ধানের শীষ গুলো নিয়ে পড়ে ফসলের ভারে। গোধুলীর রঙ আর ফসলের রঙ মিলে  মিশেএকাকার। সুবল শ‍্যালো  ঘরের একদম উপরে উঠে জলে হাত পা ধুয়ে নিল। পলাশ পুর গ্রামের এদিকটায় কয়েক বিঘা জমি। তবে একদম মেইন রাস্তার কাছে। গ্রামের একটু বাইরের দিকে। জমির পেরিয়ে গেলেও ওপাশে ময়ূরাক্ষী নদী।বানের সময় সাদা সাদা বালি গ্রাস করে নেয় ওপারের জমির সন্তানসম্ভবা জরায়ু। তবুও অনেক কায়িক পরিশ্রমে সেই বালি তুলে চাষের উপযোগী করে লাগানো হয় তরমুজ, শসা,খেরো এইসব বালি মাটির ফসল। যতটুকু পাওয়া যায় চাষ নির্ভর পরিবারের ততটুকুই লাভ। আলের দুপাশে হেলেঞ্চা কলমি আপনাআপনি মাথা নাড়ে। সুবল মাঝে মাঝে বাড়ি যাবার পথে তুলে নিয়ে যায়। টাটকা ক্ষেতের শাকের স্বাদ অমৃত সমান। সুবল আঁজলা করে জল দিয়ে কুলকুচি করল দু একবার। এদিকের জমিটা বেশ ফলবতী। বছর বছর আমন চাষ হয়। এখন আর নিজেদের জমির দায়িত্ব নিজেরা কেউ হেফাজতে রাখতে চায় না। ঝক্কি তো কম নয়। সারাবছর জমিকে সন্তানের মত লালন করা,পরিচর্যা করা, যত্ন করা পাহারা দেওয়া এবং তারপর সেই ধান ঘরে তুলে ঘর থেকে চাষী আর চাষী বউ মিলে সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে আলাদা করা। মাথায় তাদের গামছা পাগড়ির মতো বাধা কোমরে গাছকোমর করে শাড়ি শক্ত করে আঁটা। শীতের রুক্ষ হাওয়ায় ধান পাঁচরাতে গিয়ে চামড়া ফেটে যায়। সারাদিন সেই ধান একত্র করে তারপর বাড়তি ধান গোলায় ভরে রাখা— সারা বছরের খাদ্যের রসদ। এত ঝামেলার জন্য মালিকপক্ষ বর্গাদার রাখে। যা ধান পাবে অর্ধেক অর্ধেক—সোজা হিসাব। সারাবছর জমির দেখাশোনা কীটনাশক সার এসব খরচ জমির মালিকের।তবে অনেক সময় যে দুপক্ষই বেইমানি করেনা তা নয়।ছেড়ে না দিয়েও উপায় নেই। তাতে খুব একটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয় চাষী পরিবারের —যেমন সুবল দের। পোলাও,বিরিয়ানি না হলেও পুকুরের মাছ টা ,জমির শাক-সবজি দিয়ে বেশ চলে যায় সুবল দের। সুবল চোখ মেলে তাকিয়ে দেখল যতদূর দেখা যায় অনন্ত জমি বরাবর ফসলের পাকা রং ধরেছে। সাঁঝ নেমে আসছে। কাঁচা মাটির সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলো সুবল। পিছন থেকে বাঁকা চিৎকার করে ডাকছিল,"উটো কে বটেক সুবল নাকি ?ঘরকে যাবিক লাই?"

সুবল কাদের গামছা দিয়ে কপালের জল মুছে বলল,"ঘরটোতেই যেছি বাঁকাদা,তু এদিকপানে? কুথাকে ছিলি?"

বাঁকার মুখে সরল হাসি,'চৌধুরীদের বাড়ীটোতে ছিলম। তুর বাপ ও আছে। শুনলম ই জমিন গুলাতে বড় টাউনশিপ হবেক,ইস্কুল খুলবেক,একটো হোটেল বানাইবেক,মুদের দুখের দিন শেষ সুবল।সবাইকে কাজ দিবেক।সে কুথাটোই হচিল।'

সুবল ভ্রু কুচকায়,'এসব কিসের লিগ্যে'

"তু জানিস লাই !! ই দেখো কেনে সকলে জানে।ইদিকের জমিটোতে পরের বছর আর চাষ টো হবেক লাই ।বড়কত্তা কইছিল শহর থেকে কুত্ত লোকটো আসবেক।দেখো কেনে গেরাম ইকেবারে পালটিন যাবেক।তার বদলটোতে আমাদের কাজ টো দিবেক। খাওয়া পড়াটোর কষ্ট টো আর থাকবেক লাই।"

সুবল শুনছিল বটে জমির দিকে কাজে গিয়ে সবার সাথে এ ধরনের কথা। তখন বিশেষ পাত্তা দেয়নি। এখানে এসে দেখল একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। ঈষৎ বিরক্তি প্রকাশ করে সুবল,"তুদের মাথাটো ইকেবারে গেছে রে ‌।তুদের লেগেই জমিটোও খোয়াইব,কাজটোও পাবক লাই।ইকটো কথা ভেবেছিস ? শহরের বাবু গুলান হোটেল টো করবেক,টাউনশিপ করবেক আমাদিগের কাজটো হোথায় কুথাকে? পড়াটো,লিখাটো তো জানিস লাই! টাকাটো দিবেক বললেই হল! সারাটো বছর তারপর টোতে কি আঙুল টো চুষবিক?'

বাঁকা যেন নিভে যায়,"উরা যে কইছিল!অনেক লুক লেবে।তা হলে টাকা টো পাব না মুরা?"

সুবল চারিদিক দেখে নেয় তারপর নিচু স্বরে বলে,"ইটো উদের একটো চাল ! কিছু টাকা ধর‍্যে দিবেক।যাতে মালিকদের জমিটো বিক্রির সময় টোতে ঝামেলাটো না বাধাইতে পারি। তারপর কাজ টো মিটে যাবেক।আমাদের ঘরে লা খ‍্যেতে পেয়ে মরতে টো হব‍্যেক।'

চোখ বড় বড় হয়ে যায় বাঁকার,"তাহলে উপায়!তুর বাপটো তো ছিল রে "

সুবল জ্বলে ওঠে,"মুর বাপটোর কথাটো শুনেই সন্দ হচ্ছে রে।'

মাথাটা হিসেব-নিকেশ করে চট জলদি। তারপর সুবল বলে,"তু যা ক‍্যানে বাঁকা দা।দেখছি সকলে মিলে কি করাটো যায়! ডাকলে আসিস কেনে।আমি ঘরটোতে যেছি একবার।তবে জমিটোতে কুনোমতে হাত দিতে দিবক লাই বাঁকা দা!"

বাঁকা একটু ভয় পায়,"সত‍্যিটো কইছিস সুবল?তুর বাপটো তুর ব‍্যবস্থাটো করে দিবেক তারপরটোতে পালটিন যাবেক লা তো? তু যা কইলি তা যদি সত‍্যি হয় তবে লা খেতে পেয়‍্যে মা বাপকে লিয়ে কুথাকে যাব!"

সুবল আশ্বাস দেয়,"চিন্তা টো করিস না বাঁকাদা।বেইমানি করবোক লা।বেঁচে টো থাকতে ই জমিতে ক্ষতি হতে দিবক লাই। নিশ্চিন্তে ঘরটোতে যাও কেনে।দরকার টো পড়লে বাপের উল্টোদিকে যেতে হবেক।"

সুবল হনহন করে হাঁটা লাগায় বাড়ির পথে। খিদে তে পেটে রাক্ষসের মত হা হা করছিল কিছুক্ষন আগে। বাঁকার মুখ থেকে কথাগুলো শোনার পর মাথায় রাগের আগুন সলতের অপেক্ষা করছিল।খিদেটা তখন মরে আসছে। হৈমন্তীর সন্ধ্যায় দ্রুতগতিতে হাঁটার দরুন সুবলের চিকন মসৃণ শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করে উঠল চোখ দুটোয় ক্ষিপ্র দৃষ্টি।

(২)

একনাগাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে। বাঁশ বাগানের কোণে জোনাকিদের টিম টিমে আলো। উঠোনের চারিপাশে সেদ্ধ ধানের গন্ধ। পরিপাটি করে নিকানো আধা সিমেন্টের বাঁধানো উঠোন একপাশে তুলসী মঞ্চ।মাটির প্রদীপ জ্বলছে সেখানে।আর এক পাশে আগুন জ্বলছে ঢিমেতালে আখায়। দু-একটা কাঠের টুকরো ঢুকিয়ে দিলো সুবলের মা দুলি। চাল ফোটার গন্ধ।  ফ‍্যান উপচে পড়ছে কালিমাখা হাড়ির দুপাশ থেকে।সুবলের খিদেটা আবার একবার ছোবল মারলো পেটের অভ্যন্তরে। হিমেল বাতাসে খোলা উনুনের ধোঁয়া মিশে যায়। বাতাসে খিদের গন্ধ বাড়ে। সুবল আনমনে ভাবে এ জমি যদি না থাকে তাহলে এই ফ্যানের গন্ধ পুরনো হয়ে যাবে। সেদ্ধ ধানের গন্ধ উঠোনের বুকে চাপা পড়ে যাবে চিরতরে।বড় দিদির বিয়ে হয়েছে এইতো দুটো মাস আগে চেয়েচিন্তে। সুবল জানে সংসারে জমানো টাকা প্রায় শূন্য।সেই কারণেই বাপ বুধো ছুটেছে চৌধুরীদের বাড়িতে।এখনো ফেরার নামটা পর্যন্ত নেই। কি পরিকল্পনার ছক করছে কে জানে। ছোটবোনটা বারান্দায় ছওয়াটের বাল্ব এর অন্ধকার আলোর ঘুমিয়ে পড়েছে। উস্কোখুস্কো চুল মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।হাতে পায়ে খড়ি ফুটেছে। গোটা দুপুর সোনাঝুরির জঙ্গলের ধানের শীষের গয়না ফসলের বীজ তৈরি মালা বিক্রি করে ক্লান্ত। অনতিদূরে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নীরব সাক্ষী সুবলের দাদুর ময়শা বসে আছে আঁকিবুকি রেখার মুখাবয়ব নিয়ে।চোখদুটি আধবোজা। রক্তবর্ণ— ঢুলছে। ক্রমাগত খিদে পেটে নিয়ে অপেক্ষা রত। চোখের কোনে পিচুটি কেটেছে। সুবলের বুকের ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। এই সবকিছু নিমেষে নিভু আলোর তলার অন্ধকার হয়ে যাবে জমিটুকু বাঁচাতে না পারলে। দিনের শেষে ভাতের থালার ধোঁয়া কলকারখানা বা হোটেলের নিষ্প্রাণ কালো কুণ্ডলী কৃত ধোঁয়ায় পরিণত হয়ে যাবে। আদিগন্ত বিস্তৃত জমির লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে কখনো আসবেনা নূপুর পায়ে চোরকাঁটা সরিয়ে। উঁচু উঁচু বিল্ডিংয়ের পাশে খেজুর গাছের ফাঁকে সোনালী থালা কচ্চিৎ কদাচিৎ উঁকি  মারবে। সোনার ফসল চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। ক্রমাগত চিন্তাগুলো উঁকি মারতে শরীরের রক্ত গরম হয়ে গেল সুবলের। জন্ম-জন্মান্তরের এই সুতোটুকু বাঁচাতে না পারলে ক্ষমা করতে পারবে না সে নিজেকে। সুবল বেরিয়ে গেল লন্ঠন হাতে চৌধুরীদের বাড়ীর দিকে।

চৌধুরীদের বাড়িতে যখন পৌঁছলো তখনো ওদের উঠোনের পাশে বড় বড় গাড়ি রাখা। কতগুলো চাপা স্বর ভেসে আসছে। সুবল কান খাড়া করে শোনে। আজ বাঁকা কেও আসার সময় এর সাথে নিয়ে এসেছে। আঙুলের ইশারায় বাঁকাকে চুপ করতে বলে সুবল। দুই ছায়ামূর্তি আধো আধো অন্ধকারে চুপিচুপি শুনতে থাকে ধূর্ত চৌধুরী ওরফে বড়কর্তার গলা,"বুঝলে বুধো দুটো লেঠেল পাঠিয়ে দেবো,ঠিক মাঝের জমিটায় বুঝলি?তাহলেই ছড়িয়ে পড়বে।কেরোসিন বেশী করে নিয়ে যাস। ইন্দ্র থাকবে কাছাকাছি আড়ংকে ডেকে নিবি, বেশী লোক জড়ো করার দরকার নেই,জমির মালিকদের আগে থেকেই জানানো আছে ,টাকার অঙ্ক শুনে সবাই চুপ মেরে গেছে!"

বুধোর গলা শোনা যায়,"হ কত্তা !ইকদম  চিন্তা টো করবেন লা।কাজটো ঠিক করে হয়‍্যে যাবেক।তা বাদে বিশ্বাস টো রাখবক।'

পাশ থেকে সুবল লক্ষ্য করে কোট প্যান্ট পরিহিত অচেনা ভদ্রলোক ঈষৎ সন্দেহ প্রকাশ করে,"আপনি কাজটা করতে পারবেন তো মানে জমিতে আগুন লাগালে আবার ওরা চাষ করতে পারবে না তো!'

কালো দাঁত বের করে বুধো খিকখিক করে হাসে,"কি যে কন বাবু,পোড়া জমি আর বাঁজা মেয়েছেলে সমান,পোলাপানের কুনো কথাটো লাই উদিকে জমিটোও তেমনটোই।ও জমি ইকবার পুড়াইলে ইখন চাষ তো দূরের কুথা আগাছা ও হবেক লাই।"

চা খাবার ছোট কাঁচের গ্লাসের সোনালী উৎকটগন্ধের তরলটা এক নিশ্বাসে শেষ করে বুধো।"ইখন উঠি কত্তা মশাই।মাঝরেতে জাগতে হবেক।কাজটো সহজ লয় ।সাবধানটোতে মাঝের জমিটোতে আগুনটো জ্বলাইতে হবেক।তারপরটো আপনি আশপাশের জমিগুলায় ছড়িন পরবেক।"

বড়কর্তা ঘোর লাগা চোখে হাত নাড়েন। বুধো একবার টালমাটাল পায়ে উঠে বলল," টাকাটা কত্তা?'

বড়কর্তা মুখ বেঁকিয়ে হাসেন,"তোমাদের ওই দোষ,কাজ না করেই টাকা চাও। এই মহেশ দশের দুটো বান্ডিল দে বাদবাকি টাকা শেষ হবার পর।" বুধোর চোখ দুটো চকচক করে ওঠে,"এজ্ঞে কত্তা সুবলের কাজটো হয়‍্যে যাবেক তো?"বড় কর্তা ও শহুরে বাবু চোখাচোখি করেন নজর এড়িয়ে।সুবলের মাথা ঝিমঝিম করে।বাঁকা ঢোঁক গেলে বেশ কয়েকবার। সুবলের গোটা শরীরে যেন কেউ বিষ মিশিয়ে দিয়েছে।এত জ্বালা করছে ।হাতের তালু,পায়ের চেটো ঘামে ভিজে সপসপ করছে।গলার কাছে ভয়ের চোরাস্রোত।দম বন্ধ করতে চাইছে যেন। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে আসছে শীতল শোণিত-ধারা। বাঁকা ফিসফিস করে বলে,"কি হবেক ইবার?"

সুবলের সম্বিৎ ফেরে,"কিছু হবেক লাই।ইখুনি ইকবার চল কেনে খং,আলি,মসদুর,নব ,রাখো ইদের কাছে।মাঝরাতে আজ ঘুমটো হবেক লাই বাঁকা দা।একটো রাত না জাগলে খেতিটো হতে দেরি টো লাই!"

চারিদিকে সুনসান।পরিষ্কার আকাশে তারাদের জোনাকিআলো।ময়ূরাক্ষী থেকে আসা  থেকে শিরশিরে হাওয়া ঠান্ডা করতে পারেনি ওদের হাত পা। জনা কুড়ি হবে কালো কালো মাথাগুলো মাঝে সোনালী ফসলের ক্ষেতের ধরে লুকিয়ে। অপেক্ষার প্রহর গুনছে সকলে।এক, দুই, তিন। হঠাৎ তিনচার জনের হাতে মশালের আগুন চাপাস্বরের উত্তেজনা।আর বুধোর টলমলো পায়ের আওয়াজ এর নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল। আর তখনই ক্ষিপ্রগতিতে বেরিয়ে এল মুখোমুখি কালো 'ঝাঁকড়া মাথা। বলিষ্ঠ শরীর চিকচিকে চোখের দৃষ্টি আর হই হই রব। বাঁকা কে পাশে নিয়ে সুবল এগিয়ে এলো একদম সামনে বুধোর মুখোমুখি,"ইখানে এতরেতে কিসের লেগ‍্যে?আগুনটো লাগাবি? দেখি তো লাগা কেনে!সবকটার মাথাটো নামাইন দিবক।ফসলের মাটিটোতে রক্তের বান বইবে আজ!বাপ বলে রেয়াত লাই ! কি বলিস নব ,খং!"

সবাই রে রে করে উঠলো। হাতে শাবল, কোদাল, ধারালো কাস্তে, লাঠি। লেঠেলের দল এগিয়ে যেতেই একেবারে বীরদর্পে ঝাঁপিয়ে পড়ল জনা কুড়ি ।লেঠেলের রক্তে ভিজে উঠলো মাটি।বুধো তখনও হাঁফাচ্ছে।সুবল এগিয়ে এসে গলার কাছে খামচে বলল,"জমি মুদের মায়ের সমান।মায়ের দিকে হাতটো বাড়াবিক কেট‍্যে লিব। ভেবেছিল জমি পুড়াইলে আর কুন উপায় দেখবো না মোরা।ছেড়েটো দিবক।উয়ারাও জমি বিচে দিবে ।বাপেরো বাপ থাকে রে বাপ!"

বুধো হতবুদ্ধির মত তাকিয়ে থাকে। রাতের শেষে পূবদিকের সোনালী আলো তখন আমন ধানের উপর স্পর্শ করেছে। আর কিছুক্ষণ কদিন পরেই পৌষের পাকা ফসলে উঠোন ভরে উঠবে।।

সাহিত্যিক সৌমী গুপ্ত
১৬২, রাইফেল ক্লাব রোড, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ




















গোলা 

ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল বেস্পতি। ছেলেটা এত রাগী হল কী করে?এইটুকু কথায় খাবার ফেলে উঠে গেল! 

পঞ্চা পান্তার গামলায় আর এক খাবলা নুন মিশিয়ে,এক কামড় পেঁয়াজ দিয়ে খাওয়া শুরু করলো। সেদিকে একটু তাকিয়ে বেস্পতির হঠাৎ শরীরটা জ্বালা দিয়ে উঠলো। বেশ ঝাঁঝিয়ে বললো, 
---গোলাটা না হয় দে দিলে ছাবালটারে। সেই তো পড়েই থাকে,চাষ তো আর হয় না আগের মত,যা হয় ওই ক'বস্তায় পুরে না হয় এই মেটে দাওয়ায় ফেলে রাখবো।ছেলে এখন সরকারী লোক,ওর তো একটা পাকা দালান থাকতি হবে। দে দাও,দে দাও। রোজ রোজ আর এই কুকুর কান্টাকান্টি ভালো লাগে না। 

---অ! 

পঞ্চা এইটুকু শব্দ করে আবার আগের মতই খেতে লাগলো। 

পান্তার আমানিটা চুমুক দিয়ে শেষ করে গামলাটা ঠেলে সরিয়ে দিল পঞ্চা। একটা ঢেকুর তুলে একটু চুপ করে বসে থাকলো। 

---ওই গোলায় শুধু কি ফসল থাকে? ওকেনে আমার বাপ-পিতমোর আত্মা শান্তিতে বাস করে।তিন পুরুষের গোলা। চাষ করেই তো চলে যাচ্ছিল,পড়াশুনা শিখে ছেলে বাবু হয়ে গেল।তা নয় হল,তা বলি আমার গোলাটা ভেঙেই ঘর করতি হবে? 

ঠিক তখুনি ঘর থেকে বের হয়ে এল পিলন। বাবার দিকে চোখ কুঁচকে চড়া সুরে বললো, 

"আমি তো তোমার ছেলে। আমার সুখটা তোমার কাছে কিছু না? আমার চেয়ে তোমার গোলাটা বড় হয়ে গেল!আমি চাকরি করি। আমাকে একটু ভালো থাকতে হবে তো,না কি? " 

পঞ্চা কয়েক সেকেন্ড পিলনের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর হঠাৎ উঠে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।কয়েক মুহুর্ত পর সেখান থেকে বেরিয়ে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বাম হাতের মুঠো খুলে রাখলো ছেলের সামনে। সেখানে একমুঠো সোনালী ধান। পিলন দেখলো তার বাবার চোখ দুটোতে জল চকচক করছে। 

---এটা আমার বড় ছেলে। তুই ছোট। এতদিন এই ছেলেই তো আমাদের খাইয়েছে।এখনো খাওয়াচ্ছে।ওকে কি করে বঞ্চিত করি বল? ওটাই,ওই গোলাটাই তো ওর ঘর।আর তো কিছু চায়নি ও। 

হতবুদ্ধি পিলনের মনে হল,তার বাবার কালো,রোদে পোড়া শরীরটা যেন কেমন সোনালী হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।বাবার গা থেকে একটা খুব সুন্দর গন্ধ পিলনের মনটাকে হঠাৎ ছোটবেলায় নিয়ে গেল। গরম ভাতের গন্ধে পিলনের পেট জুড়ে খিদের অঙ্কুর,পিলন চেঁচিয়ে উঠলো--- 
"মা,খুব খিদে পেয়েছে,খেতে দাও!" 

সাহিত্যিক অনিন্দ্য পাল
 জাফরপুর, চম্পাহাটি, দক্ষিণ ২৪ পরগনা







লখার স্বপ্ন 

মাথায় খড়ের বোঝা নিয়ে জোর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে ঝপ্ করে মাটির মস্ত উঠোনে বোঝাটা ফেলেই চিৎকার করে ডাকতে থাকলো লখার বাপ।
--অ --লখার মা,আমি এইসে গেচি। ভাত বাড়। 
বলেই মাথার গামছা খুলে পুকুর ঘাটে যেতে গিয়েও থমকে গেল কার্তিক হালদার।কার্তিক ঠাকুরের মতন চেহারা ছিল এককালে।বাপে নাম রেখেছিল কার্তিক। ভরা বর্ষায় মাঠে কাজ করতে গিয়ে মাথায় বাজ পড়ে মরে গেল বাপটা।সেই থেকেই লখার বাপের ওপর এসে পড়ে পাঁচ ভাইবোনের সংসার।মাঠে ঘাটে হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে কার্তিক পানা চেহারা আজ ধূসরবর্ণ।
--অ-- লখার মা,কতা কইচিস না কেনে? কি হইচে?
--তোমার বড় ব্যাটা জিদ ধরতেছে। কলকেতায় পড়তে যাবে বলতেছে। 
লখা মানে লক্ষ্মণ হালদাররা তিন ভাইবোন। ছোট থেকেই লেখাপড়ায় মনোযোগী লক্ষ্মণের দুচোখ ভরা স্বপ্ন।অনেক-অনেক দূর সে পড়াশুনা করবে।কলকাতা বড় শহর।সেখানে কত নামকরা লোক থাকেন।কত কবি,কত সাহিত্যিক,কত বিশিষ্ট নাট্যকার,কত গানের জগতের লোক।তাদের কথা স্কুলের দেবতোষ মাস্টারের কাছে শুনে শুনে বড় হয়েছে সে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার একটা ছোট্ট গ্রামে যেখানে লাইটপোস্ট বসেনি এখনও কঞ্চি বাঁশের বেড়ার ঘরে ভাঙা তক্তপোশের ওপর বসে বসে রাত জেগে লম্ফ জ্বেলে দেবতোষ মাস্টারের কাছ থেকে আনা গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ,কত উপন্যাস,প্রবন্ধ চোঁ চোঁ করে পড়ে ফেলেছে সে।লুকিয়ে লুকিয়ে লিখে ফেলেছে কত কবিতা। কাউকে দেখাতে পারেনি। পাছে সবাই হাসাহাসি করে। 
--না না লখার মা,ও কে জানায় দাও ওসব জাগায় পড়তি যাতি হবিনি। বুকটা টনটন করে ওঠে লখার বাপের।লখার মাকে সায় মেনে বলতে থাকে
--বল্ দিকিনি লখার মা। এ কেমন আবদার?বড় ছাওয়াল। কোতায় বাপের সাতে বাদায় যাবি,হাতে হাতে ঢ্যাঁড়শ তোলবি,হাটে যাবি,সংসারের দুটো আয়পয় বাড়বে,ছোট বোনটা মাথায় মাথায় বাড়তেচে, তার বে দিতি হবি।তা না করে খালি খালি পড়াপড়া কেন রে হে? অত নেকাপড়া করতি ট্যাকা লাগেনি? অত তোর বাপ পাবে কোতায় ভাববিনি?লখার মাও তার বাপের কথায় সায় দেয়। 
রাতে দাওয়ায় খেতে বসে লখার মা গিরিবালা লম্ফর আলোটা একটু বাড়িয়ে দিয়ে বলে 
--একখান পেস্তাব দিই লখার বাপ।লখাকে এই বেলা একটা বে দাও। যা হোক আমাদের হাড় জুড়োয়।বে দেলেই দেকো ওর মাতা থিকে পড়ার পানা ভুত প্যালাবে। আর ঘরে বৌ আলে আমারো এট্টু বেশ্যাম হবে। বলেই জুলজুল চোখে লখার মা লখার বাপের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে যায় প্রস্তাব টা লখার বাপ খুব ভালো ভাবে গ্রহণ করেছে।
--সেই ভালো। তাইলে কেষ্টা ঘটক কে ডাক করাই।
পাশের ঘর থেকে বাবা মায়ের কথোপকথন লখার কানে গেল। খুব অসহায় বোধ হল তার। খুব কষ্ট পেল। এ কেমন পরিবারে তার জন্ম ?তার ঠাকুরদার বাবা,তার ঠাকুরদা,তার বাবা পূর্বপুরুষরা সবাই এই একভাবে রোদে পুড়ে,জলে ভিজে মাঠে কাজ করেছে।একটু অন্যরকম ভাবে বাঁচার স্বপ্ন কেউ দেখেনি।তার ভাইটাকেও লেখাপড়া না করিয়ে সব্জি জমিতে চাষাবাদের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। বোনটা সবে পনেরো বছর ছেড়ে বিয়ের জন্য বাড়ছে সে। ছোট  থেকেই দেখেছে গভীর রাত থেকে তার মা ঘুম থেকে উঠে ধান সিদ্ধ করে রোদে শুকিয়ে যখন গোলায় তোলে মায়ের নরম মুখখানা পুড়ে কষ্টিপাথর এর মতো  হয়ে যায়। খুব কষ্ট হয় লক্ষ্মণের।এ ভাবে সে বাঁচতে চায় না। স্কুলে দেবতোষ মাস্টারের মুখে খেয়া কাব্যগ্রন্থ থেকে কৃপণ কবিতা পাঠ শুনে বিভোর হয়ে থাকতো সে।বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই মায়ের কাছে বাবার পরিশ্রমের গল্প আবার তার কষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। মাধ্যমিকে ভালো ফল করার পর থেকেই সে অন্যরকম ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। 
--লখা রে,এবার বন্ধ কর দিকিনি বই পড়া। অত পড়ে কি হবে টা কি? বাপের সাতে মাঠে কাজ করলি তো বাপটা এট্টু বাঁচে। বলেই চলে গিরিবালা। 
লখা ভাবে তার বাঁচার কথা কেউ ভাবে না। সে বাঁচতে চায়।তার মাথার ভেতর কিলবিল করে দেবতোষ মাস্টারের কথা,রবীন্দ্রনাথ,শেক্সপিয়ার,পল গ্যঁগা,ম্যাক্সিম গোর্কি,বুদ্ধদেব বসু আ-র-ও  অ-নে-কে।
--এ লখা, লখা রে---এ---
মায়ের চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে বসে সে।আকাশ এখনও পরিষ্কার হয়নি।
--কাল অনেক রেত অব্দি লম্ফ জ্বালায় রেকে কি করতেচিলি?সব ত্যালটুকুন শ্যাষ কইরে দিলি বাপ? আজ সন্দেয় আলো ছাড়া থাকবি।রেশানে কম কম তেল দিচ্চে। মা বকেই চলেছে।
--যা বাপের সাতে বাদায় যা। সেতায় মেয়ে রা ঢ্যাঁড়শ তোলতেচে।পাহারা দিবি, বাপের সাতে হাটে বেচি দিয়ে বাড়ি আসবি।হাটের ব্যাপারিরা তর বাপকে ঠকায় দ্যায়। তারপর লখার মাথায় হাত রেখে মা বলে ---বাপটার পাশে থাকলি  সংসারের এট্টু আয়পয় হয়। নে নে যা খড়খড়ি উটে পড়। 
বাবার পিছনে পিছনে লখা চলে বাদায়।বাবা বলে চলে কোন ফসলের বাজার দর কত।লখার কানে বেজে চলে দেবতোষ মাস্টার...
"যতবার আলো জ্বালাতে চাই
নিবে যায় বারেবারে 
আমার জীবনে তোমার আসন
গভীর অন্ধকারে 
যে লতাটি শুকায়েছে  মূল--
কুঁড়ি ধরে শুধু,নাহি ফোটে ফুল---"

 লেখিকা স্বাতী রায়
  ৪/১ যাদবগড়, হালটু, কলকাতা 

                   



































নলেন গুড়

সকালবেলা টবের গাছে জল দিচ্ছিল অনুপমা।বেশ শীত শীত লাগছিল,ঘরের থেকে একটা হালকা চাদর গায়ে দিয়ে এল সে।সকালের ডিমের কুসুমের মত কাঁচা হলুদ রঙের রোদ এসে ব্যালকনির গাছগুলোকে উজ্জ্বল সবুজ রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে,আর এক অবর্ণনীয় অনুভূতি অনুপমার মনের ভেতর ছড়িয়ে যাচ্ছে অনেকটা একটা কাঁচের গ্লাসে এক বিন্দু জলরং পড়ার মত। নাঃ! শীত তাহলে পড়েই গেল।শীত এলেই মনটা নেচে ওঠে ওর।শীত মানেই তো বিশ্রী গরমের প্যাচপ্যাচে ঘাম আর বর্ষার ক্যাতক্যাতে কাদা থেকে মুক্তি, আর পাতে প্রিয় সবজির ভিড়,কিন্তু সবচেয়ে প্রিয় তার নলেন গুড় আর তা দিয়ে তৈরি সন্দেশ।এমনিতে মিষ্টি প্রিয় নয় একদমই - কিন্তু নলেন গুড়ের সন্দেশ এর কথা অবশ্য একদমই আলাদা।গতবার পঁচিশে ডিসেম্বরের ছুটিতে ওরা মানে অনুপমা, ওর বর ও ছেলে আর বরের দুই বন্ধু ও তাদের পরিবার সমেত মন্দারমনি গিয়েছিল।ফেরার পথে পাঁচলিটারের খালি মিনারেল ওয়াটারের বোতলে করে খাঁটি নলেন গুড় নিয়ে এসেছিল ওরা ফিরতি পথে রাস্তায় বিক্রি হচ্ছিল।গাড়ি চলাচলের পথের ধারে খোলা জমিতে কাঠের জ্বালে ইঁট দিয়ে তৈরি  বিশাল একটা লম্বাটে উনুনে বিরাট একটা অ্যালুমিনিয়ামের আয়তাকার পাত্রে খেজুর রস ফুটছে, একটা বাঁশের মাথা চিরে এক ফুট মত একটা কাঠের লম্বা টুকরো লাগিয়ে খুন্তির মতো করে নিয়ে একটা লোক সেই রসটাকে মাঝে মাঝে নাড়ছে।লোকটা বলল যে রাতে খেজুর গাছে হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয় আর ভোরবেলা সেই রস সংগ্রহ করে নিয়ে এসে জ্বাল দিয়ে নলেন গুড় বানানো হয়,"তবে শীতের মরসুমে এই গুড় হয়,সারা বছর এমন জিনিসটা পাবেন নাই বাবুরা"।

লোকটা খেজুর রস আর নলেন গুড় নিয়ে বকবক করেই যাচ্ছিল সবার সাথে।অনুপমা কিন্তু মন দিয়ে লোকটাকে দেখছিল।লোকটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সে খুব গরিব।সারাগায়ে খড়ি ওঠা,কালো রঙের মানুষটার গায়ে খড়ি উঠে উঠে কেমন ধূসর বর্ণের চেহারা হয়ে গেছে আর চুল উস্কোখুস্কো,খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর নোংরা পোশাক-আশাক। পাশে ছিল তার বউ আর দুই ছেলে মেয়ে।বাচ্চা মেয়েটির গায়ে একটা শতচ্ছিন্ন সোয়েটার আর তার থেকে একটু বড় ছেলেটার গায়ে লালরঙের একটা হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি থাকলেও গরম জামার বালাই নেই।নলেন গুড়ের দাম শুনে সবাই যখন দরদাম করছিল,তখন লোকটা বলল " বাবুরা অনেক টাকা দাদন দিয়ে কয়েকটা গাছ ইজারা নিয়েছি কিন্তু যতটা খাটনি হয় লাভ ঠিকঠাক তার কিছুই হয়না,এই টাকা দিয়ে দুবেলা-দুমুঠো পেট ভরাও যায়না। " অনুপমা বলল "থাকো কোথায়?"পিছনে একটা ঝুপড়ি দেখিয়ে বলল "এখন এখেনেই থাকি গো দিদিমনি আর বছরের অন্যসময়ে ঐদিকের গেরামে ঘর আছে ওখানে থাকি"।"এত ঠান্ডায় এই মাঠের ভিতরে? "অনুপমার প্রশ্নের উত্তরে লোকটা বলল, "কি করবো গো দিদিমণি ভোরবেলা যে হাঁড়ি নামাতে যেতে হয়,নয়তো দেরি হয়ে যাবে যে,রস মোটা হয়ে গেলে গুড়ের আর এই স্বাদ পাবেনি"।অনুপমা বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করে "তোমাদের ঠাণ্ডা লাগে না? "লোকটা হেসে বলল "সারাবছর মাঠে কত কষ্ট করে চাষ করিগো দিদিমণি,তাই বউ বাচ্চার মুখে ঠিক করে অন্ন যোগাতে পারি না,এই শীতের মরসুমে একটু লাভের মুখ দেখি,তাও দাদনের টাকা বেড়ে যাওয়াতে আমাদের মত গরিব চাষিরা দেনার দায়ে ডুবে যাচ্ছি, পেটের দুবেলা ভাতের জোগাড় যাদের হয়না তাদের আবার ঠান্ডা-গরম?? আমরা কি আর মানুষ আছিগো দিদিমণি? আমরা তো মরে বেঁচে আছি,আমরা তো সব এক একটা ভূত গো দিদিমনি!"

সেবার সকলের নলেন গুড়ের স্বাদ ও গুণমানের প্রভূত প্রশংসা করলেও  অনুপমার মিষ্টির বদলে কেমন যেন একটু নোনতা নোনতা স্বাদ লেগেছিল গুড়টায়! গরিব মানুষের রক্ত,ঘাম,কান্না মিশে ছিল যে তাতে! যতবার সে হালকা খয়েরি তরলটা পাঁচলিটারের বোতল থেকে ঢালছিল ততবার খালি লোকটার কথা মনে পড়ছিল- সত্যিই তো তারা কি আর সত্যিকারের বেঁচে আছে?একে কি বেঁচে থাকা বলে?মানুষের বাঁচার জন্য ন্যূনতম যে চাহিদাগুলো প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন- খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্থান-তার কোনোটাই তো তারা ঠিকঠাক পায়না।

আর এবার তো করোনা অতিমারিতে সারা বিশ্বই অচল হয়ে গেছে। লক্ষ কোটি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।সাধারণ মানুষই বেকার হয়ে গেছে,চরম অর্থকষ্টে ভুগছে আর দারিদ্র সীমার নিচে বসবাসকারী এই সকল মানুষদের তাহলে কি হাল হয়েছে তা সহজেই অনুমান করা যায়।এইতো সেদিন অনুপমার কথা হচ্ছিল কেষ্টর সঙ্গে।কেষ্ট  অনুপমাদের পাড়ায় সবজির নতুন ফেরিওয়ালা।বাচ্চা ছেলে -এই সতেরো আঠারো বছর বয়স,করোনার জন্য হওয়া লকডাউন-এর মাঝামাঝি থেকে সবজি বিক্রি করছে।বেশ ভদ্র ও মিষ্টি ব্যবহার।

কথায় কথায় অনুপমা জানতে পারে যে কেষ্টর বাড়ি লক্ষীকান্তপুর লাইনে,ও  ইলেভেনে পড়ে,ওর বাবা গ্রামের ছোট চাষী।বাবা,মা, ঠাকুমা আর একটা ছোট বোন নিয়ে সংসার। ওখানে জীবন কষ্টে সৃষ্টে মোটামুটি কাটত। কিন্তু এই করোনা সবকিছু গোলমাল করে দিলো।একেইতো বাবা গতবার আলু চাষ করে তেমন দাম পায়নি  বলে ওদের আর্থিক অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল।ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়া, দালালদের অত্যাচার তো রয়েছেই তার মধ্যে করোনা ও আম্ফানঝড়ের তান্ডবে সব শেষ হয়ে গেল।এখন গলা অবধি দেনা বাবার।কেষ্টর বাবা ভেবেছিল এবছর চাষের ফসল বেচে সে ধার শোধ করবে।  কিন্তু লকডাউনে সব বাজার বন্ধ থাকায় ঘরের ফসল ঘরেই পচল তার ওপর ঝড়ে ঘরদোরও ভেঙে পড়ল।অগত্যা কেষ্ট সংসারের হাল ধরতে শহরে কাকার কাছে আসতে বাধ্য হয়েছে।কাকা একটা লেদ কারখানায় কাজ করত,কিন্তু করোনায় তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাকা এখন একটা ঠেলাগাড়ি জোগাড় করেছে,তাতে করে সবজি বেচে তাই দিয়ে কাকা ভাইপো কোনরকমে দু'মুঠো খাবার জোগাড় করছে।কেষ্ট বলেছিল অনুপমাকে "জানিনা বৌদি আগামী দিনগুলো কেমন দেখবো ? বাবাকে বোধহয় এবার ক্ষেতমজুরিই করতে হবে। আমার আর বোধহয় পড়াশোনা হবে না।"  অনুপমা বলেছিল "কেন তোমাদের তো অনলাইন ক্লাস চলছে,তাই না? "

উত্তরে কেষ্ট হেসে বলেছিল "দু'বেলা দু'মুঠো ভাতেরই জোগাড় হয় না,এন্ড্রয়েড ফোনের কথাতো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারিনা বৌদি। দুঃখ হয় আমিতো তবু মাধ্যমিক পাস করেছি হয়তো টেনেটুনে উচ্চমাধ্যমিকও পড়ে বেরিয়ে যাব কিন্তু আমার ছোট বোনটার পড়াশোনা বাবা আর চালাতে পারবে না,ওকে হয়তো শহরে কোন বাড়িতে কাজে দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কোন বাড়িতে দেব? বেশিরভাগ লোকেরই তো কাজ নেই। শহরেরই এই অবস্থা,তাহলে আমাদের গ্রামের   কি হাল কি আর বলবো!আমাদের অবস্থা শহরে থেকে আপনারা কল্পনাও করতে পারবেননা বৌদি "।সত্যি!হয়তো সচ্ছল উচ্চপদস্থ অফিসারের সংসারের গৃহিণী অনুপমার পক্ষে সবটা অনুমান করা সম্ভব নয়,তবু সে বলে নয়,বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে যখন সারা পৃথিবীটারই অবস্থা টালমাটাল,ভারতের আর্থিক বৃদ্ধি মাইনাসে চলে গেছে তখনই দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলোর পরিস্থিতি তো সকলেই অল্পবিস্তর বুঝতে পারছে।

"তাহলে তোমরা কি করবে? কি করে এই ভীষণ বিপদ থেকে তোমরা বেরোবে কেষ্ট? এই দেনা থেকে মুক্তির উপায়?" 
"হাল ছাড়লে তো হবে না,কিছুতো একটা সকলে মিলে করতেই হবে।আমাদের মত গরিব মানুষের কথা তো কেউ চিন্তা করে না বৌদি,তাই আমাদের লড়াইটা আমরাই সকলে মিলে লড়বো- দলবেঁধে একসাথে। আর কদিন বাদে দেশে ফিরে যাব।দেখি তখন গিয়েই কিছু একটা ব্যবস্থা করব।" অনুপমার উত্তরে কেষ্ট বলেছিল।   
অনুপমা মনে মনে ওকে আশীর্বাদ করে বলেছিল- তাই যেন হয়,তোমরা সকলে খেয়ে পড়ে বাঁচো এটাই চাই আর মুখে বলেছিল- "সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলে পড়াশোনাটা আবার শুরু করো কিন্তু"
-"হ্যাঁ বৌদি নিশ্চয়ই" হেসে জবাব দিয়েছিল কেষ্ট।

"কোথায় গো? আজ চা দেবে না?" কর্তার হাঁকে সম্বিত ফিরল অনুপমার। "হ্যাঁ,এখনই দিচ্ছিগো"- বলে তাড়াতাড়ি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায় সে। ডাইনিং টেবিলে বসে চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দিতে দিতে কর্তামশাই বলে ওঠেন " শীত পড়ে গেল,কি বলো? গতবারের শীতে মন্দারমনি থেকে আনা সেই নলেন গুড়টা! আহা! কি অপূর্ব স্বাদ ছিল তাইনা?এক্কেবারে খাঁটি"।অনুপমা চায়ে চুমুক দিতে দিতে কোন জবাব দিলনা শুধু অন্যমনস্ক ভাবে বলল "হুঁ "।

লেখিকা অনুরঞ্জনা ঘোষ নাথ
কালিদাস পতিতুন্ডি  লেন, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ 



















নবীনতর পোস্টসমূহ পুরাতন পোস্টসমূহ হোম

ব্লগ সংরক্ষাণাগার

  • আগস্ট (3)
  • জুলাই (22)
  • জুন (8)
  • নভেম্বর (15)
  • অক্টোবর (5)
  • সেপ্টেম্বর (81)
  • আগস্ট (66)
  • জুলাই (55)
  • জুন (56)
  • মে (57)
  • এপ্রিল (46)
  • মার্চ (15)
  • জানুয়ারী (14)
  • ডিসেম্বর (73)
  • নভেম্বর (103)
  • অক্টোবর (97)
  • সেপ্টেম্বর (101)
  • আগস্ট (120)
  • জুলাই (88)
  • জুন (76)
  • মে (63)
  • এপ্রিল (11)

🔴বিজ্ঞপ্তি:

পাঁচ মাসের বিরতি কাটিয়ে আবার ও ফিরছি আমরা। খুব শীগ্রই আসছে আমাদের প্রত্যাবর্তন সংখ্যা।

অনুসরণ করুণ

এক মাসের সর্বাধিক পঠিত পোস্টগুলি:

  • শেষ শোকসংগীত ~ গোবিন্দ মোদকের কবিতা
  • দুটি কবিতায় ~ গৌতম কুমার গুপ্ত
  • ব্রাত্য ~ বিদ্যুৎ মিশ্র'র কবিতা
  • দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প
  • আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা
  • গুচ্ছ কবিতায় ~ অসীম মালিক
  • সুমিত রায়ের গল্প
  • সে প্রেম পবিত্র~ প্রেমাংশু শ্রাবণের কবিতা
  • সুব্রত মাইতির কবিতা
  • তিনটি কবিতায় ~ রাগীব আবিদ রাতুল

বিষয়সমূহ

  • Poetry speaks 2
  • অণু কথারা 21
  • আবার গল্পের দেশে 8
  • উৎসব সংখ্যা ১৪২৭ 90
  • একুশে কবিতা প্রতিযোগিতা ২০২১ 22
  • এবং নিবন্ধ 3
  • কবিতা যাপন 170
  • কবিতার দখিনা দুয়ার 35
  • কিশলয় সংখ্যা ১৪২৭ 67
  • খোলা চিঠিদের ডাকবাক্স 1
  • গল্পের দেশে 17
  • ছড়ার ভুবন 7
  • জমকালো রবিবার ২ 29
  • জমকালো রবিবার সংখ্যা ১ 21
  • জমকালো রবিবার ৩ 49
  • জমকালো রবিবার ৪ 56
  • জমকালো রবিবার ৫ 28
  • জমকালো রবিবার ৬ 38
  • দৈনিক কবিতা যাপন 19
  • দৈনিক গল্পের দেশে 2
  • দৈনিক প্রবন্ধমালা 1
  • ধারাবাহিক উপন্যাস 3
  • ধারাবাহিক স্মৃতি আলেখ্য 2
  • পোয়েট্রি স্পিকস 5
  • প্রতিদিনের সংখ্যা 218
  • প্রত্যাবর্তন সংখ্যা 33
  • প্রবন্ধমালা 8
  • বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা 10
  • বিশেষ সংখ্যা: আমার প্রিয় শিক্ষক 33
  • বিশেষ সংখ্যা: স্বাধীনতা ও যুবসমাজ 10
  • ভ্রমণ ডায়েরি 1
  • মুক্তগদ্যের কথামালা 5
  • রম্যরচনা 2
  • শীত সংখ্যা ~ ১৪২৭ 60

Advertisement

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.

মোট পাঠক সংখ্যা

লেখা পাঠাবার নিয়মাবলী:

১. শুধুমাত্র কবিতা, মুক্তগদ্য অথবা অণুগল্প পাঠাবেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং অন্যান্য বিষয়ক লেখা সম্পূর্ণ আমন্ত্রিত। ২. লাইনের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ৩. লেখা মেইল বডিতে টাইপ করে পাঠাবেন। ৪. লেখা মৌলিক ও অপ্রকাশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্য কোনো ব্লগ, ওয়েবজিন অথবা প্রিন্টিং মিডিয়ায় প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ৫. মেইলে আপনার লেখাটি সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত, কথাটি উল্লেখ করবেন। ৬. লেখার সাথে আবশ্যিক ভাবে এক কপি ছবি ও সংক্ষিপ্ত ঠিকানা পাঠাবেন।  ৭. লেখা নির্বাচিত হলে এক মাসের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হবে। এক মাসের মধ্যে কোনো উত্তর না এলে লেখাটি অমনোনীত ধরে নিতে হবে। ৮. আপনার লেখাটি প্রকাশ পেলে তার লিঙ্ক শেয়ার করাটা আপনার আবশ্যিক কর্তব্য। আশাকরি কথাটি আপনারা মেনে চলবেন। আমাদের মেইল- hridspondonmag@gmail.com
blogger-disqus-facebook

শান্তনু শ্রেষ্ঠা, সম্পাদক

আমার ফটো
পূর্ব বর্ধমান, India
আমার সম্পূর্ণ প্রোফাইল দেখুন

সাম্প্রতিক প্রশংসিত লেখা:

সুজিত রেজের কবিতা

সুজিত রেজের কবিতা

চন্দ্রানী গুহ রায়ের কবিতা

চন্দ্রানী গুহ রায়ের কবিতা

দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প

দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প

আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা

আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা

কবি সুধাংশুরঞ্জন সাহার কবিতা

কবি সুধাংশুরঞ্জন সাহার কবিতা

হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন

© হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন। শান্তনু শ্রেষ্ঠা কর্তৃৃক পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে প্রকাশিত।

Designed by OddThemes | Distributed by Gooyaabi Templates