বাতাসে শীতের শিস দিয়ে কেউ ডাকে...
ক্যালেন্ডারের পাতায় নভেম্বর উলটে যেই না ডিসেম্বর এসেছে, ঠান্ডা ঠান্ডা,নরম একটা হাওয়া নাকের ডগা'য়,কে যেন বুলিয়ে দিলো আলতো করে! তার ঢের আগে থেকেই বাহারি টুপি আর সোয়েটারে সেজে উঠেছে বড় বড় শো-রুমে'র ম্যানিকুইনেরা, কালি পুজো'র পর থেকেই টিভির বিজ্ঞাপনে, মধু রঙে'র চোখের তারা'র সুন্দরী'রা নিভিয়া আর পন্ডস্ এর কোমল লাবণ্যে ভাসছে, ময়শারাইজারের ক্রিমি টেক্সচারে ডুবিয়ে নিচ্ছে ম্যানিকিওর করা আঙুল, আর আদি অকৃত্রিম 'বঙ্গ জীবনের অঙ্গ' মার্কা এ্যাডে, চওড়া লালপেড়ে শাড়ি'র ঠাকুমার ফোকলা হাসিতে বনেদিয়ানার হাতিমার্কা ছাপ দিতে গিয়ে কমার্শিয়াল সাইটে ফুরফুরে উত্তুরে হাওয়া'র ইন্ট্রো! এইবার রে রে করে বাজার ধরতে হামলে পড়বে ই-কমার্স আর কর্পোরেট হাত ধরাধরি করে। ওদিকে জগুবাবু'র বাজারে ফুলকপি এখন পনেরো টাকা জোড়া, সুন্দরী সিমলা মির্চ তার সবুজ যৌবন ঢলিয়েও ওই মেরেকেটে চল্লিশ টাকা কিলো, মটরশুঁটি'র কচুরি তো বাঙালি এই শীতের সময়টুকুতেই একটু আয়েস করে খায়,তাও কমের দিকেই। শুধু আলু'র দাম... যাকগে! হচ্ছিলো ডিসেম্বর, সেখানে আলু কেন ভাই? আরে শীতকালে একটু নতুন ছাল-ওঠা কচকচে আলু'র তরকারি আর দু'পিস কচুরি,শেষপাতে নলেনগুড়ের সন্দেশ একখানা, তা সে নকুড় বা বাঞ্ছারাম না হয়ে নিদেনপক্ষে ওই লোকাল কেষ্টবিষ্টু'র দোকান হলেও চলবে বড়'দা! তা নয় শালা, ইউটিউবে রেসিপি দেখে বাড়িতে, ফোটা-ফুলকপি দিয়ে 'গোবি মাঞ্চুরিয়ান' হচ্ছে, মাজাকি মারার জায়গা পাওনি? কী দিন এলো রে ভাই, অঘ্রাণে ফুলকপি মুখে রুচছে না, ধনেপাতা হলদেটে, এঁচড় উঠে গেছে, ইলেক্ট্রিক শক লাগার মতো দাম! কার্তিক-অঘ্রাণ মাস জুড়ে সারাদুপুর লেপ-তোষকওয়ালাদের ধুনুরি'র টং টং আওয়াজ, জয়নগরের মোয়া হেঁকে যেত ফেরিওয়ালা, খেজুরগুড়ের নাগরি নিয়ে বসে থাকতো ব্যাপারি, হাটে নদীর মানা'র টাটকা ফসলে'র গায়ে যেন শীতের শিশিরটুকু লেগে থাকতো! আমাদের ছোটবেলায়, গ্রামে-গঞ্জে, আধা-মফঃস্বলে এত বড়দিনের হিড়িক ছিলো না। পৌষমাসে ধান ওঠার পর তখন গেরস্তের হাতে পয়সা-কড়ি থাকতো,বনভোজন, নদীর চরে ফিস্টি'র রেওয়াজ ছিলো আর ওই বড়দিনের হপ্তাখানেক আগে থেকে রাস্তার ধারে, ঝলমলে রঙিন কাগজে মোড়া,গজগজে মোরব্বা আর কাজু-কিসমিস দেওয়া কেক বিক্রি হতো। মুদি'র দোকানেও রাখতো দু'চার পিস, হাইস্কুলে'র উঁচু ক্লাসে তখন পি.কে.দে সরকারে'র গ্লোবালাইজেশন পড়ছি। এখন তো বড়দিনে চার্চে না গেলে, টেবল বুক করে ডিনার না করলে, বারবিকিউনেশন আর পার্কস্ট্রীটে'র মদির আলোয়, পাউট করা ছবি ফেবু'তে আপলোড না করলে ঠিক জাতে ওঠা যায় না! ছোটখাটো রেস্তোরাঁগুলোও সেজে ওঠে ক্রিসমাস ট্রি আর টুনিবাল্বের টুইংক্লিং-এর সাথে,দেশি খোকাখুকু'রা হ্যাট-কোটে গ্রুমড্, হরিণ-চোখের হর্নি মুখোশ এঁটে, ডি.জে. আর রক সং এ কোমর দুলিয়ে,প্রি-ক্রিসমাস ইভে'র সে এক মার-কাটারি সেলিব্রেশন, মচ্ছব আর কী! জামাইক্যান রাম ফ্রুট কেক কিম্বা জার্মান মারজিপান, বাঙালি জিভ ছুঁয়ে দেখবে না, তাও কি হয়?! তবে যাই বলো বাপু গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডারের তিনশ' ঊনষাটতম দিনে ক্রিশ্চান মতে যীশুবাবা আদৌ জম্মেছিলেন কিনা সে নিয়ে বিস্তর টানাহেঁচড়া আছে! লোকে বলে অ-খ্রিষ্টানদের, খ্রিষ্টান করার জন্যই নাকি এমন প্রথা'র শুরু, যীশু জন্মেছিলেন অক্টোবর মাসে! তবে এও ঠিক ওইদিন সব চার্চে ধর্মানুষ্ঠানের জন্য জ্বলে উঠবে রঙিন মোমের আলো।ঘন্টা, টুনিবালবে'র টিপটিপে সেজে উঠবে ক্রিসমাস ট্রি, হৃদয়াকার আইভিলতায় ছেয়ে থাকবে টম-ডিক-হ্যারিদের ছোট্ট কটেজ! ক্যাকটাস, মিসলটো আর বে-লিফে আচ্ছন্ন পুরো ক্রিসমাস উইক। এরই মধ্যে রেন-ডিয়ারে টানা স্লেজগাড়িতে চেপে সাদা দাড়ি উড়িয়ে আসবে সান্টাক্লস, তুষারধবল পথ দিয়ে, ঘন-সবুজ পাইনের বনের ভেতর দিয়ে তার রক্ত-লাল প্রকান্ড জোব্বা'র পকেটে হাত চালিয়ে বের করে আনবে চকোলেট, কেক আরও কতরকমের উপহার! ছেলেভুলানো গল্পে'র মতো তখন ধাড়ি খোকাদের'ও মোজা ভরে উঠেছে গিফ্টে, উষ্ণ লাল টার্কি'র মাংস, দুম্বার পাছা'র ডেলিকেসিতে ভেসে গেছে মধ্যবিত্ত সংস্কারের বাঁধ! উৎসব চিরদিন ছাপিয়ে যেতে চেয়েছে ধর্ম'কে, এইই যা সান্ত্বনা মনুষ্যত্বে। স্প্যানিশ কবি প্রুডেন্টিয়াসের ক্যারল তখন নেশা গাঢ় করে তুলেছে পেটরোগা বাঙালি'র দু-পাত্তর শখের রেড-ওয়াইন পড়া মস্তিষ্কে। ভার্জিন মেরিমাতা'র কোলে যীশুবাবা'র ছবি, পবিত্রতম দৃশ্যের মধ্যে অন্যতম, সন্দেহাতীত। তাঁকে ঘিরে এই যে অনুষঙ্গ তা তো মনের, মননে'র কাছে একটা চিরস্থায়ী দাগ রেখে যাবে তা সত্যি, তবুও আম-জনতা, তা জাত-ধর্ম নির্বিশেষে,পাশে'র বাড়ি'র মর্নিং-ওয়াক করা মাসিমা, ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলা'র সেন-বউদি,গোমস দম্পতি,কিম্বা পাড়া'র শিবুজেঠু, কবে যে এরা ফিসফিস করে বলা থামাবে যে —
'অমুকে'র আইবুড়ো মেয়েটা তো পোয়াতি হয়ে গেসলো!, 'কী ঘেন্না'র কতা মা, কী বলবো, ওই কলেজে-পড়া ছুঁড়ি, আবরশন নাকি করাতে গেয়ে তো যমে-মানুষে টানাটানি 'অথবা 'কী দিন এলো বাবা,মরণ, আইবুড়ি, ধাড়ি মেয়ে! কোতা থেকে ছেলেকোলে নিয়ে এসে সিঙ্গেল-মাদার নাকি সব, ছ্যা ছ্যা! ' এরাই ঘটা করে ক্রিসমাস সেলিব্রেট করে, প্রতিবেশীদের ডেকে কেক-মিষ্টি খাওয়ায়! যাচ্চলে! এখনকার ছেলেছোকড়াদের নাকি ভক্তিছেদ্দা একেবারে নেই, শুধু ঢপ আছে, বাওয়াল আছে, ঝাড়ি আছে, আর...তাই বুজি! এখন তো সবকিছুই সেলিব্রেশন, যে বাবা-মা ধর্ম বোঝেনা, মনুষ্যত্ব বোঝেনা, উদযাপন বোঝেনা শুধু ছুটি বোঝে, খাওয়া-দাওয়া আর আউট অফ দ্য ট্র্যাক, ডে-আউট বোঝে তাদের বাই-প্রোডাক্ট'রা কী 'আমেন' বলে শান্তি খুঁজে নেবে নাকি বয়োজেষ্ঠ্যদের প্রণাম করে বলবে 'আশীর্বাদ করুন যেন সত্যের পথে থাকি '! এখন সবই 'হাওয়া-হাওয়া' রে ভাই তারই মধ্যে জীবন বইয়ে নেওয়া, বাওয়া! তা বড়দিন এসেই গেলো মশায়'রা, টিপেটুপে এই দুর্মূল্যে'র বাজারে, তুলনামূলক সস্তায় ভালো একখানা কেক-পেস্ট্রি যাহোক বাগিয়ে রাখুন, না'হলে পরে আর পাওয়া যাবেনা। দুম্বা-টুম্বা ট্রাই করতে যাবেন না, টার্কি পাওয়াও শক্ত, মাসের শেষ পকেটের কথাখানা'ও তো ভাবতে হবে! বেঁচে থাক পোল্ট্রিজাত রামপাখি আর জ্যোতিআলু। চুপিচুপি বলি, একখানা ব্রাউনি নাকি বলে যেন,খাইয়েছে,গরম করার তর সয়নি, ঠান্ডা'ই মেরে দিয়েছি শালা, ভগবানের নাম করে।একেবারে টুরু লব। মেরি ক্রিসমাস!
(এ লেখা সম্পূর্ণভাবে আমার কল্পনার উপজাত,কোন ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়)
গদ্যকার অন্তরা দাঁ
কাঁটাপুকুর উত্তর, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ