হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন
প্রথম বর্ষ ~ একাদশতম সংখ্যা
বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা
সূচিপত্র:
মেঘনা রায় ॥ সংগ্রামী লাহিড়ী ॥ অসীম বিশ্বাস ॥ সৌমী গুপ্ত ॥ শ্রাবণী গুপ্ত ॥ বিকাশরঞ্জন হালদার ॥ ড: দেবদ্যুতি করণ ॥ চন্দন আচার্য ॥ প্রতীক মিত্র ॥
অচেনা ঝরনার কাছে অবহেলে হেঁটে যাওয়া খুব সহজ নয়। মাতাল জঙ্গুলে গন্ধ তীব্র এক পিছুডাক ছড়িয়ে রাখে ।ব্যস্ত সড়ক পথ রহস্য রাখেনা সে বড় সোজাসাপটা খোলামেলা তাই তাকে পড়ে নেওয়া সহজ।কিন্তু ইতস্তত সবুজ আলোয়ান গায়ে জঙ্গুলে সুঁড়ি পথে হঠাৎ আ্যালার্ম কল কিম্বা গাড়ি বিগড়ে গিয়ে বিশাল ঘাসের জমিতে চিতলের সাথে অনর্গল বৃষ্টি ভেজা আলাভোলা সবুজের কাহিনী প্রলম্বিত রেশ রেখে যায়।সেই কোন ছোটবেলা থেকেই বিভুতিভূষণ, বুদ্ধদেব গুহর জঙ্গলময় পাঠশালায় আমার নাম লেখানো। শীতের শুষ্কতায় কেমন করে ভিজে যায় কুয়াশার বনপথ, পর্ণমোচী আরণ্যক প্রতিভাস কেমন করে ভ্রামণিকের চোখে আদুরে হয়ে ওঠে, এই আরণ্যক সংহিতার পাঠ তো ওনাদেরই দান। ওনাদের হাত ধরে এবারের হঠাৎ জঙ্গল সফর হাতে কলমে শিক্ষার পাঠ বৈ তো নয়।নিঃস্বার্থ ভাবে শুধু মাত্র জঙ্গল আর বন্যপ্রাণী কে ভালোবেসে তাদেরই রাজপাটে কটা দিন কাটানো। আমাদের যত রকমারি জঙ্গুলে বন্ধু আছেন যারা বেড়ানো বলতে কেবল জঙ্গলই বোঝে তাদেরও চমক দেবার জন্যই এই অরণ্য বি.আর.হিলস. কে ঘিরেই এবারের কিসসা।
এখানে তিস্তা চলেছে খরস্রোতা ছন্দে। দুধারে সবুজ শ্যামলিমাময় পাহাড়গুলো আগলে রেখেছে তাদের । তিস্তা পেরিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা গাড়িতে পাকদন্ডী বেয়ে ওঠার সময় আশেপাশে ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে সাজানো অফবিট জায়গা বা গ্রাম সামসেট। তারপর খানিকটা আরও এগিয়ে গেলে কালিম্পং আর রংপোর ঠিক মাঝখানে নিজের ছন্দে একান্তে গড়ে ওঠা ছোট্ট গ্রাম মাণ্ঝারজঙ।অহংকারের অলংকারে অলংকৃত।যার আছে অমন মনোহরনকারী কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেতশুভ্র শিখর তারই অহংকার সাজে। পাহাড় এখানে গাম্ভীর্যের আবরনে ঢাকা। তুমি তাকে আলিঙ্গন করতে পারবে না। যেদিকে চোখ যায় নীল আকাশের নিচে দূর দূরান্তে শুধু বরফের শিখর। মাঝখানে একফালি আকাশের নিচে বিস্মৃত হতে হয় নিজের অস্তিত্ব...নগণ্য লাগে বড্ড। সূর্যরশ্মি রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার আগে সোনালী ভুল বললাম সোনার আবীর ছড়িয়ে দিয়ে যায় সারা আকাশ জুড়ে। যেন সোনা মেখেছে গায়। বরফের চূড়া গুলো সোনায় সোহাগা হয়।কি অভূতপূর্ব দৃশ্য নিজের চোখে না দেখলে অবিশ্বাস্য। আবার রাত্রির চাদর সরিয়ে ভোরের আলো যখন স্পর্শ করে আকাশ ,পাহাড় ,পর্বত চূড়া... আবছা কালো...সোনালীবর্ন ও সর্বশেষে শ্বেতশুভ্র আবরনে বড্ড অহংকারী সে।
সেই কবে ভূগোলে পড়েছি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার কলোরাডো নদীর অ্যান্টেলোপ, আফ্রিকার ব্লাইড নদীর ক্যানিয়ন কিংবা স্বদেশের গান্ডিকোটা। ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে বারবার ভেবেছি; একবার না দেখলেই নয়। কিন্তু সংগতি সায় দেয়নি; গুমরে ছিলাম ভেতরে। চোখ চালাতেই পেলাম। পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলাবতী নদীর গনগনি। অ্যান্টেলোপের মিনিয়েচার ভার্সন!
সেবার রাত থাকতে বেরিয়েছিলাম, গড়বেতা পৌঁছলাম ভোরে। প্রথমে গেলাম সর্বমঙ্গলা মন্দির। এই বয়সে ঠাকুর নাম করার যদিও ইচ্ছে হয়নি, কিন্তু তাহলে কি হবে; মা আমার ভক্তিমতি! মায়ের কথায় যেতেই হল। এই উত্তরমুখী মন্দির নাকি রাজা বিক্রমাদিত্যের আমলে কোনও যোগীর যোগসাধন দ্বারা এক রাতের মধ্যে তৈরি হয়েছে। তখনও মন্দির উত্তরমুখী ছিল না। কথিত আছে এরপর রাজা বিক্রমাদিত্য এই জঙ্গলে সাধনা করে মায়ের কাছ থেকে তাল বেতাল শক্তির বর পান। সেই দৈব ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য মন্দিরকে উত্তরমুখী করে দিতে বলেন। সেই থেকে মন্দিরের দ্বার উত্তরমুখী! মায়ের রক্তবদন আর রক্তাম্বরে স্বর্ণ মুকুট ও অলংকার শোভা পাচ্ছে। মনে মনে বার বার প্রণাম করলাম। এসব শুনে প্রণাম না করে আর থাকা যায়!সুইজারল্যান্ড কলিং
ভ্রমণপিপাসু বাঙালি বেশ কিছুদিন আগে থেকেই দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে পাড়ি দিতে শুরু করেছে বিদেশে।সিঙ্গাপুর,ফুকেট এমনকি মিশরের মাটিতেও মিশিয়ে দিতে পেরেছে বাঙালিয়ানার ঘ্রাণ।তবে চেনাজানা এমন জায়গায় না গিয়ে অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন ইতিহাস আর ভূগোলের মিশেলে মোড়া স্বপ্নের মহাদেশ ইউরোপের ছোট্ট দেশ সুইজারল্যান্ডের ছোট্ট শহর ইন্টারলেকেন কিংবা লুসার্ন থেকে।চোখের খাঁচায় বন্দি করতে না পারলে সত্যিই বোঝার উপায় নেই এই শহরগুলির সৌন্দর্য।ট্রাভেল এজেন্সির পাঠানো আইটেনারি পড়ে প্রথমে আমারও কেমন যেন মনে হয়েছিল জায়গাগুলো সম্পর্কে।চাক্ষুষ করার পর অবশ্যই আর কোন সন্দেহ থাকল না।
মনে পড়ে বিখ্যাত সেই হিন্দি চলচ্চিত্রের দিললগির সেই মুহূর্ত? হ্যাঁ হ্যাঁ,ঠিকই ধরেছেন। "দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে" সংক্ষেপে "ডিডিএলজে" তাইতো?
দিললগি মানে মস্করা।রাজের হাত থেকে সিমরণের সেই নকল ফুল নেওয়ার মুহুর্ত আজও মনে পড়ে সব্বার।ইন্টারলেকেনেই শুট করা হয়েছিল।
"Interlaken" অর্থাৎ between the lakes ( in latin inter lactus) নামই বলে দেয় যার বর্ণনা।পশ্চিমে পান্না সবুজ থুন হ্রদ, পূর্বে ব্রিয়েনজ।তারই মাঝে ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া ইন্টারলেকেন। "Ho he Matte" হল এ শহরের বুক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিশাল উন্মুক্ত পার্ক,যেখানে অনায়াসেই ঘুরে বেড়ানো যায় কিংবা সবুজ ঘাসে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ রাখা যায় বরফমোড়া ইগার, মঞ্চ অথবা ইয়ংফ্রইয়ক শৃঙ্গে।পার্কের চারিদিকে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ক্যাশিনো, কফিশপ,রেস্তোরাঁ, স্যুভেনির শপ।খোলা আকাশের নিচে এক কাপ গরম কফিতে চাইলে চুমুক দিতেই পারেন।না চাইলে?মেলতে পারেন ডানা আকাশের নীলে। কেমন করে?
প্যারাগ্লাইডিং,অ্যাবসেইলিং আপনাকে হাতছানি দেবেই।এছাড়া অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালির জন্য আছে রিভার রাফ্টিং, ক্যানিয়নিং।"অ্যাডভেঞ্চারাস ক্যাপিটেল" নামে পরিচিতি কি আর এমনি এমনিই পায়।তাহলে?এবারের ডেস্টিনেশন তবে ইন্টারলেকেন তাইতো?
ইচ্ছে না হলে চলে যেতেই পারেন লুসার্ন। এটিও সুইজারল্যান্ডের ছোট্ট পুরোনো শহর।মাঝখানে বেশ বড় লুসার্ন লেক।এ শহরের মূল আকর্ষণ ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি বিখ্যাত কাঠের ব্রিজ।নাম "চ্যাপেল ব্রিজ"। Reuss নদীর উপরে তৈরি এই ব্রিজে একবার ভয়াবহ আগুন লাগলেও এখনও পর্যন্ত এটি এখানকার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক রূপেই দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শণস্বরূপ।এছাড়া সুইজ ব্যাঙ্ক, চকলেট শপ,সুইজ ওয়াচ শপ।চটপট কিনে ফেলতেই পারেন সাধের একখান রিস্টওয়াচ।ঘুরে ঘুরে দেখে নিন প্রাচীন সব স্থাপত্য। ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলে প্রায়ই,সঙ্গে হালকা শীত।গরমের দেশের মানুষদের কাছে এ যেন বাড়তি পাওনা তাই না?
তবে আর দেরি না করে, গুছিয়ে ফেলুন রুকস্যাক।ছাতা আর টুপি মাস্ট।সানগ্লাসও।"সুইস ফ্রাঁও চাই সাধ মেটাতে খুচরো কিংবা নোটে,দেখুন না বেড়িয়ে পড়ে কপালে কি সুখ জোটে"।
কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা
পটভূমি আসাম।
শেষ দুপুরে ধান কাটা রোদ'টা তখন আমার বাসার সামনে আমলকী আর পলাশের ডালপালায় লুকোচুরি খেলছে। হঠাৎ - কি অসীম কি করছো? - কথায় পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম তাপস সরকার দা, ঝুমা আর তিন্নি গাড়ি থেকে নেমে আসছে। আমি ডালিয়া গাছগুলোর যত্ন করা ছেড়ে গেট টা খুলে দিলাম।
ঝুমা ঢুকেই বললো- বাহ !অসীম দা কি সুন্দর ডালিয়া,চন্দ্রমল্লিকা আর সিজন ফ্লাওয়ারের বাগান করেছেন ! ডালিয়া গুলো কত বড় বড়,বাড়ির সামনেটা এক্কেবারে কালারফুল হয়ে রয়েছে ! গৌরী দি কোথায়?
আমি বললাম- ভেতরে আছে, যাও।
ঝুমা ভেতরে চলে গেলো।
সরকার দা বললেন- নাজিরায় হাঁপিয়ে উঠেছি তাই চলে এলাম শিবসাগরে।
আমি বললাম- চলুন ভেতরে গিয়ে বসি।
তিন্নি আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো- কাকু আমাকে একটা ফুল দেবে?
আমি বললাম- ঠিক আছে যাওয়ার সময় নিয়ে যাস।
সবাই মিলে ঘরে এলাম।
সরকার দা গৌরী কে বললো- ভালো করে পেঁয়াজ, কঁচালংকা আর চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখো, সাথে তোমার সেই বিখ্যাত দার্জিলিং টি খাওয়াও।
ওরা এলে সাথে করে নিয়ে আসে অনেক আনন্দ, উচ্ছাস আর হাসি।
সবে আড্ডাটা জমে উঠেছে ,বাইরে গাড়ির আওয়াজ শুনে তাকাতেই দেখি একটা লাল মারুতি গেটের সামনে এসে থামলো।ওটা আমাদের পরিচিত গাড়ি। আমার বন্ধু সুবীর সবকার এলো বৌদি,বান্টি আর বনি কে নিয়ে।
আড্ডাটা জমে উঠলো গৌরীর বানানো স্পেশাল ঝালমুড়ি আর দার্জিলিঙের চায়ে।
বাচ্চাদের মস্তির আওয়াজ'ও পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছিল।
আমি একটু ভেবে বললাম- চলো তাহলে সবাই মিলে কাজিরাঙার জঙ্গলে কয়েক দিনের জন্য হারিয়ে যাই। এক কথায় সবাই রাজি হয়ে গেলো।
সেদিনের সকাল'টা ছিল ১লা পৌষ। কাজিরাঙা আমাদের হাতছানি দিয়ে গেয়ে উঠলো- "পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে,আয় রে চলে,আয় আয় আয়।"
আমার সাদা মারুতিটা রাজহাঁসের মত লাগছিল। আমরা তৈরী হয়ে একটু অপেক্ষা করতেই সুবীর সরকার এসে গেল সপরিবারে।
চোখের পলক পরতে না পরতেই তাপস সরকারের গাড়িটা আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ।
আমাদের যাত্রা শুরু হ'ল।
হাসি আর আনন্দে কখন যে আমরা জোড়হাট পৌঁচ্ছে গেছি বুঝিনি। আমাদের Lunch break টা হোল সেখানেই।
লাঞ্চের একটু পরেই আবার তিনটে গাড়ি দূরন্ত গতিতে ছুটে চললো কাজিরাঙার আকর্ষণে।
চারিদিক সবুজ বনানী - মাঝে মাঝে সবুজে ঢাকা ছোট ছোট গ্রাম,দোকান- হাট । হিমেল হাওয়ায় স্বপ্নের আবেশ নিয়ে আমরা এগিয়েই চলেছি! ছোটবেলা থেকেই মনে মনে অনেক কল্পনা করেছি কাজিরাঙার। কেমন সেই রূপ এবার তা নিজের চোখে দেখবার সময় এসেছে।
কালো অজগরের মত আঁকা বাঁকা মসৃণ রাজপথে আমাদের গাড়ির চাকা গুলো অজস্রবার ঘুরে গেলো। হঠাৎ দূরের কালো পাহাড়ে বিকেল এলো। সকলেই তখন ক্লান্ত প্রায়।
আমি গৌরীকে বললাম- এসে গেছি।
কথাটা ওয়েভ তরঙ্গে নিমেষেই অন্য গাড়ি গুলোতে ভেসে গেলো।
রাজপথ ছেড়ে একটু আঁকা বাঁকা পথ ধরে পৌঁছে গেলাম Wildgrass Resort এ। আগে থেকেই বুক করে রেখেছিলাম।
তখনও সন্ধ্যা নামেনি। অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতির দিয়ে সাজানো, বড় বড় গাছ- গাছালির মাঝে সবুজে ঘেরা resort টা। একটা নাম না জানা পাখি বারবার গাছ পাল্টাতে ব্যস্ত তখন আর তার প্রেমিক এক মনে পাকা পেঁপে খেয়ে চলেছিল। সুইমিং পুলের নীল জলের পার দিয়ে দোতলায় আমাদের ঘর গুলো। সবাই নিজের নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হলাম। আমাদের সকলের ছেলেমেয়েরাও আনন্দে মেতে উঠলো।
তখন অন্ধকার হয়েছে। অনুভব করলাম শীত। তবুও সকলে চা খেয়ে এক সাথে নিচে নেমে এলাম। সামনে একটি বিরাট গাছের উপর চারিদিক রেলিং এ ঘেরা ঘর । আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো এবং আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সেখানেই উঠে গেলাম। মাঝখানের বড় টেবিলটা ঘিরে জমে উঠলো আমাদের আড্ডা। ছেলেমেয়েরা খেলায় মেতেছে। মাথার উপর হলদেটে আলো। ছাউনির বাইরে ঘন অন্ধকারে অজস্র জোনাকি ঘুরে ঘুরে আলোর নাচে মেতেছে। সে এক অপরূপ দৃশ্য!
মহিলারা এর মাঝেই কবিতা ও গানের আলোচনা জগতে চলে গেছে। আমরা সেই সুযোগে সোমরস পানে মগ্ন হলাম। অবশেষে অল্প আলোয় ওখানেই আমরা সবাই ভিনার করলাম।
ঘরে ফিরতে ক্লান্তি এসে সবাইকে ঘুমের দেশে নিয়ে গেল।
পরের ভোরে, মুখ দিয়ে ধোঁয়া ওঠা ঠান্ডায় খোলা জিপসি তে সদলবলে বেড়িয়ে পরলাম অরণ্যের অজানা রহস্য ও আশ্চর্য কে জানতে ও দেখতে। পৌচ্ছালাম আকাঙ্খিত অরণ্য কিনারে। অনেক দূরে ঘন কুয়াশায় দেখলাম ছোট ছোট ধূসর পাহাড় হেঁটে আসছে। কাছে আসতেই হাতিরা স্পষ্ট হয়ে উঠল। দুটো হাতিতে আমরা মিলেমিশে দুলতে দুলতে গভীর গহণে হারিয়ে গেলাম, হাতির পিঠ ছুঁই ছুঁই বন্য ঘাসে শুধু খস খস আওয়াজ। চোখে পড়লো হরিণের পাল যেন প্রাত ভ্রমনে বেড়িয়েছে। হঠাৎ হাতির মাহুত চুপ করতে বললো, চোখ মেলে তাকাতেই দূরে ঘাসের মধ্যে খস খস আওয়াজ! ক্যামেরা রেডি করে চোখ রাখলাম কিন্তু কয়েক পলকের জন্য এক ঝলক হলুদের ওপর কালো কিংবা কালচে বাদামির ডোরাকাটা শরীর টা চোখে পড়লেও আর কিছু দেখতে পেলাম না। শুধু লম্বা লম্বা ঘাস গুলো দূর পর্যন্ত দুলে উঠে স্থির হয়ে গেল। মাহুত বললো- বাঘ। মাহুতরা ঐ জায়গার আশে পাশে অনেক দূর পর্যন্ত ঘোরালো কিন্তু বাঘমামার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। অবশেষে ফিরে এলাম যেখান থেকে হাতি সওয়ারি করেছিলাম।
একটু পাশেই আকাশ ছোঁয়া সারি সারি রাবার গাছ। গাছের একটা অংশে চৌকো করে বাকল কেটে একটা সরু নল ঢোকানো প্রতিটি রাবার গাছে। সেই নল বেয়ে সাদা ঘন দুধের মত তরল নিচে রাখা পাত্রে জমা হচ্ছে। গাইড বললো ওটাকেই প্রসেস করে কারখানায় রাবার তৈরি হয়। কফি ও রাবার গাছ আমার প্রথম দেখা- প্রথম অভিজ্ঞতা। অনেক ছবি তোলা হলো ওখানে।
ফেরার পথে ছোট্ট একটা পাহাড়ি নদী বয়ে যেতে দেখলাম। সেখানে সবাই পা ভেজালাম। সুবীর সরকার অনেক ছবি তুললো, আমি একটা লাল পাখির ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাপস সরকার দা 'ঝুমা' বলে চিৎকার করে উঠলো। পাহাড়ে পাহাড়ে প্ৰতিধ্বনিত হলো- ঝুমা ঝুমা ঝুমা! সবাই যেন শিশু হয়ে গেলাম। অবশেষে resort এ ফিরে এলাম।
তখন রোদের রঙটা লঘু Nitric acid এর মতো, আমরা খাওয়া দাওয়া করে শীতের পোষাকে দুটো জিপসি করে forest এর অন্য একটা দিকে, আরও গভীরে যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম।
Forest এর gate থেকে আমাদের সাথে এলেন একজন বন্দুকধারী। গভীর জঙ্গলে মানুষ সমান উঁচু ঘাসের মাঝদিয়ে সরু মেঠো রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো জিপসি দুটো। একদম সামনেই দেখলাম একটা গণ্ডার পরিবার। দুটো বিশাল আকৃতির গণ্ডার আর একটা ছোট্ট গণ্ডার জঙ্গলের একটু ফাঁকা জায়গায় ছোট ছোট ঘাস খাওয়ায় ব্যস্ত। আমাদের মাথার উপর দিয়ে একটা ঈগল পাখনা মেলে উড়ে গেল, হয়তো বা বন্ধুর খোঁজে। আমরা আরো এগোলাম- একদল বাইশন আর একপাল হরিণের কাছে। দূরের দূরবীনে ধরা পড়ল অনেক গণ্ডার। জীবনে প্রথম নিজের চোখে গণ্ডার দেখলাম। ছোট বেলায় পড়েছিলাম কাজিরাঙা গন্ডারের জন্য বিখ্যাত, সেটা খুব ভাল ভাবেই উপলব্ধি করলাম।
অবশেষে এলাম গভীর জঙ্গলে- যেখানে একটা বাঁক নিয়ে নদী বয়ে গেছে- যেন কোনো যুবতী পাশ ফিরে শুয়ে আছে শ্বেত বসনায়। চিতল মাছে ভরা নদীর ওপারে একপাল হরিণ জল খেতে এসে থমকে গেছে হাতির দল দেখে। বন্য হাতির রূপই আলাদা- ছোট ছোট হাতির বাচ্চা গুলো খুব সুন্দর। গাইড বললো হাতির দলের পেছনে বাঘ থাকে- আমি তখন সামনে জোড়া গন্ডারের বিশাল আর বন্য রূপ দেখে চলেছি।দেখলাম নদীর জলে একপাল বন্য মহিশের দূরন্তপনা। নদীর বুকে চিতল মাছ গুলো মাঝে মধ্যেই নেচে উঠছিল রুপোর গয়নার মত।
সবুজে সবুজে ঘন বিশাল এই অরণ্যে অফুরন্ত প্রানের চঞ্চলতা- এমনটা আমি ভাবিই'নি আর নিজের চোখে না দেখলে উপলব্ধি'ও করা যেত না।
এখানে না এলে এই গভীর অরণ্য মাতৃগর্ভের মত রহস্যময়ী হয়ে থাকতো সারাটা জীবন।
বিদায় বেলায় ধনেশ পাখি দুটো বুঝতে পেরে বলে উঠলো- আবার এসো তোমরা আমাদের প্রানের মাঝে।
এবার ফেরার পালা। ধীরে ধীরে ফিকে হতে লাগল সেই গভীর অরণ্য- আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল সেই পরিচিত কোলাহল। ফিরে এলাম অদ্ভুত সুন্দর এক জগত থেকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে।
পথে চা খেয়ে resort এ ঢুকলাম।
সেই সন্ধ্যায় resort এ আয়োজন ছিল আদিবাসী মেয়ে পুরুষদের নাচ। লাল পাড় সাদা শাড়ির ঐক্যতানে ছিল মাদলের দৃমি দৃমি আওয়াজ। মাঝে ছিল লকলকে আগুনের আঁচ। আমাকেও হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ওদের নাচে । অনেক ছবি তুললো সকলে।
আবার সকাল হলো, এবার ফেরার পালা। সকলেই তৈরী হয়েছি ফিরে আসার জন্য কিন্তু কেমন যেন মায়ায় পরে গেলাম সবাই। এত সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে যেতে কারো মন চাইছিল না।
সমস্ত ঘটনাটাই ছোট গল্পের মত মনে হলো- শেষ হইয়াও হইল না শেষ।
আমাদের গাড়ি তিনটে আঁকা বাঁকা পথ ধরে রাজপথে উঠলো।
তৃপ্ত মন নিয়ে শেষবারের মত দূরের সেই সবুজ নিরবতা কে দেখে নিলাম। আস্তে আস্তে আরো দূরে সরে যেতে লাগলাম আমরা। গাড়ির জানালা দিয়ে সদ্য ভেজা চুল উড়িয়ে গৌরী বন্য হাওয়ার অনুভূতি নিতে নিতে গেয়ে উঠলো- কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা...।
মনোরম মন্দারমনি
মন্দারমণি যাওয়ার ইচ্ছেটা বরাবরই ছিল। তা বলে অতিমারীর এইসব দমবন্ধ পরিবেশে যে সেখানে যাওয়া হবে ভাবিনি।হয়তো যেতামও না যদি না ছেলের ব্যাপারটা মাথায় আসতো।বছর পাঁচেকের খুদেজনটি বাড়ির বাইরে না বেরিয়ে ঘরে থেকে থেকে এমন একটা মানসিক অবস্থার শিকার যে বাইরে শব্দটা শুনলেই তার ভয় লাগে এই বুঝি করোনা হয়ে যাবে।তখনই মন্দারমণির প্রস্তাব এবং তাতে বউ আমতা আমতা করলেও ছেলে নিমেষে রাজী। সমুদ্র তার খুব পছন্দ।আমাদের সঙ্গে জুড়ে গেল আমার মামাতো ভাই বাবুসোনা। তারপর আর কি…পোশাক-টোশাকের সাথে স্যানিটাইজার, ডিসইনফেক্ট আর মুখে মাস্ক পরে শনিবার বিকেলে পৌঁছে গেলাম।টিকিট দীঘা অবদি থাকলেও বুদ্ধি করে কাঁথিতে নেমে গেলাম বলে বেশ খানিকটা আগেই গেলাম পৌঁছে।বিকেলে হোটেল মৈনাকের দোতলায় লাগেজ রেখেই সমুদ্র সৈকতে দৌড়।ভীড় ভাট্টা তেমন না থাকায় সমুদ্রের সান্নিধ্য আরো বেশি করে উপভোগ করতে পারলাম।
একটু হেঁটে বিচটা ঘুরে দেখতে দেখতে বুঝলাম মন্দারমণির এটাই বিশেষত্ব: হোটেলগুলো মূলত সমুদ্রের গা-ঘেঁষে।হোটেলের খাওয়া-দাওয়া খুব আহামরি নয় কিন্তু সমুদ্রকে এত কাছে পেয়ে আমরা খুব খুশি।আরো খুশি ছেলের আনন্দ দেখে।সে ব্যাটা বিকেল থেকেই ঝিনুক কুড়োতে লেগেছে।রাতে অবশ্য বিশেষ কোথাও ঘোরবার ছিল না।হয়তো নিরাপত্তার কারণেই বিচের দিকের গেট ছিল বন্ধ।হোটেলে ফ্যামিলি নিয়ে আসা পর্যটকের সংখ্যা বেশি।ফলে অতিমারীর থমকে থাকা বন্দী বন্দী পরিবেশটা মনেই হচ্ছিল না।তারপর রোববার ভোরে হোটেলের ঘর থেকে সানরাইজ দেখে এতটাই তরতাজা আর অণুপ্রাণিত লাগলো নিজেকে যে মনে হচ্ছিল বিশ্বনাথন আনন্দকে তুড়ি মেরে কিস্তিমাত দিতে পারি যে কোনো সময়ে।সূর্যটা এতটাই মোহময়ী ছিল যে ঘুমন্ত ছেলেকেও ডেকে দিলাম যাতে এই মুহুর্তগুলোর সাক্ষী সেও হতে পারে।বউ ছেলেকে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে চলে গেল কিছুক্ষণ পরেই।অগত্যা আমাকেও যেতে হল তাদের সাথে।সকাল বেলার লাজুক সূর্যের চোখ দিয়ে সৈকতকে দেখে বিস্কুট আর ডাবের জল খেয়ে হোটেলে ফিরে দেখি ভাই ততক্ষণে উঠেছে।ভাইএর ঘরে সবাই একসাথে কচুরি খেয়ে আবার বিচমুখী।লক্ষ্য স্নান।রাতেও চোখে পড়েছিল।বেলায় উঠেই বসলাম স্পিড বোটে।সমুদ্রের ৪-৫ কিলোমিটার ভেতরে নিয়ে গেল।টাকাটা বেশি নিলেও অভিজ্ঞতাটা বেশ রোমাঞ্চকর। ছেলে ভয় পেয়েছে বলে তাকে ভরসা দিতে গিয়ে বুঝলাম,ভয়টা আমারো কম কিছু লাগছিলো না।না, দুপুরে কাঁথি স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে অবদি আর কোথাও ঘুরিনি।মন্দারমণির ওই বিচেই ছিলাম।সমুদ্র সামনে থাকলে আর কোথাও বুঝি যেতে মন চায় না।যে অটোচালক দাদা আগের দিন আমাদের এনেছিল সেই আবার নিয়ে গেল হোটেল থেকে। হাওড়া পৌঁছতে পৌঁছতে ক্লান্ত সন্ধ্যের সাথে মোলাকাত হলেও মনে ততক্ষণে সঞ্চয় করেছি এমন সুন্দর আর আনকোরা অভিজ্ঞতার স্মৃতি যে আমি নিশ্চিত তাদের রোমন্থন পাথেয় করে আগামী দিনের পথ হয়ে উঠবে আরো মনোরম।
Designed by OddThemes | Distributed by Gooyaabi Templates