হৃদস্পন্দন

  • Home


  • Download

  • Social

  • Feature


হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন 
প্রথম বর্ষ ~ একাদশতম সংখ্যা 
বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা 

সূচিপত্র:

মেঘনা রায় ॥ সংগ্রামী লাহিড়ী ॥ অসীম বিশ্বাস ॥ সৌমী গুপ্ত ॥ শ্রাবণী গুপ্ত ॥ বিকাশরঞ্জন  হালদার ॥ ড: দেবদ্যুতি করণ ॥ চন্দন আচার্য ॥ প্রতীক মিত্র ॥ 


অরণ্যর বর্ণ পরিচয় 

অচেনা ঝরনার কাছে অবহেলে হেঁটে যাওয়া খুব সহজ নয়। মাতাল জঙ্গুলে গন্ধ তীব্র এক পিছুডাক ছড়িয়ে রাখে ।ব্যস্ত সড়ক পথ রহস্য রাখেনা সে বড় সোজাসাপটা খোলামেলা তাই তাকে পড়ে নেওয়া সহজ।কিন্তু ইতস্তত সবুজ আলোয়ান গায়ে জঙ্গুলে সুঁড়ি পথে হঠাৎ আ্যালার্ম কল কিম্বা গাড়ি বিগড়ে গিয়ে  বিশাল ঘাসের জমিতে চিতলের সাথে অনর্গল বৃষ্টি ভেজা আলাভোলা সবুজের কাহিনী প্রলম্বিত রেশ রেখে যায়।সেই  কোন ছোটবেলা থেকেই  বিভুতিভূষণ, বুদ্ধদেব গুহর জঙ্গলময় পাঠশালায় আমার নাম লেখানো। শীতের শুষ্কতায় কেমন করে ভিজে যায় কুয়াশার  বনপথ, পর্ণমোচী আরণ্যক প্রতিভাস কেমন করে ভ্রামণিকের চোখে আদুরে হয়ে ওঠে, এই আরণ্যক সংহিতার পাঠ তো ওনাদেরই দান। ওনাদের  হাত ধরে এবারের হঠাৎ জঙ্গল সফর  হাতে কলমে শিক্ষার পাঠ বৈ তো নয়।নিঃস্বার্থ ভাবে শুধু মাত্র জঙ্গল আর বন্যপ্রাণী কে ভালোবেসে তাদেরই রাজপাটে কটা দিন  কাটানো। আমাদের যত রকমারি জঙ্গুলে বন্ধু আছেন যারা বেড়ানো বলতে কেবল জঙ্গলই  বোঝে তাদেরও  চমক দেবার জন্যই এই অরণ্য বি.আর.হিলস. কে ঘিরেই এবারের কিসসা।

প্রথমে উড়ান পথে ব্যাঙ্গালোর,তারপর গাড়ি বাহনে মাইসোর হয়ে ১৭৩ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে দিতে গনগনে গরমের মধ্যে দিয়ে একটানা ব্যাঙ্গালোর থেকে ধুলো খেতে খেতে আসছিলাম। আমাদের ড্রাইভার সাহেব ধবধবে সাদা উর্দির ভেতর থেকে উঁকি দিচ্ছেন অতি সজ্জন মানুষ । তবে হালকা তালকানা আছেন বলেই রাস্তা গুলিয়ে গাড়ি এপাশে —ওপাশে নাচিয়ে খেতের পাড় ধরে ধুলো ওড়াতে ওড়াতে একেবারে ডাঁই করা আখের সামনে এসে গাড়ি খানা দাঁড় করিয়েছেন। তবে এই সুযোগে আখ চাখাও হল রাস্তার হদিস ও পাওয়া গেল।জানালা দিয়ে  ভারী শুকনো লু বইছে।  মনের সুখে দু পাত্তর মিষ্টি আখের রস পেটে পরা মাত্রই দু-চোখে দুপুর বাবুর ঘুম একেবারে ঝুপ  করে নেমে এল।সেই সুখনিদ্রা ভাঙতে ভাঙতে রাস্তার দু'ধারে কাবেরী নদীর জল নিয়ে আদালতের রায়ে অখুশি মানুষের মিছিল টপকে রুক্ষ সবুজ প্রকৃতিকে ধুলো ধোঁয়া মাখিয়ে বিলিগিরিরঙ্গনাবেট্টা ( বি.আর.হিলস.) পাহাড়ের মধ্যে ঢুকে গেলাম। এখানে বলা প্রয়োজন নদী কাবেরী নয় আমাদের গন্তব্য কাবেরীরই এক শাখানদী কাব্যময়ী কাবিনীর আশ্রয়জাত অরণ্য।  আমরা হলাম গিয়ে শহুরে লোক সামাজিক গৃহপালিত।  জঙ্গলের বর্গীয় জ নিয়ে যাদের কোনো ধারণাই নেই। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম কী করে একটা সটান রাস্তা ফস করে জঙ্গল হয়ে গেল।ডায়নে বাঁয়ে যত দূর চোখ যায় পাহাড়ের ওপর থেকে নীচ অবধি ঘন সবুজের বল্লরী ওম।বেলা শেষের সোনালি রোদ জরির নক্সা বুনছে ঐ শ্যামল অঙ্গবাসে। বাঁ দিকের নদীর ভগ্নাংশে  একটা বাইসন জল খাচ্ছে। তার একটু বিলম্বিত ধ্যাবড়নো ছায়া পড়েছে জলে। ঐ তো ফরেস্ট লজের প্রবেশ মুখের রাস্তায় দুটো ময়ূর কী সুন্দর র‍্যাম্পে ক্যাট ওয়াক করছে। ময়ূর থেকে চোখ সরাতে না সরাতেই ঝোপের আড়াল থেকে কয়েকটা স্পটেড ডিয়ার বেরিয়ে  বিদ্যুদবেগে ভ্যানিশ হয়ে গেল।আমি বিড়বিড় করে বললাম 'ব্যাম্বি'। ড্রাাইভারজি সবেগে উত্তর দিলেন 'বাম্বু নহী ম্যাডম ,ডিয়র হ্যায় ডিয়র। "

—রাত যামিনী —
    
ঘোঁৎ!যে দিকে তাকাচ্ছি সে দিকেই অজস্র দাঁতাল।  প্রকৃতির বুনো শুয়োর আজগুবি সব শব্দ করতে করতে ঘোরাঘুরি করছে। সান্ধ্যকালীন চায়ের আসরে এসেছি গোলঘরে।  কিছু শুয়োরের চেহারা  দেখলেই মনে হয় তাদের জন্মই হয়েছে গৃহস্বামীর টেবিলে সসেজিত অবস্থায় পৌঁছানোর জন্য।কিন্তু এখানে যাদের দেখছি তাদের শরীর  রীতিমতো ব্যায়াম করা। গায়ের ওপর ছাই ছাই রঙের  নিপুণ কেশ বিন্যাশ। ডাইনিং কাম গোল ঘরটাও ঠিক ঘর নয়। আকাশের নীচে নৈশভোজ করার জন্য একটা খুঁটির ওপর  চারদিকে কাঠামো খাড়া করে তার মাথার ওপর পাখি আর বাঁদরের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য লোহার জালের শক্ত একটা নেট দেওয়া।এ বাদে গৃহপালিত আর বন্যজন্তুর জন্য অন্তত নৈশভোজের সময় টুকুতে আর বিশেষ কোনও বেড়া নেই। আপাতত ভরা জঙ্গলে গোলঘরের একধারে কাঠের ওপর কাঠ চাপিয়ে বনফায়ারের ব্যাবস্থা হয়েছে। কফি ফলের গন্ধে এখানে সন্ধ্যে নামছে পা টিপে টিপে। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা একটা হালকা ভেজা ঠান্ডা বাতাস রকিং চেয়ারে আধশোয়া আমাকে জঙ্গুল ঋজুদা, পৃথু,উত্তর বঙ্গের অর্জুনের কথা মনে করাচ্ছে।  জঙ্গলের মহাকাব্যে স্বয়ং বুদ্ধদেব গুহ  মনের  গভীরে বাসা বেঁধে রয়েছেন।আসলে আমি তো ওনার সৃষ্ট চরিত্রদের সাথেই জঙ্গলে আসতে চাই  বারবার। কিন্তু বনের পরে বন তারও ওপারের বন অন্য কথামালা সাজায়। 
দূরের গেস্ট হাউস থেকে টেবিল টেনিস খেলার শব্দ ভেসে আসছে। মৃদু হলুদ আালোয় ঠান্ডা বিয়ারের বোতল বুদবুদ কাটছে। গোলঘরের পেছনে ঝিঁঝিঁর ডাক।  মাথার ওপরকার নীলাভ চাঁদ  আকাশে বিরামহীন যাত্রাপথে লক্ষ তারার চুমকি দিয়ে ক্যানভাস এঁকেছে। অন্ধকারের প্রাগঐতিহাসিক গন্ধ আমায় স্বমূলে নাড়িয়ে প্রাকৃতিক রোম্যান্টিকতার অতলের শেষ  ধাপে  নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে মনের কোনও আগল নেই,শাসন নেই।গোলঘর থেকে একটা কাঁচা রাস্তা এঁকে বেঁকে আমাদের লগহাটের দিকে চলে গেছে। একটু গা ছমছম করা রাস্তার দু'ধারের গাছে গাছে ঝোলানো নিবু নিবু লণ্ঠনের আলো পথ দেখাচ্ছে।নৈশভোজ আর প্রকৃতিরসাথে তুমুল রোমান্টিকতা শেষ করে ঘোর বাস্তবের পথ ধরে লগহাটের দিকে হাঁটা লাগালাম।এই একটু খানি সিম্পল রাস্তার মধ্যে কোনও এডভেঞ্চার থাকবেনা এমন একটা নিশ্চিত ধারণা নিয়েই অন্ধকার খাড়াই ধরে কিছুটা গিয়েছি মাত্র;কেমন একটা খসমস শব্দ শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম।  অন্ধকারে চোখ ধাতস্থ হতে দেখি এক ব্যাটা দাঁতাল তার প্রাইভেট প্রপার্টি  রক্ষা করার  ভঙ্গিতে তেরিয়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।  অবস্থা বেগতিক দেখে পশ্চাদপসারণ করতে যাচ্ছি  দেখি জঙ্গল লজের একটা লোক উর্ধশ্বাসে ছুটে আসছে। স্পষ্ট বাংলায় বলেন "আরে আরে আপনারা করেন কি?এই অন্ধকারে এমন করে যেতে আছে? বুনো শুয়োর খেপে গেলে বাঘ অবধি মেরে টাগ করে দেয়। আপনারা তো কোন ছার!" আমাদের বিপরীতমুখী সমস্বরের পুলকিত জিজ্ঞাসা "আপনি বাঙালি বাঃ!"
   
 —ফরেস্ট মডেলচন্দ্র—
    
আমাদের  মতো টুরিস্টদের মনে মনেও একটা চোরা কমপিটিশন থাকে যা অস্বীকার করার উপায় নেই।এখানে এসে ঐটা দেখতে হবে ওমুকটা বাদ গেল।ইশ!! কী করে মিসেস দেবরায় কে বলবো সারা দিনমান চক্কর কেটেও আস্ত বাঘ কেন একটু হলুদ কুচিও দেখতে পাই নি।তাই স্বভাবতই ঐ রিপু দোষেই আমরাও বাঘ দর্শনের জন্য হন্যে হয়ে গেলাম।সেই ভোর বেলার জঙ্গল সাইটিংয়ে শুরুর থেকে একগাদা সম্বর হরিণ,জায়েন্ট স্কুইরাল,বার্কিং ডিয়ার, লেঙ্গুর, হাতির পাল, ময়ূর, এক লক্ষ পাখি দেখে টেখে একদম ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে গোলঘরে চা আর টা খাচ্ছি কিন্তু মন বেচারা খুব ঝুলে আছে। "তোমার দেখা নাই রে মামা তোমার দেখা নাই।" সুরজিৎ এর সেই বিখ্যাত গানের কলি লগ হাটের এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্তে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।হঠাৎ এক নব্যবিবাহিত কাপলের আবির্ভাব ঘটল।হাই হ্যালো ইত্যাদি কুশল বিনিময়ের পরে কী কী  জন্তু দেখলেন প্রশ্ন করলেন তারা।আমাদের উত্তর শুনে চোখ কপালে তুলে বললেন 'সে কি আপনারা এখনও  বাঘ দেখেন নি? "আমি আশ্চর্য  হবার  সময়টুকুও পেলাম না যেন।কী বলে এরা? বাঘ কি শপিং মলের জিনিস? ইচ্ছে হলেই দেখা যায়? দরদাম করা যায়! ওনারা এমন ভাব করলেন যেন মনে হল চিড়িয়াখানা থেকে বাঘ দেখে ফিরব। পরে হাতরে পাতরে জানা গেল নব বর কার্তিকের বাড়ি শিকারী ফ্যামিলি।  তাই তাদের এতো বোল বোলা আর কী!! মনটা একটু খিঁচড়ে গেল। যাইহোক বাইরে বেরিয়েই দেখি বোর্ডে লেখা বিকেল বেলাতেই  আর একটা টাইগার সাইটিং হবে।বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না। 
এবার অন্য বুদ্ধি পাকড়াও করলাম।লজের সব স্টাফ দের পুছপাছ করে  জানা গেল এখানে বাঘ দেখানোর কেতা লোক আছেন থাপা সাহেব।এই থাপা সাহেবের সাথে বড়ো বেড়ালদের দোস্তি কিঞ্চিৎ অধিক।লজের পেছন দিকটায় ওনার কোয়ার্টার। গুটি গুটি  পায়ে হাজির হয়ে নক করলাম ওনার দরজায়।উনি "কৌন হ্যায়" বলে  বেরিয়ে এলেন।  বেশ শক্ত পোক্ত চেহারা থাপা সাহেবের।  তবে নাকের নীচের গোঁফ জোড়ার বিস্তার  দেখে মনে হল এই গোঁফ বিলাসী ভদ্রলোক কে দেখে বাঘ ও বোধ হয় মুচকি হাসে।"গোঁফের আমি গোঁফের তুমি গোঁফ দিয়ে যায় চেনা "এই বাংলা প্রবাদ টা ওনার জানা নেই  বলে একটু দুঃখ পেলাম।মহিলা  সহযাত্রী হিসেবে এডভান্টেজ নিয়ে আমি ও কান এঁটো  করা হাসি  দিয়ে সোজা ওনার সাথে হ্যান্ডশেক। ঐ শেক অবস্থাতেই আবদার টি পেড়ে ফেললাম।একটু ন্যাকা গলায় বললাম ওনার সাথে বাঘ দেখতে যেতে চাই।  উনি ও রসিক মানুষ ধরে ফেললেন বেশ। পরে শুনলাম আমার আবদারটা নাকি অনেকটা কাবাডি খেলতে যাব স্টাইলের বলা হয়েছিল। কারণ খোলা জঙ্গলে ফেস টু ফেস বাঘ দেখা তো সহজ কম্ম নয়। প্রথম জঙ্গল ভেঞ্চারে যদি একটা আস্ত বাঘের দেখা কপালে থাকে তবে তার কেতাই আলাদা।যাইহোক নিন্দুকদের কথায় কান দিতে নেই।আসলে বয়স জনিত কারণে উনি সাইটিং করান না এখন।তাই এতো নাটক। 
উনি ও শর্ত দিলেন বাঘ যেখানে থাকে সেখানে আর কেউ থাকে না।হয় বাঘ দেখতে পাবেন নইলে কিছুই পাবেন না—কি রাজি?  যা বোঝার বুঝে গেলাম সে দেখা না দিলে সম্বর বা বাইসন কেন একটা বেঙুরেরও দেখা পাব না।খেলতে যখন নেমেছি ময়দান ছেড়ে ভাগবো না। 
অবশেষে রওনা দিলাম দুগ্গা দুগ্গা করে। ওনার গাড়ি কিছুক্ষণ চলার পর পিচের রাস্তা ছেড়ে কাদার রাস্তায় নামল। তারপর ঘাসের রাস্তায় নামল।  শেষে রাস্তা বলে  আর কিছুই রইল না।  থাপা সাহেব দুঃখ করলেন   আাগে উনি গাড়ি নিয়ে বেরোলেই গোটা দুই বাঘ অন্তত দেখা দেবার সংকল্প নিয়ে  বেরিয়ে পড়ত।আর এখন —ছোঃ! এই সব কথা  শুনতে শুনতে বহুদূরে চলে এসেছি।গায়ের ওপর সূক্ষ্ম ধুলোর একটা আবরণ তৈরি হয়েছে। হঠাৎ থাপা সাহেব জিপটা থামিয়ে মুখের ওপর আঙুল রেখে বললেন "শশশ।" কোথাও কোনও শব্দ নেই, বাঘ দেখে বাঁদরের পালিয়ে যাওয়া নেই, শ্বাপদের গন্ধে জঙ্গলের মধ্যে থেকে হরিণের ডাক নেই —সেই অসম্ভব নিস্তব্ধতার মধ্যে শুধু চোখে একটা বাইনোকুলার লাগিয়ে থাপাজির আঙুল ফলো করলাম —বাঘ। 
জলার ঠিক উল্টোদিকে সে রাজাগজার মতো এলিয়ে পড়ে আছে এক কাত হয়ে। দেখে মনে হচ্ছে যেন সামনের ঘাসের জমি ইজারা নেওয়া আছে পায়চারি করতে বের হবে তা-ই রিলাক্স মুড। থাপা সাহেব গাড়িটা আরও কিছুটা  এগিয়ে নিলেন ইঞ্জিন বন্ধ করে।মিনিট পাঁচেক দমবন্ধ অবস্থায় কেটে গেল (বলার সময় অবশ্য বাড়িয়ে  মিনিট পনেরো বলেছিলাম) —ব্যাটা হঠাৎ বোধ করি মানুষের গন্ধ পেয়ে গোল করে ঘুরে  উঠে দাঁড়াল। তারপর এক বিশাল হাই তুলল। বাইনোকুলার ছাড়াই খালি চোখে দিব্যি ভালো পরিস্কার দেখা  যাচ্ছে বাঘমামা কে।মনে হল জলা থাকলেও যদি মামা হঠাৎ ছুটতে শুরু করে তা হলে এক কান্ড হবে। ফরেস্ট মডেল বাঘারুচন্দ্র হাই তোলা শেষ করে সটান আমাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর একটুও পাত্তা না দিয়ে দুলকি চালে গাছপালার মধ্যে ঢুকে গেল। গেল তো গেল  আর এল না। থাপাজির মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে গেছে  আমার স্পন্ডালাইটিস ওয়ালা  কাঁধে এক  চাপড় মেরে বললেন—"ক্যায়া বোলাথা না, হামনে ক্যায়া?"  সে চাপড়ের বোঝা এখনও কাঁধ থেকে নামাতে পারিনি।সেই দিন ফিরে এসে আমাদের নামের পাশে বোর্ডে টাইগার সাইটিং-এর ঢ্যারা পড়ল।আমরা বড় মুখ করে রাজা উজির মারলাম।সেই  শিকারী কাপল বেরিয়ে এসে বললো  আমরা নাকি দারুণ লাকি গাইস।  সেই রাতের  ডিনারের আগে এক পশলা ব্লুলেগুন মাতিয়ে দিলো। মনটা পুরো  ফুরফুরে বিন্দাস হয়ে গোলঘরের রক এন্ড রোল চেয়ারে বসে বুঝি সত্যি ই একটা পাখি হয়ে রাস্কিনবন্ড আর বুদ্ধদেব গুহর হরেক কিসিমে’র জঙ্গুলে  বইয়ের জঙ্গলে টুপুস টাপুস করে  উড়ে বেড়াতে লাগলো। 
পরদিন লগহাট ছেড়ে নেমে আসছি হ্যামকে শেষ বার চড়তে গিয়েও হাত ছেড়ে আসছে।  কাবিনী  যাবার পথে  বরাদ্দ দেড় দিনে এই অরণ্য প্রথম পাঠে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে।  ক্রমাগত পাহাড় ডিঙনো মন কে আরণ্যক নির্জনতায় পাখপাখালির আড্ডায়  ভিজিয়ে সতেজ করে  দিলো। কটেজের রাস্তার দিশারি লণ্ঠন গুলো খুলে নিয়ে গেছে কেউ।  লগহাটের ঠিক সামনেই একটা বেগুনি ফুলের গাছ। ঝেঁপে ফুল হয়ে আছে।  এসে থেকে ভাবছি ভালো করে দেখব ছোঁব কথা বলবো তা আর হয়ে উঠল কই ? ঐ বেগুনি ফুলের  নীচে আমাদের সেই  সাদা উর্দি পরা তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। ফরেস্টবাংলোর লাইব্রেরি থেকে সেলিম আলির  বইটা নিয়েছিলাম "দা ফল অফ আ স্প্যারো"সেটা রাখতে গোলঘরে গিয়ে দেখি সকালের সাফারির  জিপটা জাস্ট বেরিয়ে গেল। টেবিল থেকে এখনও কড়া দুধেলা কফির গন্ধ মুছে যায় নি।টেনিস টেবিলের ওপর কে যেন একটা ছাতা রেখে গেছে।  কী মনে হতে ওদের  স্টোর থেকে একটা জ্যাকেট কিনলাম  খয়রির ওপর  সাদা  সুতো দিয়ে "জঙ্গল রির্সট "লেখা।মনটা খারাপ করব না ভেবেও হয়ে যায় কেমন করে  যেন। সবাই আমরা এ ভাবেই একটা নতুন জায়গা ছেড়ে আর একটা নতুন পাওয়ার আশাতে যাই।গাড়িতে ওঠার সময় লজের লোকজন বললোএ তো বি.আর.হিলস দেখলেন,কাবিনী যান কাবিনী।বললাম " কাবিনী ই তো যাব  এ-ই  টা তো কাবিনীর বাফার এরিয়া —বর্ণ পরিচয়ের প্রথম ভাগ। গাড়িতে উঠেই বলি " ড্রাইভার জি কাবিনী চালিয়ে। "

লেখিকা মেঘনা রায় 
কল্যাণী, নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ 




    
             



পাহাড়ি অচেনা গ্রাম

এখানে তিস্তা চলেছে খরস্রোতা ছন্দে। দুধারে সবুজ শ‍্যামলিমাময় পাহাড়গুলো আগলে রেখেছে তাদের । তিস্তা পেরিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা গাড়িতে পাকদন্ডী বেয়ে ওঠার সময় আশেপাশে ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে সাজানো অফবিট জায়গা বা গ্রাম সামসেট। তারপর খানিকটা আরও এগিয়ে গেলে কালিম্পং আর রংপোর ঠিক মাঝখানে নিজের ছন্দে একান্তে গড়ে ওঠা ছোট্ট গ্রাম মাণ্ঝারজঙ।অহংকারের অলংকারে অলংকৃত।যার আছে অমন মনোহরনকারী কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেতশুভ্র শিখর তারই অহংকার সাজে। পাহাড় এখানে গাম্ভীর্যের আবরনে ঢাকা। তুমি তাকে আলিঙ্গন করতে পারবে না। যেদিকে চোখ যায় নীল আকাশের নিচে দূর দূরান্তে শুধু বরফের শিখর। মাঝখানে একফালি আকাশের নিচে বিস্মৃত  হতে হয় নিজের অস্তিত্ব...নগণ্য লাগে বড্ড। সূর্যরশ্মি রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার আগে সোনালী ভুল বললাম সোনার আবীর ছড়িয়ে দিয়ে যায় সারা আকাশ জুড়ে। যেন সোনা মেখেছে গায়। বরফের চূড়া গুলো সোনায় সোহাগা হয়।কি অভূতপূর্ব দৃশ্য  নিজের চোখে না দেখলে অবিশ্বাস্য। আবার রাত্রির চাদর সরিয়ে ভোরের আলো যখন স্পর্শ করে আকাশ ,পাহাড় ,পর্বত চূড়া... আবছা কালো...সোনালীবর্ন ও সর্বশেষে শ্বেতশুভ্র আবরনে বড্ড অহংকারী সে।  

বহু নিচে ক্রন্দসী তে তিস্তায় সুনীল বুকের উপর জমা হয় অভিমানী মেঘ। তুমি তাকে দেখে আপ্লুত হবে শিহরিত হবে ঠিকই কিন্তু মায়ার আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখবে এমন স্পর্ধা হবে না।একদম ভোরবেলা যখন রাত্রির অন্ধকারের চাদর সরে যায় আস্তে আস্তে তখন ওই পাহাড়ী চূড়াগুলো সূর্যের প্রথম রশ্মি মাখে গায়।একদম যেন ২৪ ক‍্যারেট সোনায় মুড়ে দিয়েছে কেউ।চারিপাশে অগুনতি শৃঙ্গ। তারপর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চূড়াগুলো একদম ধবধবে সাদা হয়ে যায়।তার অনেক নীচে অভিমানের মেঘ জমে পাহাড়ের কোলে। আর কিছুটা রঙ্গীত ও তিস্তার বুকে ।এক খন্ড মেঘ জমে ক্রন্দশীতে।আরও রোদ্দুর বাড়ে,সবাইকে চমকে দিয়ে দুটো শৃঙ্গের মাঝে কাঞ্চনজঙ্ঘায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওঁ লেখা। অভূতপূর্ব! নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।সেই ওঁ নিজের উপস্থিতি জানান দেয় স্বমহিমায়। প্রচলিত মত অনুযায়ী ওই ওঁ হল স্বয়ং শিবের মাথায় বিরাজ করছে। ঠিক ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি সত্যিই স্বর্গীয় প্রকৃতির কোলে যেন ক্ষুদ্র এক মানবী! মেঘবালিকার দল ক্রমশ বিলীন হয়ে যায় আকাশে। শৃঙ্গ ঢেকে যায় থোকা থোকা জুঁইসাদা মেঘে। মাঞ্জারজঙ থেকে তিস্তা যেখানে মিশেছে রঙ্গীতের সাথে ওই জায়গাটা দেখা যায় । তিস্তা সবুজ হলেও রঙ্গীত কিন্তু পরিষ্কার আকাশবর্ণা!এখানে চারিদিকে কমলালেবুর বাগান আর আছে গোল গোল ছোট ছোট কাঁচালঙ্কা। তীব্র ঝাঁঝ তার ! ঝালেও কিছু কম নয়! 
পাহাড়ি উপত্যকা গুলো অজস্র নাম না জানা ফুলে ঢেকে যায় এইসময়! অনেক ঝোরাও আছে চারিদিকে। তবে এখন শীতের সময় পাহাড় নিজের কাছে বরফের চূড়ায় জমিয়ে রাখে উচ্ছল জলরাশি। সন্ধ্যেটা নেমে আসে ঝপ করে।পাহাড়ের গভীর খাতগুলো ভয়াবহ আকর্ষণ নিয়ে বিলীন হয়ে যায়।একটা দুটো আলো জ্বলে স্থানীয় বসতিতে। তারপর গোটা পাহাড়ে যেন কেউ ফানুস জ্বেলেছে মনে হয় ।সূর্যটা পুরোপুরি নিভে যাওয়ার আগে গোটা আকাশে আগুনের আবীর ছড়িয়ে দিয়ে যায় ! তিস্তার দুধারে সাদা বেলাভূমিতে ছড়ানো ছিটানো নুড়ির গায়ে চাঁদের আলো গলে পড়ে । তিরতির করে বয়ে চলে সবুজ নদী।পাইনের বন থমকে দাঁড়ায় দুধারে বোবা কান্না নিয়ে।এখান থেকে জলসাঘর দেখা যায় যেখানে স্বয়ং রবি ঠাকুর ছিলেন বেশ কিছুদিন । সবমিলিয়ে মনে হয় কোনও অজানা মায়াময় পৃথিবীর নির্জন প্রান্তে চলে এসেছি একান্তে যেখানে জন কোলাহল নেই,নিজস্ব ভঙ্গিতে প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়েছে দুহাত ভরে। তবে যদি কেউ চায় আর্টিফিশিয়াল কোনও আনন্দে মাতবেন সেই সুযোগ কিন্তু নেই। এই প্রকৃতির কোল একদম নির্জনতায় ভরপুর‌।

সাহিত্যিক সৌমী গুপ্ত
১৬২, রাইফেল ক্লাব রোড, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ















প্রকৃতি যখন ভাস্কর -গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন

সেই কতযুগ আগে ওরা থাকতো উঁচুনিচু পাহাড়ি জমিতে ঘর বেঁধে। রুখোশুখো জমি,লাল মাটি। সেখানেই লাল লাল মানুষগুলোর ঘর। ওরা নিজেদের বলে হুয়ালাপাই। একসঙ্গে দল বেঁধে শিকার করে আনতো, জঙ্গল থেকে ফলমূল কুড়িয়ে ভাগ করে খেতো। সুখের জীবন। হঠাৎ আকাশ থেকে দেবতা পাঠালেন বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি তারা কোনোদিন দেখেইনি। জল এলো ঝাঁপিয়ে,বন্যায় ভেসে গেল ঘরবাড়ি। সবাই সর্দারের কাছে কেঁদে পড়লো, "সর্দার, একটা কিছু কর।"হুয়ালাপাইদের সর্দার খুব সাহসী, বন্যাকেও ডরায় না।বেরিয়ে পড়ল নিজের বিরাট ছুরিটা নিয়ে। সবাই অবাক হয়ে চেয়ে আছে। তাদের চোখের সামনে সর্দার জমির ওপর ছুরি বিঁধিয়ে দিল। দেখতে দেখতে চোখের সামনে মাটি খুঁড়ে নালা কাটা হলো। বন্যার জল সেই নালার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে পড়লো সমুদ্দুরে। সর্দারের জন্যেই হুয়ালাপাইরা বাঁচলো সেবার। 
সেই নালা বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ের বুক কেটে কেটে বসলো, চলে গেল অনেক, অনেক নিচে। তৈরী হল সুগভীর গিরিখাত। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। যা দেখতে দুনিয়ার লোক ছুটে আসে আরিজোনার মরুভূমিতে। 
হালোনা গল্প করছিল বোট চালাতে চালাতে। লালচে গায়ের রং। ছোট ছোট চোখদুটি সবসময়ই হাসিতে উজ্জ্বল। মাথায় লম্বা বিনুনি। নেটিভ আমেরিকান বা আমেরিকান ইন্ডিয়ান।ওরাই এখানকার ভূমিপুত্র। কলম্বাস আমেরিকার মাটিতে জাহাজ ভিড়িয়ে ভাবলেন ইন্ডিয়াতে এসেছেন। তাই এখানকার লাল মানুষগুলোকে বলা হলো 'ইন্ডিয়ান'। হালোনা হুয়ালাপাই উপজাতির মেয়ে। কলোরাডো নদী যেখানে পাহাড় কেটে চারহাজার ফুট নিচে নেমে গেছে, সেই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে বোট চালায়। লালমাটির দেশে কলোরাডোর লাল জলকে সাক্ষী রেখে লাল মেয়ের সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল সেবার। 
সেবার মানে সেই আটবছর আগের অগাস্ট মাস। মা-জননী কলকাতা থেকে সঙ্গে এসেছেন। ইস্ট কোস্ট দেখা হয়ে গেছে। এবার চলো পশ্চিমে। সানফ্রান্সিকো, লস অ্যাঞ্জেলেস, লাস ভেগাসের আড়ম্বর দেখে দেখে জননীর চোখ ক্লান্ত। বললেন, "শহর থেকে একটু দূরে গেলে হয় না?"  
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! আমি একপায়ে খাড়া। আমরা তখন লাস ভেগাসে। তিনশো মাইল গেলেই পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি - গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। কলোরাডো নদী পঞ্চাশ লক্ষ বছর ধরে যত্ন করে পাহাড় কেটে খোদাই করেছে দুশো সাতাশ মাইলের ক্যানিয়ন। একমাইলেরও বেশি গভীর। সেই পাথরে-কোঁদা ভাস্কর্য ধরা আছে আদিগন্ত পাহাড়ের গায়ে। যেন প্রকৃতির এক রূপকথা। বেশি নয়, ঘন্টা পাঁচেক গাড়ি চালালেই পৌঁছে যাবো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দক্ষিণপ্রান্তে, সাউথ রিমএ। 
জননী হাঁফ ছাড়লেন,"তাই চল।" তিনি প্রকৃতিপ্রেমী, কলোরাডো মালভূমিতে বিশুদ্ধ প্রকৃতির কোলে চোখ জুড়োবেন। 
রাতে রাতেই চলে এসেছি,পরদিন ভোরেই যাতে জেগে উঠতে পারি ক্যানিয়নের কোলে। 
হোটেলের জানলা থেকেই অপরূপ সূর্যোদয়। রং ছড়িয়ে গেল প্রাগৈতিহাসিক পাহাড়ের মাথায় মাথায়। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে বেশ কয়েকটা জায়গা আছে সূর্যোদয় ও  সূর্যাস্ত দেখার জন্যে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, এমন একটা ভিউপয়েন্ট থেকে সূর্যাস্ত দেখতেই হবে।
সক্কাল সক্কাল ব্রেকফাস্ট করেই রানিং শু পরে বেরিয়ে পড়া গেল। প্রথমেই ভিজিটারস সেন্টারে, খোঁজখবর নিতে হবে তো?   
বোঝা গেল যে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সাউথ রিম আসলে পাহাড়ী রাস্তা ধরে হাঁটার পথ। পথে একাধিক ভিউ পয়েন্ট। এক একটা থেকে এক এক রকম সৌন্দর্য। তিনটি পথ আছে এখানে - ডেজার্ট ভিউ রোড, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভিলেজ আর হার্মিট রোড। সেন্টারের হাসিখুশি মানুষটি প্ল্যানিংএ সাহায্য করলেন। ঠিক হলো আগে যাবো হার্মিট রোড ধরে। সাতমাইল লম্বা রাস্তা। 
উরেব্বাবা, হাঁটতে হবে নাকি? আলসে আমি চিন্তিত।
ভদ্রলোক হাসলেন, "না না, তাহলে আর শাটল আছে কী করতে? তুমি অবিশ্যি সাইকেলেও যেতে পারো, তবে মায়ের তো বয়েস হয়েছে, তাই শাটলই ভালো।"
যাক বাবা, নিশ্চিন্দি। সাইকেল চালাতে যে জানি না, সে কথা আর বলিনি। প্রেস্টিজ বলে একটা কথা আছে তো? 
হার্মিট রোডে বাইসাইকেলই বেশি। পারিবারিক সাইক্লিং বেশ জনপ্রিয়। মা-বাবা-কুচো-কাঁচা সব্বাই সাইকেলে, রাস্তা চলতে চলতেই পারিবারিক সম্মিলন হচ্ছে, ছবি তোলা চলছে। ভিউপয়েন্ট থেকে দেখা যায় খাঁজকাটা প্রাগৈতিহাসিক পাহাড়ের ঢাল। একেক জায়গায় একেক রকম তাদের আকৃতি। চারহাজার ফুট নিচে বয়ে যাচ্ছে সরু কলোরাডো নদী। 
এবার কী তাহলে নদীর কাছে? 
উঁহু, সেন্টারের প্রাজ্ঞ মানুষটি বলে দিয়েছিলেন আগে হেলিকপ্টার-টুর করে নিতে। মেভরিক হেলিকপ্টার দাঁড়িয়েই আছে। পাইলটের সঙ্গে চারটি করে মানুষ উড়তে পারে। ওপর থেকে পাখির চোখ দিয়ে পুরো ক্যানিয়ন একবার ঘুরিয়ে দেয়। কলোরাডো নদীকে দেখায় যেন সরু ফিতে। দারুন সে দৃশ্য। 
হেলিকপ্টারের উচ্চতা থেকে এবার আমরা সোজা চলে যাবো গিরিখাতের নিচে। যেখানে কলোরাডোর জল ছোঁয়া যাবে। এতক্ষণ ওপর থেকেই শুধু দেখেছি তাকে।
রাইড শেষে হেলিকপ্টার আমাদের নামিয়ে দিল মাটি থেকে বেশ খানিকটা নিচে। কলোরাডো নদীর খাতের অনেক কাছে। খুব সুবিধে হল তাতে। সেখান থেকে কিছুটা কাঠের সিঁড়ি ভেঙেই চলে যাওয়া যায় একেবারে নদীর ধারে, গিরিখাতের তলায়। সেখানেই হালোনার সঙ্গে দেখা। কাঠের নড়বড়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে জননীকে সাহায্য করলো। তারপর চাপালো নিজের বোটে। কলোরাডোর লাল জল কেটে এগোলো বোট। আর এক এক করে যেন রূপকথার জগৎ খুলে যেতে লাগলো আমাদের দৃষ্টির সামনে। নিচে থেকে ওপরে তাকালে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বিশালত্ব যেমন ধরা পড়ে এমনটি আর কিছুতে নয়। আমার মতে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সেরা দৃশ্য এটাই। 
দুপাশে উত্তুঙ্গ পাহাড়, তাদের গায়ে লক্ষকোটি বছরের ভাস্কর্য। কোথাও হাতির শুঁড় তো কোথাও ধ্যানরত মানুষ - খুঁজলে সব পাওয়া যায় গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দেওয়ালে। 
হালোনা বললো,"উপকথায় বলে,আমাদের সেই সর্দার নিজের হাতে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে এসব ভাস্কর্য বানিয়েছিল। পরে তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল আরও অনেকে। এ সবই হুয়ালাপাইদের হাতে খোদাই করা।"
চারহাজার ফুট নিচে লাল জলের নদীতে ভেসে,মাথায় সুনীল আকাশ নিয়ে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে সব। এ এক অন্য পৃথিবী। 
বোট রাইডের শেষে লিফ্ট নিতে হয়, আবার মাটির পৃথিবীতে ফেরত। এবার বেশ খিদেও পেয়েছে। তাই শাটল চড়ে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভিলেজ। লেট লাঞ্চ। নেটিভ আমেরিকান মেনু ব’লে আমাদের দেওয়া হলো আলুপোড়া (ওই যে,যার নাম বেকড পট্যাটো),গাজর দিয়ে অ্যাস্পারাগাস আর পর্ক। কী জানি, সাধারণ আমেরিকান দোকানেও তো এমনিই দেয়! 
হালোনার কাছে জেনেছিলাম ওরা নানারকম মাংস খায়। এলকের মাংস খুব প্রিয়। কৌতূহলে জিজ্ঞেস করতে ওয়েটার হেসে বললেন, "আসল নেটিভ আমেরিকান খাবার খেতে গেলে তোমায় ওদের রিজারভেশনে যেতে হবে।"
রিজার্ভেশন মানে সাদা মানুষের তৈরী করে দেওয়া গ্রাম। সেখানেই নেটিভ আমেরিকানদের থাকতে হয়।  মানে যে ক’টি ভূমিপুত্র এখনো বেঁচে আছে, তাদের জন্য বাসস্থান। নতুন মহাদেশ আমেরিকায় ইউরোপিয়ান সেট্লমেন্টের ইতিহাস বড় রক্তাক্ত।   
সে যাক, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পশ্চিমদিকে ওয়েস্ট রিমএ গেলে নেটিভ আমেরিকানদের রিজারভেশনে থাকা যায়। সে অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই খুব মূল্যবান। কিন্তু আমাদের ছুটি ফুরোচ্ছে।
জননীর আহারে মন নেই, মনে করালেন, "সূর্যাস্তটা কিন্তু দেখতেই হবে।" 
আমার কুঁড়েমির জন্যে তাঁর সূর্যোদয় দেখা মিস হয়ে গেছে। বুঝি আমি তাঁর দুঃখ।       
অতএব মেনু নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে চড়ে বসলাম শাটলে। এবার গন্তব্য মেদার (Mather) পয়েন্ট। সূর্যাস্তের রং ছড়ালো প্রকৃতির ভাস্কর্যের মাথায়। কে যেন রং তুলির বাটি নিয়ে বসেছে আর একের পর এক রঙের পোঁচ চাপাচ্ছে। জননী মুগ্ধ। লালে লাল চরাচর, মাটি, জল। শুধু সেই লালমাটির লালমানুষগুলো আজ রিজারভেশনে থাকে। সে কথা নাহয় আরেকদিন।

লেখিকা সংগ্রামী লাহিড়ী 
৯,উইনফিল্ড ড্রাইভ, নিউ জার্সি, আমেরিকা

















ঢেউ তুলে...
"বারে বারে আমি পথের টানেই
পথকে করেছি ঘর..."

ঊনিশশ তিরাশি। ডিসেম্বর।আঠারো তারিখ। রবিবার। আমার দক্ষিণ-ভারত ভ্রমণের প্রথম দিনটি।শিয়ালদা থেকে বাস ছাড়লো সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায়।বাবা-মা বোনের সঙ্গে আমি।চেনা-অচেনায় অন্যরা।বাসের গতি দুর্নিবার হলো কলকাতা ছাড়িয়ে। গান বাজছে। আলাপ-আলোচনার ধুম। ধারের সিট পাওয়ার আনন্দে বিভোর হয়ে,অচেনা দিক-দিগন্ত দু-চোখে গিলতে গিলতে চলেছি অপার বিস্ময়ে প্রথম থেকেই। নীল আকাশ জুড়ে বাঁধ ভাঙা জোছনা জোয়ার!একটা নদী দেখলাম। দামোদর,বললেন পাশের জন। রাত বড়ো হতে থাকে। গায়ে হালকা চাদর চাপিয়ে নিলাম। হঠাৎ কুয়াশায় ঝাপসা হয় চারপাশ। ঝাপসা হচ্ছে কিশোরী রাত্রিটি!নির্জনতা এখন। 
যখন আমরা ভুবনেশ্বরে ,তখন সকাল সাড়ে পাঁচটা। ঝিমধরা শরীরে লাগলো শীতল বাতাস। এইমাত্র স্নান-খাওয়া শেষ হলো।দেখতে গেলাম  লিঙ্গরাজ-টেম্পল।  নির্মাণ-শৈলী মনকাড়া। বেলা সাড়ে এগারোটায় বাসে। চিল্কার  উদ্দেশ্যে  পাহাড়ি-পথ ধরে ছুটে চলেছে বাস। বাইরে পাহাড়-পাথর।দূরের পাহাড় হালকা মেঘের মতো। চারদিক সবুজে-সবুজ! নদীর জল গাঢ় নীল। চিল্কায় পৌঁছে,কিছুক্ষণ পর নৌকায় করে ভাসলাম। মনেপড়ে গেলো সেই চিরায়ত সুর- "দে দোল দোল দোল, তোল পাল তোল, চল্ ভাসি সবকিছু  ত্যাইগা..." গোপালপুর।সুন্দর জায়গা। গাছ-পাতা ঘেরা,ছড়ানো ঘরবাড়ি।সমুদ্র! শুধু বালি আর বালি।এখানেই কাটাতে হবে রাত। সন্ধ্যা নামলো অনন্য মহিমায় অন্ধকার ঘনিয়ে...পূর্ণিমার গোল চাঁদ উঠলো আকাশে!আর সমুদ্রের গর্জন! নিজেকে একা করলাম দলের থেকে। দাঁড়িয়ে থাকলাম- স্বপ্ন ভূমির মতো ছায়াচ্ছন্ন বেলাভূমিতে! ভাব নষ্ট হলো! ফিরতে হলো বড়োদের ডাকাডাকিতে। সবাই মিলে কিছুক্ষণ গান-গল্প-মজা।
ভোরবেলা সূর্যোদয়ের অপেক্ষা।অপূর্ব এই দৃশ্য! দু-চোখ জুড়িয়ে গেলো। শান্ত হলো অন্তর। বেলা দশটায় আবার বাসে। লাবণ্যময়ী সমুদ্রের রূপ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। আহা!তালবন,ঝাউবীথি, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে চলে এলাম সীমাচলম। এক ধর্মাশ্রমে। বিকেল পাঁচটা।এখানেই রাত্রি যাপন।আড্ডা মেরে কেটে গেলো কিছুটা সময়। সীমাচলম ছেড়ে যাওয়ার আগে,সকালে একটু বেলায়  পাহাড়ের গা বেয়ে বাস উঠলো শিখরে। এখানে মন্দির পাথরের। মসৃণতা তাক্ লাগিয়ে দেয়!নরসিংহের  মন্দির দর্শন করে  নমে এলাম সমতল ভূমিতে। বেলা এগারোটা। শুরু হলো এগিয়ে চলা। উদ্দাম গতিতে বাস চলছে...পথে একটা ছোট্ট  পাহাড়ের কাছে বাস থামলো। চা-সময়। দৌড়ে গিয়ে বসে পড়লাম উঁচু একটা পাথরের উপর। ভালো লাগলো! আবার চলা। দিনের আলো ম্লান হয়ে, বিনয়ী সন্ধ্যা! ক্রমে কালো-কাজল রাত! পাবলুপুরমের একটা জায়গায় এখন। নৈশ-ভোজ। নারকেল গাছ ঘেরা ডোবার ধারে আমাদের বাস। জ্যোৎস্না নেমেছে মিহি কুয়াশার মতো! সময় সুখের। বেশ খাওয়াদাওয়া  হলো। আবার চলা।গভীর রাত কেটে গেলো বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে-জেগে,বসে বসে। একটা অন্যরকম  অনুভূতি! 

সুন্দর করে ফুটে উঠলো সকাল। কাঁচা আলোর হাসি মুখে নিয়ে।দেখলাম! একটু তৈরি হয়ে নেওয়া।তারপর আবার চলা। পথের দু-পাশে আখ তুলো ধানগাছে ভরা। সব কেমন নতুন করে ধরা দিচ্ছে দৃষ্টিতে! যেনো নতুন প্রাণে ঝিলমিলে! দেখি আর বিস্ময়ে মরে যাই! ডালের বড়া,লঙ্কার ফুলুরি, খেতে  খেতে যেতে যেতে বেশ লাগে। এসেগেলাম  টাঙ্গাতরুতে। জায়গাটা একটু নোংরা। মরা পুকুরে নেমে স্নানটা যদিও খুশির ছিলো।খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। পথচলা। ঘুম-ঘুম লাগছে হাওয়ায়। দেখি  প্রকৃতির মুখে আঁধারি কালো ওড়না! মুছে গেছে চাঁদ আর চাঁদের মাধুরী! শুধু  ভোঁ-ভোঁ শব্দ! ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামলো। বাসের ভেতর বন্ধুরা মিলে শুরু হলো গল্প আর গানের আড্ডা। রাত নটা। তিরুপতির  এক প্রতিষ্ঠানে। অত্যন্ত সুন্দর জায়গাটা। প্রায় আঠারো-কুড়ি  ঘন্টা জার্নি। খাওয়াদাওয়ার পর ঝট্ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।  

সকাল থেকে মেঘে ঢাকা আকাশ। বৃষ্টি! বৃষ্টি জোরে পড়ছে। আকাশ কাঁপিয়ে গুরুগম্ভীর শব্দ! আমরা  বলাজীর-গুরুজী  স্বর্ণমন্দিরে। অনেক উঁচুতে। কৃত্রিম ঝর্না, দোকানপাট। মজার ব্যাপার হলো,মনেই হচ্ছেনা যে আমারা এতো উঁচুতে! ঠাণ্ডা আবহাওয়া। ইডলি,ধোসা আর এক কাপ গরম কফি। আঃ! মেজাজটাই বদলে গেলো! অত্যন্ত আঁকা-বাঁকা পথ। বাস নামছে। অনেকের বুকে ভয়, মুখে ভয়ের ছাপ।স্পষ্ট। কুলকুল সুর তোলা ঝর্নার জল যেনো দুধের ফেনার মতো! স্বচ্ছ! অপূর্ব এই সময়টা। রোমাঞ্চকর! 

সকালে ঘুমভাঙা চোখে সবেমাত্র আলো এসে পড়েছে, দেখি দূরে আকাশ ছুঁয়ে দেওয়া পাহাড়ের মাথা থেকে ধোঁয়া উড়ছে। কারা যেনো ইটের পাঁজায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আসলে তো জলভরা ধূসর মেঘদল! সোহাগে-আবেগে ঘনিয়ে...তো একটু তাড়াতাড়ি লাঞ্চ শেষ করতে হলো। সাড়ে দশটায় বাস ছাড়লো।এবার মাদ্রাজ যাত্রা। 

মাথায় মেঘ-আকাশ। ভিজে রাস্তা দিয়ে অলস গতিতে আমাদের বাস। মাদ্রাজ-শহর কলকাতার মতোই মনে হলো। সাজানো-গোছানো। বিকালে ঘোড়ার পিঠে, সমুদ্র-সৈকতে।সমুদ্রের জল ঘোর কালো! উত্তাল! তবুও ঢেউয়ে পা ভিজিয়ে, কিছুটা সময় কাটিয়ে, গেলাম কপিলেশ্বর-মন্দিরে। তৈলচিত্রে ভরা। আকৃষ্ট হলো মন! অস্ত-দিগন্তের  রক্তাভা মুছে গিয়ে,এখন আবছায়ায় সূচিত সাঁঝবেলা! এরপর ছলনার মতো রাতটুকু কেটেগেলো মামলীপুরমের ছোট্ট একটা হোটেলে। 

সূর্য ওঠার আগে,এখনকার বন্ধুদের সঙ্গে, বাবা-মা'র হাত ধরে,দেখতে গেলাম সমুদ্র-শোভা। পাথর-নুড়ি-ঝিনুক...তটের ভিজে বালি...গর্জনে সমুদ্র ভয়ঙ্কর!ভয়াবহ!মনে হয় পাগল হয়ে গেলাম! ভেতর-অন্তর উদ্বেল হয় বারবার! মন চঞ্চল হয়। কখনও এক্কেবারে স্থির। হায় হায় করে ওঠে বুকের ভেতর!পাঁচশ সিঁড়ি ভেঙে উঠলাম পাহাড়ে। পক্ষীতীর্থ! দ্যাখা গেলো পক্ষী।খাবারের লোভে এরা আসে। বুঝলাম।পুরোহিতের হাত থেকে চাল-কলা মাখা খাবার খেতে শুরু করলো।আর ভাগ্যবান বলে হায় হায় করে উঠলো,পুণ্য লোভী মানুষজন!নেমে এলাম। এবার চললাম পণ্ডিচেরি। বাস এসে দাঁড়িয়ে পড়লো,বিশাল এক সমুদ্রের পাশে। সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় গা ভাসালাম। বসলাম পাথরের একটা খণ্ডে। কতো পাথর! এখানে সমুদ্রের জল গাঢ় নীল, ঘোলাটে আর মেটেলাল।বেশ আলাদা করে চেনা যাচ্ছে।আছড়ে পড়ছে কিনারায়। জোরে।  প্রবল বাতাসে আমার মাথার ঝাঁকড়া চুল উড়ছে। আমি উড়ছি মনের আশমানে! আমি তলিয়ে যেতে থাকি স্বপ্নের আবর্তে!"মেঘে ঢাকা তারা "- র  সেই বুক ফাটা আর্তনাদ ভেসে আসে। "দাদা আমি বাঁচতে চাই..."আমিও তো বাঁচতে চাই,ঠিক এমনি করে...পৃথিবীর এই লীলা নিকেতনে...

পরদিন সকালে স্নান করে, সেই পরম পুণ্য ক্ষেত্রে। অরবিন্দের আশ্রম।যেখানে এই নিত্যপথের যাত্রী তাঁর জীবনের দিনগুলো কাটিয়ে গিয়েছেন,পরমাত্মার সন্ধানে।  আশ্রমে প্রবেশ করলাম। নীরব-নিস্পন্দ পরিবেশ! বিশাল এক বৃক্ষ ছায়ায় এই পরম সাধকের শ্বেত-স্বচ্ছ  সমাধি।ফুলে ভরা! ফুলে ফুলে ভরা আশ্রম। গোলাপ,গাঁদা, জিনিয়া,ডালিয়া, ইনকা! কতো রঙের...  সুগন্ধী ধূপ পুড়ছে গোছা-গোছা! সমস্ত আশ্রম যেনো অব্যক্ত ব্যথায় ভরা! করুণ! শ্রদ্ধায়  মাথা নত হয়ে আসে!বেরিয়ে এলাম।দেখলাম আমি কাঁদছি! আমার দু-চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে অবিরত!  একটাও কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না।  এই পবিত্র স্থান ছেড়ে যখন চলে যাচ্ছি, তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি...

বাস চলেছে।দুদিকে পাহাড়। মাঝখান দিয়ে পথ।বেলা ঠিক এগারোটা।পাহাড় পাথর গাছপালা আর রাঙা মাটির পথ।মনে হয় যেনো কোনো সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ! একটা নিরিবিলি জায়গায় বাস থামলো।  ল্যাংটাপুটো একদল নিষ্পাপ বাচ্ছা হাত নাড়তে লাগলো আমাদের দেখে।  মুখে হাসি। তাদের সেই সরল-সোজা  উল্লাসে প্রাণ যেনো জুড়িয়ে গেলো!  শ্রীরঙ্গমে দেখলাম অনন্ত শয্যায় বাসুদেব।তেমন কিছু মনে হলনা।সাড়ে দশটায় মাদুরাই।  ডাল তরকারি পরোটা মিষ্টিতে, মিশিয়ে দিলাম খুশি।রাত কাটলো ঢালা বিছানায়।  
ঘুম ভাঙলো। তৈরি হয়ে দেখতে গেলাম  মীনাক্ষী-মন্দির। দক্ষিণ ভারতের সবথেকে বড়ো  মন্দির বলেই শুনলাম।তৈরি হয়েছিলো, প্রায় ষোলো শ,বছর আগে।  চৌষট্টি বছর ধরে।বংশপরম্পরায়  তৈরি করেছিলেন চৌত্রিশ জন রাজা।পোড়া ঘি'র গন্ধে কেমন যেনো লাগলো! মন্দিরের পাথরের কাজ মন ছুঁয়ে যায়,তবে কতকটা একই রকম।রাত এগারোটায় বাসে চেপে বসলাম।ভোর তিনটেয় ম্যাণ্ডাপাম স্টেশনে। ট্রেনে সোজা রামেশ্বরম।ভোরের আকাশ তখনও মেঘাচ্ছন্ন!রাতজাগা চাঁদ যেনো একটা দুর্বল কবিতা হয়ে লেপটে আছে আকাশের গায়ে! জোনাকির মতো মিটমিট করছে দু-একটা তারা! রাস্তায় টাল খাচ্ছে মোদো-মদ্যপ।পৌঁছালাম। স্নান করলাম সমুদ্রে। ভয়-আনন্দ।ঘোড়ার গাড়িতে রামেশ্বরম স্টেশন।ট্রেনে করে ফিরে এলাম ম্যাণ্ডাপামে।যাত্রীবাহী ট্রেন নীল সমুদ্রের ওপর দিয়ে সরীসৃপের মতো পার হয়ে এল! চারিদিকে জল আর জল! মন স্থির হয়ে গেলো। বেলা দু'টোয় বাসে। অত্যন্ত গরম। কাঠফাটা রোদ! প্রচণ্ড অস্বস্তি!গন্তব্য কন্যাকুমারী। দুপুর থেকে বিকেল। তারপর কালচে নীল সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে, নিশি-রাত! বাসের ভেতরে ঝুঁকে পড়েছে এ ওর ঘাড়ে। সবাই বেশ ক্লান্ত! অবশেষ ভোর একটার দিকে আমরা গন্তব্যে।  খাওয়াদাওয়া শেষ হতে অতয়েব সাড়ে তিনটে বেজে গেলো! 

সকালে স্নান করতে গেলাম, কন্যাকুমারী-মন্দিরের সামনে। সমুদ্রে। ঢেউয়ের দোলায় দোল খেতে খেতে, স্নান যে কতো আনন্দের! অনেকক্ষণ ধরে উপভোগ করলাম এই সমুদ্র স্নান! বিকেলে লঞ্চেকরে বিবেকানন্দের রক।পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন! মনোরম স্থান! কেমন অকারণে ভক্তিভাব জাগে! ফিরতে ইচ্ছে করেনা! ধ্যান ঘরে বসি।ধ্যান করতে চেষ্টা করি! শান্তি-শান্তি! বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হয়! মনের মধ্যে বিচিত্র স্বপ্নের ঘোর লেগে থাকে! 

সমুদ্র তীরে সূর্যোদয়। দর্শনার্থীদের ভিড়ে স্বতঃস্ফূর্ত দাঁড়িয়ে পড়ি। মেঘে চাপা আকাশ। সূর্য উঠলো না,দুর্ভাগ্যের মেঘে চাপা পড়ে গেলো মনের ইচ্ছা!  কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর, বেলা এগারোটায়, আবার পথচলা। পথের দুধারে সুন্দর সাজানো-গোছানো বাড়িঘর চোখে পড়তে থাকে।দেখতে দেখতে আমারা ত্রিবান্দ্রামের এক সমুদ্র-সৈকতে।কিনারায় বারবার আছড়ে পড়ে ঢেউ! পা ভেজাই।  ঝিনুক কুড়িয়ে নিই! এক প্রিয় বান্ধবী, এইসময়  কোনো ভাবে কপালে আলতো চুমু দিয়ে, চুপিচুপি  বলে,"প্রেমের জয় হবে একদিন..." আমি হেসেছিলাম মাত্র একবার! নীরবে! সময় এভাবেই...তারপর,আবার যাচ্ছি তো যাচ্ছি উঁচু-নীচু পথ বেয়ে। এখানে ঘন জঙ্গলের মতো নারকেল গাছের বাগানও যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকে! পথচলাতেই আনন্দে বিভোর হয়ে যাই! ক'টা দিন জীবনের দুঃখ-কষ্ট, জড়তা পেছনে ফেলে, গণ্ডিহীন উদ্দাম! এসে গেলাম কুইলন। একধরনের টক্-টক্ সামুদ্রিক মাছ খেলাম আজকের ডিনারে। এখন রাত্রি।জগত জুড়ে আঁধারে আচ্ছন্ন অস্পষ্ট মায়া!আমার মনকেমন করে! 
ক্রমে খণ্ডিত হয় রাত!দিনের আলো ফোটে। চোখের আলোয় দেখি এক অজানা পাহাড়! ধূপছায়ার মতো ছাই-কালো মেঘ উড়ে চলেছে পাহাড়ের গা বেয়ে! সম্ভবত খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে।ভিজে পথঘাট। গাছের পাতায় টাপুর-টুপুর...আমাদের বাস এবার পাহাড়ে উঠতে শুরু করলো। ঘন জনাকীর্ণ এই পাহাড়! চারিদিকে আরও অনেক অনেক পাহাড় মাথা তুলে! গাছ পাতায় ঘেরা! দেখছি আমরা অনেকটা উপরে উঠে এসেছি! অভূতপূর্ব! লাল নীল হলুদ ফুলের রঙে মাখামাখি! পথের কোথাও কোথাও এক্কেবারে রঙিন! বৃষ্টি-ধোওয়া  ফুলের রঙ উজ্জ্বল! তাজা! আরও উপরে উঠছি আমারা। বিরাট বিরাট শাল, সাগুয়ান,বাবলা। কতো অপরিচিত গাছও। গাছে গাছে বাঁদরের লাফ-ঝাঁপ! বেশ লাগছে। প্রকৃতি কতো সুন্দর হতে পারে! কতো আত্মীয় হতে পারে! অনুভব করতে পারছি সহজে! 

এই মুহূর্তে নীল-আকাশ আর ধোঁয়া-মেঘ, আমার মনটাকে একেবারে অবশ করে দিচ্ছে! আমি হারিয়ে যাচ্ছি গভীর থেকে গভীরে! ঝরঝর করে আছড়ে পড়ছে ঝর্নার স্ফটিক...পাহাড়ের গা বেয়ে চলন্ত ট্রেনের কালো ধোঁয়া, মিশে যাচ্ছে ধোঁয়া-মেঘের সঙ্গে! আমারা ক্রমাগত উপরে...ময়ূর হয়েছে মন এখন! পুচ্ছ মেলেছে! মত্ত-তালে চঞ্চল হৃদয়  উন্মুক্ত! প্রায় সাড়ে সাতশ,ফুট উপরে উঠে এলাম! মাথায় ধরে রেখেছে বিরাট শহর। লেক। আর সুদৃশ্য বোটানিক্যাল গার্ডেন।এই পাহাড়! লেকের শান্ত জলে রঙিন নৌকা,খুশির দোল,দুলন্ত পুরুষ-নারী-শিশু! পাশে সাদা কালো ঘোড়া।  চড়ার জন্য। আহা! ও-টি শহরের এই মস্ত পাহাড়ের চূড়া থেকে,রোমাঞ্চকর ভাবে নেমে এলাম! রাত তখন এগারোটা। 

বয়ে চলেছে রাত ঠিক রাতের কথামতো ...আর আমাদের পথিক পরান...প্রিয় পথচলা...
"পাখিদের খুসকো পালকে তবুও তো লেগে থাকে প্রাণ! নতজানু হয় পৃথিবী!পলাশ-রঙ গোধূলি কুড়িয়ে আনে ফেলে আসা দিন! "
সাধের ভ্রমণ,সে তো আবহমান...

লেখক বিকাশরঞ্জন হালদার 
রঘুনাথপুর, বিরেশ্বরপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা








 

অগোচরে ইতিহাস

সেই কবে ভূগোলে পড়েছি যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনার কলোরাডো নদীর অ্যান্টেলোপ, আফ্রিকার ব্লাইড নদীর ক্যানিয়ন কিংবা স্বদেশের গান্ডিকোটা। ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে বারবার ভেবেছি; একবার না দেখলেই নয়। কিন্তু সংগতি সায় দেয়নি; গুমরে ছিলাম ভেতরে। চোখ চালাতেই পেলাম। পশ্চিম মেদিনীপুরের শিলাবতী নদীর গনগনি। অ্যান্টেলোপের মিনিয়েচার ভার্সন!

সেবার রাত থাকতে বেরিয়েছিলাম, গড়বেতা পৌঁছলাম ভোরে। প্রথমে গেলাম সর্বমঙ্গলা মন্দির। এই বয়সে ঠাকুর নাম করার যদিও ইচ্ছে হয়নি, কিন্তু তাহলে কি হবে; মা আমার ভক্তিমতি! মায়ের কথায় যেতেই হল। এই উত্তরমুখী মন্দির নাকি রাজা বিক্রমাদিত্যের আমলে কোনও যোগীর যোগসাধন দ্বারা এক রাতের মধ্যে তৈরি হয়েছে। তখনও মন্দির উত্তরমুখী ছিল না। কথিত আছে এরপর রাজা বিক্রমাদিত্য এই জঙ্গলে সাধনা করে মায়ের কাছ থেকে তাল বেতাল শক্তির বর পান। সেই দৈব ক্ষমতা পরীক্ষার জন্য মন্দিরকে উত্তরমুখী করে দিতে বলেন। সেই থেকে মন্দিরের দ্বার উত্তরমুখী! মায়ের রক্তবদন আর রক্তাম্বরে স্বর্ণ মুকুট ও অলংকার শোভা পাচ্ছে। মনে মনে বার বার প্রণাম করলাম। এসব শুনে প্রণাম না করে আর থাকা যায়!
শৈশব হাতড়ে ফিরে আসি স্কুল বাসের অপরদিকে। আমার মা বাবা যেখানে বসেছে, তার কিছু দূরে স্কুলের সহশিক্ষকরা। আরও কিছু দূরে বৃদ্ধ হেড মাষ্টারমশাই। তাঁর বার্ধক্য আঁকড়ে ধরেছে আর এক স্থানীয় বৃদ্ধকে। তিনি রিটেয়ার পোস্টমাস্টার, এখন চা-মুড়ির দোকান দিয়েছেন। তিনি শোনান গড়বেতার লুকোনো ইতিহাস: "জানেন বাবু, আপনের মতন মোর এক বন্ধু ছেল; ইস্কুল মাস্টার। গত শীতে হার্টের রোগে মরল। আপনেরা মহাভারত পড়েন কিনা, সেও পড়ত। আরও কত কী যে পড়ত, কী বলব! সে আমারে কইত মহাভারতের গল্প। এইঠি আছে একাড়িয়া গাঁ, তায় ছেল পঞ্চপাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস। বকাসুর হিড়িম্বা রাক্ষসী এককালে এইঠে ছেল । ভীম হিড়িম্বকে মারিয়া বিয়া করেন তাকে। সত্যমিথ্যা বলতে তো পারিনা। আপনেরা পণ্ডিত, আপনেরা বলবেন। অখন কিস্যু নাই..."
কথায় কথায় অনেক সময় কেটে যায়। এদিকে ভাতের পাত পড়েছে। মাষ্টারমশাই উঠে যায়। আমরাও ফিরে আসি আমাদের গাড়ির দিকে। হয়তো ফেরতা বাসে ভাতঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ভাবেন; শেষ বয়সে এখানে না এলে তাঁর এতদিনের মহাভারত পড়া-ই অপূর্ন থেকে যেত।
এরপর এলাম শিলাবতীর তীরে। গনগনি যেন নদীর অবাধ্য সর্পিল গতিকে রেখেছে ভালোবাসার রাঙারঙে বেঁধে। কোমর স্পর্শ করে দিয়েছে চান্দ্রবাঁক। সেই রূপে মুগ্ধ আবাল-বৃদ্ধ । শীতের নরম রোদে সেই মুগ্ধতা নিয়ে চা খায় কোনও বৃদ্ধ; হয়তো স্কুলের হেডমাস্টার। দূরে ভাত-মাংস ফুটছে বড় কড়াইয়ে। এডুকেশনাল পিকনিক। ছাত্ররা গেছে ল্যাটেরাইট কিংবা নদীর টানে। কেউ পা ভেজায় নদীর জলে। কেউ খেলে পানি-ঝুপ্পা, কিংবা কোনও বিচ্ছু দিয়ে আসে ডুব-সাঁতার। দিদিমণি হাঁক ছেড়ে বলেন "কত বার বলেছি নদীতে নামবে না কেউ...।" কোনও ক্ষুদে ছাত্রদলের নেতা ল্যাটেরাইটের চাঁইয়ে উঠে শোনায় কবিতা। তাই শুনে মুগ্ধ অনুগামীরা।
পোস্টমাস্টারের ঘষাকাঁচের আড়ালে তেল চিটচিটে মুখে একরকম মোহ আছে। হেড মাষ্টারমশাই হারিয়ে যান মহাভারতের কালে। এতদিনের তাঁর পড়া পুরাণ গাঁথার ঘটনস্থল এখানে জেনে খুব তাজ্জব বনে গেলেন। এমন জায়গা যে তাঁরই দেশে এই অল্প শিক্ষিত লোকটি জানেন অথচ তিনি জানতেন না। তারপর ভাবলেন সব জেনে গেলে নতুন করে জানবার আনন্দটা আর থাকেনা। ওঁর বাড়ির এই জেলার অন্যদিকে, এই অঞ্চলে নয়। ভাবেন কিছু না জানতে পারলে নতুন জায়গায় পিকনিক করতে আসার দরকার কি! পোস্ট বাবুটির কাছে শুনলেন আরও অনেক কথা, এ দেশের কথা। এই বয়সে এই সব শুনতে দারুন লাগে।

লেখক ডা: করণ দেবদ্যুতি
কালিকাখালি, মঠ চন্ডীপুর, পূর্ব মেদিনীপুর



সুইজারল্যান্ড কলিং 

ভ্রমণপিপাসু বাঙালি বেশ কিছুদিন আগে থেকেই দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে পাড়ি দিতে শুরু করেছে বিদেশে।সিঙ্গাপুর,ফুকেট এমনকি মিশরের মাটিতেও মিশিয়ে দিতে পেরেছে বাঙালিয়ানার ঘ্রাণ।তবে চেনাজানা এমন জায়গায় না গিয়ে অবশ্যই ঘুরে আসতে পারেন ইতিহাস আর ভূগোলের মিশেলে মোড়া স্বপ্নের মহাদেশ ইউরোপের ছোট্ট দেশ সুইজারল্যান্ডের ছোট্ট শহর ইন্টারলেকেন কিংবা লুসার্ন থেকে।চোখের খাঁচায় বন্দি করতে না পারলে সত্যিই বোঝার উপায় নেই এই শহরগুলির সৌন্দর্য।ট্রাভেল এজেন্সির পাঠানো আইটেনারি পড়ে প্রথমে আমারও কেমন যেন মনে হয়েছিল জায়গাগুলো সম্পর্কে।চাক্ষুষ করার পর অবশ্যই আর কোন সন্দেহ থাকল না। 

মনে পড়ে বিখ্যাত সেই হিন্দি চলচ্চিত্রের দিললগির সেই মুহূর্ত? হ্যাঁ হ্যাঁ,ঠিকই ধরেছেন। "দিলওয়ালে দুলহনিয়া লে জায়েঙ্গে" সংক্ষেপে "ডিডিএলজে" তাইতো?

দিললগি মানে মস্করা।রাজের হাত থেকে সিমরণের সেই নকল ফুল নেওয়ার মুহুর্ত আজও মনে পড়ে সব্বার।ইন্টারলেকেনেই শুট করা হয়েছিল।

"Interlaken" অর্থাৎ between the lakes ( in latin inter lactus) নামই বলে দেয় যার বর্ণনা।পশ্চিমে পান্না সবুজ থুন হ্রদ, পূর্বে ব্রিয়েনজ।তারই মাঝে ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া ইন্টারলেকেন। "Ho he Matte" হল এ শহরের বুক জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিশাল উন্মুক্ত পার্ক,যেখানে অনায়াসেই ঘুরে বেড়ানো যায় কিংবা সবুজ ঘাসে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ রাখা যায় বরফমোড়া ইগার, মঞ্চ অথবা ইয়ংফ্রইয়ক শৃঙ্গে।পার্কের চারিদিকে সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে ক্যাশিনো, কফিশপ,রেস্তোরাঁ, স্যুভেনির শপ।খোলা আকাশের নিচে এক কাপ গরম কফিতে চাইলে চুমুক দিতেই পারেন।না চাইলে?

মেলতে পারেন ডানা আকাশের নীলে। কেমন করে?

প্যারাগ্লাইডিং,অ্যাবসেইলিং আপনাকে হাতছানি দেবেই।এছাড়া অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় বাঙালির জন্য আছে রিভার রাফ্টিং, ক্যানিয়নিং।"অ্যাডভেঞ্চারাস ক্যাপিটেল" নামে পরিচিতি কি আর এমনি এমনিই পায়।তাহলে?এবারের ডেস্টিনেশন তবে ইন্টারলেকেন তাইতো?

ইচ্ছে না হলে চলে যেতেই পারেন লুসার্ন। এটিও সুইজারল্যান্ডের ছোট্ট পুরোনো শহর।মাঝখানে বেশ বড় লুসার্ন লেক।এ শহরের মূল আকর্ষণ ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে তৈরি বিখ্যাত কাঠের ব্রিজ।নাম "চ্যাপেল ব্রিজ"। Reuss নদীর উপরে তৈরি এই ব্রিজে একবার ভয়াবহ আগুন লাগলেও এখনও পর্যন্ত এটি এখানকার অন্যতম ল্যান্ডমার্ক রূপেই দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন ঐতিহ্যের নিদর্শণস্বরূপ।এছাড়া সুইজ ব্যাঙ্ক, চকলেট শপ,সুইজ ওয়াচ শপ।চটপট কিনে ফেলতেই পারেন সাধের একখান রিস্টওয়াচ।ঘুরে ঘুরে দেখে নিন প্রাচীন সব স্থাপত্য। ঝিরঝিরে বৃষ্টি চলে প্রায়ই,সঙ্গে হালকা শীত।গরমের দেশের মানুষদের কাছে এ যেন বাড়তি পাওনা তাই না?

তবে আর দেরি না করে, গুছিয়ে ফেলুন রুকস্যাক।ছাতা আর টুপি মাস্ট।সানগ্লাসও।"সুইস ফ্রাঁও চাই সাধ মেটাতে খুচরো কিংবা নোটে,দেখুন না বেড়িয়ে পড়ে কপালে কি সুখ জোটে"। 

লেখিকা শ্রাবণী গুপ্ত 
তারবাগ কোয়ার্টার, পূর্ব বর্ধমানপশ্চিমবঙ্গ 





কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা  

পটভূমি আসাম।
শেষ দুপুরে ধান কাটা রোদ'টা তখন আমার বাসার সামনে আমলকী আর পলাশের ডালপালায় লুকোচুরি খেলছে। হঠাৎ - কি অসীম কি করছো? - কথায় পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম তাপস সরকার দা, ঝুমা আর তিন্নি গাড়ি থেকে নেমে আসছে। আমি ডালিয়া গাছগুলোর যত্ন করা ছেড়ে গেট টা খুলে দিলাম।
ঝুমা ঢুকেই বললো- বাহ !অসীম দা কি সুন্দর ডালিয়া,চন্দ্রমল্লিকা আর সিজন ফ্লাওয়ারের বাগান করেছেন ! ডালিয়া গুলো কত বড় বড়,বাড়ির সামনেটা এক্কেবারে কালারফুল হয়ে রয়েছে ! গৌরী দি কোথায়?
আমি বললাম- ভেতরে আছে, যাও।
ঝুমা ভেতরে চলে গেলো।
সরকার দা বললেন- নাজিরায় হাঁপিয়ে উঠেছি তাই চলে এলাম শিবসাগরে।
আমি বললাম- চলুন ভেতরে গিয়ে বসি।
তিন্নি আমার কানের কাছে মুখ এনে বললো- কাকু আমাকে একটা ফুল দেবে?
আমি বললাম- ঠিক আছে যাওয়ার সময় নিয়ে যাস।
সবাই মিলে ঘরে এলাম।

সরকার দা গৌরী কে বললো- ভালো করে পেঁয়াজ, কঁচালংকা আর চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখো, সাথে তোমার সেই বিখ্যাত দার্জিলিং টি খাওয়াও।

ওরা এলে সাথে করে নিয়ে আসে অনেক আনন্দ, উচ্ছাস আর হাসি।
সবে আড্ডাটা জমে উঠেছে ,বাইরে গাড়ির আওয়াজ শুনে তাকাতেই দেখি একটা লাল মারুতি গেটের সামনে এসে থামলো।ওটা আমাদের পরিচিত গাড়ি। আমার বন্ধু সুবীর সবকার এলো বৌদি,বান্টি আর বনি কে নিয়ে।
আড্ডাটা জমে উঠলো গৌরীর বানানো স্পেশাল ঝালমুড়ি আর দার্জিলিঙের চায়ে।
বাচ্চাদের মস্তির আওয়াজ'ও পাশের ঘর থেকে ভেসে আসছিল।

ঝুমা চায়ের কাপ টা সেন্টার টেবিলে নামিয়ে রেখে বললো- অসীমদা চলুন না কোথাও দু'তিন দিনের জন্য বেড়িয়ে আসি ,বেশ নিরিবিলি'তে থাকবো,খুব আনন্দ করবো।

আমি একটু ভেবে বললাম- চলো তাহলে সবাই মিলে কাজিরাঙার জঙ্গলে কয়েক দিনের জন্য হারিয়ে যাই। এক কথায় সবাই রাজি হয়ে গেলো।
সেদিনের সকাল'টা ছিল ১লা পৌষ। কাজিরাঙা আমাদের হাতছানি দিয়ে গেয়ে উঠলো- "পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে,আয় রে চলে,আয় আয় আয়।"
আমার সাদা মারুতিটা রাজহাঁসের মত লাগছিল। আমরা তৈরী হয়ে একটু অপেক্ষা করতেই সুবীর সরকার এসে গেল সপরিবারে।
চোখের পলক পরতে না পরতেই তাপস সরকারের গাড়িটা আমার গা ঘেঁষে দাঁড়ালো ।
আমাদের যাত্রা শুরু হ'ল।

হাসি আর আনন্দে কখন যে আমরা জোড়হাট পৌঁচ্ছে গেছি বুঝিনি। আমাদের Lunch break টা হোল সেখানেই।

লাঞ্চের একটু পরেই আবার তিনটে গাড়ি দূরন্ত গতিতে ছুটে চললো কাজিরাঙার আকর্ষণে।
চারিদিক সবুজ বনানী - মাঝে মাঝে সবুজে ঢাকা ছোট ছোট গ্রাম,দোকান- হাট । হিমেল হাওয়ায় স্বপ্নের আবেশ নিয়ে আমরা এগিয়েই চলেছি! ছোটবেলা থেকেই মনে মনে অনেক কল্পনা করেছি কাজিরাঙার। কেমন সেই রূপ এবার তা নিজের চোখে দেখবার সময় এসেছে।
কালো অজগরের মত আঁকা বাঁকা মসৃণ রাজপথে আমাদের গাড়ির চাকা গুলো অজস্রবার ঘুরে গেলো।  হঠাৎ দূরের কালো পাহাড়ে বিকেল এলো। সকলেই তখন ক্লান্ত প্রায়।
আমি গৌরীকে বললাম- এসে গেছি।
কথাটা ওয়েভ তরঙ্গে নিমেষেই অন্য গাড়ি গুলোতে ভেসে গেলো।

রাজপথ ছেড়ে একটু আঁকা বাঁকা পথ ধরে পৌঁছে গেলাম Wildgrass Resort এ। আগে থেকেই বুক করে রেখেছিলাম।

তখনও সন্ধ্যা নামেনি। অদ্ভুত সুন্দর প্রকৃতির দিয়ে সাজানো, বড় বড় গাছ- গাছালির মাঝে সবুজে ঘেরা resort টা। একটা নাম না জানা পাখি বারবার গাছ পাল্টাতে ব্যস্ত তখন আর তার প্রেমিক এক মনে পাকা পেঁপে খেয়ে চলেছিল। সুইমিং পুলের নীল জলের পার দিয়ে দোতলায় আমাদের ঘর গুলো। সবাই নিজের নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হলাম। আমাদের সকলের ছেলেমেয়েরাও আনন্দে মেতে উঠলো।
তখন অন্ধকার হয়েছে। অনুভব করলাম শীত। তবুও সকলে চা খেয়ে এক সাথে নিচে নেমে এলাম। সামনে একটি বিরাট গাছের উপর চারিদিক রেলিং এ ঘেরা ঘর । আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলো এবং আমরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে সেখানেই উঠে গেলাম। মাঝখানের বড় টেবিলটা ঘিরে জমে উঠলো আমাদের আড্ডা। ছেলেমেয়েরা খেলায় মেতেছে। মাথার উপর হলদেটে আলো। ছাউনির বাইরে ঘন অন্ধকারে অজস্র জোনাকি ঘুরে ঘুরে আলোর নাচে মেতেছে। সে এক অপরূপ দৃশ্য!

মহিলারা এর মাঝেই কবিতা ও গানের আলোচনা জগতে চলে গেছে। আমরা সেই সুযোগে সোমরস পানে মগ্ন হলাম। অবশেষে অল্প আলোয় ওখানেই আমরা সবাই ভিনার করলাম।

ঘরে ফিরতে ক্লান্তি এসে সবাইকে ঘুমের দেশে নিয়ে গেল।
পরের ভোরে, মুখ দিয়ে ধোঁয়া ওঠা ঠান্ডায় খোলা জিপসি তে সদলবলে বেড়িয়ে পরলাম অরণ্যের অজানা রহস্য ও আশ্চর্য কে জানতে ও দেখতে। পৌচ্ছালাম আকাঙ্খিত অরণ্য কিনারে। অনেক দূরে ঘন কুয়াশায় দেখলাম ছোট ছোট ধূসর পাহাড় হেঁটে আসছে। কাছে আসতেই হাতিরা স্পষ্ট হয়ে উঠল। দুটো হাতিতে আমরা মিলেমিশে দুলতে দুলতে গভীর গহণে হারিয়ে গেলাম, হাতির পিঠ ছুঁই ছুঁই বন্য ঘাসে শুধু খস খস আওয়াজ। চোখে পড়লো হরিণের পাল যেন প্রাত ভ্রমনে বেড়িয়েছে। হঠাৎ হাতির মাহুত চুপ করতে বললো, চোখ মেলে তাকাতেই দূরে ঘাসের মধ্যে খস খস আওয়াজ! ক্যামেরা রেডি করে চোখ রাখলাম কিন্তু কয়েক পলকের জন্য এক ঝলক হলুদের ওপর কালো কিংবা কালচে বাদামির ডোরাকাটা শরীর টা চোখে পড়লেও আর কিছু দেখতে পেলাম না। শুধু লম্বা লম্বা ঘাস গুলো দূর পর্যন্ত দুলে উঠে স্থির হয়ে গেল। মাহুত বললো- বাঘ। মাহুতরা ঐ জায়গার আশে পাশে অনেক দূর পর্যন্ত ঘোরালো কিন্তু বাঘমামার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। অবশেষে ফিরে এলাম যেখান থেকে হাতি সওয়ারি করেছিলাম। 

আমাদের গাইড জিপসি তে করে নিয়ে গেলো কফি আর রাবার গাছের বাগানে। পাহাড়ের গায়ে কফি বাগান । কফি গাছগুলোয় কোথাও সবুজ, লালচে বা বাদামী কফি বিজ থোকা থোকা ধরে আছে।

একটু পাশেই আকাশ ছোঁয়া সারি সারি রাবার গাছ। গাছের একটা অংশে চৌকো করে বাকল কেটে একটা সরু নল ঢোকানো প্রতিটি রাবার গাছে। সেই নল বেয়ে সাদা ঘন দুধের মত তরল নিচে রাখা পাত্রে জমা হচ্ছে। গাইড বললো ওটাকেই প্রসেস করে কারখানায় রাবার তৈরি হয়। কফি ও রাবার গাছ আমার প্রথম দেখা- প্রথম অভিজ্ঞতা। অনেক ছবি তোলা হলো ওখানে।
ফেরার পথে ছোট্ট একটা পাহাড়ি নদী বয়ে যেতে দেখলাম। সেখানে সবাই পা ভেজালাম। সুবীর সরকার অনেক ছবি তুললো, আমি একটা লাল পাখির ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাপস সরকার দা 'ঝুমা' বলে চিৎকার করে উঠলো। পাহাড়ে পাহাড়ে প্ৰতিধ্বনিত হলো- ঝুমা ঝুমা ঝুমা! সবাই যেন শিশু হয়ে গেলাম। অবশেষে resort এ ফিরে এলাম।
তখন রোদের রঙটা লঘু Nitric acid এর মতো, আমরা খাওয়া দাওয়া করে শীতের পোষাকে দুটো জিপসি করে forest এর অন্য একটা দিকে, আরও গভীরে যাওয়ার জন্য রওনা দিলাম।

Forest এর gate থেকে আমাদের সাথে এলেন একজন বন্দুকধারী। গভীর জঙ্গলে মানুষ সমান উঁচু ঘাসের মাঝদিয়ে সরু মেঠো রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো জিপসি দুটো। একদম সামনেই দেখলাম একটা গণ্ডার পরিবার। দুটো বিশাল আকৃতির গণ্ডার আর একটা ছোট্ট গণ্ডার জঙ্গলের একটু ফাঁকা জায়গায় ছোট ছোট ঘাস খাওয়ায় ব্যস্ত। আমাদের মাথার উপর দিয়ে একটা ঈগল পাখনা মেলে উড়ে গেল, হয়তো বা বন্ধুর খোঁজে। আমরা আরো এগোলাম- একদল বাইশন আর একপাল হরিণের কাছে। দূরের দূরবীনে ধরা পড়ল অনেক গণ্ডার। জীবনে প্রথম নিজের চোখে গণ্ডার দেখলাম। ছোট বেলায় পড়েছিলাম কাজিরাঙা গন্ডারের জন্য বিখ্যাত, সেটা খুব ভাল ভাবেই উপলব্ধি করলাম।

অবশেষে এলাম গভীর জঙ্গলে- যেখানে একটা বাঁক নিয়ে নদী বয়ে গেছে- যেন কোনো যুবতী পাশ ফিরে শুয়ে আছে শ্বেত বসনায়। চিতল মাছে ভরা নদীর ওপারে একপাল হরিণ জল খেতে এসে থমকে গেছে হাতির দল দেখে। বন্য হাতির রূপই আলাদা- ছোট ছোট হাতির বাচ্চা গুলো খুব সুন্দর। গাইড বললো হাতির দলের পেছনে বাঘ থাকে- আমি তখন সামনে জোড়া গন্ডারের বিশাল আর বন্য রূপ দেখে চলেছি।দেখলাম নদীর জলে একপাল বন্য মহিশের দূরন্তপনা। নদীর বুকে চিতল মাছ গুলো মাঝে মধ্যেই নেচে উঠছিল রুপোর গয়নার মত।
সবুজে সবুজে ঘন বিশাল এই অরণ্যে অফুরন্ত প্রানের চঞ্চলতা- এমনটা আমি ভাবিই'নি আর নিজের চোখে না দেখলে উপলব্ধি'ও করা যেত না।
এখানে না এলে এই গভীর অরণ্য মাতৃগর্ভের মত রহস্যময়ী হয়ে থাকতো সারাটা জীবন।
বিদায় বেলায় ধনেশ পাখি দুটো বুঝতে পেরে বলে উঠলো- আবার এসো তোমরা আমাদের প্রানের মাঝে।

ছোট বড় সকলের মুখেই দেখলাম " না দেখা কে দেখার- না জানাকে জানার" এক গভীর ছাপ- যেন পরম তৃপ্তি পরম পাওয়া ।

এবার ফেরার পালা। ধীরে ধীরে ফিকে হতে লাগল সেই গভীর অরণ্য- আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল সেই পরিচিত কোলাহল। ফিরে এলাম অদ্ভুত সুন্দর এক জগত থেকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে।
পথে চা খেয়ে resort এ ঢুকলাম।
সেই সন্ধ্যায় resort এ আয়োজন ছিল আদিবাসী মেয়ে পুরুষদের নাচ। লাল পাড় সাদা শাড়ির ঐক্যতানে ছিল মাদলের দৃমি দৃমি আওয়াজ। মাঝে ছিল লকলকে আগুনের আঁচ। আমাকেও হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো ওদের নাচে । অনেক ছবি তুললো সকলে।
আবার সকাল হলো, এবার ফেরার পালা। সকলেই তৈরী হয়েছি ফিরে আসার জন্য কিন্তু কেমন যেন মায়ায় পরে গেলাম সবাই। এত সুন্দর পরিবেশ ছেড়ে যেতে কারো মন চাইছিল না।
সমস্ত ঘটনাটাই ছোট গল্পের মত মনে হলো- শেষ হইয়াও হইল না শেষ।
আমাদের গাড়ি তিনটে আঁকা বাঁকা পথ ধরে রাজপথে উঠলো।
তৃপ্ত মন নিয়ে শেষবারের মত দূরের সেই সবুজ নিরবতা কে দেখে নিলাম। আস্তে আস্তে আরো দূরে সরে যেতে লাগলাম আমরা। গাড়ির জানালা দিয়ে সদ্য ভেজা চুল উড়িয়ে গৌরী বন্য হাওয়ার অনুভূতি নিতে নিতে গেয়ে উঠলো- কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা...।

লেখক অসীম বিশ্বাস 
খারগড়, নভি মুম্বাই, ভারত 












মনোরম মন্দারমনি 

মন্দারমণি যাওয়ার ইচ্ছেটা বরাবরই ছিল। তা বলে অতিমারীর এইসব দমবন্ধ পরিবেশে যে সেখানে যাওয়া হবে ভাবিনি।হয়তো যেতামও না যদি না ছেলের ব্যাপারটা মাথায় আসতো।বছর পাঁচেকের খুদেজনটি বাড়ির বাইরে না বেরিয়ে ঘরে থেকে থেকে এমন একটা মানসিক অবস্থার শিকার যে বাইরে শব্দটা শুনলেই তার ভয় লাগে এই বুঝি করোনা হয়ে যাবে।তখনই মন্দারমণির প্রস্তাব এবং তাতে বউ আমতা আমতা করলেও ছেলে নিমেষে রাজী। সমুদ্র তার খুব পছন্দ।আমাদের সঙ্গে জুড়ে গেল আমার মামাতো ভাই বাবুসোনা। তারপর আর কি…পোশাক-টোশাকের সাথে স্যানিটাইজার, ডিসইনফেক্ট আর মুখে মাস্ক পরে শনিবার বিকেলে পৌঁছে গেলাম।টিকিট দীঘা অবদি থাকলেও বুদ্ধি করে কাঁথিতে নেমে গেলাম বলে বেশ খানিকটা আগেই গেলাম পৌঁছে।বিকেলে হোটেল মৈনাকের দোতলায় লাগেজ রেখেই সমুদ্র সৈকতে দৌড়।ভীড় ভাট্টা তেমন না থাকায় সমুদ্রের সান্নিধ্য আরো বেশি করে উপভোগ করতে পারলাম।

একটু হেঁটে বিচটা ঘুরে দেখতে দেখতে বুঝলাম মন্দারমণির এটাই বিশেষত্ব: হোটেলগুলো মূলত সমুদ্রের গা-ঘেঁষে।হোটেলের খাওয়া-দাওয়া খুব আহামরি নয় কিন্তু সমুদ্রকে এত কাছে পেয়ে আমরা খুব খুশি।আরো খুশি ছেলের আনন্দ দেখে।সে ব্যাটা বিকেল থেকেই ঝিনুক কুড়োতে লেগেছে।রাতে অবশ্য বিশেষ কোথাও ঘোরবার ছিল না।হয়তো নিরাপত্তার কারণেই বিচের দিকের গেট ছিল বন্ধ।হোটেলে ফ্যামিলি নিয়ে আসা পর্যটকের সংখ্যা বেশি।ফলে অতিমারীর থমকে থাকা বন্দী বন্দী পরিবেশটা মনেই হচ্ছিল না।তারপর রোববার ভোরে হোটেলের ঘর থেকে সানরাইজ দেখে এতটাই তরতাজা আর অণুপ্রাণিত লাগলো নিজেকে যে মনে হচ্ছিল বিশ্বনাথন আনন্দকে তুড়ি মেরে কিস্তিমাত দিতে পারি যে কোনো সময়ে।

সূর্যটা এতটাই মোহময়ী ছিল যে ঘুমন্ত ছেলেকেও ডেকে দিলাম যাতে এই মুহুর্তগুলোর সাক্ষী সেও হতে পারে।বউ ছেলেকে নিয়ে সমুদ্র সৈকতে হাঁটতে চলে গেল কিছুক্ষণ পরেই।অগত্যা আমাকেও যেতে হল তাদের সাথে।সকাল বেলার লাজুক সূর্যের চোখ দিয়ে সৈকতকে দেখে বিস্কুট আর ডাবের জল খেয়ে হোটেলে ফিরে দেখি ভাই ততক্ষণে উঠেছে।ভাইএর ঘরে সবাই একসাথে কচুরি খেয়ে আবার বিচমুখী।লক্ষ্য স্নান।রাতেও চোখে পড়েছিল।বেলায় উঠেই বসলাম স্পিড বোটে।সমুদ্রের ৪-৫ কিলোমিটার ভেতরে নিয়ে গেল।টাকাটা বেশি নিলেও অভিজ্ঞতাটা বেশ রোমাঞ্চকর। ছেলে ভয় পেয়েছে বলে তাকে ভরসা দিতে গিয়ে বুঝলাম,ভয়টা আমারো কম কিছু লাগছিলো না।না, দুপুরে কাঁথি স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার আগে অবদি আর কোথাও ঘুরিনি।মন্দারমণির ওই  বিচেই ছিলাম।সমুদ্র সামনে থাকলে আর কোথাও বুঝি যেতে মন চায় না।যে অটোচালক দাদা আগের দিন আমাদের এনেছিল সেই আবার নিয়ে গেল হোটেল থেকে। হাওড়া পৌঁছতে পৌঁছতে ক্লান্ত সন্ধ্যের সাথে মোলাকাত হলেও মনে ততক্ষণে সঞ্চয় করেছি এমন সুন্দর আর আনকোরা অভিজ্ঞতার স্মৃতি যে আমি নিশ্চিত তাদের রোমন্থন পাথেয় করে আগামী দিনের পথ হয়ে উঠবে আরো মনোরম।

লেখক প্রতীক মিত্র 
কোন্নগর, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত











নবীনতর পোস্টসমূহ পুরাতন পোস্টসমূহ হোম

ব্লগ সংরক্ষাণাগার

  • আগস্ট (3)
  • জুলাই (22)
  • জুন (8)
  • নভেম্বর (15)
  • অক্টোবর (5)
  • সেপ্টেম্বর (81)
  • আগস্ট (66)
  • জুলাই (55)
  • জুন (56)
  • মে (57)
  • এপ্রিল (46)
  • মার্চ (15)
  • জানুয়ারী (14)
  • ডিসেম্বর (73)
  • নভেম্বর (103)
  • অক্টোবর (97)
  • সেপ্টেম্বর (101)
  • আগস্ট (120)
  • জুলাই (88)
  • জুন (76)
  • মে (63)
  • এপ্রিল (11)

🔴বিজ্ঞপ্তি:

পাঁচ মাসের বিরতি কাটিয়ে আবার ও ফিরছি আমরা। খুব শীগ্রই আসছে আমাদের প্রত্যাবর্তন সংখ্যা।

অনুসরণ করুণ

এক মাসের সর্বাধিক পঠিত পোস্টগুলি:

  • শেষ শোকসংগীত ~ গোবিন্দ মোদকের কবিতা
  • দুটি কবিতায় ~ গৌতম কুমার গুপ্ত
  • ব্রাত্য ~ বিদ্যুৎ মিশ্র'র কবিতা
  • দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প
  • আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা
  • গুচ্ছ কবিতায় ~ অসীম মালিক
  • সুমিত রায়ের গল্প
  • সে প্রেম পবিত্র~ প্রেমাংশু শ্রাবণের কবিতা
  • সুব্রত মাইতির কবিতা
  • তিনটি কবিতায় ~ রাগীব আবিদ রাতুল

বিষয়সমূহ

  • Poetry speaks 2
  • অণু কথারা 21
  • আবার গল্পের দেশে 8
  • উৎসব সংখ্যা ১৪২৭ 90
  • একুশে কবিতা প্রতিযোগিতা ২০২১ 22
  • এবং নিবন্ধ 3
  • কবিতা যাপন 170
  • কবিতার দখিনা দুয়ার 35
  • কিশলয় সংখ্যা ১৪২৭ 67
  • খোলা চিঠিদের ডাকবাক্স 1
  • গল্পের দেশে 17
  • ছড়ার ভুবন 7
  • জমকালো রবিবার ২ 29
  • জমকালো রবিবার সংখ্যা ১ 21
  • জমকালো রবিবার ৩ 49
  • জমকালো রবিবার ৪ 56
  • জমকালো রবিবার ৫ 28
  • জমকালো রবিবার ৬ 38
  • দৈনিক কবিতা যাপন 19
  • দৈনিক গল্পের দেশে 2
  • দৈনিক প্রবন্ধমালা 1
  • ধারাবাহিক উপন্যাস 3
  • ধারাবাহিক স্মৃতি আলেখ্য 2
  • পোয়েট্রি স্পিকস 5
  • প্রতিদিনের সংখ্যা 218
  • প্রত্যাবর্তন সংখ্যা 33
  • প্রবন্ধমালা 8
  • বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা 10
  • বিশেষ সংখ্যা: আমার প্রিয় শিক্ষক 33
  • বিশেষ সংখ্যা: স্বাধীনতা ও যুবসমাজ 10
  • ভ্রমণ ডায়েরি 1
  • মুক্তগদ্যের কথামালা 5
  • রম্যরচনা 2
  • শীত সংখ্যা ~ ১৪২৭ 60

Advertisement

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.

মোট পাঠক সংখ্যা

লেখা পাঠাবার নিয়মাবলী:

১. শুধুমাত্র কবিতা, মুক্তগদ্য অথবা অণুগল্প পাঠাবেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং অন্যান্য বিষয়ক লেখা সম্পূর্ণ আমন্ত্রিত। ২. লাইনের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ৩. লেখা মেইল বডিতে টাইপ করে পাঠাবেন। ৪. লেখা মৌলিক ও অপ্রকাশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্য কোনো ব্লগ, ওয়েবজিন অথবা প্রিন্টিং মিডিয়ায় প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ৫. মেইলে আপনার লেখাটি সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত, কথাটি উল্লেখ করবেন। ৬. লেখার সাথে আবশ্যিক ভাবে এক কপি ছবি ও সংক্ষিপ্ত ঠিকানা পাঠাবেন।  ৭. লেখা নির্বাচিত হলে এক মাসের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হবে। এক মাসের মধ্যে কোনো উত্তর না এলে লেখাটি অমনোনীত ধরে নিতে হবে। ৮. আপনার লেখাটি প্রকাশ পেলে তার লিঙ্ক শেয়ার করাটা আপনার আবশ্যিক কর্তব্য। আশাকরি কথাটি আপনারা মেনে চলবেন। আমাদের মেইল- hridspondonmag@gmail.com
blogger-disqus-facebook

শান্তনু শ্রেষ্ঠা, সম্পাদক

আমার ফটো
পূর্ব বর্ধমান, India
আমার সম্পূর্ণ প্রোফাইল দেখুন

সাম্প্রতিক প্রশংসিত লেখা:

সুজিত রেজের কবিতা

সুজিত রেজের কবিতা

চন্দ্রানী গুহ রায়ের কবিতা

চন্দ্রানী গুহ রায়ের কবিতা

দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প

দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প

আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা

আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা

কবি সুধাংশুরঞ্জন সাহার কবিতা

কবি সুধাংশুরঞ্জন সাহার কবিতা

হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন

© হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন। শান্তনু শ্রেষ্ঠা কর্তৃৃক পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে প্রকাশিত।

Designed by OddThemes | Distributed by Gooyaabi Templates