সৌমী গুপ্ত'র ভ্রমণ কাহিনি


পাহাড়ি অচেনা গ্রাম

খানে তিস্তা চলেছে খরস্রোতা ছন্দে। দুধারে সবুজ শ‍্যামলিমাময় পাহাড়গুলো আগলে রেখেছে তাদের । তিস্তা পেরিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টা গাড়িতে পাকদন্ডী বেয়ে ওঠার সময় আশেপাশে ছোট ছোট গ্রাম পেরিয়ে সাজানো অফবিট জায়গা বা গ্রাম সামসেট। তারপর খানিকটা আরও এগিয়ে গেলে কালিম্পং আর রংপোর ঠিক মাঝখানে নিজের ছন্দে একান্তে গড়ে ওঠা ছোট্ট গ্রাম মাণ্ঝারজঙ।অহংকারের অলংকারে অলংকৃত।যার আছে অমন মনোহরনকারী কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেতশুভ্র শিখর তারই অহংকার সাজে। পাহাড় এখানে গাম্ভীর্যের আবরনে ঢাকা। তুমি তাকে আলিঙ্গন করতে পারবে না। যেদিকে চোখ যায় নীল আকাশের নিচে দূর দূরান্তে শুধু বরফের শিখর। মাঝখানে একফালি আকাশের নিচে বিস্মৃত  হতে হয় নিজের অস্তিত্ব...নগণ্য লাগে বড্ড। সূর্যরশ্মি রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাবার আগে সোনালী ভুল বললাম সোনার আবীর ছড়িয়ে দিয়ে যায় সারা আকাশ জুড়ে। যেন সোনা মেখেছে গায়। বরফের চূড়া গুলো সোনায় সোহাগা হয়।কি অভূতপূর্ব দৃশ্য  নিজের চোখে না দেখলে অবিশ্বাস্য। আবার রাত্রির চাদর সরিয়ে ভোরের আলো যখন স্পর্শ করে আকাশ ,পাহাড় ,পর্বত চূড়া... আবছা কালো...সোনালীবর্ন ও সর্বশেষে শ্বেতশুভ্র আবরনে বড্ড অহংকারী সে।  

বহু নিচে ক্রন্দসী তে তিস্তায় সুনীল বুকের উপর জমা হয় অভিমানী মেঘ। তুমি তাকে দেখে আপ্লুত হবে শিহরিত হবে ঠিকই কিন্তু মায়ার আলিঙ্গনে জড়িয়ে রাখবে এমন স্পর্ধা হবে না।একদম ভোরবেলা যখন রাত্রির অন্ধকারের চাদর সরে যায় আস্তে আস্তে তখন ওই পাহাড়ী চূড়াগুলো সূর্যের প্রথম রশ্মি মাখে গায়।একদম যেন ২৪ ক‍্যারেট সোনায় মুড়ে দিয়েছে কেউ।চারিপাশে অগুনতি শৃঙ্গ। তারপর বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চূড়াগুলো একদম ধবধবে সাদা হয়ে যায়।তার অনেক নীচে অভিমানের মেঘ জমে পাহাড়ের কোলে। আর কিছুটা রঙ্গীত ও তিস্তার বুকে ।এক খন্ড মেঘ জমে ক্রন্দশীতে।আরও রোদ্দুর বাড়ে,সবাইকে চমকে দিয়ে দুটো শৃঙ্গের মাঝে কাঞ্চনজঙ্ঘায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওঁ লেখা। অভূতপূর্ব! নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।সেই ওঁ নিজের উপস্থিতি জানান দেয় স্বমহিমায়। প্রচলিত মত অনুযায়ী ওই ওঁ হল স্বয়ং শিবের মাথায় বিরাজ করছে। ঠিক ওই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল আমি সত্যিই স্বর্গীয় প্রকৃতির কোলে যেন ক্ষুদ্র এক মানবী! মেঘবালিকার দল ক্রমশ বিলীন হয়ে যায় আকাশে। শৃঙ্গ ঢেকে যায় থোকা থোকা জুঁইসাদা মেঘে। মাঞ্জারজঙ থেকে তিস্তা যেখানে মিশেছে রঙ্গীতের সাথে ওই জায়গাটা দেখা যায় । তিস্তা সবুজ হলেও রঙ্গীত কিন্তু পরিষ্কার আকাশবর্ণা!এখানে চারিদিকে কমলালেবুর বাগান আর আছে গোল গোল ছোট ছোট কাঁচালঙ্কা। তীব্র ঝাঁঝ তার ! ঝালেও কিছু কম নয়! 
পাহাড়ি উপত্যকা গুলো অজস্র নাম না জানা ফুলে ঢেকে যায় এইসময়! অনেক ঝোরাও আছে চারিদিকে। তবে এখন শীতের সময় পাহাড় নিজের কাছে বরফের চূড়ায় জমিয়ে রাখে উচ্ছল জলরাশি। সন্ধ্যেটা নেমে আসে ঝপ করে।পাহাড়ের গভীর খাতগুলো ভয়াবহ আকর্ষণ নিয়ে বিলীন হয়ে যায়।একটা দুটো আলো জ্বলে স্থানীয় বসতিতে। তারপর গোটা পাহাড়ে যেন কেউ ফানুস জ্বেলেছে মনে হয় ।সূর্যটা পুরোপুরি নিভে যাওয়ার আগে গোটা আকাশে আগুনের আবীর ছড়িয়ে দিয়ে যায় ! তিস্তার দুধারে সাদা বেলাভূমিতে ছড়ানো ছিটানো নুড়ির গায়ে চাঁদের আলো গলে পড়ে । তিরতির করে বয়ে চলে সবুজ নদী।পাইনের বন থমকে দাঁড়ায় দুধারে বোবা কান্না নিয়ে।এখান থেকে জলসাঘর দেখা যায় যেখানে স্বয়ং রবি ঠাকুর ছিলেন বেশ কিছুদিন । সবমিলিয়ে মনে হয় কোনও অজানা মায়াময় পৃথিবীর নির্জন প্রান্তে চলে এসেছি একান্তে যেখানে জন কোলাহল নেই,নিজস্ব ভঙ্গিতে প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়েছে দুহাত ভরে। তবে যদি কেউ চায় আর্টিফিশিয়াল কোনও আনন্দে মাতবেন সেই সুযোগ কিন্তু নেই। এই প্রকৃতির কোল একদম নির্জনতায় ভরপুর‌।

সাহিত্যিক সৌমী গুপ্ত
১৬২, রাইফেল ক্লাব রোড, কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ














0 Comments