মন্দ কপাল






              চন্দন কুমার কুণ্ডু🔹বাঁকুড়া🔹 



ঝুল বারান্দার টবে রাখা তুলসী গাছটায় সন্ধ্যা প্রদীপ দেখিয়ে গড় হয়ে প্রণাম করল মালতী। ঘরে ঢুকে যতটা সম্ভব শব্দ কম করে শাঁখ বাজাল। ফ্ল্যাট বাড়িতে বাস তাই জোরে শাঁখ বাজান মানা। তার এই ভক্তি নিয়েও ফ্ল্যাটের আনাচে কানাচে কানাকানি হয় তা তার অজানা নয়। দু'হাত জোড় করে আর একবার প্রণাম করল। প্রণাম শেষ করে ওঠার মুহূর্তেই দরজার হাতল ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকল পৃথ্বীশ।
চোখ লাল, চোয়াল শক্ত, মুখে যতটা সম্ভব বিরক্তি এনে বলল,
--অ্যাই অ্যাই, আবার ন্যাকামি। বলেছি না আমার সামনে ন্যাকামি করে দেবভক্তি দেখাবি না। এই ভক্তিটা স্বামীকে দেখালে পূণ্যি হত অনেক বেশি।
--স্বামীর মঙ্গলের জন্যই করি এসব। তোমাকে কতবার বলব সেকথা।
--আবার মুখে মুখে কথা বলবি ? তোর ওই মুখটা একদিন ভেঙে দেব আমি। এঃ, পূণ্য দেকাচ্চে...
--শোন, কাল সকালে উঠে সোজা বাপের বাড়ি যাবি।
টাকা আনবি বুজলি টাকা। আর আনতে না পারলে এখানে আর ঢুকবি না। যেখানে মন চায় যাস।
 মালতী কোন কথা বলল না। সে জানে এই লোকের সঙ্গে ঝগড়া ঝামেলা করে লাভ নেই। এর পর গালি গালাজ দেবে। তাতেও মন না ভরলে মারবে। যতক্ষণ ইচ্ছা, যেমন করে ইচ্ছা যন্ত্রনা দেওয়াতেই যেন তার শান্তি। আর এদিক ওদিক থেকে কিছু উৎসুক চোখ তাকিয়ে থাকবে তাদের জানালায়। কান পেতে কেউবা আত্ম তৃপ্তি লাভ করতে চাইবে।

 নিঃসন্তান মালতী শ্বশুর বাড়িতে আর পাঁচজনের সঙ্গেই থাকতে চেয়েছিল। কিন্তু সন্তান না হওয়ায় উঠতে বসতে গঞ্জনা শুনতে হ'ত তাকে। শাশুড়ি থেকে পাড়া প্রতিবেশী কেউ বাদ যেত না। বয়স্ক মহিলারা তাকে বাঁজা বউ বলত। বাড়ির বাচ্চাদের তার কোলে নেওয়ার উপায় ছিল না। মালতী কোলে নিলে নাকি বাচ্চাদের অকল্যাণ হবে।             
শ্বাশুড়ির গঞ্জনা তো ছিলই,
--যে মেয়েছেলে একটা বাচ্চা বিওতে পারে না সে আবার মেয়ে কিসের গো এ্যাঁ! বলি, মুখে ঝ্যাঁটা মার অমন বউ- এর। বউ নয় গো,অলক্ষ্মী অলক্ষ্মী...
এমন হাজারও গঞ্জনা চলতেই থাকত। তখন ও পৃথ্বীশ তার প্রতি এতটা বিরূপ হয়ে যায় নি। কিছুটা হলেও ভালবাসা ছিল তার । এসব নিয়ে ঝামেলা করতে মা কে নিষেধ করত। মাঝে মাঝে মালতীর কাছে দুঃখ ও করেছে সে। গ্ৰামে গঞ্জে এসব নিয়ে মানুষ পড়ে থাকে। মালতী যেন কারও কথায় রাগ না করে।

শহরে একটা ছোটোখাটো ব্যবসা আছে পৃথ্বীশের। সারাদিনের পর বাড়ি ফিরে এসব অশান্তি আর সহ্য হচ্ছিল না তার। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে দেখত মালতীকে নিয়ে অশান্তির শেষ নেই।  কিন্তু মালতীর যা স্বভাব তাতে সে যে গায়ে পড়ে ঝগড়া করবে এতো শত্রুও বলবে না। স্বভাব শান্ত এই মেয়েটির একটিই দোষ সে কোন সন্তান দিতে পারে নি। কিন্তু এটা কে কী দোষ বলা যায়? মাথার মধ্যে এমন এলোমেলো চিন্তা কেমন যেন ঢেউ খেলে যায় পৃথ্বীশের। মায়ের তীব্র চিৎকারে যেন হুঁশ ফেরে,
--তোর মতন অলুক্ষুণে বউ আমার দরকার নাই। তুই বেরো ঘর থেকে । আমি আবার ছেলের বিয়ে দোব।
 শান্ত গলায় মালতী বলে,
-- যদি তোমার ছেলের দোষ থাকে? তার জন্য যদি বাচ্চা না হয়, তখন কী করবে মা?
সপাটে একটা চড় কষিয়ে দেয় শাশুড়ি। মার খেয়ে হতভম্ব হয়ে যায় মালতী। ডুকরে কেঁদে ওঠে সে। পৃথ্বীশ কোন কথা বলে না। রাত্রে সামান্য কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

 এই সবের মধ্যে আরো কয়েকটা মাস কেটে যায়। পৃথ্বীশ একদিন মা কে জানায়, তার পরিচিত এক ভদ্রলোক তাঁর পুরান ফ্লাট বিক্রি করে অন্যত্র চলে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের হাতে সময় কম থাকায় অনেক কমেই ফ্ল্যাটটা বেচে দিচ্ছেন। দু এক দিনের মধ্যেই তার হাতে চলে আসবে ফ্ল্যাটটা। কথাটা তার মায়ের খুব একটা ভাল লাগল বলে মনে হল না। নিজের মনে গজ গজ করতে করতে তিনি বলে চললেন,
 --ফ্ল্যাট, বাড়ি, সম্পত্তি করেই কি হবে? তোমার সংসারে বাতি দেবার কে আছে যে তুমি বড় মুখ করে সম্পত্তি কেনার কথা বলছ? আমারই কি আর সে কপাল যে তোমার ছেলে মেয়ের মুখ দেখে মরব....ইত্যাদি ইত্যাদি।
যদিও তাঁর আরও দুই ছেলে আর এক মেয়ের দৌলতে সংসারে নাতি পুতির কোন অভাব নেই।  বরং বেশিই আছে বলা যায়। তবুও মন ভরে না মায়ের, ভাবে পৃথ্বীশ।

 বাজারে কিছু ধার দেনা হলেও ফ্ল্যাটটা কিনে নেয় সে। একটু ঠিক ঠাক করে নিয়ে একদিন সে মাকে জানায়, প্রতিদিন বাড়ি আসার জন্য তার ব্যবসার ক্ষতি হচ্ছে। কতকালই বা হোটেলের ভাত খাবে সে!
---এখন থেকে তাই ভাবছি ওখানেই থাকব। আর মালতীকেও নিয়ে যাব।
 তার মা বলেন,
 --তা যাবে বৈকি বাবা। ব্যবসা করচ, ঘর কিনেচ, নিশ্চয় যাবে। কিন্তু ওই অলুক্ষুণে বউয়ের হাতে তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছা হয় না বাবা। কোথায় কী তুকতাক করবে কে জানে!
পৃথ্বীশ হাসে। আর বলে,
--তোমার যেমন কথা মা। একালেও তুমি তুকতাকে বিশ্বাস কর ! পৃথ্বীশ জানে, গ্ৰামীণ সংস্কার মায়ের মনের পরতে পরতে গেঁথে আছে। মা ভাবে,সন্তানহীনা মেয়েরা অনেক তুক তাক করে পুরুষকে বশ করে রাখে। এ ভয় মায়ের মন থেকে যাওয়ার নয় সেকথাও বোঝে সে।

সকাল থেকে একটু মেঘ জমেছে আকাশে। গুম মেরে থাকা অবস্থাটা কাটিয়ে সূর্য উঠি উঠি করছে আবারও আড়ালে চলে যাচ্ছে। একটা অস্বস্তিকর গরম অনুভূত হচ্ছে। পৃথ্বীশদের আজ সকালেই যাওয়ার কথা। সকাল থেকেই মায়ের মুখ ভার হয়ে আছে। বাড়ির অন্যান্যরাও বিশেষ কোন কথা বলছে না। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস পত্র, কাপড় চোপড় আগেই রেখে এসেছে সে। অল্প কয়েকটা জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ে তারা। কয়েকদিনেই সংসার মোটামুটি গুছিয়ে নেয় মালতী। যদিও ফ্ল্যাটের জীবন তার ভাল লাগছে এমন নয়। দুটো কথা বলার লোক নেই। লোকজনের চোখের চাওনিও যেন কেমন। গ্ৰামে মানুষ মালতী। বিয়ের পর ও গ্ৰামেই কাটিয়েছে। ফ্ল্যটের মধ্যে কেমন বদ্ধ বদ্ধ লাগে তার। মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে, সে ভাবে।

 মালতীর জোরাজুরিতেই  শহরের ডাক্তারের কাছে যায় তারা। দুজনের মেডিক্যাল টেস্টের পরে ডাক্তার জানান, মালতীর গর্ভধারণে কোন সমস্যা নেই। সমস্যাটা হল পৃথ্বীশের। তার দুর্বল শুক্রানুই মালতীর সন্তান ধারণের অন্তরায়। মাথা ঘুরে যায় পৃথ্বীশের। সে এসব কী শুনছে! সে পুরুষত্বহীন! তার সন্তান জন্মদেওয়ার ক্ষমতা নেই! আর ভাবতে পারে না পৃথ্বীশ। মনে পড়ে তার মা এবং আত্মীয় পরিজনদের মালতীকে বলা কথাগুলো।  তীক্ষ্ণ বাক্যবান গুলো যেন প্রত্যেকটা তাকে বিঁধতে থাকে। কোন কথা বলে না সে। ফ্ল্যাটে ফিরে মালতী তাকে বোঝানোর চেস্টা করে, কিন্তু তার মাথা থেকে বের হয় না কিছুই।

রাত্রে প্রচুর মদ খায় পৃথ্বীশ। এর আগে সে ড্রিঙ্ক করত না এমন নয়। মাঝে মাঝে কখন  ড্রিঙ্ক করলে কাউকে কিছু না বলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ত। মালতী সেদিন আর খাওয়ার জন্য ডাকত না। কিন্তু আজ  একেবারেই বেসামাল। রাত্রে বমি করতে শুরু করলে মাথায় জল ঢেলে, সারারাত জেগে তার সেবার ত্রুটি করল না; ভোর বেলা ঘুমিয়ে পড়লে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল মালতী। সেদিনের মত সুস্থ হলেও মদ খাওয়া বন্ধ হল না বরং বেড়েই চলল। আর তার সঙ্গে যুক্ত হল  নেশার নতুন নতুন উপকরণ। ব্যবসায় অনিহা দেখা দিল। হাতে টান পড়তে শুরু করল।

 এখন প্রায় দিন নেশা করে বাড়ি ফেরে পৃথ্বীশ। মালতী কিছু বললেই ঝামেলা শুরু হয়ে যায়। গালিগালাজ করে নিত্যদিন। গায়ে হাত তুলতেও ছাড়ে না। মালতী একলা ঘরে ঈশ্বরের কাছে মুক্তি প্রার্থনা করে। নিজের বাড়ি যাওয়া প্রায় বন্ধই করেছে পৃথ্বীশ। বাপের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসার জন্য চাপ দেয় মালতীকে। সে দু- একবার মায়ের কাছে গোপনে টাকা চেয়ে নিয়ে এসেছে। মালতী জানে তার বাবা খুব বদরাগি মানুষ। একথা জানতে পারলে মেয়েকে হয়তো আর পাঠাবেই না, নয়তো তার দরজা চিরতরে বন্ধ করে দেবে। তাই লুকিয়ে মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এসেছে। কিন্ত এমনি করে আর কতদিন চলতে পারে, ভাবে সে। সত্যি তার কপালটাই মন্দ !

বিকাল থেকেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। কালো মেঘ ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলছে আকাশটাকে। এমন সময় মালতী টাকা নিয়ে ফিরতেই ছো মেরে তার হাত থেকে সবটা নিয়েই বেরিয়ে যায় পৃথ্বীশ। এদিক ওদিক থেকে কয়েক জোড়া উৎসুক চোখ কিছু একটা দেখার চেস্টা করে। বোধ হয় বুঝতে চায় সারাদিন পর বউটা কোথা থেকে ফিরল?

আজ অনেকটা মদ খেল পৃথ্বীশ। সে যেন থামতেই চায় না। ইয়ার দোস্তরা তাকে থামিয়েছে। মোটর বাইকটা স্টার্ট দিয়ে কোন রকমে রাস্তায় উঠল। কিন্তু রাস্তা যেন ঠিক ঠাহর হচ্ছে না। কেমন বেসামাল লাগল যেন। বৃষ্টির জল জমে রাস্তার খানা খন্দ গুলোও একাকার হয়ে আছে। সামনে একটা গাড়ির তীব্র আলোয় কিছু দেখতে পেল না সে। দাঁড়িয়ে যাবে ভেবে একটু স্লো করতেই পিছন থেকে একটা ট্রাক তাকে পিষে দিয়ে বেরিয়ে গেল। জলে কাদায় দলা পাকিয়ে গেল দেহটা।

বিধবা মালতী  বাপের বাড়ি ফিরে গেল। বয়স্কা মহিলারা বললেন, মন্দ কপাল মালতীর। স্বামী সুখ, সন্তান সুখ কিছুই পেল না মেয়েটা ।
                

0 Comments