
প্রকৃতি যখন ভাস্কর -গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন
সেই কতযুগ আগে ওরা থাকতো উঁচুনিচু পাহাড়ি জমিতে ঘর বেঁধে। রুখোশুখো জমি,লাল মাটি। সেখানেই লাল লাল মানুষগুলোর ঘর। ওরা নিজেদের বলে হুয়ালাপাই। একসঙ্গে দল বেঁধে শিকার করে আনতো, জঙ্গল থেকে ফলমূল কুড়িয়ে ভাগ করে খেতো। সুখের জীবন। হঠাৎ আকাশ থেকে দেবতা পাঠালেন বৃষ্টি। এমন বৃষ্টি তারা কোনোদিন দেখেইনি। জল এলো ঝাঁপিয়ে,বন্যায় ভেসে গেল ঘরবাড়ি। সবাই সর্দারের কাছে কেঁদে পড়লো, "সর্দার, একটা কিছু কর।"হুয়ালাপাইদের সর্দার খুব সাহসী, বন্যাকেও ডরায় না।বেরিয়ে পড়ল নিজের বিরাট ছুরিটা নিয়ে। সবাই অবাক হয়ে চেয়ে আছে। তাদের চোখের সামনে সর্দার জমির ওপর ছুরি বিঁধিয়ে দিল। দেখতে দেখতে চোখের সামনে মাটি খুঁড়ে নালা কাটা হলো। বন্যার জল সেই নালার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে পড়লো সমুদ্দুরে। সর্দারের জন্যেই হুয়ালাপাইরা বাঁচলো সেবার।
সেই নালা বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ের বুক কেটে কেটে বসলো, চলে গেল অনেক, অনেক নিচে। তৈরী হল সুগভীর গিরিখাত। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। যা দেখতে দুনিয়ার লোক ছুটে আসে আরিজোনার মরুভূমিতে।
হালোনা গল্প করছিল বোট চালাতে চালাতে। লালচে গায়ের রং। ছোট ছোট চোখদুটি সবসময়ই হাসিতে উজ্জ্বল। মাথায় লম্বা বিনুনি। নেটিভ আমেরিকান বা আমেরিকান ইন্ডিয়ান।ওরাই এখানকার ভূমিপুত্র। কলম্বাস আমেরিকার মাটিতে জাহাজ ভিড়িয়ে ভাবলেন ইন্ডিয়াতে এসেছেন। তাই এখানকার লাল মানুষগুলোকে বলা হলো 'ইন্ডিয়ান'। হালোনা হুয়ালাপাই উপজাতির মেয়ে। কলোরাডো নদী যেখানে পাহাড় কেটে চারহাজার ফুট নিচে নেমে গেছে, সেই গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে বোট চালায়। লালমাটির দেশে কলোরাডোর লাল জলকে সাক্ষী রেখে লাল মেয়ের সঙ্গে খুব ভাব হয়েছিল সেবার।
সেবার মানে সেই আটবছর আগের অগাস্ট মাস। মা-জননী কলকাতা থেকে সঙ্গে এসেছেন। ইস্ট কোস্ট দেখা হয়ে গেছে। এবার চলো পশ্চিমে। সানফ্রান্সিকো, লস অ্যাঞ্জেলেস, লাস ভেগাসের আড়ম্বর দেখে দেখে জননীর চোখ ক্লান্ত। বললেন, "শহর থেকে একটু দূরে গেলে হয় না?"
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই! আমি একপায়ে খাড়া। আমরা তখন লাস ভেগাসে। তিনশো মাইল গেলেই পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্যের একটি - গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন। কলোরাডো নদী পঞ্চাশ লক্ষ বছর ধরে যত্ন করে পাহাড় কেটে খোদাই করেছে দুশো সাতাশ মাইলের ক্যানিয়ন। একমাইলেরও বেশি গভীর। সেই পাথরে-কোঁদা ভাস্কর্য ধরা আছে আদিগন্ত পাহাড়ের গায়ে। যেন প্রকৃতির এক রূপকথা। বেশি নয়, ঘন্টা পাঁচেক গাড়ি চালালেই পৌঁছে যাবো গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দক্ষিণপ্রান্তে, সাউথ রিমএ।
জননী হাঁফ ছাড়লেন,"তাই চল।" তিনি প্রকৃতিপ্রেমী, কলোরাডো মালভূমিতে বিশুদ্ধ প্রকৃতির কোলে চোখ জুড়োবেন।
রাতে রাতেই চলে এসেছি,পরদিন ভোরেই যাতে জেগে উঠতে পারি ক্যানিয়নের কোলে।
হোটেলের জানলা থেকেই অপরূপ সূর্যোদয়। রং ছড়িয়ে গেল প্রাগৈতিহাসিক পাহাড়ের মাথায় মাথায়। গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে বেশ কয়েকটা জায়গা আছে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্যে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম, এমন একটা ভিউপয়েন্ট থেকে সূর্যাস্ত দেখতেই হবে।
সক্কাল সক্কাল ব্রেকফাস্ট করেই রানিং শু পরে বেরিয়ে পড়া গেল। প্রথমেই ভিজিটারস সেন্টারে, খোঁজখবর নিতে হবে তো?
বোঝা গেল যে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সাউথ রিম আসলে পাহাড়ী রাস্তা ধরে হাঁটার পথ। পথে একাধিক ভিউ পয়েন্ট। এক একটা থেকে এক এক রকম সৌন্দর্য। তিনটি পথ আছে এখানে - ডেজার্ট ভিউ রোড, গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভিলেজ আর হার্মিট রোড। সেন্টারের হাসিখুশি মানুষটি প্ল্যানিংএ সাহায্য করলেন। ঠিক হলো আগে যাবো হার্মিট রোড ধরে। সাতমাইল লম্বা রাস্তা।
উরেব্বাবা, হাঁটতে হবে নাকি? আলসে আমি চিন্তিত।
ভদ্রলোক হাসলেন, "না না, তাহলে আর শাটল আছে কী করতে? তুমি অবিশ্যি সাইকেলেও যেতে পারো, তবে মায়ের তো বয়েস হয়েছে, তাই শাটলই ভালো।"
যাক বাবা, নিশ্চিন্দি। সাইকেল চালাতে যে জানি না, সে কথা আর বলিনি। প্রেস্টিজ বলে একটা কথা আছে তো?
হার্মিট রোডে বাইসাইকেলই বেশি। পারিবারিক সাইক্লিং বেশ জনপ্রিয়। মা-বাবা-কুচো-কাঁচা সব্বাই সাইকেলে, রাস্তা চলতে চলতেই পারিবারিক সম্মিলন হচ্ছে, ছবি তোলা চলছে। ভিউপয়েন্ট থেকে দেখা যায় খাঁজকাটা প্রাগৈতিহাসিক পাহাড়ের ঢাল। একেক জায়গায় একেক রকম তাদের আকৃতি। চারহাজার ফুট নিচে বয়ে যাচ্ছে সরু কলোরাডো নদী।
এবার কী তাহলে নদীর কাছে?
উঁহু, সেন্টারের প্রাজ্ঞ মানুষটি বলে দিয়েছিলেন আগে হেলিকপ্টার-টুর করে নিতে। মেভরিক হেলিকপ্টার দাঁড়িয়েই আছে। পাইলটের সঙ্গে চারটি করে মানুষ উড়তে পারে। ওপর থেকে পাখির চোখ দিয়ে পুরো ক্যানিয়ন একবার ঘুরিয়ে দেয়। কলোরাডো নদীকে দেখায় যেন সরু ফিতে। দারুন সে দৃশ্য।
হেলিকপ্টারের উচ্চতা থেকে এবার আমরা সোজা চলে যাবো গিরিখাতের নিচে। যেখানে কলোরাডোর জল ছোঁয়া যাবে। এতক্ষণ ওপর থেকেই শুধু দেখেছি তাকে।
রাইড শেষে হেলিকপ্টার আমাদের নামিয়ে দিল মাটি থেকে বেশ খানিকটা নিচে। কলোরাডো নদীর খাতের অনেক কাছে। খুব সুবিধে হল তাতে। সেখান থেকে কিছুটা কাঠের সিঁড়ি ভেঙেই চলে যাওয়া যায় একেবারে নদীর ধারে, গিরিখাতের তলায়। সেখানেই হালোনার সঙ্গে দেখা। কাঠের নড়বড়ে সিঁড়ি ভেঙে নামতে জননীকে সাহায্য করলো। তারপর চাপালো নিজের বোটে। কলোরাডোর লাল জল কেটে এগোলো বোট। আর এক এক করে যেন রূপকথার জগৎ খুলে যেতে লাগলো আমাদের দৃষ্টির সামনে। নিচে থেকে ওপরে তাকালে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের বিশালত্ব যেমন ধরা পড়ে এমনটি আর কিছুতে নয়। আমার মতে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সেরা দৃশ্য এটাই।
দুপাশে উত্তুঙ্গ পাহাড়, তাদের গায়ে লক্ষকোটি বছরের ভাস্কর্য। কোথাও হাতির শুঁড় তো কোথাও ধ্যানরত মানুষ - খুঁজলে সব পাওয়া যায় গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের দেওয়ালে।
হালোনা বললো,"উপকথায় বলে,আমাদের সেই সর্দার নিজের হাতে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে এসব ভাস্কর্য বানিয়েছিল। পরে তার সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল আরও অনেকে। এ সবই হুয়ালাপাইদের হাতে খোদাই করা।"
চারহাজার ফুট নিচে লাল জলের নদীতে ভেসে,মাথায় সুনীল আকাশ নিয়ে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে সব। এ এক অন্য পৃথিবী।
বোট রাইডের শেষে লিফ্ট নিতে হয়, আবার মাটির পৃথিবীতে ফেরত। এবার বেশ খিদেও পেয়েছে। তাই শাটল চড়ে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ভিলেজ। লেট লাঞ্চ। নেটিভ আমেরিকান মেনু ব’লে আমাদের দেওয়া হলো আলুপোড়া (ওই যে,যার নাম বেকড পট্যাটো),গাজর দিয়ে অ্যাস্পারাগাস আর পর্ক। কী জানি, সাধারণ আমেরিকান দোকানেও তো এমনিই দেয়!
হালোনার কাছে জেনেছিলাম ওরা নানারকম মাংস খায়। এলকের মাংস খুব প্রিয়। কৌতূহলে জিজ্ঞেস করতে ওয়েটার হেসে বললেন, "আসল নেটিভ আমেরিকান খাবার খেতে গেলে তোমায় ওদের রিজারভেশনে যেতে হবে।"
রিজার্ভেশন মানে সাদা মানুষের তৈরী করে দেওয়া গ্রাম। সেখানেই নেটিভ আমেরিকানদের থাকতে হয়। মানে যে ক’টি ভূমিপুত্র এখনো বেঁচে আছে, তাদের জন্য বাসস্থান। নতুন মহাদেশ আমেরিকায় ইউরোপিয়ান সেট্লমেন্টের ইতিহাস বড় রক্তাক্ত।
সে যাক, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পশ্চিমদিকে ওয়েস্ট রিমএ গেলে নেটিভ আমেরিকানদের রিজারভেশনে থাকা যায়। সে অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই খুব মূল্যবান। কিন্তু আমাদের ছুটি ফুরোচ্ছে।
জননীর আহারে মন নেই, মনে করালেন, "সূর্যাস্তটা কিন্তু দেখতেই হবে।"
আমার কুঁড়েমির জন্যে তাঁর সূর্যোদয় দেখা মিস হয়ে গেছে। বুঝি আমি তাঁর দুঃখ।
অতএব মেনু নিয়ে বেশি মাথা না ঘামিয়ে চড়ে বসলাম শাটলে। এবার গন্তব্য মেদার (Mather) পয়েন্ট। সূর্যাস্তের রং ছড়ালো প্রকৃতির ভাস্কর্যের মাথায়। কে যেন রং তুলির বাটি নিয়ে বসেছে আর একের পর এক রঙের পোঁচ চাপাচ্ছে। জননী মুগ্ধ। লালে লাল চরাচর, মাটি, জল। শুধু সেই লালমাটির লালমানুষগুলো আজ রিজারভেশনে থাকে। সে কথা নাহয় আরেকদিন।
0 Comments