বিকাশরঞ্জন হালদারের ভ্রমণ কাহিনি


ঢেউ তুলে...
"বারে বারে আমি পথের টানেই
পথকে করেছি ঘর..."

ঊনিশশ তিরাশি। ডিসেম্বর।আঠারো তারিখ। রবিবার। আমার দক্ষিণ-ভারত ভ্রমণের প্রথম দিনটি।শিয়ালদা থেকে বাস ছাড়লো সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায়।বাবা-মা বোনের সঙ্গে আমি।চেনা-অচেনায় অন্যরা।বাসের গতি দুর্নিবার হলো কলকাতা ছাড়িয়ে। গান বাজছে। আলাপ-আলোচনার ধুম। ধারের সিট পাওয়ার আনন্দে বিভোর হয়ে,অচেনা দিক-দিগন্ত দু-চোখে গিলতে গিলতে চলেছি অপার বিস্ময়ে প্রথম থেকেই। নীল আকাশ জুড়ে বাঁধ ভাঙা জোছনা জোয়ার!একটা নদী দেখলাম। দামোদর,বললেন পাশের জন। রাত বড়ো হতে থাকে। গায়ে হালকা চাদর চাপিয়ে নিলাম। হঠাৎ কুয়াশায় ঝাপসা হয় চারপাশ। ঝাপসা হচ্ছে কিশোরী রাত্রিটি!নির্জনতা এখন। 
যখন আমরা ভুবনেশ্বরে ,তখন সকাল সাড়ে পাঁচটা। ঝিমধরা শরীরে লাগলো শীতল বাতাস। এইমাত্র স্নান-খাওয়া শেষ হলো।দেখতে গেলাম  লিঙ্গরাজ-টেম্পল।  নির্মাণ-শৈলী মনকাড়া। বেলা সাড়ে এগারোটায় বাসে। চিল্কার  উদ্দেশ্যে  পাহাড়ি-পথ ধরে ছুটে চলেছে বাস। বাইরে পাহাড়-পাথর।দূরের পাহাড় হালকা মেঘের মতো। চারদিক সবুজে-সবুজ! নদীর জল গাঢ় নীল। চিল্কায় পৌঁছে,কিছুক্ষণ পর নৌকায় করে ভাসলাম। মনেপড়ে গেলো সেই চিরায়ত সুর- "দে দোল দোল দোল, তোল পাল তোল, চল্ ভাসি সবকিছু  ত্যাইগা..." গোপালপুর।সুন্দর জায়গা। গাছ-পাতা ঘেরা,ছড়ানো ঘরবাড়ি।সমুদ্র! শুধু বালি আর বালি।এখানেই কাটাতে হবে রাত। সন্ধ্যা নামলো অনন্য মহিমায় অন্ধকার ঘনিয়ে...পূর্ণিমার গোল চাঁদ উঠলো আকাশে!আর সমুদ্রের গর্জন! নিজেকে একা করলাম দলের থেকে। দাঁড়িয়ে থাকলাম- স্বপ্ন ভূমির মতো ছায়াচ্ছন্ন বেলাভূমিতে! ভাব নষ্ট হলো! ফিরতে হলো বড়োদের ডাকাডাকিতে। সবাই মিলে কিছুক্ষণ গান-গল্প-মজা।
ভোরবেলা সূর্যোদয়ের অপেক্ষা।অপূর্ব এই দৃশ্য! দু-চোখ জুড়িয়ে গেলো। শান্ত হলো অন্তর। বেলা দশটায় আবার বাসে। লাবণ্যময়ী সমুদ্রের রূপ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। আহা!তালবন,ঝাউবীথি, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ পেরিয়ে চলে এলাম সীমাচলম। এক ধর্মাশ্রমে। বিকেল পাঁচটা।এখানেই রাত্রি যাপন।আড্ডা মেরে কেটে গেলো কিছুটা সময়। সীমাচলম ছেড়ে যাওয়ার আগে,সকালে একটু বেলায়  পাহাড়ের গা বেয়ে বাস উঠলো শিখরে। এখানে মন্দির পাথরের। মসৃণতা তাক্ লাগিয়ে দেয়!নরসিংহের  মন্দির দর্শন করে  নমে এলাম সমতল ভূমিতে। বেলা এগারোটা। শুরু হলো এগিয়ে চলা। উদ্দাম গতিতে বাস চলছে...পথে একটা ছোট্ট  পাহাড়ের কাছে বাস থামলো। চা-সময়। দৌড়ে গিয়ে বসে পড়লাম উঁচু একটা পাথরের উপর। ভালো লাগলো! আবার চলা। দিনের আলো ম্লান হয়ে, বিনয়ী সন্ধ্যা! ক্রমে কালো-কাজল রাত! পাবলুপুরমের একটা জায়গায় এখন। নৈশ-ভোজ। নারকেল গাছ ঘেরা ডোবার ধারে আমাদের বাস। জ্যোৎস্না নেমেছে মিহি কুয়াশার মতো! সময় সুখের। বেশ খাওয়াদাওয়া  হলো। আবার চলা।গভীর রাত কেটে গেলো বাসের ভেতরে ঘুমিয়ে-জেগে,বসে বসে। একটা অন্যরকম  অনুভূতি! 

সুন্দর করে ফুটে উঠলো সকাল। কাঁচা আলোর হাসি মুখে নিয়ে।দেখলাম! একটু তৈরি হয়ে নেওয়া।তারপর আবার চলা। পথের দু-পাশে আখ তুলো ধানগাছে ভরা। সব কেমন নতুন করে ধরা দিচ্ছে দৃষ্টিতে! যেনো নতুন প্রাণে ঝিলমিলে! দেখি আর বিস্ময়ে মরে যাই! ডালের বড়া,লঙ্কার ফুলুরি, খেতে  খেতে যেতে যেতে বেশ লাগে। এসেগেলাম  টাঙ্গাতরুতে। জায়গাটা একটু নোংরা। মরা পুকুরে নেমে স্নানটা যদিও খুশির ছিলো।খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। পথচলা। ঘুম-ঘুম লাগছে হাওয়ায়। দেখি  প্রকৃতির মুখে আঁধারি কালো ওড়না! মুছে গেছে চাঁদ আর চাঁদের মাধুরী! শুধু  ভোঁ-ভোঁ শব্দ! ঝিরঝিরে বৃষ্টি নামলো। বাসের ভেতর বন্ধুরা মিলে শুরু হলো গল্প আর গানের আড্ডা। রাত নটা। তিরুপতির  এক প্রতিষ্ঠানে। অত্যন্ত সুন্দর জায়গাটা। প্রায় আঠারো-কুড়ি  ঘন্টা জার্নি। খাওয়াদাওয়ার পর ঝট্ করে ঘুমিয়ে পড়লাম।  

সকাল থেকে মেঘে ঢাকা আকাশ। বৃষ্টি! বৃষ্টি জোরে পড়ছে। আকাশ কাঁপিয়ে গুরুগম্ভীর শব্দ! আমরা  বলাজীর-গুরুজী  স্বর্ণমন্দিরে। অনেক উঁচুতে। কৃত্রিম ঝর্না, দোকানপাট। মজার ব্যাপার হলো,মনেই হচ্ছেনা যে আমারা এতো উঁচুতে! ঠাণ্ডা আবহাওয়া। ইডলি,ধোসা আর এক কাপ গরম কফি। আঃ! মেজাজটাই বদলে গেলো! অত্যন্ত আঁকা-বাঁকা পথ। বাস নামছে। অনেকের বুকে ভয়, মুখে ভয়ের ছাপ।স্পষ্ট। কুলকুল সুর তোলা ঝর্নার জল যেনো দুধের ফেনার মতো! স্বচ্ছ! অপূর্ব এই সময়টা। রোমাঞ্চকর! 

সকালে ঘুমভাঙা চোখে সবেমাত্র আলো এসে পড়েছে, দেখি দূরে আকাশ ছুঁয়ে দেওয়া পাহাড়ের মাথা থেকে ধোঁয়া উড়ছে। কারা যেনো ইটের পাঁজায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। আসলে তো জলভরা ধূসর মেঘদল! সোহাগে-আবেগে ঘনিয়ে...তো একটু তাড়াতাড়ি লাঞ্চ শেষ করতে হলো। সাড়ে দশটায় বাস ছাড়লো।এবার মাদ্রাজ যাত্রা। 

মাথায় মেঘ-আকাশ। ভিজে রাস্তা দিয়ে অলস গতিতে আমাদের বাস। মাদ্রাজ-শহর কলকাতার মতোই মনে হলো। সাজানো-গোছানো। বিকালে ঘোড়ার পিঠে, সমুদ্র-সৈকতে।সমুদ্রের জল ঘোর কালো! উত্তাল! তবুও ঢেউয়ে পা ভিজিয়ে, কিছুটা সময় কাটিয়ে, গেলাম কপিলেশ্বর-মন্দিরে। তৈলচিত্রে ভরা। আকৃষ্ট হলো মন! অস্ত-দিগন্তের  রক্তাভা মুছে গিয়ে,এখন আবছায়ায় সূচিত সাঁঝবেলা! এরপর ছলনার মতো রাতটুকু কেটেগেলো মামলীপুরমের ছোট্ট একটা হোটেলে। 

সূর্য ওঠার আগে,এখনকার বন্ধুদের সঙ্গে, বাবা-মা'র হাত ধরে,দেখতে গেলাম সমুদ্র-শোভা। পাথর-নুড়ি-ঝিনুক...তটের ভিজে বালি...গর্জনে সমুদ্র ভয়ঙ্কর!ভয়াবহ!মনে হয় পাগল হয়ে গেলাম! ভেতর-অন্তর উদ্বেল হয় বারবার! মন চঞ্চল হয়। কখনও এক্কেবারে স্থির। হায় হায় করে ওঠে বুকের ভেতর!পাঁচশ সিঁড়ি ভেঙে উঠলাম পাহাড়ে। পক্ষীতীর্থ! দ্যাখা গেলো পক্ষী।খাবারের লোভে এরা আসে। বুঝলাম।পুরোহিতের হাত থেকে চাল-কলা মাখা খাবার খেতে শুরু করলো।আর ভাগ্যবান বলে হায় হায় করে উঠলো,পুণ্য লোভী মানুষজন!নেমে এলাম। এবার চললাম পণ্ডিচেরি। বাস এসে দাঁড়িয়ে পড়লো,বিশাল এক সমুদ্রের পাশে। সমুদ্রের ঠাণ্ডা হাওয়ায় গা ভাসালাম। বসলাম পাথরের একটা খণ্ডে। কতো পাথর! এখানে সমুদ্রের জল গাঢ় নীল, ঘোলাটে আর মেটেলাল।বেশ আলাদা করে চেনা যাচ্ছে।আছড়ে পড়ছে কিনারায়। জোরে।  প্রবল বাতাসে আমার মাথার ঝাঁকড়া চুল উড়ছে। আমি উড়ছি মনের আশমানে! আমি তলিয়ে যেতে থাকি স্বপ্নের আবর্তে!"মেঘে ঢাকা তারা "- র  সেই বুক ফাটা আর্তনাদ ভেসে আসে। "দাদা আমি বাঁচতে চাই..."আমিও তো বাঁচতে চাই,ঠিক এমনি করে...পৃথিবীর এই লীলা নিকেতনে...

পরদিন সকালে স্নান করে, সেই পরম পুণ্য ক্ষেত্রে। অরবিন্দের আশ্রম।যেখানে এই নিত্যপথের যাত্রী তাঁর জীবনের দিনগুলো কাটিয়ে গিয়েছেন,পরমাত্মার সন্ধানে।  আশ্রমে প্রবেশ করলাম। নীরব-নিস্পন্দ পরিবেশ! বিশাল এক বৃক্ষ ছায়ায় এই পরম সাধকের শ্বেত-স্বচ্ছ  সমাধি।ফুলে ভরা! ফুলে ফুলে ভরা আশ্রম। গোলাপ,গাঁদা, জিনিয়া,ডালিয়া, ইনকা! কতো রঙের...  সুগন্ধী ধূপ পুড়ছে গোছা-গোছা! সমস্ত আশ্রম যেনো অব্যক্ত ব্যথায় ভরা! করুণ! শ্রদ্ধায়  মাথা নত হয়ে আসে!বেরিয়ে এলাম।দেখলাম আমি কাঁদছি! আমার দু-চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে অবিরত!  একটাও কথা বলতে ইচ্ছে করছিলো না।  এই পবিত্র স্থান ছেড়ে যখন চলে যাচ্ছি, তখন ঝমঝম করে বৃষ্টি...

বাস চলেছে।দুদিকে পাহাড়। মাঝখান দিয়ে পথ।বেলা ঠিক এগারোটা।পাহাড় পাথর গাছপালা আর রাঙা মাটির পথ।মনে হয় যেনো কোনো সাম্রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ! একটা নিরিবিলি জায়গায় বাস থামলো।  ল্যাংটাপুটো একদল নিষ্পাপ বাচ্ছা হাত নাড়তে লাগলো আমাদের দেখে।  মুখে হাসি। তাদের সেই সরল-সোজা  উল্লাসে প্রাণ যেনো জুড়িয়ে গেলো!  শ্রীরঙ্গমে দেখলাম অনন্ত শয্যায় বাসুদেব।তেমন কিছু মনে হলনা।সাড়ে দশটায় মাদুরাই।  ডাল তরকারি পরোটা মিষ্টিতে, মিশিয়ে দিলাম খুশি।রাত কাটলো ঢালা বিছানায়।  
ঘুম ভাঙলো। তৈরি হয়ে দেখতে গেলাম  মীনাক্ষী-মন্দির। দক্ষিণ ভারতের সবথেকে বড়ো  মন্দির বলেই শুনলাম।তৈরি হয়েছিলো, প্রায় ষোলো শ,বছর আগে।  চৌষট্টি বছর ধরে।বংশপরম্পরায়  তৈরি করেছিলেন চৌত্রিশ জন রাজা।পোড়া ঘি'র গন্ধে কেমন যেনো লাগলো! মন্দিরের পাথরের কাজ মন ছুঁয়ে যায়,তবে কতকটা একই রকম।রাত এগারোটায় বাসে চেপে বসলাম।ভোর তিনটেয় ম্যাণ্ডাপাম স্টেশনে। ট্রেনে সোজা রামেশ্বরম।ভোরের আকাশ তখনও মেঘাচ্ছন্ন!রাতজাগা চাঁদ যেনো একটা দুর্বল কবিতা হয়ে লেপটে আছে আকাশের গায়ে! জোনাকির মতো মিটমিট করছে দু-একটা তারা! রাস্তায় টাল খাচ্ছে মোদো-মদ্যপ।পৌঁছালাম। স্নান করলাম সমুদ্রে। ভয়-আনন্দ।ঘোড়ার গাড়িতে রামেশ্বরম স্টেশন।ট্রেনে করে ফিরে এলাম ম্যাণ্ডাপামে।যাত্রীবাহী ট্রেন নীল সমুদ্রের ওপর দিয়ে সরীসৃপের মতো পার হয়ে এল! চারিদিকে জল আর জল! মন স্থির হয়ে গেলো। বেলা দু'টোয় বাসে। অত্যন্ত গরম। কাঠফাটা রোদ! প্রচণ্ড অস্বস্তি!গন্তব্য কন্যাকুমারী। দুপুর থেকে বিকেল। তারপর কালচে নীল সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে, নিশি-রাত! বাসের ভেতরে ঝুঁকে পড়েছে এ ওর ঘাড়ে। সবাই বেশ ক্লান্ত! অবশেষ ভোর একটার দিকে আমরা গন্তব্যে।  খাওয়াদাওয়া শেষ হতে অতয়েব সাড়ে তিনটে বেজে গেলো! 

সকালে স্নান করতে গেলাম, কন্যাকুমারী-মন্দিরের সামনে। সমুদ্রে। ঢেউয়ের দোলায় দোল খেতে খেতে, স্নান যে কতো আনন্দের! অনেকক্ষণ ধরে উপভোগ করলাম এই সমুদ্র স্নান! বিকেলে লঞ্চেকরে বিবেকানন্দের রক।পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন! মনোরম স্থান! কেমন অকারণে ভক্তিভাব জাগে! ফিরতে ইচ্ছে করেনা! ধ্যান ঘরে বসি।ধ্যান করতে চেষ্টা করি! শান্তি-শান্তি! বাধ্য হয়ে ফিরে আসতে হয়! মনের মধ্যে বিচিত্র স্বপ্নের ঘোর লেগে থাকে! 

সমুদ্র তীরে সূর্যোদয়। দর্শনার্থীদের ভিড়ে স্বতঃস্ফূর্ত দাঁড়িয়ে পড়ি। মেঘে চাপা আকাশ। সূর্য উঠলো না,দুর্ভাগ্যের মেঘে চাপা পড়ে গেলো মনের ইচ্ছা!  কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর, বেলা এগারোটায়, আবার পথচলা। পথের দুধারে সুন্দর সাজানো-গোছানো বাড়িঘর চোখে পড়তে থাকে।দেখতে দেখতে আমারা ত্রিবান্দ্রামের এক সমুদ্র-সৈকতে।কিনারায় বারবার আছড়ে পড়ে ঢেউ! পা ভেজাই।  ঝিনুক কুড়িয়ে নিই! এক প্রিয় বান্ধবী, এইসময়  কোনো ভাবে কপালে আলতো চুমু দিয়ে, চুপিচুপি  বলে,"প্রেমের জয় হবে একদিন..." আমি হেসেছিলাম মাত্র একবার! নীরবে! সময় এভাবেই...তারপর,আবার যাচ্ছি তো যাচ্ছি উঁচু-নীচু পথ বেয়ে। এখানে ঘন জঙ্গলের মতো নারকেল গাছের বাগানও যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকে! পথচলাতেই আনন্দে বিভোর হয়ে যাই! ক'টা দিন জীবনের দুঃখ-কষ্ট, জড়তা পেছনে ফেলে, গণ্ডিহীন উদ্দাম! এসে গেলাম কুইলন। একধরনের টক্-টক্ সামুদ্রিক মাছ খেলাম আজকের ডিনারে। এখন রাত্রি।জগত জুড়ে আঁধারে আচ্ছন্ন অস্পষ্ট মায়া!আমার মনকেমন করে! 
ক্রমে খণ্ডিত হয় রাত!দিনের আলো ফোটে। চোখের আলোয় দেখি এক অজানা পাহাড়! ধূপছায়ার মতো ছাই-কালো মেঘ উড়ে চলেছে পাহাড়ের গা বেয়ে! সম্ভবত খানিক আগে বৃষ্টি হয়ে গেছে।ভিজে পথঘাট। গাছের পাতায় টাপুর-টুপুর...আমাদের বাস এবার পাহাড়ে উঠতে শুরু করলো। ঘন জনাকীর্ণ এই পাহাড়! চারিদিকে আরও অনেক অনেক পাহাড় মাথা তুলে! গাছ পাতায় ঘেরা! দেখছি আমরা অনেকটা উপরে উঠে এসেছি! অভূতপূর্ব! লাল নীল হলুদ ফুলের রঙে মাখামাখি! পথের কোথাও কোথাও এক্কেবারে রঙিন! বৃষ্টি-ধোওয়া  ফুলের রঙ উজ্জ্বল! তাজা! আরও উপরে উঠছি আমারা। বিরাট বিরাট শাল, সাগুয়ান,বাবলা। কতো অপরিচিত গাছও। গাছে গাছে বাঁদরের লাফ-ঝাঁপ! বেশ লাগছে। প্রকৃতি কতো সুন্দর হতে পারে! কতো আত্মীয় হতে পারে! অনুভব করতে পারছি সহজে! 

এই মুহূর্তে নীল-আকাশ আর ধোঁয়া-মেঘ, আমার মনটাকে একেবারে অবশ করে দিচ্ছে! আমি হারিয়ে যাচ্ছি গভীর থেকে গভীরে! ঝরঝর করে আছড়ে পড়ছে ঝর্নার স্ফটিক...পাহাড়ের গা বেয়ে চলন্ত ট্রেনের কালো ধোঁয়া, মিশে যাচ্ছে ধোঁয়া-মেঘের সঙ্গে! আমারা ক্রমাগত উপরে...ময়ূর হয়েছে মন এখন! পুচ্ছ মেলেছে! মত্ত-তালে চঞ্চল হৃদয়  উন্মুক্ত! প্রায় সাড়ে সাতশ,ফুট উপরে উঠে এলাম! মাথায় ধরে রেখেছে বিরাট শহর। লেক। আর সুদৃশ্য বোটানিক্যাল গার্ডেন।এই পাহাড়! লেকের শান্ত জলে রঙিন নৌকা,খুশির দোল,দুলন্ত পুরুষ-নারী-শিশু! পাশে সাদা কালো ঘোড়া।  চড়ার জন্য। আহা! ও-টি শহরের এই মস্ত পাহাড়ের চূড়া থেকে,রোমাঞ্চকর ভাবে নেমে এলাম! রাত তখন এগারোটা। 

বয়ে চলেছে রাত ঠিক রাতের কথামতো ...আর আমাদের পথিক পরান...প্রিয় পথচলা...
"পাখিদের খুসকো পালকে তবুও তো লেগে থাকে প্রাণ! নতজানু হয় পৃথিবী!পলাশ-রঙ গোধূলি কুড়িয়ে আনে ফেলে আসা দিন! "
সাধের ভ্রমণ,সে তো আবহমান...

লেখক বিকাশরঞ্জন হালদার 
রঘুনাথপুর, বিরেশ্বরপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা








 

0 Comments