হৃদস্পন্দন

  • Home


  • Download

  • Social

  • Feature


আমাদের চুপকথা 
[অন্তিম পর্ব]
  
রজতাভ
 
অরু,অরুনা মুখার্জি,আর সুবিমল মজুমদার।দুই বন্ধু, এক সঙ্গে এক কলেজে পড়ত। এক মাস্টারের কাছে যাতায়াত ও করত। ওরা অনেক পথ ঘুরেছে। রঙিন স্বপ্ন দেখেছে। আর পাঁচটা কলেজে পড়া কৌতূহলী  ছেলেমেয়েদের মতো ওরা লুকিয়ে প্রেম করেছে। তবু ওরা বিয়ে করেনি। অরুনা বলে- বিয়ে করলে নাকি ওদের প্রেম হারিয়ে যেত। বলিহারি বাবা মেয়ের বুকের পাটা! এই প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কি মরিয়া চেষ্টা! নিজের চোখে তো দেখেছি কত রাত ও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। আমার বুকে মাথা রেখে ও কি তবে ওর হারানো প্রেমকে খুঁজে বেড়াত?কি জানি! কথায় বলে,নারীর মন নারায়নে জানে না,আমি তো কোন ছাড়!   
কিন্তু এই বয়সে এসে ও এমন করে সুবিমলকে খুঁজে বেড়ায় কেন? যদিও মুখে কিছু বলে না। কিন্তু ওর মন! সেও কি ফাঁকি দিতে পারে!  
নাকি এ শুধু স্মৃতি রোমান্থনে আনন্দ খোঁজার চেষ্টা!  নাকি এই অনন্ত প্রতীক্ষা- ওর মিলনের সুখ!   
এ সময় অপরাহ্ণের আলোয় কেমন এক বিষাদের সুর। ঘর ফেরতা পাখিগুলো মনের আনন্দে বাসায় ফিরছে। মেঘের বুকে রুপালি রেখা ছড়িয়ে বলাকার দল ভেসে চলেছে। ঘরে ফেরার আনন্দ ওদের মনে। কিন্তু আমার ফেরার আনন্দ কৈ?  
ভাবছি খবরেরে কাগজে একটা বিঙ্গাপন দেব। ওদেরকে একসঙ্গে বসিয়ে দেখব,ওরা কত প্রেম করতে পারে! হিংসা হচ্ছে কি আমার? তবে কি সুবির এই সওভাগ্য আমি কি মেনে নিতে পারছি না? কেন এই বয়সে এসে এমন করে অরুকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি? ছেলে- মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার আমাদের। সব ভাসিয়ে ও কি চলে যাবে? নাকি এবার ওর জন্যে সেই ব্যবস্থাই আমার করা উচিত!     
অরুনা এ বছর সেপ্টেম্বরে রিটায়ার করল। তাও বাচ্ছাদের শিখিয়ে পড়িয়ে ওর দিন কাটছিল বেশ। ছেলে মেয়েকে নিয়ে আমাকে কোনদিন ভাবতে হয়নি। ঐ মানুষ করেছে। ওরা এখন প্রতিষ্ঠিত। এক সময় ও বলত, সব সময় কাজে ডুবে থাকতে ওর বেশ লাগে। আজ বুঝেছি সে ও যে সুবিমলকে ভুলে থাকার ছলনা। নাকি সত্যি ও কাজ ভালোবাসে!     
মাঝে মাঝে মনে হয় অরুনাকে আজো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। অথচ ও তো কোনদিন ওর কর্তব্যে অবহেলা করেনি। সকাল সকাল (কখনো কখনো ভোরবেলা) উঠে আমার অফিসের ভাত রান্না করা, ছেলে- মেয়ের খাওয়ানো,পড়ানো,শ্বশুর শাশুড়ির সেবা যত্ন- সব তো নিপুন হাতে একা সামলেছে। বাবা তো বড় বউমা বলতে অজ্ঞান! হু! ওর হাতে সকালবেলা চা না হলে বাবার মুখ ভার হয়ে থাকত। বিল্টুটা (আমার ভাইপো) প্রায়ই বায়না করত- জেঠিমার কাছে ঘুমাবো।  
এত সব ভালোবাসা,এত দায়িত্ব কর্তব্য সব ফাঁকি! এত মানুষকে একা হাতে সামলাতে আর ক'জন পারত কে জানে!  
আজ এই বয়সে এসে সেই অরুনাকে আমি কিনা অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি!বার বার মনে হয়-এত সব কিছু ফাঁকি!এত বছর পরেও ওকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি! ঠিকই চিনে ছিল সুবিমল?   
আজ তিরিশ বছর ধরে কর্তব্য করতে করতে ও কি ক্লান্ত? কত বার ওকে ঠাকুর ঘরে গিয়ে বলতে শুনেছি- আমার মুক্তি দাও ঠাকুর। এবার মুক্তি দাও। কিসের থেকে ও পালিয়ে যেতে চাইছে? সবটাই কি প্রবঞ্চনা? হা, ইশ্বর! শুধু যে কর্তব্যের খাতিরে মানুষ এত কিছু করতে পারে, ওকে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত।
কিন্তু এই অবসর জীবনে এসে আমি বা কি নিয়ে থাকব? কোন কোন দিন ঘুম ভেঙে ওঠে দেখতাম,ও বারান্দায় ইজি চেয়ারে ঠায় বসে আছে। মেঘের অন্তরালে লুকানো চাঁদকে দেখে কি যেন বিড়বিড় করছে! ওকি তবে রাতের নিস্তব্ধতায় ওদের অনন্ত প্রতীক্ষার বার্তা খুঁজে ফেরে! স্মৃতি রোমন্থনে আনন্দ খোঁজে! ওর এই প্রতীক্ষার নীরব সাক্ষী হয়ে আরও কতদিন আমাকে কাটাতে হবে কে জানে!  
আজ এই অন্ধকার রাতের স্তব্ধতাই আমার অনন্ত নিসঙ্গতার সঙ্গী। আর অরুনা সেই স্তব্ধতার মধ্যে নীরবে ওর প্রেম নিয়ে বেঁচে আছে। 
                                                                                            ৭-ই বৈশাখ ১৪১৭
                                                                                                    অপরাহ্ণ
                                                                                                        রজতাভ

                        
      লেখক বিশ্বনাথ প্রামাণিক 
      বিদ্যাসাগর পল্লী, সোনারপুর, কলকাতা- ১৫০










চিত্তচৈত 

এই বাতাসে গন্ধ ঝড়ের ফাগুনবাতাস আগুনবাতাস
ফুলপরিদের কোমলমুখে কীসের আলো স্বপ্ন ভাসে? 
বসন্তদিন স্বপ্নসুখের তার পিছনে শঙ্কা কেন ডঙ্কা বাজায়!
কোন সে নিষাদ ধনুক হাতে লক্ষ করে কোমলশরীর
রক্তলোভী! গন্ধফুলের মগ্নছোঁয়া হাত ধুয়ে নেয় পলাশরেণু
বাজায় বেণু কোন রাখালে মাতাল সুরে টানছে কেন
গাঁয়ের রাধা শালের বনে বাধা কঠিন জলের ছলে
যাওয়া বারণ ধু-ধু পুকুর আজ যে রাবণ বাড়ির মানুষ।
থাক না বাঁশি ভাঙন সুরে বাঁধন আছে শক্ত ভীষণ
আজ সে থাকুক বাড়ির ভেতর দেহটাকেই দেখুক লোকে
মনের নাগাল অনেকদূরে উড়ছে ধুলো গরম পথে
মুখ পুড়ে যায় বুকও পোড়ে চৈতে তবু সইতে আগুন
দল বেঁধে যায় রঙ্গময়ী সেই কি জয়ী?দেয় না ছেড়ে
মানুষগুলো সেই যে যারা স্বপ্ন দেখে মধুর ঋতু বধূর মনে
ঝড় তুলে দেয় চৈত্রপবন বাঁধন ছেড়ে দেহমনের
লাগায় ডানা স্বপ্নপরি যাবে কোথায়? 

            কবি জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়
গোপেশ্বরপল্লি, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া










জীবন বসন্ত

এসো দুজন একসাথে চলি 
পাড়ি দেই আটলান্টিক-হিমালয় পবর্তমালা, 
চাঁদের আলোয় ভেসে ভেসে মহাশূন্যে গেয়ে উঠি জীবন বসন্তে- মিলনের শ্রেষ্ঠ দ্বৈত গান।
সুরের জাদুতে উড়ুক আজ প্রাণের কোকিল
আর,দুলতে থাকুক একটি চিত্রের রঙ্গময় পৃথিবী;        তাতে লেখা হোক প্রেম দিয়ে দুটি নাম জন্ম জন্মান্তরের পাতায়।


গন্তব্য

বিচলিত রাত ডেকে যায়
সাঁকো হীন নদীর তীরে,
নিহত দিনের শোকের ঘোরে কাটে রাত্রির ছায়া। 
আলো এসে পড়ে পত্র পল্লবে,
দিনমান চেয়ে থাকি -                                                  একটি সহজ গন্তব্যে।

কবি ঝুটন দত্ত 
কেন্দুয়া, ময়মনসিংহ , বাংলাদেশ 
                                                                          






ফিরে দেখা 

আজ চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেছে সুদেষ্ণার।ঘুম ভেঙে গেছে? না, ঘুমাতেই পারে নি কে জানে। আজ ভ্যালেন্টাইন্স ডে।এক সপ্তাহ আগে ফোনে কলেজের এক বন্ধু মারফৎ খবর পেয়েছে দীর্ঘ একত্রিশ বছর পর তাদের মহাবিদ্যালয়ের বন্ধুরা রি- ইউনিয়ন করবে।দিনটা তারা চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি ঠিক করেছে।বুকের মধ্যেটা মোচড় দিয়ে উঠল তার।অস্ফুটে বলে ওঠে-- সৌমাল্যর সাথে কথা হয়েছে?ও আসবে?
--আসবে আসবে সবাই আসবে। একটা জমজমাট গেট টুগেদার হবে। তুই আসবি কিন্তু। কোন হলে হবে তোকে হোয়াটসঅ্যাপে জানিয়ে দেব।

ঠিক একত্রিশ বছর আগে সতেরো বছরের সুদেষ্ণার মুখটা মনে করার চেষ্টা করল পঞ্চাশ ছুঁতে চলা সুদেষ্ণা। তখন সবে একাদশ শ্রেণী।কৃষ্ণনগর,ছোট মফস্বল শহর।কবি বিজয়লাল উচ্চ মহাবিদ্যালয়ে শুধু একাদশ দ্বাদশ শ্রেণীই পড়ানো হয়। সে দিনটাও ছিল চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি। কানের পাশে জোড়া বিনুনি করে সবে শাড়ি পরতে শেখা সুদেষ্ণা অন্য দিনের মতো ধীর পায়ে কলা বিভাগে ঢুকতেই পায়ের কাছে টুপ করে ঢিল বাঁধা কাগজের টুকরো এসে পড়ল।সতেরোর সুদেষ্ণার বুকের ভিতর একরাশ প্রশ্ন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উথালপাথাল করে উঠল।কী ওটা? মহাবিদ্যালয়ের চাতাল ততক্ষণে ছাত্র ছাত্রীদের আগমনে সরগরম হতে শুরু করেছে। শিক্ষক শিক্ষিকারাও অনেকেই ঢুকছেন গেট দিয়ে। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে সুদেষ্ণা প্রানপন চেষ্টা করে যাচ্ছে শাড়ি দিয়ে কাগজের টুকরোটা আড়াল করতে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে সবার অলক্ষ্যে অতি সন্তর্পণে কাগজটা তুলে নিয়েই সোজা চালান করে দিল ব্লাউজের ভিতর। নাঃ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। ওয়াশরুমে গিয়ে কাগজটা খুলে দেখবে কী লেখা আছে।কেউ কি ওকে উদ্দেশ্য করেই ছুঁড়েছে কাগজটা? নানান প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছে তার।সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলার ডানদিকের বড় হলঘরটা কলা বিভাগের ঘর।সিঁড়ির প্রথম ধাপ পেরিয়ে পরের ধাপে টার্ন নিতেই দেখতে পেল সৌমাল্য কে। খুব নিচু স্বরে সুদেষ্ণাকে কমনরুমে যেতে বলেই দ্রুত বেরিয়ে গেল।কমার্স বিভাগের ছেলে সৌমাল্য। ছোটখাটো  সুন্দর চেহারার লাজুক ছেলেটা তাকে কমনরুমে কেন এভাবে যেতে বলল ভেবে পেল না সে।অদম্য কৌতূহলী মন আর অপেক্ষা করতে পারছে না।ওয়াশরুমে ঢুকে কাঁপা হাতে ব্লাউজের ভিতর থেকে কাগজের টুকরো বের করে খুলতেই দেখে খুব তাড়াতাড়ি হাতের লেখায়--আমি তোমাকে ভালোবাসি।বুকের ভেতর দ্রিম দ্রম শব্দে সারাদিন একটা ক্লাস ও মন দিয়ে শুনতে পারে নি ।শিক্ষকদের কোনো কথাই তার কানে ঢোকেনি।শুধু সময় গুনেছে বিকেল পাঁচটা কখন বাজবে।কমনরুম তাকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির মতো টানছে। তারপর টানা দুবছর সৌমাল্য কে একবেলা না দেখে থাকতে পারত না সুদেষ্ণা। সিনেমা,পার্ক,কলেজ এক্সকারসন,কমনরুম, একসাথে টিফিন খাওয়া,খেলাধূলা আরো কত কী।যেন ঝড়ের গতিতে চলে গেল দুটো বছর।উচ্চ মাধ্যমিকে দুজনেই খুব ভলো রেজাল্ট করে শহরের বড় কলেজে ভর্তি হল সুদেষ্ণা বাংলা অনার্স নিয়ে। আর সৌমাল্য চলে গেল অ্যাকাউন্টেন্সিতে অনার্স নিয়ে কলকাতার নামি কলেজে।আলাদা কলেজ, আলাদা শহর,দেখা করার সময় কম তবু দুজনের মন যেন এক সুরে, এক লয়ে গাঁথা। ঠিক এইসময় সুদেষ্ণার বাবা মারা গেল হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে।কাকাদের জোরাজুরিতে মাও সম্মত হল।বিয়ে করতে বাধ্য হল সুদেষ্ণা। 

পাশের ঘরে গোঙানির শব্দে বিছানা ছেড়ে মাঝের দরজাটা বন্ধ করে দিল সে।সারারাত পাশবিক অত্যাচার করে তার চাকুরিজীবী স্বামীর মদের নেশা কাটতে শুরু করেছে। সুদেষ্ণার আপত্তিকে কেউ গুরুত্ব দেয় নি।সমবয়সী সৌমাল্যর ভবিষ্যতের ওপর মায়ের কোনো আস্থা ছিল না। অগত্যা মাকে ভালো রাখার জন্যই মানসিক ভাবে অপ্রস্তুত সুদেষ্ণা সংসার সমুদ্রে পাড়ি দিল। আজ সে আর কারুর কথা ভাববে না।দীর্ঘ একত্রিশ বছর পর আবার সৌমাল্যর সাথে দেখা হবে। ও কি করে,কোথায় থাকে,বৌ কেমন হয়েছে কিছুই জানেনা। কত প্রশ্ন মনের মধ্যে ভিড় করছে।ও সুখেই আছে নিশ্চয় বিয়ে করে। ভালো ছাত্র ছিল।ভালো চাকরিও করছে নিশ্চিত। আজ রবিবার। ছুটির দিন।তার চাকুরিজীবী স্বামীর মদের নেশা সারাদিন ধরেই চলবে। আর চলবে পদে পদে ঠোক্কর দিয়ে কথা।প্রতিবাদ করলেই মার। এই পরিবেশেই কত কষ্ট করে মেয়ে টাকে লেখাপড়া শিখিয়েছে। বাড়ির সবাই মিলে প্রায় জোর করেই মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছিল।সুদেষ্ণা রুদ্রমুর্তি ধারন করে বন্ধ করেছে সে বিয়ে।মেয়ে কে সরাসরি প্রশ্ন করছিল বাবা ঠাকুমার প্রস্তাবে সেও রাজি কি না। সবে আঠারোয় পা দেওয়া মেয়ে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল।পড়াশুনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। কমার্সের ভালো ছাত্রী আজ চ্যাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ।ব্যাঙ্গালোরে একটা ফার্ম হাউসের ম্যানেজমেন্ট এর দায়িত্বে আছে।

পাশের ঘর থেকে চিৎকার করছে চাকুরিজীবী স্বামী।আজ আর কোনো দিকে তাকাবে না সে। দ্রুত স্নান সেরে ছোট টিপ হালকা রঙের শাড়ি আর হাতঘড়ি টা পরেই আয়নায় নিজেকে ভালো করে দেখল অনেক বছর পর। হালকা লিপস্টিক ঠোঁটে বুলিয়ে নিল।ছোট একটা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল সে।আকাশে এখনো আলো ফোটেনি।ট্রেন ধরতে হবে।কৃষ্ণনগর লোকাল। বউবাজার থেকে শিয়ালদহ স্টেশনটা অন্যদিন হেঁটে যেতে দীর্ঘ পথ মনে হয়। আজ যেন পাখির মতো হাওয়ায় ভাসছে সে।ট্রেনে চেপেই স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলে মেয়েকে একটা ফোন করে সে।একমাত্র মেয়েটাই তার অতীত জানে, বর্তমান জানে, ভবিষ্যতের কথা ভেবে আতঙ্কিত হয়।কতদিন মেয়ে তাকে বলেছে--প্রতিদিন এভাবে মার খেয়ে পড়ে না থেকে বাবার থেকে সেপারেশন নিয়ে নাও মা।এভাবে আর কষ্ট সহ্য কোরো না। তোমার জন্য আমার খুব চিন্তা হয়।আজকালকার দিনের মেয়ে। কত সাহসী। কত সহজে জীবনের জটিলতার সমাধান করে ফেলে।তার মেয়ে তার মতো হয়নি ভেবে ভালো লাগে তার।

--হ্যালো,কে- মা?বলো মাই ফ্রেন্ড বলো।এত সকালে? কি ব্যাপার?মেয়ের ঐ এক দোষ। আদর করে মাকে ফ্রেন্ড বলে সম্বোধন করে।সুদেষ্ণা কি বলবে মেয়ে কে?কিছুই কি হয়নি? অবশ্যই হয়েছে। মদ্যপ স্বামী কে ঘরে একলা ফেলে রেখে এই প্রথম একত্রিশ বছর পর সে ছুটে চলেছে আলোর সন্ধানে ---একা। মেয়ে কে বললে হয়তো খুশিই হবে।

--আমি কৃষ্ণনগর যাচ্ছি। আজ আমাদের মহাবিদ্যালয়ের বন্ধুরা রি-ইউনিয়নের গেট টুগেদার পার্টি করছে। তোকে বলেছিলাম। ভুলে গিয়েছিস? আমি সেখানেই যাচ্ছি। বলতে গিয়ে গলাটা একটু কেঁপে উঠল তার।

-- গ্রেট! দারুন কাজ করেছো মা। এই তো আমার মাকে আমি এইরকমই দেখতে চাই। এনজয় ইয়োরসেল্ফ।তোমার সব বন্ধুদের ছবি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পোস্ট কোরো মা।জীবনের বেশিটাই অন্যের কথা ভেবেছো। এবার নিজের কথা ভাবো। নিজেকে চেনো।বাঁচতে শেখো নিজের জন্য...আরো কিছু বলছিল মেয়ে।ট্রেনের হর্নে সব কথা তার কানে এসে পৌঁছালো না।লাইন টা কেটে।
ট্রেনের হাওয়ায় চোখ বন্ধ করে আরাম করে বসতেই ক্লান্ত শরীর অবসন্ন হয়ে এলো তার।কত কান্নাকাটি করেছে সে মায়ের কাছে পড়াশুনা করতে চেয়ে। কি অসুবিধা ছিল মায়ের কে জানে। তাকে বিয়ে দেবার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেন? সৌমাল্য অনেক বুঝিয়েছিল মাকে। পাঁচটা বছর সময় চেয়েছিল।তার মধ্যেই সে একটা চাকরি পেয়ে যাবে কথা দিয়েছিল মাকে।মা কিছুতেই রাজি হল না। বরং কাকাদের পরামর্শে প্রায় জোর করেই একটা কিশোরীর সব স্বপ্ন হত্যা করল। শ্বশুরবাড়ির কারুর মত ছিল না পড়াশুনা সে পড়াশুনা করুক।শুধু সেবা আর সবার মন পাবার জন্য পদে পদে রান্না করতে হয়েছে। তবু মন পায়নি। পান থেকে চুন খসলেই মার খেয়েছে।

বড় হল ঘরটা গমগম করছে।সব বন্ধু দের সাথে একত্রিশ বছর পর দেখা।হলের ভেতরে একটা পুরোনো দিনের গান বাজছে।সুদেষ্ণা কাউকে চিনতে পারছে কাউকে পারছে না। সবাই সবার সাথে হাত মেলাচ্ছে। তাকে দেখতে পেয়েই বুকে জড়িয়ে ধরেছে স্বাগতা রেবা রীনা জবা। সবাই আপ্লুত।বড় ডায়াসের  একটা কোনে চোখ আটকে গেল সুদেষ্ণার। ঐ -ঐতো সৌমাল্য। অবিকল এক আছে।কারোর সাথে ফোনে কথা বলছে।একত্রিশ বছরে এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। শুধু চেহারাটা একটু ভারি হয়েছে।বেসিনের আয়নায় নিজেকে দেখল সে।দুচোখের কোলে কালি আর ক্লান্তির ছাপ।আয়নার কাছ থেকে সরে এসে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে আনমনা হয়ে গেল সে।দীর্ঘ একত্রিশ বছর পর কেউ চেনা কেউ অচেনায় ধরা দিচ্ছে একে অপরকে। 

--কেমন আছো? চমকে পেছন ঘুরে তাকিয়ে সুদেষ্ণা দেখে সেই দুষ্টুমি তে ভরা গভীর চোখদুটো তারই দিকে তাকিয়ে হাসছে। 
--ভালো। তুমি?
--খুব ভালো। 
--তুমি কোথায় থাকো? ছেলেমেয়ে কটা?  সুদেষ্ণা জানার চেষ্টা করল সৌমাল্যর বিয়ে করে কতটা সুখী।
--আমি এখন ব্যাঙ্গালুরু থাকি।একটা ফার্মহাউস করেছি। বলতে পার ফার্ম হাউসের মালিক।দামি সিগারেটে সুখের টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল সে।

একদল বান্ধবী যেন সতেরোর তরুনীর মতো ছুটে এসে সৌমাল্য কে চেপে ধরে ডায়াসের ওপর নিয়ে গেল স্যাক্সোফোন বাজানোর জন্য। প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিল সৌমাল্য।স্যাক্সোফোনে একটার পর একটা সুর তুলে আন্দোলিত করে গেল সকলের হৃদয়। সারাদিনের ঠাসবুনোট অনুষ্ঠানের মধ্যেই চলল খাওয়া দাওয়ার পর্ব। এরই মাঝে ছোট একটা কাগজের টুকরো সুদেষ্ণার হাতে গুঁজে দিয়ে আবার মেতে উঠলো সৌমাল্য। একত্রিশ বছর আগের মতো খুব সন্তর্পণে ওয়াশরুমে ধীর পায়ে ঢুকে কাগজের টুকরোটা খুলতেই চমকে উঠল সে। 
--ঠিক বিকেল পাঁচটা নদীর পাড়ে বেদিতে বসব। সেই বেদি! কত বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা কেটেছে তাদের এই বেদিতে বসেই।

আচ্ছন্ন সুদেষ্ণা ধীরে ধীরে হল থেকে বেরিয়ে গেল সকলের অলক্ষ্যে। মন্ত্রের মতো পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলো নদীর ধারে। মাত্র পনের মিনিট পথ হেঁটে এসে বেদিতে বসে হাঁপাতে লাগল।উত্তেজনায় দীর্ঘদিনের অত্যাচারিত শরীর টলছে।রুমাল দিয়ে চোখ মুখ মুছতেই দেখতে পেল সুঠাম ঝকঝকে সৌমাল্য তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। 
--আর তিনটে বছর অপেক্ষা করতে পারলে না?অকপট সৌমাল্য।
--তোমার স্ত্রী ...সুদেষ্ণা কে কথা শেষ করতে না দিয়েই সৌমাল্য বলে ওঠে--বিয়ে করিনি।
--কেন?
--অদৃষ্টে নেই। তুমি কেন এত অত্যাচার সহ্য করেছ মুখ বন্ধ করে? 
--ক্ কে বলল তোমাকে? কি করে জানলে তুমি এসব? অবাক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সৌমাল্যর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ভ্রু কুঁচকে। 
--সব জানি আমি। আয়ুষি আমাকে সব বলেছে। অবাক হবার আরো বোধহয় কিছু বাকি ছিল। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না সুদেষ্ণা। মেয়ের নাম জানল কি করে সৌমাল্য? 

পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে ক্রমশ। ধপ করে বসে পড়ল বেদিতে।
আয়ুষি আমার অফিসে একটা গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে আছে সম্পূর্ণ নিজের যোগ্যতায়। ঝকঝকে প্রাণোচ্ছল মেয়ে। কাজেও সমান দক্ষ। ওর কাছে আমি সব শুনেছি। তোমার প্রতিদিনের অত্যাচারিত হবার গল্প ,কত কষ্ট সহ্য করে মেয়ে কে মানুষের মতো মানুষ করেছ সব শুনেছি। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে সুদেষ্ণার। মেয়ে তো তাকে কোনোদিন কিছু বলেনি সৌমাল্যর কথা।বিশ্বাস হচ্ছে না তার। সন্দিগ্ধ চোখে সৌমাল্য কে দেখতে থাকল। 

--আমার অফিসে সবচেয়ে দক্ষ বুদ্ধিমতী মেয়ে আয়ুষি। ওর কাছে সব শুনে ওরই পরিকল্পনায় আজকের এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। কথাগুলো বলে একদৃষ্টিতে সুদেষ্ণাকে দেখতে লাগল সৌমাল্য। ঠিক সেই সময় তার ফোনের হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল আসতেই মেয়ের ছবি স্ক্রিনে ভেসে উঠল।মেয়ে ফোন করেছে। হাত কাঁপছে সুদেষ্ণার। এই প্রথম মেয়ের কাছে গুটিয়ে যাচ্ছে সে।কাঁপা হাতে ফোন ধরতেই ওপাশে মেয়ের আনন্দচ্ছল মুখ।স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে উঠল --আজ সারাদিন কেমন কাটালে মা? তোমাকে আর আঙ্কেল কে একসাথে দেখে আমার মনটা খুব ভালো হয়ে গেল।জানো মা,আমি তোমাকে কিছু বলিনি।কারণ আগে জানালে তুমি এত সাবলীল ভাবে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারতে না। আমি সব জানি এটা জানলেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে।মা,ঐ ভদ্রলোক তোমার ভালোবাসাকে গুরুত্ব দিয়ে আজও বিয়ে করেন নি।জীবনে কাউকে আর আনেন নি। আনন্দ কর মা। দিনটা উপভোগ কর।বাকি জীবনটা উপভোগ কর।তোমার সাথে আমি আজ আর ফোনে  কথা বলে তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করে দেব না।ফোনটা কেটে দিল মেয়ে। ঝরঝর করে কাঁদছে সুদেষ্ণা। দুই হাতের বাহুডোরে সুদেষ্ণা কে বেঁধে সৌমাল্য বুকে জড়িয়ে ধরল। সৌমাল্যর বুকে মুখ গুঁজে জীবনের সব সঞ্চিত কান্না উগড়ে দিল সুদেষ্ণা। ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে সারিবদ্ধ একদল হাঁস পড়ন্ত বিকেলের সোনালী আলোয় সেই ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল।

 লেখিকা স্বাতী রায়
  ৪/১ যাদবগড়, হালটু, কলকাতা


















পৃথিবী

তিন ভাগ জল।এক ভাগ স্থল। 
পৃথিবীকে ডুবিয়ে দিলাম,এবার সাঁতার কাটো। 
এপারে সীতার দুঃখগুলো ডুবন্ত শ্রীলঙ্কায়,
খুঁজে পাওয়া কি এতই সহজ?
আজ তোমাকেই দেখতে হবে-
হনুমানের লম্ফ ঝম্প বিস্তর। 
এক দিন স্বপ্ন দেখেছিলে
লবণাক্ত জলে বিষাক্ত দিনগুলো
হয়ে গেছে প্রবাল দ্বীপ। 
নিঃশব্দে বিকিয়ে যাওয়া মহাজনী ঋণ
শোধ করতে হবেনা কোনদিন। 
ডাঙ্গায় থাকবেনা বাঘ
শুনতেও হবে না হালুম হুলুম হুঙ্কার। 
কুমিরের পিঠে চড়ে পৌঁছে যাবে
নদীর উৎস অথবা মোহনায়। 
জলের উপরিতল চোখ মেলে দেখে
অত্যাচারী স্থলের অতল স্পর্শী স্পর্ধা
তলিয়ে যাচ্ছে, কেউ কোথাও নেই।

 কবি লক্ষ্মণ দাস ঠাকুরা
সুকান্তপল্লী, কালনাগেট, পূর্ব বর্ধমান




"আমাদের চুপকথা"
[পর্ব ৩]

অরুনা

‘’অজো নিত্যঃ শাশ্বত হয়ং পুরানো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’’
                                                                                 - শ্রীমদ্ভাগবত গীতা; সাংখ্যযোগ, শ্লোক-২০
 
এখন সকাল। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে গীতা পড়ার অভ্যাস করেছি। আমার শ্বশুর মশাই বলেন, সকালে স্নান করে পূজা পাঠ সেরে নিষ্ঠাবান চিত্তে গীতা পাঠ করলে মন পবিত্র হয়, সারাদিন নাকি ভালো থাকা যায়। কথাটা যে কত সত্যি তা এ ক’বছরে বেশ বুঝতে পারছি। পুজাপাঠ সেরে রোজ এখন নিয়ম করে আরও একটা কাজ করি। তা হল-ডায়রি লেখার অভ্যাস। সে বলত,ডায়রি নাকি ভালো বন্ধু হতে পারে। ঠিক নিকট জনের মতো মানসিক দুঃখ,কষ্ট,যন্ত্রণার শরিক হতে পারে সেও।        
আজ পুব গগনে আকাশ ঝকমকিয়ে সূর্যি ঠাকুর উঁকি দিচ্ছে।কোথাও এতটুকুও কুয়াশার প্রলেপ নেই।এ সময় রোজের মতো আজও পুবের আলোয় আমাদের পুব মুখো বড় ছাদ বারান্দা ভরে গেছে। আর তারি আলো এসে পড়েছে আমার ঠিক পায়ের নীচটায়। ছাদের রেলিং এ রাখা চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদা, ডালিয়া,নানা রঙের ফুল গাছগুলো যেন হাসছে।   
শীতের সকাল বলে ছেলে-মেয়েরা এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। রজতাভ ও ঘরে ঘুমাচ্ছে।অভ্যাস মতো আমি শুধু ভোরবেলা উঠি। এ সময় প্রকৃতি দেখতে বড় ভালো লাগে। স্নান সিক্ত ভেজা চুলের গোছা এসে পড়েছে আমার চোখে-মুখে। ছাদের এই ঘরে এ সময়টা বেশ নিরিবিলি। শুধু কটা ছাতার পাখি লাফিয়ে লাফিয়ে কিচির-মিচির করতে করতে নেচে চলেছে গোটা ছাদময়। ওরা কি প্রাণ চঞ্চল!
ঠিক তার মতো। কতদিন তার কোন খবর পাই না। সুবিমল মজুমদার। একদা কলেজের কিশোরী মেয়ে গুলোর নয়নের মণি। আর হবে নাই বা কেন! যেমন সুন্দর রুপ,তেমনি স্মাট। আর সে ছিল আমার স্বপন চা…,ছি ছিঃ এ আমি কি লিখছি! এ কথা যে এখন ভাবা ও যে পাপ! 

তবু ভাবনা গুলো ঠেকিয়ে রাখা যায় কৈ! ভাবনা আসে যে ভাবনার নিয়মে। সে ও কি এখন আর ডায়রি লেখে? আমার কথা কি আর ভাবে?     
খাতা ভর্তি যত সব হিজিবিজি লেখা- অসমাপ্ত গল্প,অপরিনত কবিতা- সব নিয়ে এসে প্রথম আমাকে দেখানো চাই। তখন যদি ওর মুখের একটা ছবি তুলে রাখতে পারতাম, কি যে মুখের অবস্থা হত- টেনশনে আর লজ্জায় একেবারে কুঁকড়ে যেত। এখন মনে পড়লে বড় হাসি পায়। 
এক সময় সে ও আমাকে লেখালিখির জন্য কত বুঝিয়েছে। অভিমান করে বলেছে-‘’ সাহিত্যের ছাত্রী, এত গল্প-কবিতা পড়িস, কোনদিন এক কলম লিখে দেখতে ইচ্ছা করে না তোর? তুই কি রে?’’    
হেসে বলেছি- সবার দ্বারা সব কিছু কি হয়? তুই লিখিস,এই তো আমার হল। ও মৃদু হেসে চুপ করে যেত,আর জোরাজুরি করত না।   
কবিতা তো দূরের কথা, জীবনে কোনদিন ডায়রি পর্যন্ত লিখিনি। আর আজ ওর সেই নেশা এই বুড়ো বয়সে এসে কেমন করে যেন আমায় পেয়ে বসেছে।
বড় অভিমানি ছিল সে। কথায় কথায় ছেলেমানুষটির মতো রাগ করত। রাগলে ওকে বেশ দেখতে লাগত। ইচ্ছা করত,আরও বেশি করেই রাগিয়ে দিই। আবার সে রাগ ভাঙাতে আমাকেই তো সাধ্য-সাধনা করতে হত। বড় ছেলেমানুষ ছিল সে।    
কতদিন আর ওর খবর পাই না। কোথায় আছে কে জানে! একদিনের কথা খুব মনে পড়ে-
আমরা মফস্বলের ছেলে মেয়ে, তায় মফস্বলের কলেজে পড়ি। প্রথমবার ওর সঙ্গে কলেজ স্টীট গিয়ে গুচ্ছের খানেক বই পত্তর কেনা কাটা করে ফেরার পথে পথ হারিয়ে ফেলি। যদিও পথ হারানোর ব্যাপার টা ও আমার কাছে গোপন রাখতে চেয়েছিল ( বোধহয় ওর পৌরুষে লেগে ছিল),আমিও না বোঝার ভান করেছিলাম। পাছে ও লজ্জা পায়। সে দিন ওকে ঠিক আমার অভিভাবকের মতো মনে হচ্ছিল। আমার হাত ধরে অতি সন্তর্পণে বড় বড় রাস্থাগুলো পার করছিল। যেন আমি কচি খুকি,আর ও আমার গোঁফ ওয়ালা ইয়া বড় গার্জেন! হা হা হা…  
আজো কত স্মৃতি আছে মন জুড়ে। সব কি আর লিখে শেষ করা যায়!   
কলেজ থেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আমরা প্রায় এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতাম। বড় কোন ছুটি পড়লে আমরা লুকিয়ে দেখা করতাম। কলকাতা বইমেলা থেকে কলেজের নদীর তীর- কিছুই বাদ যায় নি। ভালবাসার কাঙাল ছিল সে। আজও কি সে আমাকে তেমন ভালবাসে! 
রজতের বাবা বলে খবরের কাগজে ‘হারানো কলমে’ একটা বিঙ্গাপন দাও। কিম্বা এফ এম এ ‘’হারায়ে খুঁজি’’ অনুষ্ঠানে চিঠি দাও- না হয় আমার অফিসের ফোন নম্বরটাই দেবে (তখন মোবাইলের এত রমরমা ছিল না। আমাদের বাড়িতে ও ল্যান্ডফোন এলো অনেক পরে)। রজতের বাবা কত পরামর্শ দেয়। জানি কিছুই মন থেকে বলে না। তবু আমি তো কোনদিন ওঁকে কিছু গোপন করি নি। 
ও কি আজকাল আমাকে ব্যঙ্গ করছে! কোন পুরুষ মানুষ তার স্ত্রীর প্রাক্তন প্রেমিককে কি খুঁজে আনে? ওরা বড় স্বার্থপর,ওদের ধারনা ভালোবাসা পাওয়ার একচেটিয়া অধিকার শুধু পুরুষ মানুষের- সে প্রাক্তন প্রেমিকার হোক বা সতীসাদ্ধি (!) বউ এর।    
অবশ্য রজতাভ সে রকম নয়। কোনদিন আমাকে এতটুকু দুঃখ দেয় নি। বরং শান্ত মনে মনোযোগ দিয়ে আমাদের সব কথা শুনেছে। আমার পাশে থেকেছে সব সময়। সময় সময় মনে হয়, ওঁকে আমি ঠিক সুখী করতে পারিনি। ও বড় চাপা স্বভাবের। মুখে কিছু বলে না কখনো। সুবিমল  নিজেকে প্রকাশ করত বেশি,রজতাভ ঠিক তার উলটো।তাই ওঁকে নিয়ে ইদানীং ভয় হয়,ভাবনা হয় বেশি।  
কেউ নাকি তার প্রথম প্রেম ভুলতে পারে না। হবে হয়ত! সুবি প্রায় বলত- 
‘’নশ্বর দেহের নাশে আত্মা স্থায়ী হয়।
নাহি তার হ্রাস বৃদ্ধি নাহি তার ক্ষয়।।‘’
কি জানি বলার জন্যে বলা কিনা! 
যাক,আজ আর না। ওর এবার ঘুম থেকে উঠবার সময় হয়ে এলো। বিল্টু টা উঠে পড়েছে মনে হয়। আমার শ্বশুর মশাইয়ের আমার হাতের চা না হলে চলে না। সুবি,যেখানে থাকো,ভালো থেকো তুমি।   
               
                                                       অরু
               
                                     ১লা পৌষ ১৪১৭; সকাল

ক্রমশ...

                           
    লেখক বিশ্বনাথ প্রামাণিক 
      বিদ্যাসাগর পল্লী, সোনারপুর, কলকাতা- ১৫০





 


"উপেক্ষা"

কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বপ্নের পুষ্প ধরে কত আশায়
স্বপ্নগুলো ভেঙে যায় পদলেহনে। 
তবু নিশ্চুপ, নেই কোনো অভিমান অভিশাপ। 
হাসির কম্পনের আবরনে ক্লেশাচ্ছাদিত হৃদয়ে
ধীরে ধীরে মস্তক তোলে নিরভিমানে। 
সমাজের ভিন্ন প্রজাতির কীটের বিষাক্ত
দংশনে জর্জরিত সমস্ত শরীর। 
ক্ষয়িত হয় দেহ,নেই দোষারোপ
দুই পায়ে পিষে যায় ফিরে দেখে না কেউ,
সে নিম্নবাসী।
বোবা কান্নাগুলো শীত বিন্দু হয়ে টপ টপ পড়ে। 
লাঞ্ছনা-উপেক্ষার কঠিন ভার মস্তকে, 
কিন্তু বিস্মৃত হয় না অস্তিত্বের পরিতৃপ্ততা।
চিরকাল গ্লানিভরা পদলেহনেও সে উন্নত
জন্ম যার দলন সহিতে মৃত্যুতে সে অমর। 

নিম্ন স্থান হলেও তবু মর্যাদায় শালগ্ৰামবাসী। 

                 কবি বৃন্দাবন নস্কর
         ক্যানিং, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পশ্চিমবঙ্গ









জাল 

মতিলালের চা দোকানটা বাজারের ভিতরে এক কোনে হলেও সকাল সাতটা থেকে বেলা বারোটা অবধি খদ্দেরের ভিড় লেগেই থাকে ।
দুপুরের পর থেকে যত বেলা গড়াতে থাকে কর্মব্যস্ত দোকানটা তত‌ই ঝিমিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বিকেল হয়, সন্ধ্যা নামে।রাস্তা ধারের দোকানগুলো ছাড়া বাজারের ভিতরের অধিকাংশ দোকানের ঝাঁপ সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে যায়। টিমটিমে আলো জ্বালিয়ে চাটাই পেতে পাঁচ -সাত জনের কয়েকটা তাসের মজলিস বসে। সব‌ই যে নির্দোষ তাসের আড্ডা তা হলফ করে বলা যায় না।টাকা পয়সার খেলাও চলে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর ওটাই ওদের বিনোদন।
মতিলালের দরমাঘেরা টালির চালের দোকানটাকে দিনের আলোয় যতটা নির্ভেজাল চা'এর দোকান বলে মনে হয়, রাতে তার ব্যবসায়িক চরিত্র ঠিক ততটাই বদলে যায়। মালিকানার‌ও হাত বদল হয়ে যায়। এলাকার স্বঘোষিত অভিভাবক দীনেশের কব্জায় চলে যায় দোকানটা।

দীনেশ চন্ডীতলার এক প্রভাবশালী নেতার ডানহাত। তার মুরুব্বিয়ানার খাতিরে বাজার কমিটিকে যে মাসোহারা গুনতে হয় সেটি নেহাত দুরছাই করার মতো নয়।মন্দ লোকে বলে, তোলা। দীনেশ‌ও তেমন অবিবেচক নয়। ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা বিপদে -আপদে কিছু গচ্ছিত রেখে তার কাছ থেকে প্রায়শঃই টাকা ধার নেয় ।অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গচ্ছিত সম্পত্তি আর উদ্ধার হয় না। এছাড়া ছোটখাটো বেআইনি কাজ সামলানোর দায়িত্ব‌ও দীনেশের। তার লম্বা হাত দিয়ে সব ধরণের প্রশাসনিক জটিল সমস্যা সমাধান এক লহমায় করে ফেলে । অবশ্য তার জন্য অভিযুক্তকে কিছু মালকড়ি খসাতে হয়।

আবছা আলোয় মতিলালের দোকানের পিছন দিকে ছায়া-ছায়া মানুষ -জনকে যাতায়াত করতে দেখা যায়। দোকানের মাঝে একটা পার্টিশন। পেছনে আর একটা দরজা আছে। চা'এর দোকানের আড়ালে ওখানে রাতের বেলায় অন্য একটা ব্যবসা চলে। বন্ধ দোকানটার সামনে বসে ভোলা খাসির ছাঁট দিয়ে তৈরি ঝাল ঝাল ঘুগনি বিক্রি করে। তাসের আড্ডায় মতিলালকে ও দেখা যায়। দীনেশ‌ ও কয়েকজন সাগরেদ পরিবৃত হয়ে একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় বসে সবকিছুর দিকে নজর রাখে।
একটা দামী বিদেশী ব্র্যান্ডের সিগারেট ধরিয়ে দীনেশ হাঁক দেয়, "মতি, আজ ঠান্ডাটা বড্ড বেড়েছে রে। পাঁচ কাপ ইস্পেশাল চা বানা দেখি। "
মতি ঝাঁপ তুলে দোকানে ঢুকে যায়।
কোন এক আড্ডা থেকে কেউ একজন বলে, "আমরা কি হাফ  কাপ করে পাবো না দাদা?আমরা চা খাবো না ?"
"তোরা শালা মাল খেয়ে গা গরম কর। তোদের কথা ভেবে এতো রিস্ক নিয়ে সাপ্লাই দিচ্ছি, বলে কিনা চা
খাবোনা দাদা! "
আর একজন একটা অ‌শ্রাব্য শব্দ ব্যবহার করে বিকৃত সুরে রসিকতা করে বলে, "...চুল্লু খেয়ে যদি টেঁসে যাই! "সবাই খিক খিক করে হেসে ফেলে।
"তোর চৌদ্দপুরষের তেমন পুণ্যবল থাকলে বর্তে যাবি।দু'লাখ টাকা,  বুঝলি দু 'লাখ টাকা দিচ্ছে সরকার! ওই টাকাটা পেলে তোর ব‌উ এর একটা হিল্লে হয়ে যাবে।টাকা থাকলে কত শালা ছোক ছোক করবে তোর ব‌উ এর পিছনে।"
আর একপ্রস্থ হাসির রোল ওঠে।
তাস খেলার একটা ঠেকে অনুচ্চ স্বরে গুঞ্জন ওঠে। সঞ্জয় উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
"আমি আজ আর খেলব না।"
সবাই গর্জে ওঠে, "খেলবি না মানে! মামদোবাজি? "
সঞ্জয় মাছ বিক্রি করে। "হেরে গেলে কাল মাল তুলতে পারবো না।"
"টাকা না থাকলে খেলতে বসিস কেন? কোমরের জোর নেই, সখ ষোল‌ আনা! কোন কথা শুনবো না। খেলা শেষ করে তবেই উঠতে পারবি। "
সবজি ব্যবসায়ী মদন মন্তব্য করে, "পাশা খেলায় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি রেখে ছিল। তুই ও তাই করনা।"
"খবরদার মদনা। মুখ ভেঙে দেব।"

মদনও উঠে দাঁড়ায়। একটা গন্ডগোল বাধার উপক্রম হচ্ছে দেখে দীনেশ হুঙ্কার ছাড়ে , "অ্যা‌ই, থাম তোরা। সঞ্জয় আয়। আমার কাছে টাকা আছে, নিয়ে যা। "সঞ্জয় কাছে এলে বলে, "জানিস নিশ্চয়, খালি হাতে আমি টাকা দিই না ।অসুবিধায় পড়েছিস তাই দিলাম। কাল কিন্তু সোনা দানা কিছুএকটা জমা দিয়ে যাবি। "

মানুষের অসহায়তার সুযোগ নিয়ে এমন অনেক সম্পদ সঞ্চিত হয়েছে দীনেশের ঘরে। সেই সঙ্গে সঞ্চিত হয়েছে বহু মানুষের অভিসম্পাত‌ও।
"ব‌উ এর সোনার গয়না তেমন কিছু নেই দাদা।আমি তো কিছুই দিতে পারি নি। যা রোজগার তাতে সংসার চালাতেই হিমসিম খেয়ে যাই। আমি কথা দিচ্ছি, রোজ কিছু কিছু দিয়ে তোমার টাকা শোধ করে দেব।"
"ওসব পেঁয়াজি ছাড়ো চাঁদু।ওসব মিনমিনে কাঁদুনিতে দীনেশ সাউ এর মন গলে না। যা,তোকে টাকা নিতে হবে না।"
"রাগ করছ কেন দাদা!তুমিই তো আমাদের বল-ভরসা। বেশ, কাল একটা কিছুএনে দেব।"
কথাটা বলল বটে। তবে পারবে কিনা সে বিষয়ে তার নিজের‌ও সন্দেহ আছে। অথচ রোজগার তার মন্দ নয়। শুধু জুয়া আর মদের নেশায় সে আকণ্ঠ ডুবতে বসেছে ।এই অনৈতিকতার চক্রব্যূহ থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা তার নেই ।প্রয়োজনে বার বার দীনেশের কাছে হাত পাততে হয় ।তার মতো অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসাদার এরকম অনেক দীনেশের শিকার ।দীনেশের মতো অ্যান্টি সোস্যালরা সমাজের সর্বত্র এমন জাল বিছিয়ে রেখেছে।

পশ্চিমা -ঝঞ্ঝার দাপটে সকাল থেকেই আকাশ জুড়ে সমুদ্রের ফেনিল ঢেউয়ের মতো মেঘের সন্তরণ আর মাঝে মাঝে ছেঁড়া ছেঁড়া মলিন সূর্যালোকের লুকোচুরি খেলা চলেছে। বিকেল বেলা ঘন মেঘে ঢেকে গেল, শুরু হল ঝিম ঝিম বৃষ্টি। পূরবীর এখন খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কাল রাত থেকেই সঞ্জয়ের আচরণে একটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছিল। ভেবেছিল সন্ধেবেলায় নিশ্চয় একটা সারপ্রাইজ দেবে। প্রতিবছর আজকের দিনে ওরা রেস্টুরেন্টে খায়,সিনেমা দেখে। বিবাহবার্ষিকীর তারিখটা কখনো ভোলে না সঞ্জয়। তাই বিকেল থেকেই সাজগোজের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। ট্রাঙ্ক খুলে বরের পছন্দের শাড়িটা বের করল। ট্রাঙ্ক এর ভিতর থেকে তার গয়নার কৌটোটা বের করে ভাবলো, আজ ব্রোঞ্জের চুড়ি গাছা,গলায় সোনার চেইন আর কানের দুল পরবে।
খুব সুন্দর করে সাজবে সে। গয়নার কৌটো খুলে সে আকাশ থেকে পড়ে। তার কানের দুল জোড়া নেই! ট্রাঙ্ক এর সমস্ত জিনিস বের করে, ছতিচ্ছন্ন করে পাগলের মতো তন্ন তন্ন করে খোঁজে ।তার দুল জোড়া কোথাও খুঁজে পেল না।হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে পূরবী। যেন তার চরম সর্বনাশ হয়ে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে নিরালম্ব ব্রততীর মতো মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। 

অনেকক্ষণ পরে উঠে বসে। সঞ্জয়কেই সন্দেহ হয়। কিছুদিন ধরেই ওর হাবভাব ভালো লাগছে না।
তাছাড়া আজকের দিনটা ওকিছুতেই ভুলে যেতে পারে না।
পূরবীর সন্দেহ হয়, সঞ্জয় নিশ্চিত কোনো সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে।
চটজলদি উঠে দাঁড়ায় সে । নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে তাদের সাত বছরের ছেলে হাবলুকে ডাকে। এখনি বাজারে ওদের আড্ডায় যেতে হবে। হয়তো সঞ্জয় কোনো বিপদে পড়েছে!
সন্ধ্যার আঁধারে ,শীতল বাদলা হাওয়া উপেক্ষা করে বাজারের গেটে একটি শিশুর হাত ধরে এক স্ত্রীলোকের ছায়ামূর্তিকে এসে দাঁড়াতে দেখা যায়।
স্ত্রীলোকটি শিশুটিকে বলে, "হাবলু যাও , তোমার বাবাকে ডেকে আনো। "
শান্ত ও দীপ্ত নারীকন্ঠে সচকিত হয়ে সকলে বাজারের প্রবেশ পথের দিকে তাকায়। শিশুটি, সঞ্জয়ের' কাছে এগিয়ে এসে বলে, "বাবা, চলো।মা ডাকছে। "
সঞ্জয় মাথা নিচু করে বসে থাকে।
স্ত্রীলোকটি দৃঢ়কন্ঠে  বলে, "হাবলু বল্, আমার গলায় শেষ সম্বল সোনার চেনটা আছে। দরকার হলে ওটাও যেন নিয়ে যায়। তবু একদন্ড ওখানে আর বসে থাকা চলবে না। "

তাসের গোছাটা সজোরে মাটিতে ফেলে দিয়ে সঞ্জয় এবার ত্বরিতে উঠে দাঁড়ায়। তারপর হনহন করে বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। এখন ওকে আর কেউ বাধা দিতে পারে না। কোন কটু কথা  বলার কারো সাহস  হয় না।সঞ্জয়ের ব‌উ পূরবীর রুদ্র রূপ দেখে দীনেশ‌ও ভড়কে যায়। তার মুখ দিয়েও কোন কথা বের হয় না।

সাহিত্যিক চয়ন কুমার রায় 
  টিকরহাট, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ







"ছায়াময়"

আঁকাবাঁকা দাগ কাটা জানলায়
বার বার দেখি তাকে- 
যেন আবছায়া- 
মায়াবী আলোতে খেলা করে
যেন এক মোহিনীর মায়া
উদ্ভট স্বপ্নেরা এসে ভীড় করে
ঘুমন্ত মানুষের জানলার কাঠের ঝিল্লির উপরে-
দ্রুতগামী বহুচক্রযান
অন্ধকার ছিঁড়ে ফেলে 
চলে যায় দূর থেকে দূর-
দুপুরের আমিষ রোদ্দুর 
ছায়া ফেলে বিধ্বস্ত মাথায়
লাল নীল সোফাসেট এ সাজা
কোনো নিরীহ মধ্যবিত্ত জীবনযাত্রায়।
প্রতিমার মুখে ঘামতেল
কপালের তীব্র সিঁদুর 
সিন্ধুঈগলের বাসা থেকে বহু বহুদুর- 
আমাদের মজ্জমান মানসে ছড়ায়
বহু শতাব্দীর সূর্যোদয়,সূর্যাস্তের আলো
বিবিক্ত,বিচিত্র,বহুমুখ
শালিখ, চড়াই, কাক আর
মারা পড়া কবিদের সঙ্গমের সুখ।
ঘামে ডোবা একফালি আয়নায়
জমে থাকা টিপ
অনির্বান,অচঞ্চল দীপ
আমাদের কাদাঘাঁটা আধমরা প্রাণে-
আগুনের অঙ্গীকার আনে।

কবি অনিন্দ্য দত্ত
আন্ধেরী পূর্ব, মুম্বাই, ভারত










"আমাদের চুপকথা"
[পর্ব- ২]

মিনতি

জীবনে কোনও দিন ডায়রি লিখিনি। অথচ কতবার লিখতে চেয়েছি। পারিনি। ভয় হয়,পাছে উনি দুঃখ পান। ওর পাগলামি কি দিন দিন বাড়ছে? অমা! একি কাণ্ড! মানুষটা সেই এক ভাবনা নিয়ে সারাজীবনটাই কাটিয়ে দিলো গো! দেখতে বড় ইচ্ছা হয় তার। সে কেমন রূপসী! কি আছে তার- যার জন্য এমন ছিনে জোঁকের মতো দিন রাত লেগে আছে!ভাগ্যবতি তুমি, সৌভাগ্যবতি।

এই এতো বয়সেও স্বামী-পুত্র ভরা সংসার নিয়েও মানুষটাকে আজও চিনে উঠতে পারলাম না।

ছেলেটা বায়না ধরেছে। বাবা- মায়ের বিয়ের রজত জয়ন্তিতে এবার বড় করে উৎসব করবে। কি হবে এসব করে! নেহাত সুমুর আব্দার,তাই আর না করতে পারিনি। ও বড় হচ্ছে, ওর ইচ্ছা- অনিচ্ছাকে তো মর্যাদা দিতে হবে! এই তো সেদিন মুখুজ্জে গিন্নিদের সুবন্ন জয়ন্তী হল। কি ধুমধাম,হই হুল্লোড়, তারপর মাস পেরতে না পেরতেই মুখুজ্জে গিন্নি বিধবা হলেন। আমারো যদি…

রাম,রাম এ কি ভাবছি! ওঁর শতবছর পরায়ু হোক, ওঁর কোলে মাথা রেখে যেন চোখ বুঝতে পারি। হে ঈশ্বর, অপরাধ নিও না।   

মানুষটাকে দেখলে আজকাল বড় কষ্ট হয়। সারা জীবন একটু শান্তি পেলে না। সব দিয়েছি, ওকে সুখী করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। তবু...

কতবার দেখেছি ঘুমের ঘোরে বকবক করছে। কখনো বা কাঁদছে ছেলেমানুষের মত। কতবার ঘুম থেকে উঠে সারারাত বারান্দায় পায়চারী করতে দেখেছি। সব, সব দেখেছি। তবু সামনে যেতে পারিনি, পাছে ও লজ্জা পায়। এমন করে কি মানুষ বাঁচতে পারে!

কি অপরাধ করেছি আমি! যার জন্য এই এতকিছুর মধ্যেও এমন নিঃসঙ্গ হয়ে আছি! ও কিন্তু কোনদিন আমাকে কষ্ট দেয় নি। না চাইতেই সব পেয়েছি- ভালো ভালো শাড়ি, গহনাতে আলমারি ঠাসা। কি হবে এসব! ইচ্ছা করে টান মেরে ফেলে দিই সব। তারপর যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই। ভালোবাসা না পাওয়ার যন্ত্রনা কি তবে আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে? কি জানি হয়তো হবে। তবু মুখ ফোটে ভিখারীর মতো ভালোবাসা ভিক্ষা করতে পারবো না আমি।

রাত কত হলো কে জানে! রাতের তারারা এখনো জেগে আছে আকাশের গায়ে। সারারাত ওরা আলো দেবে মিটমিট করে। ওদের ক্লান্তি নেই। ওরা কিছু পাওয়ার প্রত্যাশা করে না। আমারও যদি দুটো ডানা থাকত বেশ হত।মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় ওদের দেশে চলে যাই।

সুবিমল এখনো ঘুমাচ্ছে। ভাঙা চাঁদের আলো এসে পড়েছে ওর মুখে। কানের পাশে চুল গুলোতে পাক ধরেছে ।এ নিয়ে ওর কি আক্ষেপ! বলে- বুড়ো হয়ে গেছি। বয়সের এই বেড়ে ওঠা ও মানতে পারে না। ওর ধারণা এখনো সেই কলেজে পড়া পাতলা ছিপছিপে যুবকটি আছে। আর ওর হাত ধরে চলেছে ওঁরই বয়সি আরো একজন।  

কতবার ওকে বলতে শুনেছি ,অরুনার কথা। হাওয়ায় দোলা খাওয়া এলোমেলো চুলগুলো ওর ঘারের কাছে যখন উড়ে এসে পড়ত, ওঁর নাকি ভারি ভালো লাগত। গল্পের তুফান উড়িয়ে সমানতালে পা চালিয়ে ওরা  চলেছে নদীর পাড় ধরে। কিংবা কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ার অলিতে গলিতে। নীল রঙের শাড়ি- সালোয়ার ওঁর বড় প্রিয়। সে কি তার জন্য? কি জানি! শুনেছি নীল রংয়ের সালোয়ারে তাকে নাকি বেশ মানাত।

কতবার নীল কাপড় কিনতে চেয়েছি ও আগ্রহ দেখায়নি। ও বলে - সবকিছু সবাইকে মানায় না। হালকা গোলাপিতে তুমি অতুলনীয়। কি জানি! শুধু বলার জন্য বলা কিনা! নাকি আমার মন রাখতে চাওয়া!

সব পুরুষ মানুষের মতো ও নয়। বৌয়ের মনে রেখে কথা বলা ওর ধাতে নেই । যা ভাল লাগে সাফ সাফ বলে দেয় । যা ভালো লাগে না, তাও …  

যেবার সুমন পেটে এল, অফিস থেকে ফিরে আমাকে ধরে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে বলেছিল- দেখো, তোমাকে কেমন লাগছে! যেন মনে হয় একটা দানব তোমার পেটটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে পাহাড় করে তুলেছে।

-আহা! কি কথার ছিরি! এ সময় সব মেয়েরই এমন দেখতে হয়।

-হয় নাকি?

-হয় তো। দেখনি তোমার বৌদির, কত বড়টা লাগছিল! 

ও আর কিছু বলেনি। আনমনে হয়ে পড়েছিল। অস্ফুটে শুধু বলেছিল- তারও তো এমন হবে। সবকিছুতেই ওঁর তার কথা মনে পড়ে। সব ভাবনাতে ওঁর সে।

পাগল একটা, পাগল। পাগল তো। যে দিন বিশেষ লেখা লিখি করে না এ ঘরে এসে শুয়ে পড়ে, বুঝতে পারি ও আজ আদর চাইছে- কেমন যেন এক অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আজ ওর মাথায় বড় হাত বুলাতে ইচ্ছা করছে । কিন্তু যদি জেগে ওঠে! জাগুক, তবু আজ একটু বাঁধন ছাড়া হতে দোষ কি! সুবিমল কি জেগে ছিল! আমার হাতের স্পর্শে ও চঞ্চল হয়ে ওঠে- কিগো তুমি ঘুমাবে না! আর কত লেখালেখি করবে?

এইতো এবার শোবো, তুমি ঘুমাও।

-রাত কত হলো? হবে, দুটো কি তিনটে। তুমি ঘুমাও, তোমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিই।

-তোমার শরীর খারাপ হবে মিনু, আর না এবার ঘুমোতে এস।

-তাহলে আজকাল আমার কথা ভাবো?

ও কিছু বলে না। ওর উত্তরের প্রত্যাশাও করিনা। ধীরে ধীরে ওর পাশে শুয়ে পড়ি। দীর্ঘ পঁচিশ বছর যেমন শুয়ে আসছি। ও কোন কথা বলে না। আমাকে কাছে পেয়ে বামদিকের নাইট বাল্বের সুইচ অফ করে দেয় সুবিমল।

    ৯ই বৈশাখ ১৪১৭

মিনতি, রাত ২টো ৫৬

ক্রমশ...

                        

      লেখক বিশ্বনাথ প্রামাণিক    বিদ্যাসাগর পল্লী, সোনারপুর, কলকাতা- ১৫০
















নবীনতর পোস্টসমূহ পুরাতন পোস্টসমূহ হোম

ব্লগ সংরক্ষাণাগার

  • আগস্ট (3)
  • জুলাই (22)
  • জুন (8)
  • নভেম্বর (15)
  • অক্টোবর (5)
  • সেপ্টেম্বর (81)
  • আগস্ট (66)
  • জুলাই (55)
  • জুন (56)
  • মে (57)
  • এপ্রিল (46)
  • মার্চ (15)
  • জানুয়ারী (14)
  • ডিসেম্বর (73)
  • নভেম্বর (103)
  • অক্টোবর (97)
  • সেপ্টেম্বর (101)
  • আগস্ট (120)
  • জুলাই (88)
  • জুন (76)
  • মে (63)
  • এপ্রিল (11)

🔴বিজ্ঞপ্তি:

পাঁচ মাসের বিরতি কাটিয়ে আবার ও ফিরছি আমরা। খুব শীগ্রই আসছে আমাদের প্রত্যাবর্তন সংখ্যা।

অনুসরণ করুণ

এক মাসের সর্বাধিক পঠিত পোস্টগুলি:

  • শেষ শোকসংগীত ~ গোবিন্দ মোদকের কবিতা
  • দুটি কবিতায় ~ গৌতম কুমার গুপ্ত
  • ব্রাত্য ~ বিদ্যুৎ মিশ্র'র কবিতা
  • দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প
  • আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা
  • গুচ্ছ কবিতায় ~ অসীম মালিক
  • সুমিত রায়ের গল্প
  • সে প্রেম পবিত্র~ প্রেমাংশু শ্রাবণের কবিতা
  • সুব্রত মাইতির কবিতা
  • তিনটি কবিতায় ~ রাগীব আবিদ রাতুল

বিষয়সমূহ

  • Poetry speaks 2
  • অণু কথারা 21
  • আবার গল্পের দেশে 8
  • উৎসব সংখ্যা ১৪২৭ 90
  • একুশে কবিতা প্রতিযোগিতা ২০২১ 22
  • এবং নিবন্ধ 3
  • কবিতা যাপন 170
  • কবিতার দখিনা দুয়ার 35
  • কিশলয় সংখ্যা ১৪২৭ 67
  • খোলা চিঠিদের ডাকবাক্স 1
  • গল্পের দেশে 17
  • ছড়ার ভুবন 7
  • জমকালো রবিবার ২ 29
  • জমকালো রবিবার সংখ্যা ১ 21
  • জমকালো রবিবার ৩ 49
  • জমকালো রবিবার ৪ 56
  • জমকালো রবিবার ৫ 28
  • জমকালো রবিবার ৬ 38
  • দৈনিক কবিতা যাপন 19
  • দৈনিক গল্পের দেশে 2
  • দৈনিক প্রবন্ধমালা 1
  • ধারাবাহিক উপন্যাস 3
  • ধারাবাহিক স্মৃতি আলেখ্য 2
  • পোয়েট্রি স্পিকস 5
  • প্রতিদিনের সংখ্যা 218
  • প্রত্যাবর্তন সংখ্যা 33
  • প্রবন্ধমালা 8
  • বিশেষ ভ্রমণ সংখ্যা 10
  • বিশেষ সংখ্যা: আমার প্রিয় শিক্ষক 33
  • বিশেষ সংখ্যা: স্বাধীনতা ও যুবসমাজ 10
  • ভ্রমণ ডায়েরি 1
  • মুক্তগদ্যের কথামালা 5
  • রম্যরচনা 2
  • শীত সংখ্যা ~ ১৪২৭ 60

Advertisement

যোগাযোগ ফর্ম

নাম

ইমেল *

বার্তা *

Blogger দ্বারা পরিচালিত.

মোট পাঠক সংখ্যা

লেখা পাঠাবার নিয়মাবলী:

১. শুধুমাত্র কবিতা, মুক্তগদ্য অথবা অণুগল্প পাঠাবেন। ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং অন্যান্য বিষয়ক লেখা সম্পূর্ণ আমন্ত্রিত। ২. লাইনের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। ৩. লেখা মেইল বডিতে টাইপ করে পাঠাবেন। ৪. লেখা মৌলিক ও অপ্রকাশিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্য কোনো ব্লগ, ওয়েবজিন অথবা প্রিন্টিং মিডিয়ায় প্রকাশিত লেখা পাঠাবেন না। ৫. মেইলে আপনার লেখাটি সম্পূর্ণ অপ্রকাশিত, কথাটি উল্লেখ করবেন। ৬. লেখার সাথে আবশ্যিক ভাবে এক কপি ছবি ও সংক্ষিপ্ত ঠিকানা পাঠাবেন।  ৭. লেখা নির্বাচিত হলে এক মাসের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হবে। এক মাসের মধ্যে কোনো উত্তর না এলে লেখাটি অমনোনীত ধরে নিতে হবে। ৮. আপনার লেখাটি প্রকাশ পেলে তার লিঙ্ক শেয়ার করাটা আপনার আবশ্যিক কর্তব্য। আশাকরি কথাটি আপনারা মেনে চলবেন। আমাদের মেইল- hridspondonmag@gmail.com
blogger-disqus-facebook

শান্তনু শ্রেষ্ঠা, সম্পাদক

আমার ফটো
পূর্ব বর্ধমান, India
আমার সম্পূর্ণ প্রোফাইল দেখুন

সাম্প্রতিক প্রশংসিত লেখা:

সুজিত রেজের কবিতা

সুজিত রেজের কবিতা

চন্দ্রানী গুহ রায়ের কবিতা

চন্দ্রানী গুহ রায়ের কবিতা

দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প

দাহ ~ পাভেল ঘোষের ছোটগল্প

আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা

আঁচল ~ অভিনন্দন মাইতির কবিতা

কবি সুধাংশুরঞ্জন সাহার কবিতা

কবি সুধাংশুরঞ্জন সাহার কবিতা

হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন

© হৃদস্পন্দন ম্যাগাজিন। শান্তনু শ্রেষ্ঠা কর্তৃৃক পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে প্রকাশিত।

Designed by OddThemes | Distributed by Gooyaabi Templates