আমাদের চুপকথা
[অন্তিম পর্ব]
রজতাভ
অরু,অরুনা মুখার্জি,আর সুবিমল মজুমদার।দুই বন্ধু, এক সঙ্গে এক কলেজে পড়ত। এক মাস্টারের কাছে যাতায়াত ও করত। ওরা অনেক পথ ঘুরেছে। রঙিন স্বপ্ন দেখেছে। আর পাঁচটা কলেজে পড়া কৌতূহলী ছেলেমেয়েদের মতো ওরা লুকিয়ে প্রেম করেছে। তবু ওরা বিয়ে করেনি। অরুনা বলে- বিয়ে করলে নাকি ওদের প্রেম হারিয়ে যেত। বলিহারি বাবা মেয়ের বুকের পাটা! এই প্রেমকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য কি মরিয়া চেষ্টা! নিজের চোখে তো দেখেছি কত রাত ও দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি। আমার বুকে মাথা রেখে ও কি তবে ওর হারানো প্রেমকে খুঁজে বেড়াত?কি জানি! কথায় বলে,নারীর মন নারায়নে জানে না,আমি তো কোন ছাড়!
কিন্তু এই বয়সে এসে ও এমন করে সুবিমলকে খুঁজে বেড়ায় কেন? যদিও মুখে কিছু বলে না। কিন্তু ওর মন! সেও কি ফাঁকি দিতে পারে!
নাকি এ শুধু স্মৃতি রোমান্থনে আনন্দ খোঁজার চেষ্টা! নাকি এই অনন্ত প্রতীক্ষা- ওর মিলনের সুখ!
এ সময় অপরাহ্ণের আলোয় কেমন এক বিষাদের সুর। ঘর ফেরতা পাখিগুলো মনের আনন্দে বাসায় ফিরছে। মেঘের বুকে রুপালি রেখা ছড়িয়ে বলাকার দল ভেসে চলেছে। ঘরে ফেরার আনন্দ ওদের মনে। কিন্তু আমার ফেরার আনন্দ কৈ?
ভাবছি খবরেরে কাগজে একটা বিঙ্গাপন দেব। ওদেরকে একসঙ্গে বসিয়ে দেখব,ওরা কত প্রেম করতে পারে! হিংসা হচ্ছে কি আমার? তবে কি সুবির এই সওভাগ্য আমি কি মেনে নিতে পারছি না? কেন এই বয়সে এসে এমন করে অরুকে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি? ছেলে- মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার আমাদের। সব ভাসিয়ে ও কি চলে যাবে? নাকি এবার ওর জন্যে সেই ব্যবস্থাই আমার করা উচিত!
অরুনা এ বছর সেপ্টেম্বরে রিটায়ার করল। তাও বাচ্ছাদের শিখিয়ে পড়িয়ে ওর দিন কাটছিল বেশ। ছেলে মেয়েকে নিয়ে আমাকে কোনদিন ভাবতে হয়নি। ঐ মানুষ করেছে। ওরা এখন প্রতিষ্ঠিত। এক সময় ও বলত, সব সময় কাজে ডুবে থাকতে ওর বেশ লাগে। আজ বুঝেছি সে ও যে সুবিমলকে ভুলে থাকার ছলনা। নাকি সত্যি ও কাজ ভালোবাসে!
মাঝে মাঝে মনে হয় অরুনাকে আজো ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। অথচ ও তো কোনদিন ওর কর্তব্যে অবহেলা করেনি। সকাল সকাল (কখনো কখনো ভোরবেলা) উঠে আমার অফিসের ভাত রান্না করা, ছেলে- মেয়ের খাওয়ানো,পড়ানো,শ্বশুর শাশুড়ির সেবা যত্ন- সব তো নিপুন হাতে একা সামলেছে। বাবা তো বড় বউমা বলতে অজ্ঞান! হু! ওর হাতে সকালবেলা চা না হলে বাবার মুখ ভার হয়ে থাকত। বিল্টুটা (আমার ভাইপো) প্রায়ই বায়না করত- জেঠিমার কাছে ঘুমাবো।
এত সব ভালোবাসা,এত দায়িত্ব কর্তব্য সব ফাঁকি! এত মানুষকে একা হাতে সামলাতে আর ক'জন পারত কে জানে!
আজ এই বয়সে এসে সেই অরুনাকে আমি কিনা অবিশ্বাস করতে শুরু করেছি!বার বার মনে হয়-এত সব কিছু ফাঁকি!এত বছর পরেও ওকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি! ঠিকই চিনে ছিল সুবিমল?
আজ তিরিশ বছর ধরে কর্তব্য করতে করতে ও কি ক্লান্ত? কত বার ওকে ঠাকুর ঘরে গিয়ে বলতে শুনেছি- আমার মুক্তি দাও ঠাকুর। এবার মুক্তি দাও। কিসের থেকে ও পালিয়ে যেতে চাইছে? সবটাই কি প্রবঞ্চনা? হা, ইশ্বর! শুধু যে কর্তব্যের খাতিরে মানুষ এত কিছু করতে পারে, ওকে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত।
কিন্তু এই অবসর জীবনে এসে আমি বা কি নিয়ে থাকব? কোন কোন দিন ঘুম ভেঙে ওঠে দেখতাম,ও বারান্দায় ইজি চেয়ারে ঠায় বসে আছে। মেঘের অন্তরালে লুকানো চাঁদকে দেখে কি যেন বিড়বিড় করছে! ওকি তবে রাতের নিস্তব্ধতায় ওদের অনন্ত প্রতীক্ষার বার্তা খুঁজে ফেরে! স্মৃতি রোমন্থনে আনন্দ খোঁজে! ওর এই প্রতীক্ষার নীরব সাক্ষী হয়ে আরও কতদিন আমাকে কাটাতে হবে কে জানে!
আজ এই অন্ধকার রাতের স্তব্ধতাই আমার অনন্ত নিসঙ্গতার সঙ্গী। আর অরুনা সেই স্তব্ধতার মধ্যে নীরবে ওর প্রেম নিয়ে বেঁচে আছে।
৭-ই বৈশাখ ১৪১৭
অপরাহ্ণ
রজতাভ