বিশ্বনাথ প্রামাণিকের ধারাবাহিক গল্প


আমাদের চুপকথা

[পর্ব-১]

                                        সুবিমল

২রা এপ্রিল ২০১০ 

কাল থেকে সূর্যের মুখ মেঘের অবগুন্ঠনে ঢাকা।আজ সারাটা দিন ধরে প্রকৃতির মধ্যে কেমন যেন এক অসম্ভব নীরবতা বিরাজ করছে।এখন গভীর রাত।পড়াশোনার ক্ষতি হয় বলে এখন পড়ার 
ঘরেই শুয়ে পড়ি। মিনু ওঘরে ঘুমাচ্ছে।আজ ডায়রির পাতা গুলোতে খুব হাত বুলাতে ইচ্ছা 
করছে,মনে হয় যেন এখানেই সেই ঘুমন্ত রাজকন্যে আজো বন্দী হয়ে আছে।   
এখন অখণ্ড অবসর।

ছেলেটা বড় হয়েছে,সংসারের হাল ধরতে শিখছে।ওদের মা কান্ডারীর মত নিপুন হাতে এতদিন সংসার চালিয়েছে।এখন ও শিখুক।আমার স্ত্রী মিনতি দক্ষিণ কলকাতার মেয়ে।সম্ভ্রান্ত বংশ বলে ওর একটা অহংকার 
আছে।ওদের আভিজাত্যের তুলনায় আমরা কিছুই নয়।

আজ কদিন হলো ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখা শুরু করেছে।মেয়েও নাকি দেখে ঠিক করে ফেলেছে।মুখার্জিদার মেয়ে সুনিতা,বামন।মিনতি বলে,ওসব আর আজকাল কেউ মানে না।বরং এ বিয়ে নাকি অনেক গর্বের।সায় দিয়ে বলেছিলাম, (অবশ্য না বলে উপায় ছিল না) তা বেশ তো ব্যবস্থা করো গিয়ে। সমাজ অনেক বদলেছে।

-বদলেছে তো,বামুন-কায়েত, হিন্দু-মুসলমান,বাগদী, মুচি মেথর- সব 
মিলে মিশে যাচ্ছে।

মিনতির আগ্রহ দেখে হাসি পেয়েছিল।মুখে কিছু না বললেও মনে মনে জানি,সে সবই উপার্জিত,প্রতিষ্ঠিত ছেলে মেয়েদের বেলায়।পাত্র ধরার প্রতিযোগিতার বাজারে কন্যাদায়গ্রস্ত 
পিতাদের এটুকু উদার না হয়ে উপায় কি!  অবশ্য আমার ভাবনা নেই,সুমন (আমার ছেলে) বড় আই টি সেক্টরে সার্ভিস করে।ওর তো বামন মেয়েই জুটবে। 

চুপ করে আছি দেখে মিনতি বোধহয় খুশি হতে পারেনি।ঝংকার দিয়ে হাত নেড়ে জানায় -কোন 
জগতে পড়ে আছ তুমি?কিছু কি খবর রাখো না?

-খবর? রাখি তো। 

-তবে!

-ভাবছি।

ও বিদ্রুপ করে।বসে বসে সারাজীবন যত খুশি ভাবো।তোমার ভাবনা মানে সেই তো,কে এক অরুনা না 
বরুনা,কি যেন নাম!সত্যি তুমি মানুষ বটে।এত বছর হয়ে গেল তবু তোমার মোহ ঘুচল না!  

মুহূর্তে ধৈর্য হারিয়ে চিৎকার করে উঠি।মিনতির মুখে,শুধু মিনতি কেন!বোধহয় জগতের কারোর মুখে অরুনার 
নিন্দা আমি শুনতে পারতাম না।সে একান্ত আমার ভাবনা,তার অংশীদার আমি 
কাউকে হতে দেব না।

মিনতি আর কথা বাড়ায় নি।ধীরে ধীরে ও ঘরে চলে যায়।আমি জানি,ও আমার এই ভয়ঙ্কর ভাবনার জগতকে ভয় করে।এর মধ্যে অনেকবার অতি সন্তর্পনে ও ঢুকতে চেয়েছিল।আদর করে,অভিমান করে,ভালোবেসে।আজ হতাশায় বিদ্রূপ করে।

করুক,তবু না। এ শুধু আমার জগত।এখানে আমি সব,আমিই রাজা।আর অরুনা…
                                         
                                      রাত্রি
                        সুবিমল মজুমদার

১৫ এপ্রিল ২০১০

এখন রাত একটা।আমার সব লেখালেখি রাত জেগে।মিনু প্রথম প্রথম ঘোর আপত্তি করত-
তোমার বয়স হচ্ছে।শরীর খারাপ করলে কে দেখবে? সেই তো আমাকেই সব ঝক্কি পোহাতে হবে।হেসে বলেছিলাম- এখনো এত বুড়ো হয়ে যায় নি,
আমাকে নিয়ে তুমি অতো ভেবো না ত।আমি দিব্য আছি।

তাই মিনু আজকাল আর খুব একটা 
আপত্তি করে না।ওকে উৎসাহ দিই- তুমিও তো একটু- আধটু
লেখা-ঝোকা করতে পারো। 

ও মুখে কিছু বলে নি বটে,তবে মুখ দেখে বুঝেছিলাম,কথাটা বোধ হয় মনে ধরেছে।

ও অঘোরে ঘুমাছে,ঘুমাক।শুধু আমার চোখে ঘুম নেই।ও বলে,বুড়ো বয়সে ঘুম-নিদ্রা সব কমে যায়।যাগ গে।ও নিয়ে আর ভাবি না।সেদিন জোর করে মা-ছেলে মিলে হেলথ চেক আপ করিয়ে নিয়ে এলো।এখনো সুগার,পেসার নর্মাল দেখে ওরা খানিক 
নিশ্চিন্ত।

ছেলে আবার এবছর বায়না ধরেছে 
আমাদের বিয়ের রজত জয়ন্তী পালন 
করবে।এই এক ফ্যাসান হয়েছে আজকাল।লোকজন আত্মিয়-স্বজন ডেকে হৈ-হুল্লোড়,তারপর বুড়ো বয়সে ছেলে মেয়েদের সামনে
মালাবদল! ঘেন্না হয় আজকাল,ছি,ছি!

ছেলের সব আবদারই ওর মায়ের সম্মতি আছে।আমার আপত্তি কেইবা শুনছে! বিস্তর 
আয়োজন হচ্ছে।মা-ছেলেতে বসে বসে ফর্দ তৈরি করছে- কোথায় কাকে কাকে নেমন্তন্ন করবে? কী কী খাওয়াবে?প্যান্ডেল,লাইটিঙ,এমন কি মাইক পর্যন্ত…   

আমার মত জানতে চায়।বলেছি,যা ভালো বোঝো করো।তবে এই বাজে খরচের কোন মানে হয় না, এ কথাও শুনিয়ে দিয়েছি।

ছেলে অসন্তুষ্ট হয়- বাবা প্লিজ,জীবনটা ইনজয় 
করতে শেখো।

-এনজয়! জীবনে কত কষ্ট করেছি ,সে-কথা যদি জানতিস…

-সেই জন্য তো বাবা এখন আনন্দ করো,
উপভোগ করো।সারা জীবন দুঃখ বয়ে বেড়াবার মানে কী, 
বুঝি না।

সুমন অফিসে যায়।অফিস থেকে ফিরে বান্ধবীদের সঙ্গে ফোনে গল্প করে।ওরা অনেক বেশি স্মার্ট।তবে কি ছেলেকে ঈর্ষা করতে শুরু করেছি?ছি! ছি!তাই কখনো হয়?ওরা ভালো থাকুক ওদের জগত নিয়ে।

মনে হয় কতদিন নিজেকে দেখি নি।বুড়ো হয়ে গেছে কি? নিজেকে দেখতে বড় সাধ হয়।ধীরে ধীরে ড্রেসিং টেবিলের বড় আয়নাটার সামনে এসে দাঁড়ালাম।এটা বিয়ের সময় ওর বাবা দিয়েছে (এ ঘরের অর্ধেক জিনিসই ওর বাবার দেওয়া)।  

ইস! কতগুলো চুল পেকে গেছে।হাত বুলাতে থাকি মুখে,খোঁচা খোঁচা দাড়ি 
মুখময়।আয়নায় ও কার ছবি!ও কি তবে সেই সুবিমল মজুমদার!নাকি আর কেউ!সে দিন ছেলে অফিসে চলে যাওয়ার পর 
মিনতি ডেকে আয়নার সামনে দাঁড় করাই।দেখো,নিজেকে দেখেছ কেমন লাগছে?

-কেন! কি এমন দেখে আবার চমকে উঠল যে বড়!

-সময় জীবনের ওপর কেমন বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছে তাই দেখছি ।

মিনু অবাক হয়ে যায় আমার কথা শুনে।ও বলে আজকাল তোমার সব কথা বুঝতে পারি না।কি হয়েছে তোমার? তুমি কি অসুস্থ?

-অসুস্থ! হয়তো হবে।আচ্ছা মিনু আমাদের বয়স কত হলো?
-তা হয়েছে।

তুমি যে বছর রিটায়ার করলে সে বছর তো তোমার 
ষাট পেরলো।

-ও হ্যাঁ। তা বটে।আমি যে এখন বুড়ো হয়ে গেছি সে কথা 
আমার মনেই থাকে না।

-তবে সে তো এখন তোমার মত হয়েছে-
মাথার চুল পেকেছে,মুখের শিরা ফুলে 
উঠে…

ও তাড়াতাড়ি আমার কথায় বাঁধা দিয়ে বলে- হ্যাঁ,সেম এজ হলে...মিনতি অসন্তুষ্ট হয়।
আমি অরুনার কথা যত ভাবতে ভালোবাসি, মিনতি ততটাই ভুলতে চায়,ভোলাতে চায়।আজকাল ও হাল ছেড়ে দিয়েছে।তবে সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকে -নিজের 
অধিকার হারিয়ে যাওয়ার ভয়।কিংবা এতদিন একসঙ্গে থাকার পরেও 
ভালো করে অধিকার না-পাওয়ার রাগ।

কি জানি মিনতি কি ভাবে!যা খুশি ভাবুক।তবু এত দিন যখন অরুনার জন্য অপেক্ষা করেছি 
জীবনের বাকি কটা দিনও তার পথ চেয়ে থাকব।

ক্রমশ...

                     

        লেখক বিশ্বনাথ প্রামাণিক

       বিদ্যাসাগর পল্লীসোনারপুরকলকাতা১৫০



0 Comments