শৌভিক চ্যাটার্জী'র গল্প


গগনপার
শৌভিক চ্যাটার্জী 

রাগি সূর্য প্রতিজ্ঞা করেছে সব পুড়িয়ে ছারখার করে ছাড়বে।মনে হচ্ছে আকাশ থেকে যেন জ্বলন্ত পারদ ঢালছেন ভগবান।চামড়া চটচট করে পুড়ে যাচ্ছে।রাস্তার ধারের বাড়িঘর গুলোকে মনে হচ্ছে বৈশাখের দুপুরে ঘর্মাক্তকলেবর,ক্লান্ত।সারিসারি বাড়ি ঝিমোচ্ছে।গাছপালা গুলোরও একই দশা।কেমন যেন রক্তশূন্য ভাব।থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
আর দাঁড়িয়ে আছে গগন। তিন মাথার মোড়ের মাথায়,এই ভর দুপুরে একজন মধ্য তিরিশের মানুষ ঠায় দাঁড়িয়ে।
            গগন কাসুন্দি ফেরি করে রাস্তায় রাস্তায়।বকুলপুর থেকে শিয়ালদা গামী ট্রেনে উঠে নেমে পরে কোন একটা জনপদে।তারপর সারাদিন ফেরি করে কাসুন্দি। কোনদিন পাঁচশো টাকার কাজ হয়।কোনদিন দুশো।আবার কোনও কোনও দিন শিকে ছিঁড়লে হাজার খানেক টাকারও কাজ হয়।ব্যবসায় গগনের কোনো ইনভেস্টমেন্ট নেই।পুরো টাকা মালিককে দিয়ে দেয়।মালিক টোয়েন্টি পারসেন্ট দেয়।পাঁচশো টাকার কেনাবেচা হলে একশো টাকা গগনের।সরল হিসেব।

গগন অনেকটা গরীব।গগনের সংসার চলে না।সংসার বলতে তিনজনই থাকার কথা।গগন,ওর বউ সন্ধ্যা আর মেয়ে মালতি।কিন্তু দিন পনেরো হল,গগনের বউ ওর পাশের পাড়ার শ্রীধর বৈরাগ্যের সাথে ভাব ক'রে পালিয়েছে।শ্রীধরের ব্লাউজের দোকানে কাজ করে সন্ধ্যা।গগনের বিশেষ দুঃখ হয়নি।শ্রীধরের পয়সাকড়ি আছে।সন্ধ্যাকে ভালোই রাখবে।ভেগে যাওয়ার দু পাঁচদিন আগেই গগনের বউ একদিন অনেক রাতে আদিখ্যেতা গলায় বলেছে,
'শ্রীধরদা আমার বুকের দিকে তাকায়।'
'তুমি কী করে জানলে তাকায়?'
'ও,তুমি বুঝবে না।মেয়ে মানুষে সব বুঝতে পারে!'
'তুমিও ওর দিকে চেয়ে থাকো বুঝি?'
'তা মাঝেমাঝে! বেশ লাগে জানো। বেশ শক্তপোক্ত ব্যাটাছেলে যাকে বলে আরকি!'
গগন একদৃষ্টে চেয়েছিল বউ এর চোখের দিকে।এমন দীঘল চোখ বড় একটা দেখা যায় না।এমন চোখ থাকলে যে কোনো পুরুষের বুক শুষে খালি করে দেওয়া যায়।গগনেরও তাইই হয়েছিল।বিয়ের সময়।সন্ধ্যার খুব একটা দোষও নেই।দুবছর হল,ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মে পড়ে গিয়েছে গগন।মাজায় ভয়ঙ্কর চোট।তারপর থেকে সম্ভোগ করার শক্তি খুইয়েছে গগন।সম্ভোগের পিছুপিছু আদর,সোহাগ সবই গেছে।সারারাত ছটফট ক'রে, ভোরবেলা সন্ধ্যাকে কুয়ো তলায় গায়ে জল ঢালতেও দেখেছে গগন।তবু একবারও গায়ে হাতটুকু দিতেও দেয়নি সন্ধ্যা।গগনের পৌরুষের একমাত্র এবং শেষ চিহ্ন ওদের মেয়ে।ওরই ঔরসজাত।সবাই বলত,'বাপের মুখটা কেটে বসানো,থুতনির জরুলটা পর্যন্ত বাপের মত!'
ভালবাসা,স্নেহ,মায়া,মমতা সবটাই ওই মেয়ে।বাপের মেয়ে অন্ত প্রাণ। মেয়েরও আজন্ম তাই।সেও বাপ ছাড়া কিচ্ছু বোঝেই না।কাজে বেরবার সময় রোজ ছুটে আসে।জুলজুলে চোখ ক'রে বাপের দিকে তাকায়।গগন জানে মেয়েকে। বোঝেও।সারাদিনের কাজের শেষে গগন চকোলেট নিয়ে ফেরে।মেয়ে বাপের কোলে বসে সে চকোলেট খায়।তারপর বাপের গালে একটা চুমু খায়।বাপ বেটির কপালে চুমু খায়।বাপ মেয়েকে,'মা,মা রে!'বলে ডাকে।মেয়ে একমুখ আদর নিয়ে বাপের কোলে জড়সড় হ'য়ে বসে।যার একচোখ ভাষা,তার কন্ঠে স্বর দেয়নি ভগবান।গগনের মেয়ে মূক ও বধির। নপুংসক স্বামী আর পঙ্গু সন্তানে অতিষ্ঠ হয়ে থাকত সন্ধ্যা।চারবছরের মেয়েকে প্রায় একা কোলেপিঠে করে রাখত গগন।মাকে ফেলে বাপের গায়ের ওপর  ঘুমোত মালতি। মেয়ের গন্ধ লেগে থাকত বাপের শরীরে,মনে আর আত্মায়।সেই গন্ধ নিয়ে সারাদিন কাদুন্দি বেচত গগন।মনে হত,স্বর্গের লক্ষী ঠাকুর মেয়ের গন্ধ হয়ে আশীর্বাদ করছেন গগনকে।
       সন্ধ্যার ওপর গগনের খুব রাগ।নাহ্!সে ও শ্রীধরের সাথে পালিয়েছে বলে না।ওর জন্যই বাড়ি ফিরে মেয়ের মুখটা আজ আর দেখতে পায় না গগন।মেয়েটার একটাই ছবি ছিল।লাল টুকটুকে ফ্রক পরে,হাতে বল নিয়ে।গগনই স্টুডিয়োতে গিয়ে তুলে এনেছিল।বাঁধিয়েও এনেছিল।'ওই ছবিটাই একমাত্র ভরসা ছিল,সেটাও নিয়ে গেল মাগী!'একমাত্র ভরসা কারণ,দিন সাতেক হল,গগনের মেয়েটা মারা গেছে।আর নেই।তিনদিনের ধুম জ্বর।আর ভীষণ শ্বাসকষ্ট নিয়ে মেয়েটা চলে গেল।হাসপাতালে বেড পেয়েছিল কিন্তু কেউ ভালো করে ছুঁয়েও দেখল না।মেয়েটা বাপের সামনেই গুঙিয়ে গুঙিয়ে চলে গেল।কথা তো বলতে পারত না,কিন্তু ওই অস্ফুট গোঙান থেকেই গগন শুনতে পেত,'বাবা,খুব কষ্ট হচ্ছে!'চোখের সামনে চার বছরের ফুটফুটে মেয়েটা মারা পড়ল।বেখয়ারে।আসলে গগনের সংসারে কেউ নেই।ফাঁকা।সংসারে গগনও নেই।গগনেরও সংসার নেই।
 
[২]
    
এই প্রখর দুপুরে,প্রায় অজানা শহরের তিনমাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে গগন।হাতের কাসুন্দির ব্যাগ বড় ভারী।তবু কিছুই মালুম পাচ্ছেনা ও।আসপাশের সমস্ত ঘুমন্ত বাড়ি গুলির মধ্যে,একটা বাড়িতে চোখ আটকে আছে গগনের।আবিষ্ট চোখে,এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে গগন,বাড়িটার দিকে।একতলা বাড়ি।বোঝা যায়,সারা বাড়ি গভীর তন্দ্রায়।কিন্তু ছোট্ট একটা মানুষ বাইরের বারান্দায় খেলছে।খেলনাবাটি।ছোটো ছোটো হাঁড়ি,কড়াই,হাতা,খুন্তি,স্টোভ সাজিয়ে  তৈরি করেছে কল্পনার সংসার।আপন মনে কীসব বকবক করছে।সেই এক মুখের ধাঁচ। ঘাড় পর্যন্ত কোঁকড়া চুল।শ্যামলা রঙ।দীঘির মত ভড়াট চোখে।হাসি হাসি মুখ।'মা,আমার মা,মালতি মা।মা তুই এখানে!'মেয়েটিকে দেখে অদ্ভুত ভ্রমে ভাসতে থাকে কন্যা হারা পিতা।একপ্রকার অবশ হয়েই এগিয়ে যায় গগন।ছোটো গ্রিলের গেট খুলে,বারান্দায় উঠে যায়।পারিপার্শ্বিকতার ধরাছোঁয়ার বাইরে,পিতৃত্বের এক স্বর্গসুখে আচ্ছন্ন হতে থাকে গগন।শিশুটিকে কোলে তুলে কপালে চুম্বন এঁকে দেয়।'মা,মা গো কোথায় ছিলি তুই!'
শিশু কন্যাটি চমকে ওঠে।চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।বাড়ির ভিতর থেকে রূদ্ধশ্বাসে বাইরে আসে মেয়েটির মা,বাবা এবং আরো কেউ কেউ।'এই তুমি কে?'গগন নিরুত্তর। সে তার হারানো মেয়ের চোখের জল মোছাতে ব্যস্ত।
'চোর,চোর ছেলেধরা ছেলেধরা..!
ভয়ার্ত চিৎকারে জুটে যায় বেশ কিছু মানুষ।
'এর আগেরটাও তার মানে এই করেছিল!'
'মালকে পুলিশে...'
'ধ্যার পুলিশ।ক্যালাও..'
কলার ধরে গগনকে নামিয়ে আনা হয় রাস্তায়।গগনের চোখ তখনো মেয়েটিতেই আটকে।পিছন থেকে ঘাড়ে কেউ একটা রদ্দা মারলে গগন পড়ে যায়।তারপর বুকে নেমে আসে লাথি।মুখে লাথি।পেটে লাথি।তলপেটে লোহার রড় জাতীয় কিছু একটা দিয়ে প্রবল আঘাত।মাথায় একটা থান ইঁট দিয়ে বারি দেয় কেউ।মাথা উপচে রক্তে থইথই করছে রাস্তা।
গগন চোখ বুজচ্ছে। আহা!কী আরাম।ওই তো আর একটু এগোলেই মালতিকে ছুঁতে পারবে গগন।লাল টুকটুকে জামা পড়ে,হাতে বল নিয়ে খেলছে মেয়েটা।দুহাত বাড়িয়েছে বাপের দিকে।গগন এগিয়ে যাচ্ছে সাদা আলোর দিকে।

শৌভিক চ্যাটার্জী 
কালনা, পূর্ব বর্ধমান, পশ্চিমবঙ্গ




















0 Comments