সাদাত হাসান মান্টোর এক ডজন অণুগল্প ~ ভাবানুবাদে সিদ্ধার্থ সিংহ


সাদাত হাসান মান্টোর অণুগল্প
ভাবানুবাদ সিদ্ধার্থ সিংহ 

একেবারে ছুটি

‘ধর... ধর... ধর... পালাতে না পারে...’

খানিক তাড়া খাবার পর ধরা পড়তেই তাকে বর্শা দিয়ে মারার জন্য একজন ছুটে গেল। সে তখন কাঁপা কাঁপা গলায় আকুল ভাবে বলল, ‘আমাকে মেরো না, আমাকে মেরো না... আমি তো ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছি।’

ফেরত

দুই বন্ধু মিলে দশ-বিশ জনের মধ্যে থেকে একটা মেয়েকে বেছে বিয়াল্লিশ টাকায় কিনে নিল।

রাত শেষ হওয়ার মুখে এক বন্ধু সেই মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল, 'তোমার নাম কী?'

মেয়েটি তার নাম বলল। নাম শুনে সেই বন্ধুটি হতবাক হয়ে রইল।

বলল, আমাদের তো বলল, তুমি অন্য ধরনের। মেয়েটি জবাব দিল, ওরা মিথ্যা বলেছে।

এই কথা শুনে সে ছুট্টে তার বন্ধুর কাছে গিয়ে বলল, ওই হারামজাদারা আমাদের মিথ্যে বলেছে। চল, মেয়েটাকে ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে আসি।

পূর্ব বন্দোবস্ত

ব্যারিকেডের কাছেই প্রথম ঘটনাটা ঘটল। তাই একজন কনস্টেবলকে সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে পোস্টিং করা হল।

তার পরের দিনই ভাঁড়ার ঘরের সামনে আর একটি ঘটনা ঘটল। দ্বিতীয় ঘটনা যেখানে ঘটল ওই কনস্টেবলকে সেখানেই বদলি করা হল।

তৃতীয় ঘটনাটা মাঝরাত্তিরে লন্ড্রির কাছেই ঘটল। যখন ওই কনস্টেবলকে নতুন জায়গায় যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিল ইনস্পেক্টর, তখন সে একটা অনুরোধ করল। বলল‌ --- 'দয়া করে আমাকে সেই জায়গায় পোস্টিং করে দিন যেখানে এর পরের ঘটনাটা ঘটবে।'

খবরদার

দাঙ্গাবাজরা কোনও রকমে টেনে-হিঁচড়ে বাড়ির মালিককে বাইরে এনে ফেলল।

সে জামা প্যান্টের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে দাঁড়াল। তার পর দাঙ্গাবাজদের সাবধান করে দিয়ে বলল, ‘চাইলে আমাকে মেরে ফেলো, কিন্তু খবরদার, আমার টাকাপয়সায় কিন্তু হাত দেবে না!’

দয়া

'দয়া করে আমার যুবতী মেয়েটিকে আমার সামনে মেরো না…'

'ঠিক আছে, ও যখন বলছে তা হলে সেটাই করি…চল, এই মেয়েটিকে ওই দিকটায় নিয়ে যাই।'

জেলি

ভোর ছ'টা নাগাদ পেট্রলপাম্পের কাছে ঠেলাগাড়ির মধ্যেই আচমকা বরফ-ফেরিওয়ালার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে দিল কেউ। সাতটা পর্যন্ত দেহটা পড়ে রইল রাস্তায়। ঠেলা থেকে বরফ গলে গলে পড়তে লাগল।

সওয়া সাতটা নাগাদ লাশ উঠিয়ে নিয়ে গেল পুলিশ। বরফ আর চাক চাক রক্ত সেই রাস্তায়ই পড়ে রইল।

পাশ দিয়ে একটা টাঙা যাচ্ছিল। তাতে বসে ছিল ছোট্ট একটা বাচ্চা। রাস্তায় জমে থাকা থকথকে রক্তের দিকে তাকিয়ে ওর জিভে জল এসে গেল। সে তার মায়ের হাত টেনে আঙুল দিয়ে সে দিকে দেখিয়ে বলল, ‘দেখো মা, জেলি!’

সরি

ছুরিটা সজোরে নাভির পাশ দিয়ে বুকে পাকস্থলীটাকে বের করে ফেলল। তার সঙ্গে বেল্টটাও কেটে দিল।

পরক্ষণেই আক্রমণকারী আফসোস করে বলল--- 'আহা! আমি একটা ভুল করব বলেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি।'

জবাই আর কোপ

‘আমি লোকটার গলায় ছুরি ধরলাম, আস্তে আস্তে পোচ দিয়ে জবাই করলাম।’
‘এ তুই কী করলি!’
‘কেন?’
‘জবাই করলি কেন?’
‘এভাবেই তো মজা!’
‘মজার বাচ্চা, তুই এক কোপ দিয়ে মারলি না কেন? এই ভাবে...' বলেই জবাই করা লোকটার গলা এক কোপে আলাদা করে দিল।

বিশ্রামের সময়

'এখনও সে মরেনি, দেখো এখনও তার একটু শ্বাস রয়েছে।'

'ওগো, শ্বাসটা টেনে বের করে নাও আমি কাহিল হয়ে পড়েছি।'

জুতো

সবাই রে রে করে স্যার গঙ্গারামের মূর্তির দিকে ছুটে গেল। মূর্তির ওপর লাঠির বাড়ি পড়ল। ইট বৃষ্টি হল। কে একজন গিয়ে মূর্তির মুখে আলকাতরা মাখিয়ে দিল। আরেক জন অনেকগুলো পুরোনো ছেঁড়া জুতো জড়ো করে একটা মালা বানিয়ে মূর্তির গলায় পরানোর জন্য তড়িঘড়ি এগিয়ে গেল। কিন্তু এর মধ্যেই পুলিশ এসে পড়ল। দাঙ্গাবাজদের ছত্রভঙ্গ করতে গুলি চালাতে শুরু হল।

জুতোর মালা পরাতে যাওয়া লোকটা জখম হল। চিকিৎসার জন্য তাকে তখন‌ ‘স্যার গঙ্গারাম হাসপাতাল’-এই নিয়ে যাওয়া হল।

যথাযথ পদক্ষেপ

যখন মহল্লায় হামলা হল, কিছু কম বুদ্ধির লোক মারা পড়ল। যারা বাকি ছিল, তারা প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে বাঁচল। একজন লোক আর তার বউ নিজের ঘরের তলকুঠুরিতে গিয়ে লুকিয়ে রইল।

খুনিরা কখন আসে... এই ভয়ে দু'দিন দু'রাত স্বামী-স্ত্রী দমবন্ধ করে কাটিয়ে দিল। কিন্তু কেউ এল না।

কেটে গেল আরও দু'দিন। কমতে লাগল মৃত্যুর ভয়। খিদে আর তেষ্টার কষ্ট তার চেয়েও বেশি হতে লাগল।

আরও চার দিন কেটে গেল। জীবন-মৃত্যু নিয়ে আর কোনও আগ্রহ রইল না তাদের। ওখান থেকে বের হয়ে এল দু'জন।

স্বামী খুব দুর্বল কণ্ঠে বাইরে থাকা লোকদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমরা নিজেই ধরা দিচ্ছি... আমাদের মেরে ফেলো।’

যাদের বলা হল, তারা খুব চিন্তায় পড়ে গেল, ‘আমাদের ধর্মে তো জীবহত্যা পাপ!’

এরা সবাই ছিল জৈন। তাই তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে যথাযথ পদক্ষেপের জন্য সেই স্বামী-স্ত্রীকে পাশের মহল্লার লোকদের হাতে তুলে দিল।

চ্যালেঞ্জ

আগুন লাগল যখন, সারা মহল্লা পুড়ে ছাই... শুধু একটা দোকান বেঁচে গেল। সেই দোকানের ওপরে সাইনবোর্ডে তখনও পড়া যাচ্ছিল--- এখানে বাড়ি বানানোর মালপত্র পাওয়া যায়।

সাহিত্যিক সিদ্ধার্থ সিংহ
২৭/পি, আলিপুর রোড, কলকাতা


সাদাত হাসান মান্টো (১৯১২-১৯৫৫)

সাদাত হাসান মান্টো জন্মেছিলেন ১৯১২ সালের ১১ মে। তিন বার ব্রিটিশ আমলে এবং তিন বার স্বাধীন পাকিস্তানে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন উর্দু ভাষার অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ছোট গল্পকার। উপমহাদেশের দাঙ্গা এবং দেশভাগের শ্রেষ্ঠ কথাকার। আমার মতে, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রথম পাঁচ জন গল্পকারের মধ্যে মান্টো নিঃসন্দেহে একজন। আমার ধারণা, এই গল্পগুলো পড়লেই যে কোনও সচেতন পাঠকই আমার সঙ্গে একমত হবেন।





































0 Comments