দূরদ্বীপবাসিনী ~ রচয়িতা দাঁ'র ছোটগল্প


রচয়িতা দাঁ'র ছোটগল্প
দূরদ্বীপবাসিনী

"আজি ঝড়ো ঝড়ো মুখর বাদরদিনে..."

ঘরের মধ্যে একা একাই গুন গুন করে চলেছে দীপা। কর্মসূত্রে চারদিনের জন্য কালিম্পং এসেছে ওরা। টীমে একটি মাত্র মেয়ে দীপা ফলে তার জন্য হোমস্টের একটা সিঙ্গেল রুম বরাদ্দ হয়েছে। কাল রাত থেকে এখানে বৃষ্টি হয়েই চলেছে, তাই আজ সবাই অফিসে ডুব মারার প্ল্যান করেছে। এই প্রথমবার বিয়ের পর নাবিককে ছেড়ে একা বাইরে এসেছে দীপা। নানারকম বাস্তব অবাস্তব অযুহাত খাঁড়া করে এতদিন বাইরে যাওয়াটা আটকে রেখেছিল দীপা, কিন্তু সেটা তো সবসময় সম্ভবপর নয় আফটার অল যত ভালো চাকরি কেউ করুক না কেন, 'চাকরি যে করে সে চাকর'। একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং আরও কিছু অসুবিধার কথা বলে কলকাতা থেকে কালিম্পং পাঠানো হয়েছে চারজনের একটি টীমকে। নাবিক আসতে চেয়েছিল কিন্তু এতো শর্ট নোটিশের অর্ডার, ও ঠিক ছুটি ম্যানেজ করতে পারেনি। অতএব চারদিনের অনন্ত বিরহ। সারাদিন কাজের ফাঁকে দু-একটা কথা আর রাতে ভিডিও কল, তাও যদি ভাগ্যক্রমে নেটওয়ার্ক থাকে। দীপাদের কর্মক্ষেত্রগুলো সাধারণত এরম জায়গাতেই হয়, শহর বা লোকালিটী থেকে একটু দূরে হয়।

চারপাশে পাহাড়ে ঘেরা, সেখানে নানারকম পাহাড়ি গাছ, ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ি ঝর্ণার কুলকুল শব্দ, কত রকম পাখির ডাক, শহরের কোলাহলের বাইরে নিস্তবদ্ধতা, দূষনমুক্ত খোলা আকাশ, মনোরম আবহাওয়া সবমিলিয়ে রোম্যান্টিক পরিবেশ। আর এরম পরিবেশে মনের মানুষটার সাথে বিলীন হয়ে যেতে না পারার যে বেদনা তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন। ভালোবাসায় যখন দুজনের হৃদয় ও আত্মা এক হয়ে যায় তখন আর চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল হবার ভয় থাকে না। কিন্তু দুটো শরীর, মন, হৃদয়, আত্মা একত্রে বিলীন হয়ে যাবার পরও যদি আবেগঘন মুহুর্তে বা কোনও রোমান্টিক পরিবেশে প্রকৃতির বুকে হারিয়ে যাবার মুহুর্তে কাছে না থাকা মনের মানুষটি র জন্য বিরহে মন হাহাকার না করে, হৃদয়ের গভীরে পরম শান্তিতে বাস করা মানুষটিকে যদি কাছে টেনে ভালবাসার উষ্ণতায় ও আদরে  ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে না করে তাহলে ধরে নিতে হবে সে হয় পাথর নয় সাধু-সন্ন্যাসী, যিনি সকল মোহ-মায়া ত্যাগ করতে সমর্থ হয়েছেন। এখনকার উন্নত প্রযুক্তির যুগে অন্তত ভিডিও কলিং এর দৌলতে দূরত্ব কিছুটা কমানো সম্ভব হয়েছে ঐ 'নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো' ধরনের কিন্তু তার জন্যে ও দরকার দ্রুত গতি সম্পন্ন ইন্টারনেট পরিষেবার। নইলে অদৃশ্য সুদর্শন চক্র কাবাব মে হাড্ডির রোল প্লে করবে। দেখলেন হয়তো আপনার পুরুষ সিংহটি হঠাৎ করে আপনার অসাক্ষাতে, আপনার কোনও রকম চোখ রাঙানি ছাড়াই তোতলামি করতে শুরু করেছেন।আপনার অনুপস্থিতিতে কার চোখ রাঙানিতে এরূপ তোতলামি করছে তা অনুসন্ধান করতে এবং এরূপ অবিবেচকের মত পরিষেবা দেবার জন্য আপনি যখন  ইন্টারনেট কোম্পানির মালিকের ওপর রেগে গিয়ে তাকে খিস্তি দিয়ে তার গুষ্টির ষষ্ঠী পূজো করছেন তখন আপনার বরটি হয়তো অপরপ্রান্ত থেকে দেখছেন আপনার মত বাঘিনীও হঠাৎ শক পেয়ে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন, আর যেভাবে থেমে থেমে কথা বলছেন তাতে  মনের আড়াল না হলেও, কয়েক দিনের স্পর্শের অভাবে মানুষ কিভাবে রোবোটে পরিনত হয়ে গেল তা নিয়ে বিস্তর দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হবে।আর যে হতভাগারা এরম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে সমুদ্র সমতল থেকে পাহাড় চুড়োয় ভিডিও কলের মাধ্যমে প্রেমালাপ করেছেন তাদের অনেকেই ঐবিশেষ মুহুর্তের সাক্ষী নিশ্চয়ই আছেন যখন দুজনের কথোপকথন বেশ মাখোমাখো জায়গায় পৌঁছে গেছে, সামনে থাকলে যে কোন সময় দুজনের মধ্যে তুফান সৃষ্টি হতে পারতো ঠিক সেই সময় সুদর্শন চক্র ঘুরতে শুরু করল। যাইহোক, গতকাল থেকে ইন্দ্র দেব দীপার প্রেমের বিরূদ্ধে এমন ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন যে এই দুই অসহায় প্রেমিক - প্রেমিকা থুরি নববিবাহিতা স্বামী-স্ত্রীরও এরম করুন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। গতকাল রাত থেকেই কালিম্পং এর যে অঞ্চলে দীপা আছে তার নেটওয়ার্ক নেই। ভিডিও কল তো দূর ফোনে বিবেকের গলার আওয়াজ শোনার সুযোগটাও মিলছে না। একবার কষ্ট করে অন্যের ফোন থেকে কানেক্ট করে কথা বলেছিল দীপা কিন্তু লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সে আর কতক্ষণ প্রেমালাপ সম্ভব! আর এটাই মূল কারণ অফিস ডুব মারার। এত দূরে আসার জন্য এমনিতেই মন খারাপ তার ওপর নেটবিভ্রাটে আরো মুড অফ, তাই অফিসে গিয়ে কাজ দেখানো অযৌক্তিক। দীপা তাই আজ ঘরে থেকেই বৃষ্টি উপভোগ করবে মনস্থ করেছে। হোমস্টের সুবিধা হল এখানেই ঘরোয়া খাবারের ব্যবস্থা থাকে, তাই দুপুরের লাঞ্চের চিন্তাও নাই।
 
জানলা দিয়ে দূরের মেঘাচ্ছন্ন পাহাড়ের দিকে একমনে চেয়ে থাকতে থাকতে দীপা টাইম মেশিনে করে চলে গেল বেশ কয়েক বছর আগের দিনগুলোতে। পাহাড় সবসময়ই দীপার খুব পছন্দের।বরফে ঢাকা পাহাড়চুড়ো হোক বা সবুজ পাহাড়ি গাছে ঢাকা পাহাড় কিম্বা উদ্ভিদবিহীন ন্যাড়া পাহাড় যেখানে পাহাড়ের গায়ে শুধুই রঙের বৈচিত্র্য সবই পছন্দ দীপার। পাহাড়ি নদী, ঝরনা, আঁকা বাঁকা রাস্তা, সরল মানুষজন, ভেড়ার পাল,লোম ওয়ালা কুকুর, পাহাড়ের ঢালের চা-বাগান এবং পিঠে ঝুড়ি, বুকে বাচ্চা নিয়ে কাজ করা চা বাগানের শ্রমিক সবই টানে দীপাকে। কয়েক বছর আগে দীপা তখন ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা শেষ করেছে। পুজোর সময় বাড়িতে বসে চূড়ান্ত বোর হয়েছে কারন ওর সব বন্ধুরা তাদের বয়ফ্রেন্ডদের সাথে ঠাকুর দেখতে যেতে বা ঘুরতে যেতে ব্যস্ত। আর দীপা তখনও সিঙ্গেল, কালের নিয়মে দু-একটা প্রেম আসব আসব করছিল কিন্তু ফুল ফোটার আগেই শুখিয়ে ঝরে পড়ে গেছে বিভিন্ন কারনে। সেসব নিয়ে আফশোষ নেই দীপার। কিন্তু কতোদিন পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে অথচ তিন-চারদিনের জন্য ঐ জোঁকের মত লেগে থাকা বয়ফ্রেন্ড গুলোকে ছেড়ে ঘুরতে যেতে পারছে না ওর বন্ধুগুলো, এটাই তখন সবচেয়ে বিরক্তিকর লাগত দীপার । আর আজ ওর নিজের ও সেম হাল। একসময় প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়ায় যে পরম শান্তি লাভ করত, একা একাই বেরিয়ে পড়ত রাধিকার মত অভিসারে প্রকৃতি রূপী কৃষ্ণকে আপন করে নেবে বলে; এখন কৃষ্ণ বদলে গেছে আর এই রোমান্টিক পরিবেশ, অফিস অর্ডার সবকিছুই জটিলা-কুটিলার ভূমিকা পালন করছে নাবিকের সাথে মিলিত হতে না দিয়ে। এখন দীপা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে সেইসময় ওর বন্ধুগুলো কেনো তিন-চার দিনের জন্য একলা ঘুরতে আসতে পারত না। তখন এগুলোকে ন্যাকামো মনে হত, কিন্তু এখন বুঝতে পারে মন থেকে ভালোবাসলে আর একলা হওয়া যায় না।আর তখন তো ইন্টারনেটের ও এত কম দামে অ্যভেলেবিলিটি ছিল না। নাবিকের সাথে দেখা হওয়ার আগে অনুভূতি গুলো অন্য ছিল, পরিচয়ের পর মূলত সম্পর্কে জড়িয়ে পরার পর অনুভূতি গুলো নতুন রূপ, রস, গন্ধ পেয়েছে।

সেবার কালীপুজোর আগে দীপা বন্ধুদের আশা ছেড়ে দিয়ে একাই বেরিয়ে এসেছিল এই কালিম্পং এরই উদ্দেশ্যে। তখন টিউশনের জমানো টাকায় ঘোরা, তাই সস্তায় নিরাপদ স্থানই বেশি গ্রহনযোগ্য। আর তার জন্য হোমস্টেই আদর্শ।  অনেকদিন ধরে পড়াশোনা, টিউশন, কম্পিটিটিভ এক্সাম প্রভৃতির চাপে ভারাক্রান্ত দীপা সেবার কিছুদিন শুধু নিজের মত করে পাহাড়কে উপভোগ করার জন্য কালিম্পং এসেছিল। উঠেছিল যে হোমস্টেটাতে, সেটা ছিল পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে, ছোট্ট দোতলা একটা বাড়ি। একতলাটাতে মালিকের ঘর, একটা ছোট্ট কিচেন গার্ডেন আর তারপাশ দিয়ে উঠে গেছে কাঠের ঘোরানো সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠলে সামনে ছাদ আর দুটো ঘর। একটা সিঙ্গেল, একটা ডবল। সিঙ্গেল ঘরটা ফাঁকা পেয়ে ওটাই বুক করেছিল দীপা। পাশের ঘরটাও বুকড। ঘরের সামনে একটা ছোট্ট ছাদ সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ছাদে একটা টী-টেবিল, আর কয়েক টা ফুলের টব দিয়ে সাজানো। এক কথায় অসম্ভব সুন্দর। দীপার কপাল জোরে এই ঘরটার আগের রেন্টার কোনও কারনে আগের দিন রাতে চেক-আউট করে গেছেন তাই এই ঘরটা ফাঁকা ছিল। নাহলে এই পিক  সীজনে ঘর পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। হোমস্টের মালকিন ফুলমতিয়া, ইয়ং মেয়ে,একটা দশ-বারো বছরের ছেলেকে নিয়ে থাকে। বর একটা অন্য মেয়েকে নিয়ে অন্য জায়গায় থাকে। হোমস্টের নীচে একটা কমন ডাইনিং রুম, তার পাশেই কিচেন। ফুলমতিয়া নিজেই রান্না করে খাওয়ায়, ভাত, রুটির সাথে লোকাল খাবার ও পাওয়া যায়। দুপুরে খাবার সময় পাশের ঘরের অতিথির সাথে দেখা হল।অদ্ভূত রকম শান্ত একটা ছেলে, কেমন একটা অন্যমনস্ক ধরনের। 

ডাইনিং টেবিলে খাবার ঢাকা দিয়ে রাখা রয়েছে। দীপা একটু আগেই নেমেছে। নর্থ বেঙ্গল এর আগেও বহুবার এসেছে দীপা,তাছাড়া এবার একা, কেউ শেয়ার না করলে গাড়ি ভাড়াতেই সব পয়সা শেষ হয়ে যাবে, তাই খুব একটা ঘোরাঘুরির প্ল্যান নিয়ে আসেনি ও, তবে সুযোগ পেলে দশ মিনিটে পিঠে একটা ছোট ব্যাগপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়তে সবসময়ই প্রস্তুত সে। সকালে চেক ইনের সময় ই বাচ্চাটাকে দেখেছে, মূলতঃ ওর সাথে ভাব জমাতেই দীপা ঘর থেকে ফ্রেশ হয়ে, বাড়ির লোকের কুশল মঙ্গল খবর নেওয়ার দায়িত্ব শেষকরে ও নীচে নেমে এসেছে। খাবার সময় ফুলমতিয়া কাঞ্চাকে বলল, "আঙ্কেল কো বুলালো বেটা"। কাঞ্চা একছুটে ওপরে চলে গেল, নীচে এসে বলল, "আঙ্কেল শো রাহা থা, লেকিন বোলা আ রাহা হ্যায়"।এরপর তিনি আসেন। দীপা এবং সেই অতিথির সাথে তিনি প্রায় জোড় করেই কাঞ্চাকে ও খেতে বসিয়ে দিলেন।আর খেতে খেতে ওর সাথে গল্প ও জুড়ে দিলেন। দীপার বেশ ভালোই লাগলো তার আচরন কিন্তু তার দীপার প্রতি কোনও আগ্রহ নেই, সুতরাং আগবারিয়ে অচেনা পুরুষের প্রতি আগ্রহ দেখানোটা দৃষ্টিকটু, তাই পরিচয় হল না। ফুলমতিয়া পরিবেশন করার সময় অতিথি বললেন, "যাদা মাত দিজিয়ে ভাবি, তবিয়ত ঠিক নহী হ্যায়।" সামান্য কিছু খেয়েই উঠে চলে গেল সে। লাঞ্চের পর দীপা ও চলে আসে। বিকেলের দিকে একটু আশপাশ টা কাঞ্চাকে নিয়েই ঘুরতে বেরিয়েছিল, তারপর  সন্ধ্যে বেলায় ফুলমতিয়ার হোম মেড ফ্রায়েড  মোমো আর  স্যুপ।তখনই শুনলো পাশের ঘরের ছেলেটা ও নাকি কলকাতা থেকে এসেছে দুদিন হল । কাঞ্চাকে নাকি খুব ভালোবাসে, খেলে গল্প করে ওর সাথে। কলকাতা শুনে পরিচয় করার ইচ্ছেটা বেরে গেছিল দীপার কিন্তু রাতে খেতে এলো না ছেলেটা, দীপা জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, তার নাকি জ্বর এসেছে।এরম অচেনা অজানা জায়গায়  পাহাড়ি এলাকায় এসে জ্বর বাঁধালো ছেলেটা, দীপার কেমন মায়া হল। রাতে খাওয়া সেরে ঘরে ঢোকার আগে দেখল পাশের ঘরের দরজাটা খোলা, ঘরে লাইট জ্বলছে। দীপা কি ভেবে ঘরে নক করে বলল, "May I come in" ।হ্যাঁ, না কোনও স্পষ্ট শব্দই এলো না, কেমন অচৈতন্য হয়ে পড়ে রয়েছে একটা মানুষ। দীপা উত্তরের আশা না করেই এগিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করল, "আপনার কি জ্বর এসেছে?", "কিছু ওষুধ খেয়েছেন?" কিন্তু কোনও উত্তর ই স্পষ্ট ভাবে বোঝা গেল না। দীপা বাধ্য হয়ে নিজেই কপালে হাত দিয়ে দেখল বেশ জ্বর গায়ে ছেলেটার। পাহাড়ি অঞ্চলে তাড়াতাড়ি রাত নেমে আসে। আর এতো রাতে কাকে বিরক্ত করবে না করবে কিছুই বুঝতে পারলো না দীপা আবার ঐ অবস্থায় ফেলে আসার মত অমানবিক কিছু হতে পারে না। দীপা নিজের ঘর থেকেই কিছু বিস্কুট, জল, ওষুধ এনে ছেলেটাকে খাইয়ে দিল। ছেলেটা প্রায় ঘোরের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু এত রাতে একা একটা মেয়ে অন্য একটা পুরুষের ঘরে থাকবে এসব ভেবে দীপা অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে চলে আসছিল, কিন্তু হঠাৎ দীপার ওড়নাতে টান লাগল, ছেলেটা মুঠো করে ধরে যেন একটা আশ্রয় খুঁজছে। দীপা যেতে পারল না, নিজের ওড়না ছিঁড়ে, আর যে কৌটো করে ছেলেটার জন্য খাবার  এনেছিল সেটাতেই জল নিয়ে ছেলেটার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিল। অন্য সময় হলে দীপার খুব বিরক্ত লাগত, বেড়াতে এসে এসব ঝামেলায় জড়াতে কিন্তু ছেলেটাও এখানে এত অসহায় যে নিমেষে দীপার মধ্যে মাতৃসত্তা উন্মোচিত হল। প্রায় সারারাত মাথায় জলপট্টি দিয়ে ভোরের দিকে জ্বর প্রায় কম দেখে রোগীর গায়ে, নিজের গায়ের চাদরটাই ভালো করে চাপা দিয়ে দীপা নিজের ঘরে ফিরে যায়। ঘন্টা খানেক পর সেই অপরূপ মূহুর্তের আবির্ভাব হল মূলতঃ যার জন্য ফিরে ফিরে আসা হিমালয়ের পাদদেশে, সূর্যের আলোর প্রথম কিরন, রক্তিম আভা ছড়িয়ে পরেছে শ্বেত শুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায়। প্রতিবারের মত একই রকম মুগ্ধ দৃষ্টিতে  দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা বছর চব্বিশের মেয়ে। মুগ্ধতা কাটিয়ে পিছনে ঘুরতেই ধাক্কা খেল ওরই চাদর গায়ে দেওয়া একটা বছর ত্রিশের ছেলের সাথে। এই প্রথম ভালো করে দুজন দুজনের চোখের দিকে চেয়ে দেখল। কি যেন একটা মায়া, মুগ্ধতা মেশানো আবেদনময় দৃষ্টি ছিল সেই চোখে। ক্ষনিকের জন্য দুজন দুজনের দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে লাজুক হরিনীর মত চোখ নামিয়ে নিল দীপা।পাশ দিয়ে ঘরে চলে যাবার সময় আবার পথ আটকে দাঁড়ালো অচেনা পুরুষটি তারপর নিঃশব্দে গায়ের চাদরটা খুলে দীপার গায়ে জড়িয়ে দিল। মাথা উঁচু করে আরেকবার চেয়ে দেখল দীপা, তারপর ছুটে ঘরে চলে গেল।

কিছুক্ষণ কোনো এক আবেশের মধ্যে আচ্ছাদিত হয়েছিল দীপা। তারপর আস্তে আস্তে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। বারবার পাশের ঘরের অচেনা অতিথির চোখ, প্রথম দেখা, স্পর্শ এইসব ফিরে ফিরে আসতে লাগলো দীপার ভাবনায় আর আগের রাতে বিনিদ্রিত অবস্থায় রোগীর সেবা করার পরও চোখে ঘুম এল না সহজে। নিজের আচরনে নিজেরই বিষ্মিত লাগছিল দীপার, যে দীপা বাড়িতে কুটো নেড়ে দুটো করে না বলে মায়ের কাছে বকুনি খায়, তার হঠাৎ কি এমন হল যার জন্য সে একটা অচেনা অজানা ছেলের সেবার জন্য রাত ভোর করে দিল! এইসব ভাবতে ভাবতেই সে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল।

দীপা হোম স্টের সিঁড়ি বেয়ে নেমে একা একাই কোথায় যেন হেঁটে যাচ্ছে। চারপাশের মনমুগ্ধকর পরিবেশ। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, যার একপাশে খাড়া পাহাড় অপর পাশে খাদ। দীপা হেঁটে চলেছে। কোনও দিকে ওর কোনও হুঁশ নেই, কোথাও যাবার তাড়া নেই আবার থেমে থাকার কোনও ক্লান্তি ও নেই। কোনও গন্তব্যের ঠিক নেই, আবার হারিয়ে যাবার ভয় ও নেই। কোনও এক অমোঘ টানে দীপা হেঁটে চলেছে। খাদের নীচ দিয়ে স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদী তার খরস্রোত নিয়ে বয়ে চলেছে। আর অপরদিকে খাড়া পাহাড়। সেখানে নানারকম পাহাড়ি গাছ।হঠাৎ দীপা ঐ গাছপালার আকর্ষণে ঐদিকে হাঁটতে শুরু করল। নানারকম গাছ, নানারকম ফুলের জমাট গন্ধ, পাখির কলরব এসবের মধ্যে হারিয়ে যেতে থাকল দীপা। দীপা দিকশূন্যর মত আরও গভীরে যেতে থাকল। হঠাৎ একদল খারাপ লোক দীপার পথ আটকে ধরল। দীপা প্রানপন ছুটতে আরম্ভ করল কিন্তু রাস্তা খুঁজে পেল না। এভাবে দিগ্বিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে ছুটতে ছুটতে দীপা ধাক্কা খেল একটি ছেলের সাথে। তাকিয়ে দেখল ওরই পাশের ঘরের সেই ছেলেটা। ঘুম ভেঙ্গে গেল দীপার। অসময়ে ঘুমিয়ে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে উঠতে। ঘুম ভাঙার পর দীপার খেয়াল হল "ছেলেটার নাম টা তো জানা হল না! শরীর কেমন আছে সেটাতো সকালেই জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল! সকালে কি যে হল আমি যেন নিমেষে কোথায় হারিয়ে গেলাম!!"

দীপা ফ্রেশ হয়ে বাইরে এসে আগে পাশের ঘরের দিকে গেল, ঘর বন্ধ। দীপা শশব্যস্ত হয়ে নীচে নেমে এল। ফুলমতীয়াকে জিজ্ঞেস করল। ফুলমতীয়া বলল," ভাইয়া তো সুবা মে নিকাল গ্যায়া বহিন। "

দীপা : কাঁহা গ্যায়া?

ফুলমতীয়া: ওতো পাতা নহী। বোল রাহা থা দার্জিলিং কে তরফ যা রাহা হ্যায়। চেক আউট করকে গ্যায়া।
এক মুহূর্তে দীপার সমস্ত উত্তেজনা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। দীপার মনে হতে লাগল "আর দেখা হবে না তাহলে? কোনও রকম কনট্যাক্ট নম্বর ও তো নেওয়া হয়নি, আর কনট্যাক্ট হবে না তাহলে? একই শহরে ই তো থাকে, তাও কি একবার দেখা হতে পারে না? কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে আবার দেখা হবে"। এসব ভাবতে ভাবতেই সারাদিন নষ্ট হল, কোনও কিছুতেই ঠিক মন বসছে না দীপার। আর পাশের বন্ধ ঘরটাকে দেখলেই আরও মন খারাপ করছে। শুধু একবার আলাপ করার জন্য আরেকবার দেখা হবার জন্য দীপার মন উদ্বিগ্ন হতে থাকে।

সন্ধ্যে বেলা দীপা বাইরের ছাদে বসে একমনে আকাশের তারা গুনছিল, তার সাথে চলছে পছন্দের গান, "আভি না যাও ছোড় কার...", হঠাৎ একটা অচেনা মনগ্রাহী কন্ঠস্বর :-

-দূউউরদ্বীইপবাসিনী

দীপা : (চমকে তাকিয়ে) আপনি?? আমার নাম জানলেন কি করে?

-বুঝলেন ম্যাডাম, আপনি মন থেকে কিছু চাইলে সেটা কিছুতেই আপনার থেকে দূরে থাকতে পারে না।যতদূরেই থাকুক আপনার কাছে ঠিক চলে আসবে আর এতো মাত্র দুঘন্টার পথ। 

দীপা : (হতচকিত হয়ে) মানে? আমার উদ্দেশ্যে বলছেন? আমি তো কিছু চাইছিলাম না।
-সত্যি?

দীপা : হ্যাঁ! কি চাইব আমি এখন হঠাৎ?
-সত্যি ই কিছু চান নি? ভেবে দেখুন তো....মনে মনে কারো জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন না? 

দীপা : না, না তো কারো জন্য তো প্রতীক্ষা করছিলাম না। আর... যদি করিও বা আপনি কি করে জানলেন? আপনি কি ম্যাজিসিয়ান? 
-ম্যাজিসিয়ান? নদীর তল বুঝতে গেলে বুঝি ম্যাজিসিয়ান হতে হয়? মানুষের মন ও তো নদীর মতো, কখনো প্রবহমান আবার কখনও স্হির। ছলছল করে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী যেমন পাহাড়ের সৌন্দর্য্যকে বিশেষ মাত্রা দেয় তেমনই সহজ  সরল প্রফুল্লময় মন বাইরের সৌন্দর্য্যকে বাড়িয়ে তোলে। 

দীপা : তবে, আপনি বুঝি ডুবুরি? 

-স্বচ্ছ পাহাড়ি নদীর তল খুঁজতে গেলে কি  ডুবুরি হতে হয়? আমি নাবিক।  জীবন সমুদ্রের মধ্যে ভেসে বেড়াই, দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে, হয়তো বা খুঁজে ফিরি কোনও দূরদ্বীপবাসিনীকে।

ফুলমতীয়া দুজনের জন্য চা নিয়ে আসে। টেবিলে রাখতে রাখতে বলে, "ভাইয়া, মিলা আপকো জো ছোড়কে গ্যায়া?"

দীপা : ছোড়কে গ্যায়া! ক্যায়া ছোড়কে গ্যায়া? আগর ছোড়কে যায়ঙ্গে তো তুম যব সুবা মে আয়ে থে রুম ক্লিন করনে কে লিয়ে তব হি তো মিল যানা চাইয়ে থা।

ফুলমতীয়া : পাতা নহী বহিন। মেরা তো কুছ নহী মিলা। অ্যায়সাই জাদা সামান তো নহী থা ভাইয়া কো সাথ। ভাইয়া বোল রাহা থা কৌই মেহেঙ্গা বালা চীজ  ছোড়কে গ্যায়া ও মে ঢুন নেহী পাউঙ্গি।

দীপা :আচ্ছা। এমনকি জিনিস ছেড়ে গেছেন আপনি যেটা আপনি ছাড়া কেউ খুঁজে পাবে না? 

নাবিক: মন। ভাবী, আপকো বহীন কো থোরা হেল্প করনে কে লিয়ে বলিয়ে না, উনকো পাস হো সাকতা কাল রাত নে যব মেরা ভুখার আয়ী ঔর ঔ মেরা শর কে পাস বঠে হুয়ে থী তব হী খো গ্যায়া।

ফুলমতীয়া: তব বহীন আপ থোরা মদত কিজিয়ে। ঘর আকে মেহেরবানকা কুছ খো জায়েগা ইয়ে হামলোগোকে লিয়ে আচ্ছা নহী হ্যায়। 
(ফুলমতীয়া চলে যায়) 

দীপা :Biscuit নেবেন? 

নাবিক :না হয় আমার কথা আপনার ভালো লাগেনি, তাই বলে কাল এত কষ্ট করে যাকে বাঁচালেন আজ তাকে বিষ কীট মানে বিষাক্ত কীট দেবেন? 

দীপা :আপনার সাথে কথায় পারব না।

নাবিক: শুধু কথা কেন? কথা বার্তা বন্ধুত্ব ভালোবাসা সবকিছুতেই আমাকে হারানো সহজ নয়।

দীপা :Wow! What a self confidence? Have to cultivate...

নাবিক :Sure.. আমি তো হাত বাড়িয়েই রেখেছি.... Will you be my friend?

দীপা : বন্ধুর আসল নাম টা কি জানতে পারি? কি বলে ডাকব?

নাবিক : কেন? নাবিক নামটা কি খারাপ? দূর দ্বীপের বাসিন্দার বিভিন্ন রূপকে যে খুঁজে পায় সে তো নাবিক ই হয়। বরং আপনার এই বিশাল নামটা কে রেখেছেন বলুন তো মিস মিত্র। দূউরদ্বীপবাসিনী।

দীপা(হাসতে হাসতে) : আমার ঠাকুর্দা। সবাই আমায় দীপা বলেই ডাকে।

নাবিক : আচ্ছা দীপা, সকালে চেক আউট করার সময় দেখলাম আপনি কলকাতা থেকে আসছেন, কলকাতার কোথায় থাকেন জানতে পারি কি?

দীপা : না জানতে পারেন না। বন্ধুদের এভাবে আপনি আজ্ঞে করলে কিচ্ছু জানা যায় না।
নাবিক (কান ধরে) : sure.. আমার ই ভুল আর আপনি না... এবার তো বল কলকাতার কোথায় গিয়ে নোঙর ফেললে তোমায় খুঁজে পাব? 

দীপা (মৃদু হেসে) : আমি বালিগঞ্জে থাকি। তুমি? 
নাবিক:আমি সল্টলেক। 

দীপা : আচ্ছা একটা প্রশ্ন কাল থেকে মাথায় ঘুরছে। তুমি তো একা এসেছো, তবে ডবল রুম বুক করার কারন। 

নাবিক : যদি হঠাৎ দোকা হয়ে যাই(সজোরে হাসতে হাসতে)। আসলে আমার এক বন্ধুর আসার কথা ছিল লাস্ট মোমেন্টে ক্যান্সেল করে দিল। এটা আগে থেকেই বুক করা ছিল, এসে লোকেশন টা মেইনলি আউটসাইড ভিউটা পছন্দ হয়ে যায় তাই থেকে গেলাম পাশের টা বুকড ছিল তখন। আর এটা লাস্ট মোমেন্টে ক্যান্সেল করলে রিফান্ড পাওয়ার কোনো চান্স ও ছিল না তাই...।

আর তাই তো তোমার সাথে ও দেখা হয়ে গেল বলো, এটা আমি বুক করে রাখলে কাল রাতে মাথার কাছে বসে থাকার জন্য কাকে পেতাম বলোতো এই বিদেশ বিভুঁইয়ে। কাল যখন খুব জ্বর এসেছিল মায়ের কথা মনে পরছিল। আমার মা ও ঘুরতে খুব ভালোবাসতেন। গত ফেব্রুয়ারিতে আমাদের ছেড়ে ঐ আকাশের তারা হয়ে গেছে। তারপর কাল রাতে তুমি এলে, মা চলে যাবার পর আর কেউ কখনো এভাবে সেবা করেনি। আজ সকালে এখান থেকে চেক আউট করে দার্জিলিং যাবার কথা ছিল তারপর সেখান থেকে তিনচুলে। সকালে তো কোনও কথা বলার আগেই তুমি পালিয়ে গেলে, বেরোবার সময় দেখলাম ঘর বন্ধ তাই আর বলার সুযোগ হলনা। কিন্তু তারপর চেক আউট করার পর মনে হল যাহ্ তোমাকে তো থ্যাংকস জানানো হল না! সারাদিন মনটা খুব উচাটন করছিল তাই এ যাত্রায় তিনচুলে ক্যান্সেল করে তোমার শরণাপন্ন হলাম হে দেবী।

দীপা :ও তার মানে থ্যাংকস জানাতে এসেছিলে?
নাবিক : থ্যাংকসের সাথে সাথে ঐ মূল্যবান জিনিস টাও যে খুঁজতে এসেছি যেটা বললাম তখন... মন। খুঁজে পেলে আমাকে বোলো কিন্তু।

হঠাৎ দীপার ঘরের কলিং বেলটা বেজে উঠল। লাঞ্চ এসে গেছে। কলিং বেলের ক্যাড়ক্যাড়ে আওয়াজে সম্বিত ফিরে এলো দীপার। বৃষ্টিটাও ধরেছে। দীপা ভাবল, "আর একটা দিনের বিরহ তারপর আশ্রয় নেব নাবিকের বুকে। আর ইন্দ্র দেব কি এতটা অপ্রসন্ন হবেন আমার ওপর, আজও কি একটু কথা বলতে পারব না একটা বার চোখের দেখা দেখতে পারব না। নেটওয়ার্ক তো রয়েছে দেখছি লাঞ্চ টা সেরেই ফোন করব।" 

সাহিত্যিক রচয়িতা দাঁ 
কলেজস্ট্রীট, কলকাতা - ৯, পশ্চিমবঙ্গ 































 










0 Comments