আঘাত ~ মিনতি গোস্বামীর অণুগল্প


মিনতি গোস্বামীর অণুগল্প 
আঘাত 

শোকে পাথর হওয়া কাকে বলে নীনা আজ হাড়ে হাড়ে বুঝছে।মায়ের দিকে তাকিয়ে সে চোখের জল ফেলেছে,মাকে জড়িয়ে হাঁউমাঁউ করে কেঁদেছে,তবু মায়ের মুখ থেকে একটি শব্দ ও বের হয়নি।মা আজ শোকে পাথর,আর একমাত্র নীনাই সেই পাথরকে আগলে বসে আছে।ডাক্তার বলেছেন,আরো কোন বড় আঘাতে হয়তো কোনদিন সুস্থ হতে পারেন নীনার মা।

নীনার মা দশদিন বাকরুদ্ধ হয়েছেন।একমাত্র ছেলে হঠাৎ করে করোনায় মারা যায়।হাসপাতাল থেকেই সরকারিভাবে তার সৎকার হয়েছে।বাড়ির কেউ শেষদেখা ও করতে পারেনি।মৃত‍্যুসংবাদ শোনার পরেই মীরাদেবী আর কথা বলেননি।

নীনার বাবা বেসরকারি কাজ করতেন।
নীনার বয়স  যখন পাঁচ,গাড়ি এক্সিডেন্টে তার বাবা মারা যান।নীনা আর ছেলে অরুনাভকে মীরাদেবীই বড় করেন অনেক কষ্টে।
পুরোনো জামাকাপড় সেলাই করে,পাঁপড়ের ব‍্যবসা করে সংসারটা টানেন মীরাদেবী।অরুনাভ লেখাপড়ায় ভালো ছিল।এঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেই একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়।মাকে রেহাই দেয় কাজকর্ম থেকে।

মাত্র দুবছর সুখের পরেই এই শোক মীরাদেবী মেনে নিতে পারেননি​।মীরাদেবী নীনার থেকে বেশ ভালোবাসতেন অরুনাভকে।

অরুনাভ ছিল মায়ের আদর্শ ছেলে।সে মা ও বোনকে আঁকড়ে থাকতো।তাদের দেখভাল ও কর্তব‍্যে তার কোন ত্রুটি ছিলনা। মাকে কথা দিয়েছিল,"বোনের ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দেবার দায়িত্ব সে পালন করবে, তারপর নিজে বিয়ে করবে"।সে কখনো কোন মেয়ের দিকে তাকায়নি সংসারের কথা ভেবে।

নীনা কিন্তু কলেজে ভর্তি হয়েই একটি ছেলের প্রেমে পড়ে।অন‍্য বন্ধুদের মত সে নীনাদের বাড়িতে ও আসতো।একদিন তাদের ঘনিষ্ট হবার দৃশ্য মা দেখে ফেলেন। নীনার মা সেদিন জোর গলায় নীনাকে বলেন,"হাসানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত‍্যাগ করতে,কারণ হাসান বিধর্মী।তার সাথে বন্ধুত্ব করা যায়,বিয়ে করে সংসার করা যাবেনা।সে যদি এই সম্পর্ক স্থায়ী করে তাহলে অরুনাভ আত্মহত্যা করবে।আর মীরাদেবীও সেটা কোনদিন ই হতে দেবেননা।
সেই থেকেই নীনার চলাফেরায় নিষেধাজ্ঞা।
নীনাও আর এগোতে পারেনি।

নীনা কদিন পর সন্ধ‍্যেবেলায় হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে,"হাসান ছাড়,ছাড়।মা দেখে ফেলবে।
ঘরের দরজাটা খোলা আছে,পর্দাটা টানা নেই।মা এক্ষুনি এসে পড়বে।
উঃ,তুই আমাকে ছাড়,আমার খুব লাগছে।
তুই আমাকে পাগলের মত ভালোবাসিস কেন?প্লিজ আ‌‌মাকে ছেড়ে দে।আমার পোশাকটাই তুই ছিঁড়ে ফেললি?"

মীরাদেবী হঠাৎ একটা লাঠি নিয়ে ছুটে আসেন।
চিৎকার করে বলেন,কোথায়,কোথায় গেল জানোয়ারটা?
আজ ওকে মেরেই ফেলবো।"

নীনা মায়ের গলা জড়িয়ে কাঁদতে থাকে।
কাঁদতে কাঁদতে বলে,"মা কেউ কোথাও নেই।আমি চেয়েছি শুধু আমার মাকে।আমি আবার তোমাকে ফিরে পেয়েছি।এমন করেই তুমি আমাকে আগলে রাখো মা।"

লেখিকা মিনতি গোস্বামী 
বোরহাট কালীতলা, নূতনগঞ্জ, পূর্ব বর্ধমান 

















0 Comments